বড় কিছু যাই হোক না কেন, দেবতাকে ঠকিয়ে করা যাবে না, বুঝলি?
ঠকানো মানে কী?
দেবতার যা প্রাপ্য তোকে দিতেই হবে। না যদি দিস নিজের থেকে, তিনি কেড়ে নেবেন।
কোন্ দেবতার কথা যে বাবা বলে জয়মালিকা বুঝতে পারে না। বাবার দেবতার কোন নাম নেই, অন্তত কোন নামে কখনো ডাকতে শোনেনি বাবাকে। শুধু দেবতা, কোন একজন পুরুষ, ভুল করেও কখনো দেবী বলতে শোনেনি সে।
জর্মন সাহেবরা যখন এলো, সে সেই স্বাধীনতার পরে পরেই, পঞ্চাশ-একান্ন সাল হবে; পাহাড় কেটে, বনজঙ্গল সাফ করে, গ্রামের পর গ্রাম লোকজনের বসতি তুলে দিয়ে নিজেদের থাকার জন্যে কলোনি বানালো, ক্লাব তৈরি হলো, কাজ-কর্মও পেলো স্থানীয় লোকরা; আদিবাসী, ছোট-বড় জাত, সবাই। আস্তে আস্তে দোকান-বাজার বসলো, বাইরের থেকে দলে দলে আসতে লাগলো লোকজন, দেখতে দেখতে তিন-চার বছর কেটে গেলো। বড় বড় মেশিন, দিনরাত তার আওয়াজ। তারপর একদিন তৈরি হয়ে গেলো কারখানা। গ্রাম-গঞ্জ, দূর দূর থেকে মানুষ দেখতে আসে, লম্বা লম্বা অফিস ঘর, এদিক-ওদিক-একসাথে-দেখতে-পাওয়া-যায়-না এমন বড় বড় ঘরের ভেতর হাজারো মেশিন-যন্ত্রপাতি, আর তাদের সবাইকে ছোট করে দিয়ে একদিকে খাড়া ইঁটের একটা কী যেন – সবাই বলে ব্লাস্ট ফার্নেস, তার মধ্যে নাকি পাথর গলিয়ে তৈরি হবে লোহা ! রাজেন্দ্রবাবু এসে তার উদ্বোধন করবেন, খবরের কাগজে-রেডিওতে কত হৈ হৈ। তারপর কী হলো? উদ্বোধনের আগে, পাথর গলিয়ে এক কাঁচ্চা লোহা বানাবার আগেই দেবতা তাঁর পাওনা আদায় করে নিলেন।
কীভাবে?
সে কথা শুনলে তোর গায়ে কাঁটা দেবে। এত বনজঙ্গল সাফ করে, পাহাড় উড়িয়ে দিয়ে, পশু-পাখিদের তাড়িয়ে দিয়ে যে কারখানা তৈরি হলো, সেই কারখানায় একদিন আশ্চর্য এক ঘটনা। প্রোডাক্শন শুরু হয়নি তখনো, লোকজন নেওয়া হয়ে গেছে। ব্লাস্ট ফার্নেসটা যেখানে, সেখানে সব বড় বড় ইঞ্জিনীয়াররা, ম্যানেজাররা, আর সবাই ঘোরাঘুরি করছে; ফার্নেসে চলছে ট্রায়াল রান, সবকটা ইলেকট্রিক পয়েন্ট চালু, হঠাৎ – বিশ্বাস করবি? – সবায়ের মাঝখানে লাফ দিয়ে পড়লো এক বিশাল বাঘ!
বাঘ!
বাঘ। কোথা থেকে এলো কে জানে, ছোটখাটো বাঘের বাচ্চা নয়, এক বিশাল ডোরাকাটা বাঘ। রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। এত বড়ো, কোন চিড়িয়াখানায় কেউ দেখেনি কখনো। সবাই যখন হতবুদ্ধি, প্রাণের ভয়ে শুরু হয়েছে দৌড়োদৌড়ি-চেঁচামেচি-কান্নাকাটি, হঠাৎ ভয় পেয়েই বুঝি, বাঘটা এটা-ওটা বেয়ে বেয়ে উঠতে উঠতে, এক লাফে ব্লাস্ট ফার্নেসের ভেতরে ! আর ঢুকেই বিরাট এক গর্জন। গা-হিম-করা সেরকম গর্জন কেউ কখনো শোনেনি আগে। যতক্ষণে সবায়ের খেয়াল হলো ইলেকট্রিক সাপ্লাই সব বন্ধ করে দেওয়া দরকার, ততক্ষণে বাঘটা পুড়ে ছাই !
কী হলো তারপর?
শোন্, আমি তো ছিলাম না সেখানে, কী হলো খানিকটা আন্দাজ করতে পারি, খানিকটা লোকের মুখে যা শুনেছি তা বলতে পারি। শুনেছি সবচেয়ে বড় দুই জর্মন ইঞ্জিনীয়ার যেখানে দাঁড়িয়েছিলো সেখানেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায় তারা, তাদের আর জ্ঞান ফেরেনি কখনো। শপ-ফ্লোরে যারা ছিলো কমবেশি সবাই অসুস্থ হলো খানিকটা, কেউ কেউ গুরুতর। পড়ে-টড়ে গিয়ে জখম হলো কেউ কেউ। তাদের চিকিৎসা-টিকিৎসার ব্যবস্থা হলো, কাউকে কাউকে দূরের হাসপাতালে পাঠানো হলো। মোট কথা, ভাবা ছিলো একরকম, হলো আরেক রকম। কারখানার কাজ পিছিয়ে গেলো, দিল্লীর থেকে বড় বড় সব লোকজন এলেন, হঠাৎ একদিন শোনা গেলো পুজোপাঠ হবে। স্টীল প্লান্ট যে বাড়িগুলোকে বলা হচ্ছিলো তাদের বাইরে একদিন দেখা গেলো সামিয়ানা-টামিয়ানা খাটিয়ে বিরাট মণ্ডপ তৈরি হচ্ছে। পুজো হবে নাকি ! তো, পুজোও হলো। কারখানার ভেতরে শুনলাম পুরীর মন্দির থেকে পুরোহিত এসে কী সব শান্তি স্বস্ত্যয়ন করেছেন। রাঁচি থেকে এক ক্রীশ্চান সাহেব আর মসজিদের মোল্লাও এসেছেন নাকি, প্রার্থনা-টার্থনাও হয়েছে। আর তিনদিন ধরে এখানকার যত লোক, সবাইকে খাওয়ানো হলো সামিয়ানার নীচে। আমরাও খেতে গিয়েছিলাম। সবাই বলাবলি করতে লাগলো, লোহার দেবতা নিজেই বলির ব্যবস্থা করে নিলেন, পাঁঠা বলি বা মোষ বলি নয়, একেবারে বাঘ !
দেবতার পাওনা আদায়ের থেকে প্রসঙ্গটা ঘুরিয়ে দেয় জয়ি, জয়মালিকা যার পোষাকি নাম, প্রশ্ন করে, আচ্ছা বাবা, এই বলছো তুমি সেখানে ছিলে না, আবার বলছো তোমরাও খেতে গিয়েছিলে বাঘ বলির পুজোয় !
তা-ই তো, ঠিকই তো, শপ ফ্লোরে ছিলো যারা, তারা তো কারখানায় চাকরি পেয়ে ডিউটিতে গিয়েছিলো, চাপা দীর্ঘশ্বাসটা যথাসম্ভব ছোট করে ধীরে ধীরে ছেড়ে বলে হেমন্ত, আমাদের তো চাকরি হয়নি, আমরা তাই পরে শুনেছি, তবে হ্যাঁ, খাওয়ার নেমন্তন্ন ছিলো টাউনশিপের সবায়ের।
তোমার চাকরি হলো না কেন?
উত্তর দেবার আগে কয়েক মুহূর্ত কথা বলে না হেমন্ত। তারপর মেঝে থেকে জলভর্তি ঘটিটা তুলে নিয়ে ঢক ঢক করে জল খায় খানিকটা: এ কথাটা তুই আমাকে কখনো জিজ্ঞেস করবি ভাবিনি আমি। এই টাউনশিপের কে না জানে ব্যাপারটা ! তুইও ইশকুল-টিশকুলে আর পাঁচজনের মুখে শুনেছিস মনে করেছিলাম।
স্কুলেই শুধু নয়, টাউনশিপের এখানে ওখানে, দোকানে-বাজারে তো শুনেছে নিশ্চয়ই জয়ি। কিন্তু কিছুতেই মেলাতে পারেনি। স্টীল প্লান্ট তৈরি হবার সময় নানা কন্ট্রাক্টরের কাছে কাজ করেছিলো স্থানীয় লোকজন, প্লান্ট তৈরি হয়ে গেলে তাদের প্রায় সবাইকেই যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি দিয়েছিলো কোম্পানী। মাত্র কয়েকজন চাকরি পায়নি, তার বাবাও তাদের মধ্যে একজন। কোম্পানীর ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন অবিশ্যি চাকরি-না-পাওয়া এই মানুষগুলোকেও তাদের মেম্বার করে নিয়েছে, তাদের চাকরির জন্যে মামলাও করেছে সুপ্রীম কোর্টে, সে মামলা চলছে এখনো। এই ইউনিয়নের দাপটেই বিনা ভাড়ায় টাউনশিপের ছোট ছোট কোয়ার্টারে থাকতে দেওয়া হয়েছে তাদের, এমনকি স্টীল প্লান্টের ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার জন্যে যে ইংলিশ-মিডিয়ম স্কুল তৈরি করা হয়েছিলো, সেখানেও বিনা মাইনেতে ভর্তি করে নেওয়া হয়েছে এই সব পরিবারের একটি করে সন্তানকে, সে ছেলেই হোক বা মেয়ে। জয়িও তো সেই সুবাদেই পড়ছে এই স্কুলে। কিন্তু চাকরি না পাওয়া এই হতভাগ্যদের মধ্যে তার বাবাও পড়লো কেন, এ প্রশ্নের উত্তর তার জানা নেই।
স্কুলের পড়াটাও খুব সুখের নয় জয়ির। একে তো সে খুব একটা ভালো ছাত্রী নয়, পাশ করে যায় কোনরকমে। ছেলেমেয়েদের নিজেদের মধ্যে মেলামেশাও কোন এক অলিখিত নিয়মে শ্রেণীবিভক্তই প্রায়। এই শ্রেণীবিভাগ বাসস্থান অনুযায়ী। সবচেয়ে বড় বড় বাংলোয় যারা থাকে, তারা মেশে ঐ ধরণের বাংলোয় যারা থাকে শুধু তাদেরই সঙ্গে। এইরকমই। বন্ধু হবে সে, যে আমার বাড়ির মতো বাড়িতেই থাকে ! তার মানে, তার বাবা আর আমার বাবা একই রকমের চাকরি করে একই স্টীল প্লান্টে। জয়ি থাকে যে কোয়ার্টারে, সে রকম কোয়ার্টারে থাকে আর যারা, তারা তো কেউই জয়িদের ঐ ইংরিজি স্কুলটায় যায় না ! তারা যায় আরেকটু দূরে অন্য একটা স্কুলে। জয়ি তাই একাই স্কুলে যায়, ক্লাসে কথাটথা বলেই না প্রায়, টিফিনের সময় চুপ করে বসে থাকে নিজের সীটটায়, আর ছুটি হয়ে গেলে একা একাই ফেরে স্কুল থেকে। খেলার সাথী কেউ নেই জয়ির, একা একা বিকেল বেলায় বারান্দায় বসে ছবি আঁকে, যা তার মাথায় আসে, তা-ই। আর মাঝে মাঝে রেডিও খুলে গান শোনে। রবীন্দ্রসঙ্গীত। সপ্তাহের কোন্ কোন্ দিনে ঠিক কোন্ কোন্ সময় রবীন্দ্র সঙ্গীত বাজবে রেডিওতে, তা জয়ির ঠিক ঠিক জানা। তার বাবাই জানিয়েছে তাকে। বাবা তো রোজ বাড়িতে থাকে না, কখনো বারশুয়াঁ, কখনো বোণ্ডামুণ্ডা, কখনো টেনসা আর কখনো বা উদিতনগর। এ সব জায়গায় নাকি বাবার চেনাজানা অনেক লোক, তারা কাজ দেয় বাবাকে। কাজ হয়ে গেলে, কয়েকদিন পর ফেরে। ফেরে যখন, থেকে যায় তিন চার দিন। তখন বাবার সাথী ঐ রেডিওটা, আর জয়ি। বাবা মেয়ে একসঙ্গে গলা মিলিয়ে রেডিওর গানের সঙ্গে রবীন্দ্রসঙ্গীত গায় তখন। রেডিওটা এক জর্মন সাহেব বাবাকে দিয়েছিলো নাকি, এখনকার ট্রানজিস্টর রেডিওর মতো নয়, কাঠের বড় একটা বাক্স, ভেতরে আলো জ্বলছে দেখা যায়। আর আওয়াজ ! কী গমগমে আওয়াজ রেডিওটার। ধুলো-টুলো ঝেড়ে রোজ পরিষ্কার করে রাখে জয়ি রেডিওটাকে।
অন্য ভাইবোনরা কেমন দূরে দূরে থাকে জয়মালিকার থেকে। মা-ও। মা অবিশ্যি এমনিতেই কম কথা বলে, সারাদিন কোন-না-কোন কাজ করছে বাড়িতেই, কিন্তু সাড়া শব্দ পাওয়া যায় না। জ্ঞান হবার পর থেকেই এ রকম দেখছে জয়ি,
এমনকি বাবার সঙ্গেও প্রয়োজনের বাইরে কোন কথা বলতে কখনো শোনেনি সে। আর বাবাও যেন কী রকম ! বাড়িতে যতক্ষণ থাকে, খায়-দায়, ঘুমোয় আর গান গায়। অন্য ভাইবোনদের যেন চেনেই না, জয়ির সঙ্গেও যেটুকু কথা বলে, সে-ও মাপা। মাঝে মাঝে অবিশ্যি ওর ছবির খাতাটা টেনে নিয়ে ছবি দেখে, যতগুলো আছে খাতাটায় সব ছবিগুলোই দেখে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে, তার পর কোন মন্তব্য না করে খাতাটা বন্ধ করে রেখে দেয়।
এই ছবি আঁকার থেকেই জয়ি প্রথম বন্ধু পেলো। স্কুলের ড্রয়িং টীচার ওর ছবি পছন্দ করেন, কখনো কখনো এক-আধটা লাইন একটু বাঁকিয়ে-চুরিয়ে দেন, কিন্তু ক্লাশে সে সব আলোচনা হয় না, যারা ইংরিজি-ম্যাথ্স্-সায়েন্সে ভালো তাদের সবাই চেনে, ছবি আঁকার ভালো ছাত্রী অনালোচিতই থেকে যায় স্কুলে। এরই মধ্যে একদিন – ক্লাস নাইনে পড়ে তখন – টিফিনের সময়ে রোজকার মতো ক্লাসে চুপচাপ বসে আছে, সাধারণত সেকেণ্ড বেঞ্চে বসে একটা মেয়ে, নাম তুলিকা, ওর পাশে এসে বসলো হঠাৎই। কিছু না ভেবেই সঙ্কোচে একটু সরে বসতে যাচ্ছিলো জয়ি, তুলিকা ওর হাত চেপে ধরে আরেকটু ঘেঁসে এসে বললো, জয়মালিকা, তোমার ছবি আমাকে দেখাবে?
ব্যাপারটার আকস্মিকতা জয়িকে বিমূঢ় করে দিলো প্রায়, যেন কথাটার মানেই বুঝতে পারেনি সে, উত্তর দিলো, আমার ছবি, কেন?
মিসেস পাণ্ডে তো আমাকে বাড়িতে ছবি আঁকা শেখাতে আসেন, উনি তোমার মস্ত ফ্যান, আমাকে বলেছেন তোমার ছবি দেখতে, তোমার ছবি নাকি একেবারে অরিজিনাল।
অরিজিনাল? অরিজিনাল মানে কী? আমি অন্য ছবি দেখে আঁকি না, তাই?
সে তো আমিও আঁকি না, কিন্তু তুমি যে সব স্ট্রোক দাও, সে নাকি একেবারে নতুন ভাবনা। উনি বলেছেন উনি মাঝে মাঝে তোমার ছবি অন্য রকমের করে দেবার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু তাতে ইমপ্রুভ না করে আরও খারাপ হয়ে গেছে ছবিটা। তুমি যে ভাবে আঁকো, তা নাকি তোমার নিজেরই, আর কেউ সেরকম আঁকতে পারে না।
যা বললো তুলিকা, তার পুরোপুরি মানে বুঝতে পারে না জয়ি, কিন্তু মনের মধ্যে এক আশ্চর্য অনুভূতি। অরিজিনাল?ওর ছবির উপর মিসেস পাণ্ডে যখন নতুন করে দাগিয়ে দেন, ছবিটা আরও খারাপ হয়ে যায়? ওর মতো আর কেউ আঁকতে পারে না? মিসেস পাণ্ডেও নয়?
আমি তো ছবির খাতা আনিনি আজ, তুলিকাকে জবাব দেয় জয়ি, কাল নিয়ে আসবো।
জয়ির ড্রয়িঙের খাতাটা প্রায় জোর করেই রেখে দিলো তুলিকা পরের দিন, বললো বাড়িতে নিয়ে গিয়ে ওর বাবাকে দেখাবে। এমন যে একটা ঘটনা ঘটে গেলো কাউকে বলতে পারে না জয়ি। প্রয়োজনের বাইরে বিশেষ কথাই তো হয় না কারো সাথে, বাবা বাড়িতে থাকলে তবু বলতে পারতো হয়তো। কী বলবে তুলিকার বাবা ওর ছবিগুলো দেখে? বকবে নাকি? ওর তো মাইনে লাগে না এই স্কুলে পড়তে। এরকম সুযোগ পেয়েও ইংরিজি-ম্যাথ্স্-সায়েন্সের মতো ভালো ভালো সাবজেক্টে মাথা না ঘামিয়ে ছবি এঁকে সময় নষ্ট করছে বলে স্কুলের প্রিন্সিপালের কাছে নালিশ করে দেবে নাকি?
জয়িদের কোয়ার্টার থেকে হেঁটে হেঁটে স্কুলে পৌঁছোতে প্রায় আধ ঘন্টা সময় লাগে; দশটায় স্কুল শুরু, সোয়া নটার মধ্যেই পৌঁছে যায় জয়ি। তুলিকারা তিন চার জন ছেলেমেয়ে একটা গাড়িতে এক সঙ্গে আসে, ওদের তাড়া নেই, ওদের গাড়ি ঢোকে প্রায় স্কুল শুরু হওয়ার সময়েই। ফার্স্ট পিরিয়ডেই সেকেণ্ড বেঞ্চ থেকে হাত নেড়ে কিছু একটা বললো তুলিকা। তারপর টিফিনের সময় সবাই যখন হৈ হৈ করে ক্লাস থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে, তুলিকা ছুটে চলে এল জয়ির কাছে, এক হাতে জয়ির সেই ড্রয়িঙের খাতা, আর এক হাতে একটা খাম: এই নে, আমার বাবা চিঠি লিখেছে তোকে।
এই নে! তোকে! একটা ধাক্কা খায় জয়ি। কাঁপা কাঁপা হাতে খামটা খুলে চিঠিটা বের করে সে। ছোট, দু-তিন লাইনের লেখা – খুব ভালো ছবি আঁকো তুমি। পারলে আজই তুলির সঙ্গে চলে এসো আমাদের বাড়ি। অনেক ভালো ভালো ছবি দেখাব তোমাকে। চিঠির শেষে যেখানে লেখকের নাম থাকে, সেখানে লেখা: কাকু।
কাকু! তুলিকার বাবা তার কাকু হবেন? নিজের কোন কাকুর কথা জয়ি শোনেনি কখনো, তুলিকার বাবা...
তুলিকার গলার আওয়াজে সম্বিৎ ফেরে জয়ির। একটা চকলেটের বার জয়ির দিকে এগিয়ে দিয়ে এক মুখ হাসি নিয়ে তুলিকা বলে, এই নে, আজ থেকে আমরা বুজ্ম্ ফ্রেণ্ড।
কী সব যে হয়ে যাচ্ছে বুঝতে পারে না জয়মালিকা। চকলেটটা সে নেয় না: কিন্তু, কিন্তু আমি কী দেবো তোমাকে?
তোমাকে নয়, মাথা নেড়ে বলে তুলিকা, তোকে। ওয়েল, নো প্রবলেম, চকলেটটার মোড়কটা অভ্যস্ত হাতে ছাড়িয়ে নেয় তুলিকা, তারপর মট করে দুটো টুকরো করে ফেলে সেটাকে, একটা টুকরো জয়ির অবশ হাতে গুঁজে দিয়ে আর একটা টুকরো প্রায় জোর করেই মুখে ঢুকিয়ে দেয় জয়ির, তারপর হেসে বলে, কী বোকা রে, আমাকে কী দিবি ভাবছিলি, দে এই চকলেটটা আমার মুখে পুরে।
স্কুলের শেষে তুলিকার পাশে বসে ওদের গাড়িতেই সেদিন জয়ি গেলো ওদের বাড়িতে। তুলিকার বাবা তখনো অফিস থেকে ফেরেননি, ওর মা ওদের দুজনকে পাশাপাশি বসিয়ে অনেক রকমের খাবার দিলেন, আর টেলিফোনে তুলিকার বাবাকে জানিয়ে দিলেন ওদের আসার কথা। কাকু ফেরার পর কত যে ছবি দেখা হলো! কত বই ওদের বাড়িতে। ছবি যে এরকম হতে পারে আগে কখনো ভাবেনি জয়ি। দেশ বিদেশের সব শিল্পীরা ! শুধু একটা বইয়ে বাঙালি নামের কয়েকজনের ছবি আছে। একজনের নাম নন্দলাল বসু। তাঁর ছবি দেখে অবাক জয়ি। মাত্র কয়েকটা লাইনে এত কিছু বোঝানো যায়!
বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যে হয়ে গেলো। তা নিয়ে অবিশ্যি চিন্তা করেনি জয়ি। সে কখন ফেরে তা নিয়ে কারো মাথাব্যথা যে নেই তা সে ভালো মতই জানে। কিন্তু আজ সে বাড়ি ফিরেছে অন্য ভাবে। তুলিকাদের বাড়ি থেকে তাকে গাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। সে গাড়ি একটা হর্ণ দিয়ে যখন তাদের কোয়ার্টারের সামনে দাঁড়ালো, মা বেরিয়ে এলো। শুধু মা-ই নয়, আশপাশের কোয়ার্টার থেকেও দেখা গেলো অনেকে উঁকিঝুকি দিচ্ছে। দেবে, দেবেই তো। গাড়িতে চড়ে এ পাড়ায় কেউ বাড়িতে ফিরেছে কখনো ! বেশ একটু ভারিক্কি চালেই গাড়ি থেকে নেমে ধীরে ধীরে বাড়িতে গিয়ে ঢুকলো সে।
ছোট ছোট পাঁচ ভাইবোন তার মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে। যে মা স্কুল থেকে ফেরার পর ফিরেও তাকায় না, কথাও বলে না, সেই মা-ই এগিয়ে এসে চুলের মুঠি ধরে তার গালে সপাটে এক থাপ্পড়! আচমকা আক্রমণে পড়ে গেলো জয়ি। তারপর মারের পর মার! এলোপাতাড়ি! আর মুখে শুধু একটাই কথা। বাপের মুখ পুড়িয়ে এলো আদুরে মেয়ে!
সারারাত মেঝেতেই পড়ে থেকেছিলো জয়মালিকা। তাকে কেউ ডাকেনি, কেউ খেতে দেয়নি। কখন সে ঘুমিয়ে পড়েছে তার মনে নেই। কিন্তু যতক্ষণ জেগেছিলো, একটাই কথা শুধু ভেবেছে সে। মুখ পোড়ানো মানে কী সে জানে না। কিন্তু সেটা যে ভালো কাজ নয় তা সে বোঝে। সে তো কোন খারাপ কাজ করেনি। আর করেও যদি থাকে, শুধু বাবারই মুখ পুড়লো কেন? কেন মারও নয়? মা-ই তো মারছিলো তাকে। তাহলে কি বাড়ি ফিরলে বাবাও মারবে? আরও বেশি?
উত্তরটা জয়ি পেয়েছিলো পরের দিনই, আর পেয়ে, এক দিনেই অনেকটা বড় হয়ে গেলো সে। স্কুলে যায়নি পরের দিন। বিকেলের দিকে ফিরলো বাবা। মার খেয়ে ফুলে যাওয়া তার মুখের দিকে একবার তাকিয়ে, কিছু একটা বলতে গিয়েও না বলে অন্য দিকে চলে গেলো সে। অনেক রাত্তিরে, সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে যখন, জয়িকে ডেকে তুললো বাবা।খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করে কী হয়েছে জেনে নিলো সে। সবটা শুনে মেয়েকে বললো, তোর ছবির খাতাটা আনবি একবার?
বাবা যে সব ছবিই খুব যত্ন করে দেখে এ তো জানতোই জয়ি। ছবির খাতা আনতে বলায় অভিমানে-আনন্দে চোখে জল এসে গেলো তার। প্রথম ছবিটা খুলে আঙুলের ইশারায় মেয়েকে ডাকলো বাবা। বাবার পাশে গিয়ে বসলো সে। দেখ্, এই যে গোরুটাকে এঁকেছিস গাছের নীচে, গাছের ডালটায় পিঠের বাঁ দিকটা ঘসে চুলকিয়ে নিচ্ছে, ওর ঐ ওপর দিকে তোলা, আরামে চোখ বোজা মুখটা তুই মাত্র তিনটে লাইনে এঁকেছিস। তোর ছবিটা দেখার পর আমি অনেক চেষ্টা করলাম অন্যভাবে ছবিটা আঁকার। তোর মতো হলো না কিছুতেই।
ধ্যাৎ, হেসে ফেললো জয়ি। তুমি ভীষণ মিথ্যে কথা বলো বাবা।
না রে, ঠিকই বলছি। এই যে আমি এসে প্রত্যেক বার তোর ছবির খাতা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখি, কেন জানিস? তোর স্ট্রোকগুলোর বদলে অন্য ভাবে আঁকা যায় কিনা বুঝতে। আমি যখন বাইরে চলে যাই, মনে করে করে তোর ছবিগুলো নিজের মতো করে আঁকতে চেষ্টা করি। হয় না, তোর মতো অত ভালো কিছুতেই হয় না।
কথাটা ঘুরিয়ে দেয় জয়ি, আচ্ছা বাবা, তুমি যে বেশির ভাগ সময়টাই বাড়ির বাইরে থাকো, কোথায় থাকো?
এক জায়গায় কি আর থাকি রে, যে ধরণের কাজ পাই, তার ওপর নির্ভর করে কোথায় থাকবো। ধর্ কোন দোকানে ফার্নিচার তৈরির কাজে লেগে গেলাম, রাত্তিরে সেই দোকানেই থেকে গেলাম। টেনসায় গিয়ে খনির কন্ট্রাক্টরের কাছে কাজ করি যখন, তখন কন্ট্রাক্টরই কোন একটা ফাঁকা কোয়ার্টারে ঢুকিয়ে দেয়। আর যেবার কন্ট্রাক্টর ব্যবস্থা করতে পারে না, ওখানে আমার চেনা-পরিচিত আছে অনেকে, তাদের কারোর সাথে থেকে যাই।
সব জায়গায় তোমার এত জানাশোনা কী ভাবে হলো বাবা?
বাছ-বিচার না করে যেখানে যা কাজ পাই তাই করি তো, তাই অনেক লোকের সঙ্গে আলাপ হয়ে যায়। আর তা ছাড়া আমি তো এই অঞ্চলেরই লোক, ছোটবেলা থেকে এই পাহাড়-জঙ্গল ধুলোমাটির মধ্যেই বড় হয়েছি, তাই ধুলোমাটিতে থেকে যেতেই বা আমার কী অসুবিধে বল্।
হঠাৎ এর পর প্রসঙ্গটা ঘুরিয়ে দেয় বাবা, কাল স্কুল থেকে ফেরার পর থেকে তোর উপর দিয়ে যা গেলো, সেটা এবার থেকে তোকে সইয়ে নিতে হবে। মাঝে মাঝেই এ রকম ঘটনা ঘটতে পারে, হয়তো এর চেয়েও বড়সড়ো কিছু। তোকে তৈরি থাকতে হবে তার জন্যে। কেন, সেটা বলার জন্যেই ঘুম থেকে ডেকে তুললাম তোকে। ভেবেছিলাম আরও কিছুদিন পর তোকে বলবো, কিন্তু বড্ড তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যেতে হবে তোকে। কী করবো, পৃথিবীর হাতে আর সময় বেশি নেই বোধ হয়, সব কিছুতেই এখন তাড়াহুড়ো।
প্রথম কিস্তিতেই পাঙ্খা হয়য়ে গেলাম। অপেক্ষায় আছি। ছোটবেলায় বর্তমান ঝারখন্ডের গোমো জেলায় পাওয়ার হাউস বোকারোর কথা মনে পড়ছে।
জার্মান সাহেবদের কথা শুনে মনে হচ্ছে রাউরকেল্লা স্টিল প্ল্যান্টের পত্তন হচ্ছে উপন্যাসের পটভূমি। অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় আছি পরের কিস্তিগুলোর জন্য। বেশ ঝরঝরে ভাষা।
পড়লাম। আকর্ষণীয় লেখা।