কলেজ স্ট্রীট-বিধান সরণি অঞ্চলে তিনটে ট্রাম পুড়েছে আজ। দোকান-পাট সব বন্ধ, রাস্তাঘাট থমথমে, ছাত্র-পুলিশ খণ্ডযুদ্ধে আহত অনেকে, এমনকি মারাও গেছে একজন। ছাত্র। ছাত্রদের দাবি, তার মৃত্যু হয়েছে পুলিশের গুলিতে, পুলিশ অবিশ্যি গুলি চালানো অস্বীকার করেছে, আকাশবাণীর খবর মারফত পুলিশ জানিয়েছে নিজেদের ছোঁড়া বোমার আঘাতেই মৃত্যু হয়েছে ছাত্রটির। সমস্ত অঞ্চলে আগামী তিন দিন ১৪৪ ধারা।
সোমেশ্বর যখন বাড়ি ফিরলো তখন রাত দশটা বেজে গেছে। ওদের বাড়িতে রাত্তিরে একসাথে খাওয়া হয়, সেদিন খেতে বসেনি কেউ, রেডিও এবং বিশেষ সান্ধ্য সংস্করণ খবরের কাগজের দৌলতে কলেজ স্ট্রীটের গণ্ডগোলের খবর ছড়িয়ে পড়েছে, অতএব সবাই চিন্তিত।
একতলায় রান্নাঘরের পাশেই যে দালান সেখানে আসন বা পিঁড়ি পেতে খাওয়া হয়; ডাইনিং টেবিলের প্রচলন নেই ওদের বাড়িতে, সোমেশ্বরের নিজের একটা ছোট ঘর আছে, সেটা দোতলায়। বাড়িতে ঢুকে অপেক্ষমান চিন্তিত মুখগুলোর দিকে এক ঝলক তাকিয়েই তাড়াতাড়ি কোরে দোতলায় উঠে গেলো ও, মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই তৈরি হয়ে চলে এলো নীচে।
কী ব্যাপার, এত দেরি হলো যে, প্রশ্নটা করলেন সতীনাথ।
শুনেছো নিশ্চয়ই আজ কলকাতায় গণ্ডগোলের কথা।
শুনেছি বলেই উদ্বেগ। আর তা ছাড়া গাড়ি-ঘোড়া তো বন্ধ হয়ে গেছে অনেক আগেই। তোমাকে নিশ্চয়ই হেঁটেই ফিরতে হয়েছে, এত রাত্তির অবধি করছিলেটা কী?
কী করছিলাম সেটা যদি এখনই বলি, তোমাদের পছন্দ হবে না। এখন গণ্ডগোল চলছে, কয়েকটা দিন কেটে যাক না।
তোমার কাজ-কর্ম, চলন-বলন বেশ কিছুদিন ধরেই অনেকের পছন্দ হচ্ছে না এটা কী তুমি জানো? – বলে উঠলো
ন কাকা।
হ্যাঁ, আন্দাজ করতে পারি বলেই এত রাত্তিরে আর কথা বাড়াতে চাইছি না।
তুই ছিলি কোথায়, তোকে কী পুলিশ-টুলিশে ধরেছিলো? – মাছের ডেকচিটা, যেটা থেকে মাছ পরিবেশন করছিলো, সেটা একপাশে রেখে উদ্বিগ্ন মুখে জিজ্ঞেস করলো মা।
না মা, ধরলে এত সহজে ছেড়ে দিতো না।
তুমি কোথায় ছিলে? – আর একবার জিজ্ঞেস করেন সতীনাথ।
কলেজেই ছিলাম বাবা, শঙ্কর ঘোষ লেনের ঐ সরু গলিতে এত পুলিশ এত রাত্তির অবধি টহল দিচ্ছিলো যে কলেজ থেকে বেরোনোই মুশকিল ছিলো। ওরা চলে যেতে আমরা বেরিয়ে পড়ে তারপর হেঁটে হেঁটে ফিরছি।
কিন্তু ট্রাম-ফাম যা পোড়বার সে সব তো দুপুরের মধ্যেই হয়ে গেছে, ওয়ান ফর্টি ফোর ডিক্লেয়ারও হয়ে গেছে দুপুরের মধ্যে, তখন থেকেই তুমি কী কলেজে ছিলে, আর বেরোতে পারনি? – আবার ন কাকার প্রশ্ন।
নাঃ, তখন থেকেই কলেজে ছিলাম না, মিছিলে ছিলাম। তারপর ওয়ান ফর্টি ফোর ঘোষণার পর আবার কলেজে ফিরে যাই।
এই খেয়ে নে, হাত গুটিয়েই তো বসেই আছিস তখন থেকে, মা বলে ওঠে এত কথার মাঝখানে।
সোমেশ্বর আবার খেতে শুরু করে চুপচাপ, বেশ কিছুক্ষণ কেউই কথা বলে না। হঠাৎ ন কাকা বলে ওঠে মিনিট পাঁচেক পর, তুমি টায়ার্ড আছো, শুয়ে পড়ো আজ, কাল থেকে কয়েকদিন আর বেরিয়ো না বাড়ি থেকে, ঝামেলা-টামেলা সব মিটে যাক, তারপর আবার কলেজ।
তা হয় না ন কাকা, কাল আমায় কলেজ যেতেই হবে, জরুরি কাজ আছে।
এখন আবার, – ন কাকা এ টুকু বলতেই হাত তুলে ইঙ্গিতে থামতে বলেন সতীনাথ, তারপর আর কথা হয় না, সবাই চুপচাপ খেয়ে নেয়।
পরের দিন সোমেশ্বর যখন ফেরে তখন বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যে, নীচে বাইরের বারান্দায় একটা চেয়ারে একা বসে সতীনাথ, মাথার উপরে টিউব-লাইটটা জ্বলছে, সতীনাথের কোলের উপর সেদিনের খবরের কাগজটা ভাঁজ করা অবস্থাতেই, আর তাঁর হাত দুটো সেই কাগজের ওপরেই জড়ো করা। সোমেশ্বর ঢুকেই জিজ্ঞেস করে, অমন চুপ কোরে বসে আছো, কী হলো?
কিছু হয়নি, ভাবছিলাম। বসো না।
সোমেশ্বর ঢুকে যায় বাড়ির ভেতরে, তার পর একটা চেয়ার টেনে নিয়ে এসে বাবার পাশেই বসে পড়ে।
পড়াশোনা কেমন হচ্ছে তোমার? – জিজ্ঞেস করেন সতীনাথ।
খুব একটা ভালো নয় বাবা।
হ্যাঁ, আমারও তাই মনে হচ্ছিলো। তোমার সাবজেক্টগুলো তো আমি নিজেও জানিনা যে সাহায্য করবো তোমাকে। কলেজ-টলেজেও আজকাল পড়াশুনো হয় না ততটা। তোমার যদি মনে হয় কারোর কাছ থেকে আলাদা কোরে একটু সাহায্য নেবে, প্রাইভেটলি যদি কেউ দেখিয়ে দিলে সুবিধে হয় তোমার, তাহলে না হয় আমি একটু গঙ্গেশ বাবুর সাথে কথা বলি, উনি যদি কাউকে রেকমেণ্ড করেন।
না বাবা, ঠিক তা নয়, আসলে আমিই ঠিক ততটা মন দিতে পারিনি কিছুদিন।
মন দিতে পারনি? কেন?
এ প্রশ্নের সরাসরি উত্তর কী দেবে ঠিক বুঝতে পারে না সোমেশ্বর, তারপর বলে, স্কুলের দিনগুলো অন্যরকমের ছিলো বাবা, তখন স্কুলে যাওয়া, একটু-আধটু লাইব্রেরিতে যাওয়া আর বিকেলবেলায় খেলাধুলো, এর বাইরে অন্য কিছু ভাবিনি কখনো; কিন্তু কলেজে এসে আরও অনেক কিছু দেখতে শিখলাম। শুধু কলেজে যাওয়া, পড়াশোনা করা, পরীক্ষায় ভালো ফলের চেষ্টা, একটা ভালো চাকরি পাওয়া, এটাই জীবনের লক্ষ্য হতে পারে না, এটা বুঝতে পারলাম। আশপাশের মানুষদের সম্বন্ধেও আমাদের সবায়ের কিছুটা দায় যে আছে, সেটাও বুঝতে শিখলাম।
এটাই তো স্বাভাবিক সোম, এটাই হবার কথা। শুধুমাত্র নিজের কথা ভাববে, আর সব কিছুর বিনিময়ে নিজের কেরিয়রের কথাই চিন্তা করবে শুধু, এ শিক্ষা তো আমি না দেবারই চেষ্টা করেছি তোমাদের। কিন্তু তার জন্যে পড়াশোনায় মন লাগবে না কেন?
ঠিক তার জন্যে পড়াশোনায় মন দিতে পারছি না এ কথা আমি বলছি না বাবা। আসলে অন্য ব্যাপারেও অনেকটা জড়িয়ে পড়ছি।
অন্য ব্যাপারে জড়িয়ে পড়ছো? কী ব্যাপারে?
ছাত্র রাজনীতি।
ছাত্র রাজনীতি? দেখো, একটা সময় এসেছিলো যখন গান্ধীজী স্বয়ং ছাত্রদের বলেছিলেন স্কুল-কলেজ ছেড়ে প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে আসতে, পরাধীন দেশে ছাত্রদেরও তখন প্রাথমিক দায় ছিলো পরাধীন দেশকে স্বাধীন করার। কিন্তু আজ তো আর তা নয়। দেশ স্বাধীন হয়েছে, এখনকার ছাত্রদের তো দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবার লড়াইয়ে যোগ দিতে হবে, দেশের এখন নানা রকমের স্কিল চাই। এখন আর ছাত্র-রাজনীতি কিসের, এখনই তো মন দিয়ে পড়াশোনা করার সময়।
তোমার ভাবনা অতি সরলীকৃত বাবা, ওভার সিমপ্লিস্টিক। দুশো বছরেরও ওপর নানা কায়দায় আমাদের দেশের নানা সম্পদ লুঠ করার পর সেকেণ্ড ওয়র্ল্ড ওয়রের শেষে যখন ইংরেজরা বুঝতে পারলো আর সহজ রাস্তায় সরাসরি সে কাজটা তারা করতে পারবে না, তখন তারা শুধু তাদের কায়দাটা বদলিয়েছে, আর কিছু নয়।
এ তুই কী বলছিস সোম, যারা আজাদী ঝুটা বলেছিলো তুই কী তাদের দলে নাম লিখিয়েছিস?
আমি কারো দলে নাম লেখাইনি বাবা, কিন্তু তুমিই বলো, সাতচল্লিশ, বা এমনকি পঞ্চাশের পরেও, সত্যি সত্যিই কী এ দেশের সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে কোন উন্নতি হয়েছে?
হয়নি। আর তাই তো আমাদের দায়িত্ব বেড়ে গেছে। অন্য কোন দিকে মন না দিয়ে এখন আমাদের নিজেদের তৈরি করতে হবে যাতে আমরা এ দেশের প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকারকে নিশ্চিত করতে পারি।
সেটা কী ভাবে হবে? যাদের মৌলিক অধিকারের কথা বলছো, তাদের নিজেদের কোন ভূমিকাই থাকবে না সে লড়াইয়ে? শুধু কতগুলো শিক্ষিত মধ্যবিত্ত লোক ব্যবসাদারদের মুনাফা, আর রাজনীতিবিদদের গদি বাঁচানোর জন্যে বেশি বেশি করে নিজেদের স্কিল তৈরি করবে? আর ততদিন আপামর জনসাধারণ কাজের অভাবে, খাদ্যের অভাবে, না খেয়ে মরবে?
সময় দিতে হবে সোম, সময় দিতে হবে। কোন কিছুই ম্যাজিকে হয় না। গোড়ায় তো কতকগুলো ভুল হয়েই গেছে, এই যে দেশটা ভাগ হয়ে গেলো, এটা কী ঠিক হয়েছে? গান্ধীজী নিজেও তাঁর ভুল বুঝেছিলেন, শোধরাবার ব্যবস্থাও নিচ্ছিলেন তিনি, সে সময় আর পেলেন না। কিন্তু তার মানে তো এই নয় যে, এত কষ্ট কোরে যে স্বাধীনতা আমরা পেলুম তা আমরা রক্ষা করবো না।
বাবা, তোমাকে ছোটবেলার একটা কথা মনে করিয়ে দিই। তোমার মনে আছে, অনেক দিন আগে, আমরা তখন অনেক ছোট, মা একটা পাখি পুষেছিলো? পুষেছিলো মানে পুষেছিলো মাত্র এক দিনের জন্যে। পাখিটাকে একটা খাঁচায় রেখে দিয়েছিলো মা। তুমি যখন ফিরলে রাত্তিরে, খাঁচাটাকে দেখে খুবই অখুশি হলে তুমি। মুক্ত আকাশের পাখি, তুমি বলেছিলে, তাকে খাঁচায় রাখাটা অন্যায়, মনে আছে তোমার? পরের দিন ভোরবেলা আকাশ লাল হতে-না-হতেই পাখিটাকে ছেড়ে দিয়েছিলে তুমি, বলেছিলে কারোর স্বাধীনতা হরণ পাপ। আজ যদি আমি বলি, তুমি ঠিক করনি, কারণ পাখিটা তো আমাদের নিজেদের দেশেরই পাখি, আমরাই রেখেছিলাম তাকে খাঁচায়, স্বাধীনতা হরণটা হলো কোথায়?
তার মানে?
তুমি তো তা-ই বলছো বাবা। যতদিন ইংরেজরা শোষণ করেছে এ দেশের গরীব-গুর্বোকে, সেটা অন্যায় ছিলো। এখন আমরাই করছি, তাই সবাই স্বাধীন।
তুমি যেটাকে শোষণ বলছো সেটা নেই আমি বলছি না, কিন্তু সেটা একটা ইকনমিক ইস্যু। ব্যক্তি-স্বাধীনতা অন্য জিনিষ।
এই যে যাঁরাই ইনকনভিনিয়েন্ট বিনা বিচারে তাঁদেরই আটক করা হচ্ছে, সেটা কী ব্যক্তি-স্বাধীনতা?
ইনকনভিনিয়েন্ট হলেই করা হচ্ছে কিনা আমি জানিনা, কিন্তু কিছুদিন আগেই বিদেশী শত্রুর আক্রমণ হয়েছে, পাকিস্তানও যখন তখন লড়াই বাধিয়ে দিতে পারে, এ রকম অবস্থায় মাঝে মাঝে একটু বাড়াবাড়ি হতেই পারে, এটা একেবারে ব্যক্তিস্বাধীনতা হরণ এমনটা ভাবতে আমি রাজি নই। আচ্ছা, তোকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি। এতক্ষণ ধরে তোর সাথে কথা বলে মনে হলো তোদের মূল চিন্তাটা অর্থনীতি-কেন্দ্রিক। এটাই হওয়ার কথা। এটাই ক্ল্যাসিকাল মার্কসিস্ট কনসার্ণ। বোঝা যাচ্ছে এদেরই দলে পড়েছিস তুই। আচ্ছা বল্ তো এই যে এতগুলো ট্রাম তোরা পোড়ালি, কার গেলো? সম্পদ নষ্ট করে ইকনমিক লড়াই করবি তোরা? তোর মনে থাকার কথা নয়, বছর বারো-তেরো আগে আর একবার ট্রাম মুভমেন্ট হয়েছিলো, প্রায় একমাসের ওপর কলকাতা শহরটাই অচল হয়ে গিয়েছিলো প্রায়। বিধানবাবু বিদেশে ছিলেন, এখানকার লীডাররা সামলাতে পারছিলেন না। সে সময়ে কম্যুনিস্ট পার্টির লোকদের প্রধান দাবি ছিলো বিদেশী ট্রাম কোম্পানিকে ন্যাশনালাইজ করে নেওয়া হোক্। এ বারেও নিশ্চিত সে একই দাবি তুলবে কম্যুনিস্টরা। আচ্ছা, ভাব তো, সত্যি সত্যিই ন্যাশনালাইজ করলে ট্রাম তো জাতীয় সম্পত্তি হবে। সে সম্পত্তি নষ্ট করে তোদের লাভটা কী হচ্ছে?
বাবা, তুমি ট্রাম মুভমেন্টটাকে একটা লড়াই বললে সেটাই যথেষ্ট। আর লড়াইয়ে অনেক ট্যাকটিকাল লাইন নিতে হয়, অনেক ডিসরাপশন তৈরি করতে হয়। একটু-আধটু সম্পত্তির ক্ষয়-ক্ষতিটা সেখানে বড়ো কথা নয়। গান্ধীজীর লবণ সত্যাগ্রহে তোমরা অংশ নিয়েছিলে। সেখানে কী শুধুই সমুদ্রের জল ফুটিয়ে নুন তৈরি করা হয়েছিলো? সারা ভারতবর্ষের লোক সেদিন গান্ধীজীর ডাকে সব রকমের আইন ভেঙেছিলো, ছেলেরা স্কুলে যায়নি, দোকানবাজার সব বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিলো। কোন ইকনমিক অ্যাকটিভিটি চলতে দেওয়া হয়নি। কেন? আসলে সেটাও একটা লড়াই ছিলো। জেতবার জন্যে ওটাই ছিলো ট্যাকটিকাল লাইন, ডিসরাপশন তৈরি করা।
সতীনাথ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, আমি কলেজে ফিলসফি পড়তুম। প্রথম যখন হেগেল-মার্কস পড়েছি, আমরাও মনে মনে মার্কসকে শ্রদ্ধা করেছি; তোর এখন যে বয়েস, এ বয়েসে হয়তো এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমরা বেঁচে গিয়েছিলুম, মার্কসিস্ট হওয়ার কথা ভাবিওনি। কেন জানিস? নৈতিক সংঘাত। আমাদের আজন্ম শিক্ষা নাস্তিক মার্কসের মেটিরিয়ালিজ্ম্ থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলো আমাদের। তোদের তো আমি সেভাবে মানুষ করতে পারিনি। এই তো, এখনই সন্ধ্যা-আহ্ণিক বন্ধ করে দিয়েছিস, বাইরে কার হাতে কী খেয়ে বেড়াস আমি ভয়ে জিজ্ঞাসাই করি না। আমি এখনো বেঁচে আছি, তা সত্ত্বেও পৈতেটা পর্যন্ত ফেলে দিয়েছিস তুই, যদুগোপাল ন্যায়রত্নের পৌত্র !
নৈতিক কথাটা তুললে যখন, তোমাকে একটা কথা বলি বাবা। আমার যত বন্ধুবান্ধব তারা বেশির ভাগই কংগ্রেসি বাড়ির ছেলে। আমাদের জেনারেশনে এটাই স্বাভাবিক। কারোর বাবা অ্যাকটিভ কংগ্রেসি, কারোর বাবা শুধুই সমর্থক। এই যে দেশে খাদ্য সমস্যা চলছে, র্যাশনে সীরিয়ালের পরিমাণ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে, জেলায় জেলায় কর্ডনিং করা হচ্ছে যাতে চালের চোরা কারবার না হয়, মন্ত্রীরা সব রেডিয়ো-খবরের কাগজে লোককে উপদেশ দিচ্ছেন চালের বদলে মুগ সেদ্ধ খাও, আলু খাও; মধ্যবিত্ত আসলে খাচ্ছেটা কী? বন্ধুদের বাড়ি গেলে দেখি ঐ চোরাবাজারের চালেই ভাত খাওয়া হচ্ছে, করবেটা কী লোকে তা ছাড়া? কিন্তু আমাদের বাড়িতে? মার শারীরিক পরিশ্রম তিন গুণ বেড়ে গেছে, মা কিন্তু তবুও ঐ কোটার র্যাশনেই চালিয়ে যাচ্ছে, আর নানা রকমভাবে বুদ্ধি খাটিয়ে রোজ রোজ আমাদের মুগ-আলু-ছাতু-যব দিয়ে মুখরোচক পেটভরা খাবার খাইয়েই যাচ্ছে। মা-ও তোমাকে বলেনি, আর তুমিও ভাবোনি নীতিভ্রষ্ট হওয়ার কথা। দেশে অভাব আছে, কষ্ট করবো: মুখে বলছো, কাজেও সপরিবার তা-ই করছো। আইডিয়ালিজ্ম্-মেটিরিয়ালিজ্ম্ ছেড়ে দাও বাবা, ও সব নিয়ে অনেক তর্ক চলতে পারে, কিন্তু ঘোষিত নীতির থেকে এক চুলও না সরতে সাহস লাগে বাবা, তুমি আমাদের সেই সাহস শিখিয়েছো, মানুষ করেছো কিনা জানিনা।
সতীনাথ চশমা মোছেন, তারপর খবরের কাগজটা হাতে নিয়ে বাড়ির ভেতরে চলে যান।
ট্রাম ভাড়া কিন্তু বেড়েই গেলো, সাত-দশদিন কলেজ পাড়ায় মিছিল-ধরপাকড়-লাঠালাঠিতে লাভ হলো না কিছুই। ভাতের সমস্যায় জেরবার মানুষ যথারীতি বাড়তি ভাড়াটুকু দিয়ে অফিস-কাছারি যেতে শুরু করলো আবার, বিধান সভায় একটু-আধটু তর্কাতর্কির পর একেবারেই থেমে গেলেন পার্টির নেতারা।
অথচ আন্দোলনটা আদৌ হলো কেন ! সোমেশ্বরের মনে আছে, নিছক ভাড়া বৃদ্ধি প্রতিরোধের আন্দোলন হিসেবে ওরা নামেনি এতে। ট্রাম ভাড়া বাড়ানোর প্রস্তাবের বিরোধিতা করে গণ প্রতিরোধকে অনেকটা দূরে টেনে নিয়ে যাওয়াই ছিলো ওদের উদ্দেশ্য। এই আন্দোলনের আগে যে রুদ্ধদ্বার মীটিঙে আন্দোলনের পরিকল্পনা আর কৌশল নিয়ে আলোচনা হয়েছিলো সেখানে পার্টির একজন বয়স্ক নেতা ওদের মনে করিয়ে দেন তিপ্পান্ন সালের ট্রাম আন্দোলনের কথা। এক মাস ধরে চলেছিলো সে আন্দোলন, শহরভিত্তিক এমন গণ-প্রতিরোধ সাতচল্লিশের পর এ দেশ দেখেনি আর। কলকাতায় লাঠিচার্জ, পুলিশ-মিলিটারির গুলি চালানো, তারই সাথে বার্ণপুরে আন্দোলনকারী শ্রমিকের উপর গুলি, হাজার হাজার নিম্ন-মধ্যবিত্ত আর শ্রমিক-মজুরের স্বতস্ফুর্ত প্রতিবাদ রাস্তায় নেমে, এবং শেষ পর্যন্ত ট্রাম শ্রমিকদেরও ধর্মঘট করে এই আন্দোলনে যোগদান, আন্দোলনকে একটা অন্য মাত্রা এনে দিয়েছিলো। পুলিশ-মিলিটারির বাইরেও সরকার তখন ভলান্টিয়ার নামধারী গুণ্ডাদের নামিয়েছিলো রাস্তায়, আক্রমণ হয়েছিলো এমনকী সাংবাদিক এবং সমস্ত দেশি খবরের কাগজের ওপরেও। তিপ্পান্ন সালের সেই ট্রাম আন্দোলন ছিলো গণ-অভ্যুত্থানের একটা সুযোগ, প্রফুল্ল সেনের কেয়ারটেকার সরকার প্রায় পড়ে যাবার অবস্থায় এসেছিলো, য়্যোরোপ থেকে ফিরে ডঃ রায় যদি প্রায় সব দাবি না মেনে নিতেন, এ দেশের ইতিহাস তাহলে অন্যভাবে লেখা হতো।
ইতিহাস মনে করিয়ে দিয়ে পক্ককেশ সেই নেতা বলেছিলেন সে সুযোগ আর একবার এসেছে। সেই প্রফুল্ল সেন এখন মুখ্যমন্ত্রী। সরকার দিশেহারা। সারা দেশে খাদ্যাভাব এমন একটা জায়গায় পৌঁছেছে যে ট্রাম দিয়ে শুধু শুরুই, তারপর এই আন্দোলনকে আমরা এমন এক মাত্রায় নিয়ে যেতে পারবো যা গণ-অভ্যুত্থানের রূপ নেবে। সময় এসেছে কমরেডস, এবার সুযোগের সদ্ব্যবহার আমরা করবোই।
অথচ, কী হলো ! পনের দিনেই সব শেষ ! সোমেশ্বর, পবিত্র, আমিনুল, আর বিভিন্ন কলেজের ছাত্রকর্মীরা মীটিং করলো নিজেদের মধ্যে। এই নেতৃত্ব পচে গেছে। এরা সুযোগ খুঁজছে সমঝোতার, আর যেমন করে হোক ক্ষমতায় আসার। আমাদের ওরা ব্যবহার করবে শুধু দাবার বোড়ের মতো। বিপ্লব যদি সত্যি সত্যিই চাই, তাহলে কলকাতায় বসে থাকলে চলবে না, আমাদের ছড়িয়ে পড়তে হবে কলকাতার বাইরে, পার্টির ভেতরে যারা আছে, নানা গণ সংগঠনে পার্টির সমর্থক যারা আছে, সবায়ের সাথে যোগাযোগ করতে হবে, সত্যিকারের বিপ্লবীদের গ্রূপ আর স্টাডি-সার্কল তৈরি করতে হবে। বিপ্লবের প্রস্তুতি চাই, এখন থেকে প্রস্তুত হতে হবে আমাদের।
পরীক্ষা-টরীক্ষা দেওয়া হলো না, বছরের শেষে সোমেশ্বর পৌঁছোলো দুবরাজপুর, ওদের গ্রূপের বার্তা সঙ্গে নিয়ে। মাস দুয়েক থাকলো সোমেশ্বর, ফিরে এলো আশ্চর্য অভিজ্ঞতা নিয়ে। পার্টির কর্মী যারা, তাদের কী কখনো বলা হয়েছে পার্টির আদর্শের কথা ! সমস্ত পার্টি সংগঠনটাই যেন ভোটের জন্যে অঙ্ক কষে তৈরি। কার কোথায় প্রভাব, কার কথায় কতজন ভোট দেবে, সেই অঙ্কে নেতৃত্বের পরিমাপ ! ইসলামপুর নামের এক গ্রামে কৃষক সভায় লেভি সংগ্রহের কাজে গেলো সোমেশ্বর, তার থাকার জায়গা নির্দিষ্ট হলো যেখানে সেটা এক সম্পন্ন জোতদারের বসতবাড়ি। মাছ ভাজা আর হাঁসের মাংস সহযোগে দুপুরের খাওয়া ! এত খাবার কেন কম্যুনিস্ট কর্মীর জন্যে? আরে, আপনি আমাদের অতিথি,
তা-ও কলকাতা থেকে !
স্থানীয় কলেজের ছাত্রনেতা চণ্ডী গরাইও যোগ দিলো লেভি সংগ্রহ অভিযানে। সে টাই পরে এসেছে ! এত সাজগোজ কেন? আরে কম্যুনিস্ট হওয়া তো ভালো থাকবার জন্যেই, কংগ্রেসি কুশাসনের কষ্ট থেকে উত্তরণের জন্যেই, কৃষকসাধারণকে সেটা বোঝাতে হবে না ! কাজের অবসরে একটু-আধটু তত্ত্ব আলোচনার সুযোগ খোঁজে সোমেশ্বর। থামিয়ে দেয় তাকে চণ্ডী। হ্যাঁ, একটা কমিউনিস্ট ইশতেহার তাকে দিয়েছিলেন দিনেশদা, পড়া হয়নি এখনো, পড়ে নেবে। তার চেয়ে শুনুন না মামা-ভাগনে পাহাড়ে কী হয়েছিলো। আমি তখন ক্লাশ নাইনে, অভিযানের শ্যুটিং হয়েছিলো সেখানে। খুব ভাব হয়ে গিয়েছিলো আমার সৌমিত্রদার সাথে। এবার আপনার সাথে কলকাতায় গিয়ে একবার দেখা করে আসবো। সৌমিত্রদার বাড়ি চেনেন তো? চেনেন নিশ্চয়ই।
কলকাতায় ফেরার পর হিন্দু হোস্টেলে ওদের আলোচনা হয় প্রায় রোজই। এই নেতৃত্ব বিপ্লব করার কথা ভেবেছে কখনো? যাদের সঙ্গে বিরোধ করে পার্টি আলাদা হলো, তাদের সাথে এদের চরিত্রের কোন তফাৎ আছে? ইচ্ছে করে অন্ধকারে রাখা হচ্ছে পার্টি কর্মীদের, গণ সংগঠন বাড়ানো শুধু ভোটের কথা ভেবে। এখন দুটিমাত্র কাজ, ছড়িয়ে পড়তে হবে বিভিন্ন গণ সংগঠনে, মানুষের খাওয়া-পরার কষ্টের সাধারণ অভিজ্ঞতা বোঝা আর তার মার্কসীয় সমাধান নিয়ে আলোচনা, আর সুযোগ পেলেই আন্দোলন সংগঠিত কোরে অভিজ্ঞতা সঞ্চয়।
খাদ্য সঙ্কট নিয়ে পুরো দেশ উত্তাল, ছেষট্টির গোড়াতেই শুরু হলো খাদ্য আন্দোলন, সে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়লো সবায়ের সাথে সোমেশ্বরও। পার্টি নেতৃত্বের খুব উৎসাহ এই আন্দোলনে, সামনের বছর সাধারণ নির্বাচন, এই সব গণ আন্দোলনে সাধারণ মানুষের উত্তেজনা বাড়ে, বাড়ে সরকার বিরোধী চেতনা, ভোটের বাক্সে তার প্রতিফলনও হয়। ছাত্ররাও জানে এ সবই, কিন্তু সে জন্যে তো গণ আন্দোলন থেকে দূরে সরে থাকা যায়না। এর মধ্যে পার্টির নেতৃত্বের নয়া সংশোধনবাদী ঝোঁক নিয়ে লেখা-টেখাও শুরু হয়ে গেছে, কলকাতা আর আশপাশে ছোটখাটো লিটারেচার, প্যাম্ফলেট আর পত্র-পত্রিকাও ছড়িয়ে পড়ছে কিছু কিছু, এমনকি শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং জেলা কমিটির কোন কোন সদস্য যোগাযোগও করছেন।
হিন্দু হোস্টেলের আড্ডাটা এবার ছড়িয়ে পড়লো পুরো প্রেসিডেন্সী কলেজেই। কয়েকজন ছাত্রের বহিষ্কার আর পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কোর্সে ভর্তির নিষেধাজ্ঞা থেকে শুরু হওয়া আন্দোলন ছড়িয়ে পড়লো কলকাতা আর তার আশপাশের কলেজগুলোয়। প্রেসিডেন্সী কলেজের লন, ছাত্রদের সবাই মিলে বসে আলোচনা করার নতুন জায়গা, ভবিষ্যতে যা প্রেসিডেন্সী কনসোলিডেশন নামে পরিচিত হবে, যেন বিপ্লবের প্রস্তুতি শিবির। কলেজ বন্ধ রইলো চার মাস, কিন্তু ছাত্রদের প্রস্তুতি থেমে থাকলো না।
অনবদ্য