জলধর বলে, আপনি সীরিয়স জয়িদি? সত্যি সত্যিই সব কিছু ছেড়ে দিয়ে খুশিঝোরাতে থাকবেন?
খুশিঝোরাতে না-থাকার কথা আমি আর ভাবতে পারিনা, বলে জয়ি। এই এগজিবিশনটা খুশিঝোরা আর আমাকে এক কোরে দিয়েছে, এখন আর খুশিঝোরা ছাড়া আমার আলাদা কোরে কোন অস্তিত্বই নেই।
ভালোই হলো। কিন্তু কী করবেন এখন? আপনি তো চুপ করে বসে থাকার লোক ন'ন, কিছু ভেবেছেন?
ভেবেছি। কিন্তু যেটা করতে চাই সেটার জন্যে তোমার সাহায্য চাই আমার। প্রথম যখন বাবার ডাকে এখানে এসেছিলাম, রঘুনাথ আমাকে ওর মোটর সাইকেলে বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিলো সাত-ঘুরুং নদীটার কাছে। ওখানে একটা বড়ো হাট বসেছিলো সেদিন। এই হাটে এতো লোক কোথা থেকে আসে জিজ্ঞেস করায়, রঘুনাথ বললো কাছাকাছি ভাবকান্দি নামে একটা আদিবাসী গ্রাম আছে, সেখান থেকেই আসে বেশির ভাগ লোক। সেই গ্রামটা, আর যে গ্রামের থেকে আমাদের অষ্টমী আসে গোরুর দেখাশোনা করার জন্যে – ডাংলাজোড়া – এই দুটো গ্রামে তুমি আমাকে নিয়ে যাবে? বাড়ি বাড়ি? আমি তো ওদের সবায়ের ভাষা বুঝবো না, তাই তোমার সাথে যাবো প্রথম প্রথম। ওদের গ্রামে গিয়ে আমি ছবি আঁকবো, আর ওদের বাচ্চাদের ছবি আঁকা শেখাবো।
ব্যাপারটা আপনি যেরকম ভাবছেন ঠিক সেরকম হবে না। আপনি ছবি আঁকতে চান আঁকতেই পারেন, কিন্তু ওদের বাচ্চাদের ধরতেই পারবেন না, ছবি আঁকা শেখাবেন কীভাবে? আজকাল দুয়েকটা বাচ্চা আশপাশের স্কুল-টুলে
যাচ্ছে – স্কুলের পড়া তো ফ্রী হয়ে গেছে এখন – তাদের তবুও একটা রুটিন গোছের কিছু আছে, বাকিদের তো কিছুই নেই। কখন বাড়িতে থাকে তার কী ঠিক আছে কিছু !
তবুও যাবো তুমি যদি নিয়ে যাও। আমার ছবির এগজিবিশনের সময় তোমরা এখানকার বাচ্চাদের একটা ছবি আঁকার প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করেছিলে, মনে আছে তোমার? তার থেকে দশখানা ছবি এগজিবিট হিসেবে রাখা হয়েছিলো। সেগুলোর খুব প্রশংসা হয়েছে। এদের মধ্যে অনেক বাচ্চা আছে যারা শেখালে খুব ভালো ছবি আঁকতে পারবে। আমি চেষ্টা কোরে দেখতে চাই।
আপনি চাইলে আমি নিশ্চয়ই নিয়ে যাবো, কয়েকদিন গিয়েই দেখুন, হয়তো আমার আন্দাজটাই দেখা যাবে ভুল।
আদিবাসী মেয়েরা দেখা গেলো কম লাজুক, জয়ি তাদের ছবি আঁকবে শুনে পটাপট বসে গেলো; একা, জোড়ায়, অনেকে মিলে একসাথে, যেভাবে বললো জয়ি। জয়ি বললো ছবিগুলোর গোড়ার কাজটুকুই ও করছে মেয়েদের সামনে বসে, বাকিটা হবে খুশিঝোরায়, যখন ও সময় পাবে একা একা কাজ করার। যে মেয়েরা তাদের নিজেদের ছবি পেতে চায়, তাদের আসতে হবে খুশিঝোরায়, কয়েকদিন পর।
প্রথম কয়েকদিন জলধরকে যেতে হলো জয়ির সাথে, তারপর দেখা গেলো মেয়েরাই আসছে দলে দলে, তাদের সঙ্কোচ নেই আর, এসে শুধু নিজের ছবিটাই সংগ্রহ করে তাই নয়, গল্প-টল্প করে, খেতে দিলে বসে যায়, যে চারাগুলো লাগানো হয়েছে জল দেয় তাদের, বাচ্চাদের ট্যাঁকে কোরে নিয়েও আসে কেউ কেউ। আর ট্যাঁকের বাচ্চা নয় যারা, তারাও সাহস কোরে আসতে শুরু করেছে ইদানিং, ছবি আঁকা শেখায় আগ্রহ তাদের যথেষ্ট। খুশিঝোরার আশপাশের গ্রামগুলোয় দিদি হয়ে উঠতে জয়ির সময় লাগে মাত্র দিন পনেরো।
জলধর বলে একদিন, দেখলেন তো জয়িদি, আমি এখানকার লোক, একেবারেই আদিবাসী, কিন্তু দেখা গেলো আমার আন্দাজটাই ভুল ছিলো ! পনেরো দিনে এদের হৃদয়ের রানি হয়ে উঠেছেন আপনি !
রানি-টানি নয়, আসলে নিজের ছবি পেতে ভালোবাসে সবাই, ওতেই কাজ হলো।
তো ছবি আঁকার ইশকুল না হয় চালু করলেন আপনি, কিন্তু ঐ চৌধুরি সাহেব যেটা বলেছিলেন, রেগুলার একটা ইনকামের ব্যবস্থা, কী করবেন সে ব্যাপারে?
কী করবো ভাবিনি, তাড়া কী? ডিকুদের ডেকে আনবো না নিশ্চিন্ত থাকতে পারো তুমি।
সেটা জানি, কিন্তু ব্যাপারটা জরুরি, টাকাপয়সার দরকার তো সব কিছুতেই। আমাদের যে দুটো কাজ করার কথা ছিলো তার প্রথমটা যতই ছোট করে হোক, শুরু করে দিয়েছেন আপনি; কিন্তু দ্বিতীয়টা, অর্থাৎ বনসৃজন, সেটা কিন্তু যথেষ্ট খরচসাপেক্ষ।
জয়ি বলে, যা-ই করি, স্থানীয় মানুষদের নিয়েই তো করতে হবে। তুমি কী লক্ষ্য করেছো, এখানকার মেয়েরা ঘরে বসে কিছু কিছু জিনিস তৈরি করে, খানিকটা নিজেদের প্রয়োজনেই, কিন্তু পয়সা আয় করার জন্যেও করে কিছু কিছু?
আপনি কিসের কথা বলছেন, বাবই ঘাসের দড়ি? ওটা কিন্তু মেয়েরাই করে না শুধু, পুরুষরাও করে, বাজারে বিকোয় কিলোপ্রতি পনেরো ষোল টাকায়।
হ্যাঁ, বাবই ঘাস, কিন্তু দড়ি হিসেবে না বেচে ওগুলো দিয়ে নানা কাজের জিনিস, ঘর-সাজাবার জিনিস তৈরি করা যায়। আমার মনে হয়, শিখিয়ে দিলে যে কোন মেয়েই করতে পারবে, আর ভালোই দাম পাবে। এটা কীরকম জানো? আমাদের প্লান্টে আমরা তৈরি করি স্টীল। কিন্তু সেই স্টীল দিয়েই যদি থালাবাটি-বাসনকোসন তৈরি করা যায়, তাহলে ঐ স্টীলের ভ্যালু-অ্যাডিশন হয়, বাজারে দাম পাওয়া যায় বেশি ! আমরা এখানকার মেয়েদের বাবই ঘাসের দড়ির ভ্যালু-অ্যাডিশন শেখাতে পারি। তারপর সেগুলোর বিক্রি-ব্যবস্থা। একটা কোঅপারেটিভ গোছের তৈরি করলে ওরাও কিছু আয় করে, আমরাও।
এটা তো খুবই ভালো আইডিয়া জয়িদি, শুধু বাবই ঘাসই বা কেন, খেজুর পাতার নানান জিনিসও তো সখ করেই তৈরি করে এখানকার মেয়েরা, হাটে নিয়ে গিয়ে বিক্কিরিও করে, কিন্তু সে তো সামান্য দামে। আমরা যদি কলকাতা-টলকাতায় এসব বিক্কিরির ব্যবস্থা করতে পারি, কাজের কাজ হয়।
জয়ি বললো, আমার কোন তাড়া নেই জলধর। এখানে থেকে যাবো বলে সিদ্ধান্ত যখন নিয়েই ফেলেছি একবার,
কিছু-না-কিছু করবোই। খুশিঝোরার লাইফ মেম্বারশিপের জন্যে যাঁরা আগ্রহী তাঁদের মধ্যে তিরিশ জনের একটা লিস্ট তৈরি করা হয়েছিলো। তাঁরা মেম্বারশিপ নিলে এখনই তো তিরিশ লাখ টাকা জমা পড়বে আমাদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে। ভালো কাজে পয়সার অভাব হয় নাকি? কিন্তু বনসৃজনের যে কথা তুমি বললে, সে ব্যাপারে তোমার সাথে একটা পরামর্শ করার দরকার আছে। তোমার মনে আছে তুমি ঐ রাস্তার ওপারের শুকনো জমিটাই টার্গেট করেছিলে প্রথম বনসৃজনের কাজের জন্যে? খোঁজ কোরে কোরে ঐ জমিটার কে মালিক তুমি বের করেছিলে, পাতাপাড়ার সরকাররা। এমনকি ঐ সরকারদের এক ভাই, যিনি বান্দোয়ানের স্কুলে মাষ্টারি করেন, তাঁর সাথেও যোগাযোগ করেছিলে তুমি। তোমার মনে হয়েছিলো ওঁরা ওই জমির ব্যাপারে খুব একটা ভাবেন-টাবেন না। একে তো শুকনো জমি, কৃষিযোগ্য নয় বলেই মনে হয়, তার উপর খালি জমিটার মাঝে মাঝেই এক-একটা ছোট ছোট প্লট আছে যেগুলো ট্রাইবাল প্লট। ঐ জমিতে ওঁদের কোন ইন্টারেস্টই নেই। আমি ভাবছি, তোমাকে সঙ্গে নিয়ে একবার ওঁদের সঙ্গে দেখা করবো, সব ভাইয়ের সাথে একসাথে। জমিটা আমরা কিনতে চাইনা। ওঁদের জমি ওঁদেরই থাক। ওঁরা তো ওটা ফেলেই রেখেছেন, আমরা ওই জমিতে গাছ পুঁততে চাই।
হেমন্ত রঘুনাথের সাথে বেরিয়েছিলো, ওর মোটর সাইকেলে। ফিরে দেখলো জলধর। জলধরকে একটু বেশিই ভালোবাসে হেমন্ত। বললো, ভালোই হলো জলধর তোমার সাথে দেখা হয়ে, আজ রাতে তুমি খেয়ে যেও।
এই কাকু দেখা হলেই আমাকে খেয়ে যেতে বলবেন, হেসে বলে জলধর, উপলক্ষটা কী?
উপলক্ষ কী একটা থাকতেই হবে? হাটে গিয়েছিলুম, আজ দেখি খাসির মাংস বিক্কিরি হচ্ছে, সামনের ঠ্যাং দুটো নিয়ে এসেছি। জয়ি মাংস ভালোবাসে, পেয়েও গেলাম, আর তুমিও খারাপ বাসো বলে শুনিনি। ধরো, সেটাই উপলক্ষ। তারপর জলধরের উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে মুখটা বাড়িয়ে হেঁকে রঘুনাথকে বললো, বেশি করে চাল নিও রঘুনাথ, জলধরও খাবে আজ।
বলেই একটা চেয়ার টেনে নিয়ে ওদের মাঝখানে বসে হেমন্ত, জয়ির দিকে তাকিয়ে বলে, কোথায় গাছ পুঁতবি বলছিলি?
সবটা শুনে হেমন্ত বলে, ওরা যদি দেয়ও অনুমতি, লাভটা কী হবে? বাঁচাতে পারবি গাছ ওখানে? অতো শুকনো জায়গা, মাটিটাও মনে হয়না ভালো, ওখানে গাছ বাঁচানো সহজ হবে না।
কিছুক্ষণ সবাই চুপচাপ, নীরবে মাথা ঝুঁকিয়ে বসে থাকে জলধর। জয়ি বলে ওঠে হঠাৎ, কোনই কী উপায় নেই বাবা?
উপায় কী করে থাকবে, জল ছাড়া গাছ বাঁচবে কী কোরে? দেখিসনি কতোটা জায়গা একেবারে খালি, আগাছাও নেই প্রায়। জলের ব্যবস্থা না কোরে গাছ লাগাবার কোন মানেই হবে না ওখানে।
বলে, কিন্তু তারপরেই সোজা হয়ে বসে হেমন্ত। জলধরের দিকে তাকিয়ে বলে, ঐ জমিটা দিয়ে খানিকটা ভেতরের দিকে হাঁটলে একটা মজা পুকুর আছে লক্ষ্য করেছো?
হ্যাঁ, আছে তো, জলধর জবাব দেওয়ার আগেই বলে ওঠে জয়ি।
ওটা কাদের?
কাদের ঠিক জানিনা, খোঁজ নিতে হবে। মাষ্টারমশাই বলছিলেন ঐ পুরো এলাকাটাই ওঁদের, শুধু মাঝে মাঝে এক-একটা ট্রাইবাল প্লট। কিন্তু মালিকানা কার ওঁরা ঠিক ঠিক জানেন না।
পুকুরটা ট্রাইবাল প্লট না হওয়াই সম্ভব, বলে হেমন্ত। খোঁজ নাও। পুকুরটার যদি সংস্কার করা যায়, একটু গভীর করা যায় যদি, তাহলে হয়তো একটা উপায় আছে। ঐ পুকুরের জলটা ব্যবহার করতে হবে।
খুব ইন্টারেস্টিং বাঁক।
পছন্দ