এমন দিন কমই হয় যখন খুশিঝোরার গেস্ট হাউজে কোন অতিথি নেই। ছুটির দিনে বেশি, অন্য দিন কম, কিন্তু অতিথি থাকেই। এবং এই অতিথিরাই এখানকার প্রাণশক্তি, এরা না থাকলে খুশিঝোরার অস্তিত্ব বিপন্ন। সোমেশ্বরের মনে পড়ে যায় এখানে প্রথমবার আসার আগে টেলিফোনে ওর জয়মালিকা সেনের সাথে কথোপকথন। জয়মালিকা বলেছিলেন, চলে আসুন, আপনারা এলেই তো আমাদের চলে, আমরা কিছু টাকাপয়সা পাই।
টাকাপয়সা পাই ! টাকাপয়সা পাওয়াটা জরুরি, টাকাপয়সা ছাড়া চলবে কী করে !
খুশিঝোরায় যারা আসে শুধুমাত্র বেড়াতে আসাই তাদের উদ্দেশ্য নয়। বেশির ভাগই আসে একটা অন্য তাগিদ থেকে। তাগিদটির নাম জয়মালিকা। জয়মালিকা শুধুই শিল্পী নয়, জয়মালিকা একজন বড়ো মাপের মানুষ। সে তার যথাসর্বস্ব পণ করেছে সব-হারানো আদিবাসীদের জন্যে। এমন মানুষের সান্নিধ্যে আসতে চায় যারা, তারাই এখানে আসে। এমন মানুষের সাথে পরিচিত হতে চায় তারা, এমন মানুষের সাথে কথা বলতে চায় তারা, এমন মানুষের কাজে লাগতে চায় তারা। হয়তো জয়মালিকাকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি, এ কথা বলতে পারার অভিমানও কোন কোন মানুষের খুশিঝোরায় আসার আসল প্রেরণা।
আরও একদল মানুষ আসে যারা খুশিঝোরার ভালো কাজে অংশগ্রহণ করতে চায়। সেই ভালো কাজগুলোর মধ্যে একটা ছিলো বৃক্ষরোপণ, গাছ লাগানো। শিল্পী জয়মালিকার খ্যাতির একটা প্রধান কারণই ছিলো তাঁর বনসৃজনের কাজ। রুক্ষ অনুর্বর জমির চরিত্র নাকি বদলিয়ে দিয়েছিলেন জয়মালিকা; সেই আন্দোলনে অংশ নিতে, নিজের হাতে গাছ পুঁতে সেই আন্দোলনের ছটায় উজ্জ্বল হতেও, দলে দলে শহরের মানুষ এসেছে খুশিঝোরায়। ইদানিং জয়মালিকা আর বৃক্ষরোপণের কথা বলেন না, তিনি এখন ধরণীর উপাসিকা, ধরণ্যৈ নমঃ তাঁর মন্ত্র। কলকাতায় কারো কারো কাছে সোমেশ্বর শুনেছে কয়েকবছর আগে ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী বৃক্ষমিত্র পুরস্কার জয়মালিকাকে দেওয়া হবে বলে গুজব রটেছিলো। সে পুরস্কার শেষ পর্যন্ত না আসার পর থেকেই বৃক্ষরোপণের কথা বন্ধ করে ধরণীতে দেবত্ব আরোপ করে ধরণীর উপাসিকা হয়েছেন তিনি। সোমেশ্বর অবিশ্যি বৃক্ষ এবং ধরণীর উপাসনার পার্থক্য বোঝে না। কিন্তু বেশ কয়েকবছর বৃক্ষরোপণের কথা না বলায় গাছ লাগিয়ে জয়মালিকার কাজের শরিক হতে আসে না আর কেউ। যারা আসে, তারা অনেকেই দেবত্বপ্রাপ্ত ধরণীর, অতএব তাঁর পূজারিনী জয়মালিকারই, ভক্ত !
এ ছাড়া যে ভালো কাজের জন্যে খুশিঝোরার খ্যাতি, তা হলো খুশিঝোরার স্কুল। খুশিঝোরার স্কুলের ব্যাপারে কলকাতায় পত্রপত্রিকায়, বিদ্যজ্জন সমাজে, বিস্তর আলোচনা হয়েছে। দূর দূরান্তের গ্রাম থেকে একটি একটি করে ছেলে বা মেয়েকে আক্ষরিক অর্থে তুলে নিয়ে এসে লেখাপড়া শেখাচ্ছে খুশিঝোরা। প্রয়োজন হলে তাদের আহার-বাসস্থানের ব্যবস্থা করেও ! সোমেশ্বর লক্ষ্য করেছে এখানে যাঁরা বেড়াতে আসেন অন্তত একটা দিন তাঁরা ভোরবেলায় স্কুলের বাসে চেপে ছেলেমেয়েদের নিয়ে আসতে যান। উৎপল অথবা জয়মালিকা, কেউ-না-কেউ এই প্রস্তাবটা দেয় সাধারণত। যান না স্কুলের বাসে সকালবেলায়, দেখে আসুন না কোথা থেকে ছেলেমেয়েরা আসে আমাদের স্কুলে। যাঁরা যান, অসাধারণ এক অভিজ্ঞতা হয় তাঁদের। হতদরিদ্র, অশিক্ষিত, কোন্-আশ্চর্য-যাদুতে-যেন-বেঁচে-থাকা মানুষদের একটি একটি ছোট ছোট ছেলেকে বা মেয়েকে যত্ন করে বিদ্যাভ্যাসের জন্যে যখন নিয়ে আসা হয় স্কুলের বাসে, তখন সেই বাসে বসে-থাকা কলকাতা-থেকে-আসা সুবিধাভোগী মানুষটাও যেন জয়মালিকার পুণ্যার্জনের শরিক হয়ে ওঠে ! সে ভাবে, যে অসাধারণ কাজ এখানে হচ্ছে তাতে যতই ক্ষুদ্র হোক, কিছু অবদান তার থাক ! কিন্তু কী হতে পারে তার অবদান? কী ক্ষমতা তার? অনেক ভেবে সে হয়তো মনে করে কিছু অর্থসাহায্য তো করতেই পারে সে !
অসাধারণ কাজ যে হচ্ছে তা সে বোঝে কী করে? অন্তত মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়ানো হয় যে স্কুলে সেই স্কুলের পড়াশোনার মান বোঝবার একটা সহজ উপায় আছে। বোর্ডের পরীক্ষার ফল। কিন্তু যে স্কুলে পড়ানো হয় ক্লাস এইট অবধি সেখানে কেমন পড়াশোনা হয়, তা বুঝতে হলে অনেক গভীরে যেতে হয়, ছেলেমেয়েদের সাথে কথা বলে বুঝতে হয় তারা কতোটা শিখেছে। এক-আধ দিনের জন্যে বেড়াতে এসে তা বোঝা মুশকিল। সে ক্ষেত্রে, স্কুলটা ভালো কী মন্দ তা বোঝবার এবং বোঝাবার জন্যে সবচেয়ে সহজ পথ যেটা তা বইয়ের শিক্ষা নয়, বইয়ের বাইরের শিক্ষা, যাকে বলা যায় এক্সট্রা কারিক্যুলার শিক্ষা। খুশিঝোরাকে যদি চালাতে হয়, এবং সে চালানো যদি নির্ভর করে বেড়াতে আসা মানুষদের অর্থানুকূল্যের উপর, তাহলে জোর দিতে হবে এই শিক্ষার ওপরেই। খুশিঝোরার স্কুলে তাই সমবেত গান শেখানো হয় যত্ন কোরে, ঝাড়খণ্ডী উপভাষার বা আদিবাসী কোন ভাষার গান নয়, রবীন্দ্রসঙ্গীত বা বিখ্যাত শিল্পীদের গাওয়া আধুনিক বাংলা গান, ঝাড়খণ্ডী উচ্চারণে তা নতুন মাত্রা পায়, নতুন গান হয়ে ওঠে। ধন্য ধন্য করেন বেড়াতে আসা মানুষরা। নাটক শেখানো হয় বাছাই করা ছেলেমেয়েদের, সাধু রামচাঁদ সাঁওতালি ভাষায় যে নাটক লিখেছিলেন সে নাটক নয়, ডাকঘর বা অবাক জলপান বা লক্ষ্মণের শক্তিশেল ! এবং আবার, ঝাড়খণ্ডী উচ্চারণেই ! এই নাটকে যারা অভিনয় করবে তাদের হোস্টেলের আবাসিক হতেই হয়, তা না হলে সন্ধ্যায় অবসর যাপনের জন্যে তা দেখানো যাবে কী কোরে! তাই ক্লাস ফাইভ আর ক্লাস সিক্সের অন্য ছেলেমেয়েরা হোস্টেলে না থাকলেও হেমাল এবং রিমিলকে থাকতে হয় হোস্টেলেই।
মাত্র দিন দশ-বারো হয়েছে সোমেশ্বররা এসেছে এখানে। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছেলেমেয়েদের ভালো করে পড়তে শেখানো, ভবিষ্যতের একটা দিশা দেখানোর চেষ্টা করা, এবং, স্বাভাবিক ঝোঁক যে ছেলেমেয়েদের মধ্যে দেখা যাবে, তাদের বই পড়ার অভ্যাসে উদ্বুদ্ধ করা। সোমেশ্বর মনে করে অক্ষরপরিচয় থাকুক বা না-ই থাকুক, এ দেশের দরিদ্রতম খেটে খাওয়া মানুষটিও নিজের বেঁচে-থাকার জগতে শিক্ষিত। এদের সান্নিধ্যে এসে নিজেকে শিক্ষিত করে তোলার বাসনাও তার প্রবল।
খুশিঝোরা সোমেশ্বরকে একসাথে এক জায়গায় এতোগুলো ছেলেমেয়ের সান্নিধ্যের সুযোগ দিয়েছে। সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতেই হবে। কাজেই মাঝে মাঝে বাধা আসুক, ছেদ পড়ুক, ধৈর্য হারালে চলবে না। তাছাড়া, ওরা তো থাকছেই এখানে, যখনই হোক সময় বের করে নেওয়া যাবেই হোস্টেলের ছেলেমেয়েদের পড়াবার জন্যে, ঠিক বের করে নেবে ওরা।
আগস্টের শেষে যখন তিন-চারদিনের জন্যে কলকাতায় গেলো সোমেশ্বররা, ওর ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজনদের এই উপলব্ধির কথাই বললো ওরা। অতল দারিদ্রসীমারও নীচের মানুষ যারা, তাদের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের স্কুলে নিয়ে এসে পড়াতে গেলে – এবং তা-ও সরকারি সাহায্য ছাড়া – হয়তো জয়মালিকা সেনের রাস্তাই ঠিক ঠিক রাস্তা, এই পথে চলতে গিয়ে বাধা হয়ে দাঁড়াবে সহজ-খ্যাতির যে চোরাগলিগুলো, সেগুলোকে অতিক্রম করাই এখন সাধনা ওদের। যে ছেলেমেয়েদের কাছাকাছি পৌঁছোবার ক্ষমতাই ছিলো না ওদের, জয়মালিকা সেন তাদের কাছাকাছি আসার সুযোগ তো কোরে দিয়েছেন, সেই সুযোগকে কাজে লাগাতেই হবে।
কলকাতায় সোমেশ্বর-সম্ভৃতার পরিচিতরাও কিছু কিছু সাহায্য করতে চায় খুশিঝোরাকে। স্কুলের ছেলেমেয়েরা য়্যুনিফর্ম পরে স্কুলে আসে কিন্তু ওদের বেশির ভাগেরই পায়ে জুতো নেই, যাদের আছে তাদেরও অতি সস্তার রবারের চটি, এই কথা শুনে ওর ছোট ভাই একটা চেক দিয়ে দেয় সোমেশ্বরের হাতে। ব্ল্যাঙ্ক চেক। সব ছেলেমেয়ের জন্যে জুতো মোজা কিনতে যা খরচ হবে সেই অঙ্কটা চেক-এ বসিয়ে নিলেই চলবে।
খুশিঝোরায় ফিরে প্রথমেই জয়মালিকাকে চেকটা দেয় সোমেশ্বর। জয়মালিকা পুলকিত। বলছেন কী মাষ্টারমশাই ! সব ছেলেমেয়ের জুতোর খরচ দিচ্ছেন আপনি !
আমি নই, আমার ভাই। আমাদের পরিবারের এবং আমার বন্ধুবান্ধবদের অনেকেই মাঝে মাঝে কিছু কিছু অর্থসাহায্য করতে চায়। যখনই পাবো, আপনাকে এনে দেবো। আপনার কী মনে হয়, কতো খরচ হবে জুতোর জন্যে?
কী ধরণের জুতো দিতে চান? ক্যাম্বিসের? কেড্স্ জাতীয়?
না না, ক্যাম্বিসের কেন হবে? স্ট্যাণ্ডার্ড জুতো, যা স্কুলের ছেলেমেয়েরা পরে, আপনি-আমি সবাই পরেছি।
জয়মালিকা হিসেব করে, স্কুলে একশো এগারোজন ছাত্রছাত্রী মোট, দুশোর নীচেই হবে এক-এক পেয়ার, পঁচিশ হাজার টাকার বেশি তো মোজা নিয়ে হবে না কোনমতেই।
তাহলে পঁচিশ হাজার টাকা লিখে নিন, আর আমার ভাইয়ের নামে একটা এইট্টি জি সার্টিফিকেট দিয়ে দেবেন। একটা কাগজে ভাইয়ের নামটা লিখে জয়মালিকাকে দেয় সোমেশ্বর।
জয়মালিকার ঘর থেকে বেরিয়ে নিজেদের ঘরের দিকে যাচ্ছে যখন, দৌড়োতে দৌড়োতে ওর সামনে এসে দাঁড়ায় ক্লাস সেভেনের নবীন মুণ্ডা, গূড ইভ্নিং স্যর, আজ ফিরলেন?
হ্যাঁ, এই তো।
আজ পড়া হবে?
হবে না কেন, আমি চান-টান করে সাতটার মধ্যে এসে যাবো খাবার ঘরে, তোরা চলে আসিস। সবাই আছে তো?
সেদিন রাত্তিরে খাওয়ার সময় বলে উৎপল, কী ব্যাপার সোমদা, এতোটা রাস্তা গাড়ি চালিয়ে এলেন, বিশ্রাম নেওয়া-টেওয়া নয়, এসেই আবার পড়ানো শুরু !
যে কাজের জন্যে এসেছি সেটা তো করতে হবে, না হলে এই যে খাচ্ছি, আপনারাই বা দেবেন কেন !
কী যে বলেন, বলে উৎপল, তবে একটা কথা বলি আপনাকে, এতো যে কষ্ট করছেন, আমি বলতে পারি এ সবই অপাত্রে দান। ওদের তো আমিও পড়তে শিখিয়েছিলাম, আগে আমিই পড়াতাম তো, সব ভুলে মেরে দিয়েছে ! আসলে পড়াশোনা ওদের রক্তে নেই, যতোই চেষ্টা করুন, ওদের দিয়ে হবে না।
সম্ভৃতা একটু উদ্বেগ নিয়ে তাকায় সোমেশ্বরের দিকে। ও জানে, এরকম অপমানজনক কথা শুনে ছেড়ে দেবার লোক সোমেশ্বর নয়। আবার না তর্কাতর্কি ঝগড়াঝাঁটি শুরু হয়।
হঠাৎ কথা বলে ওঠেন জয়মালিকা, মাষ্টারমশাই, আমি ভেবে দেখলাম ছেলেমেয়েদের জুতোগুলো কলকাতা থেকে তৈরি করিয়ে আনাই ভালো হবে। আমি একজনকে চিনি যার জুতোর কারখানা আছে। সামনের সপ্তাহে আমি কলকাতা যাচ্ছি, তখন একেবারে অর্ডার দিয়ে আসবো, পুজোর আগেই তাহলে জুতোগুলো এসে যাবে।
ভালোই তো, বলে সোমেশ্বর, পুজোর পর তো ঠাণ্ডা পড়ে যাবে, তার আগে হয়ে গেলে ভালোই তো।
পরের রোববার সকালে যখন হাঁটতে বেরিয়েছে সোমেশ্বর, গেটের কাছাকাছি এসে জয়মালিকার সাথে দেখা। কাঁধে একটা ব্যাগ নিয়ে নিজের ঘরের দিক থেকে আসছে সে।
কোথায় চললেন? – জিজ্ঞেস করে সোমেশ্বর।
কলকাতায় যাবো দিন দুয়েকের জন্যে, জবাব দেয় জয়মালিকা, বলেইছিলাম তো আপনাকে।
পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে গেটের দিকে যায় ওরা, সোমেশ্বর গেটটা খুলে দেয়। বাইরে দাঁড়িয়ে আছে স্কুলের বাসটা। জয়মালিকা বাসে ওঠে। জানলার ধারে একটা সীটে বসে হাত নাড়িয়ে বলে সোমেশ্বরকে, আপনার জুতোর কথা মনে আছে। অর্ডার দিয়ে আসবো।
হাত নাড়ে সোমেশ্বরও।
সেদিন থেকেই আর একটা কাজ শুরু করে সোমেশ্বর-সম্ভৃতা। বাড়ি থেকে যাতায়াত করে যেসব ছেলেমেয়েরা তাদের মধ্যে স্কুলে পড়াবার সময় যাদের মনে হয় অপেক্ষাকৃত দুর্বল লেখাপড়ায়, সেই ছেলেমেয়েদের বাড়িতে যেতে শুরু করলো ওরা মুজফ্ফর সাহেবকে নিয়ে। মুজফ্ফর সাহেব প্রায় সব ছেলেমেয়ের বাড়ি চেনেন। বাড়ির কী অবস্থা, বাবা-মা কী করে, নিজে লেখাপড়া না জানলেও ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার ওপর নজর রাখা যায় কীভাবে, এসব নানান বিষয়ে আলোচনা। বাবা-মাদের মাঝে মাঝে স্কুলেও আসতে বলে ওরা। ছেলেমেয়েরা স্কুলে কী করে, কী খায়, কী ওদের খেলাধুলো, মাষ্টারমশাইরা কেমন, এসব তো জানতে হবে ! তবে হ্যাঁ, ওরাও আসবে আবার।
সোমবার দুপুরের খাওয়ার পর যখন ক্লাস এইট-এ যাচ্ছে সোমেশ্বর, প্রতুল বাবু বললেন সেভেন আর এইট-এর ছুটি হয়ে গেছে। ওরা সবাই মিলে খড় আনতে গেছে।
খড় আনতে? মানে?
যে গোরু-মোষরা আছে এখানে তাদের জন্যে খড়ের দরকার হয় না? অনেক খড়। স্কুলের বাসে ছেলেরা গেছে সেই খড় আনতে। তাই ওদের এখন ছুটি।
ও, একটু নিরাশ সোমেশ্বর। তারপর সে নিজের ঘরে যায়। ছেলেমেয়েদের একটা পরীক্ষা নেবার কথা ভাবছিলো সে, ঘরে ঢুকে ল্যাপটপটা বের করে আনে, প্রশ্নগুলো তৈরি করে রাখা যাক। যে ঘরটায় ওরা থাকে সে ঘরটায় বসে কাজ করার মতো জায়গা নেই, ডাইনিং টেবিলে কাজটা করা যাবে। ল্যাপটপ বগলে ডাইনিং হলের দিকে যেতে যেতে সে দেখতে পায় ক্লাস সেভেনের হাসি আর ক্লাসে এইটের মিনতি আর সঙ্গীতাকে। ওদের মাথায় ছোট ছোট গামছা গোল করে বিঁড়ের মতো পাকানো। বিঁড়ের ওপর চ্যাপ্টা কড়া। সেই কড়ায় সিমেন্ট-বালি-জলের একটা মিশ্রণ। মেয়েরা আস্তে আস্তে একটা মই বেয়ে উঠছে যে ঘরে জয়মালিকা থাকে তার ছাদে। সেখানে দুজন মিস্ত্রী ইঁট গেঁথে তুলছে একটা দেওয়াল। এ দৃশ্য অনেক দেখেছে সোমেশ্বর ছোটবেলা থেকে। রাজমিস্ত্রীর সহায়িকা এই মেয়েদের কলকাতায় বলা হয় কামিন। ছাত্রী বোধ হয় বলা হয়না ভূভারতে কোত্থাও !
সেদিন সন্ধ্যেবেলা পড়তে পড়তে একটু ঢোলে ছেলেমেয়েরা।
পরপর তিন দিন চললো খড় আনা আর কামিনগিরির পালা। বেস্পতিবার দেড়টার সময় যখন দুপুরের খাওয়ার ঘন্টা পড়লো, সোমেশ্বর ক্লাস সেভেন আর এইট-এর ছেলেমেয়েদের ডেকে বললো, কী রে, আজও কী খড় আনা তোদের? জানিস কিছু?
জবাব দেন প্রতুল বাবু, মনে হয় না আজ আর কোন ছুতো বের করতে পারবে। ডাক্তারবাবুকে জিজ্ঞেস করছিলাম সকালে, উনি তো দুধ দোয়াতে যান। উনি বললেন আর খড় রাখবার জায়গা নেই। আর দেওয়ালগুলোও শেষ। এবার তো ঢালাই !
তাহলে তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে দুটোর মধ্যে ফিরিস তোরা, বলে সোমেশ্বর, আজ আধ ঘন্টা আগে ক্লাস শুরু করবো, আর চলবে সাড়ে চারটে পর্যন্ত।