দ্বিতীয়বার ক্যালকাটা ক্লাব, এবারেও হোস্ট অরুণ চৌধুরি। সুকান্ত আর অনলাভও এসেছে, কিন্তু অনুরোধ সত্ত্বেও আসেনি জলধর আর নিলীন। ক্যালকাটা ক্লাবে যাওয়ার ব্যাপারে ওদের একটু সঙ্কোচ আছে, দুজনেই বলেছে ওদের আলাদা কোরে কোন মতামত নেই, সবাই মিলে যা ঠিক করবে, তা-ই ওদের মত। আর এসেছেন দুজন ভদ্রলোক অরুণের সাথে, একজন কমলাক্ষ দাশ, ইনি জয়ি-সুকান্ত-অনলাভর পূর্বপরিচিত, খুশিঝোরা ট্রাস্টের নামে জমিটা হস্তান্তরের ব্যাপারে ইনিই সাহায্য করেছিলেন। দ্বিতীয় জন অমিতাভ সিংহল, যদিও মাড়োয়ারি নাম নিজেকে ইনি বাঙালিই বলেন, কলকাতাতেই জন্ম, ইদানিং একটা পুস্তক প্রকাশনী সংস্থা করেছেন, তাছাড়াও দুয়েকটা বাংলা চলচ্চিত্র প্রযোজনা করেছেন। আলাপ করিয়ে দিয়ে অরুণ বললেন, এঁদের আমিই নিয়ে এলাম। কোন ফর্মাল মীটিং তো নয়, আপনাদের আপত্তি নেই তো? জমি হস্তান্তর সংক্রান্ত দলিলপত্র হয়ে গেছে এর মধ্যে, ফলত এখনই হয়তো কমলাক্ষর প্রয়োজন নেই, কিন্তু তিনি থাকলেই বা ক্ষতি কী ! অমিতাভ সিংহলের ব্যাপারেও আপত্তির কোন কারণ দেখলো না ওরা, অরুণ যখন এনেছেন, ভালো বুঝেই এনেছেন নিশ্চয়ই। আলোচনা শুরু হলো খুশিঝোরা সমিতির পরিচালন-নীতির ব্যাপারে। অরুণের মতে, কোন সংস্থাই ঠিক ঠিক চলতে পারে না যদি না সংস্থার নিজের নিয়মিত অর্থাগমের একটা পরিকল্পনা থাকে। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলো সাধারণত স্বদেশী-বিদেশী-সরকারি-বেসরকারি অনুদান পায়, নানারকমের অনুদানই এই সব সংস্থার আর্থিক সঙ্গতি। অরুণের মতে সে সব অনুদান কিছু কিছু করে আসতে শুরু করবেই ভবিষ্যতে, কিন্তু সেগুলো নির্দিষ্ট প্রোগ্রামভিত্তিক হওয়াই ভালো। শুরুতেই যদি একটা নিয়মিত আয়ের ব্যবস্থা করা যায় কাজের অনেক স্বাধীনতা থাকে।
খুশিঝোরা এরই মধ্যে কলকাতার মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবি মহলে মোটামুটি পরিচিত নাম। এক লাখ টাকার বিনিময়ে লাইফ মেম্বার হওয়ার জন্যে উৎসাহ দেখিয়েছে অনেকেই। এদের মধ্যে পঁচিশ-তিরিশ জনকেও যদি এখনই নিয়ে নেওয়া হয় একটা মোটামুটি টাকার সংস্থান তাতেই হতে পারে। অরুণের মতে নিয়ে নেওয়াই উচিত, তবে একটু বুঝেশুনে। টাকার অঙ্কটা এতই কম যে অনেকেই উৎসাহী হবে, কিন্তু খতিয়ে দেখতে হবে যাকে নেওয়া হচ্ছে সে কতোটা সমমনস্ক, সাবধান থাকতে হবে যেন সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে অবাঞ্ছিত কিছু লোক সংস্থার কর্তৃত্ব না হাতিয়ে নেয়। জয়ির ঘনিষ্ঠ পরিচিতদের মধ্যে থেকে – যারা বেশির ভাগই শিল্প-সাহিত্যের সাথে যুক্ত, অথবা সাংবাদিকতার সাথে – তিরিশ জনের একটা প্রাথমিক লিস্ট তৈরি করা হলো।
এবার নিয়মিত আয়ের ব্যাপারটা। অরুণের যেটা মাথায় ছিলো, মূলত যে প্রস্তাবটা দেওয়ার জন্যে আজ সে সকলকে ক্যালকাটা ক্লাবে ডেকেছে, সেটা সে বলে এবার। শহরাঞ্চলের শিক্ষিত পরিবারগুলি ইদানিং ছোট ছোট হওয়ার ফলে মধ্যবিত্তের একটা নতুন সমস্যা দেখা দিচ্ছে। ছেলেমেয়েরা বিদেশে থাকে, এমনকী স্বদেশে হলেও অন্য শহরে। বৃদ্ধ বাবা-মা, বিশেষত দুজনের মধ্যে একজনই যদি বেঁচে থাকেন, শুধু যে একাকিত্বেই ভোগেন তা-ই নয়, অনেক সময় দেখাশোনা করার মানুষের অভাবে কষ্টে দিন যাপন করেন। এঁদের সমস্যাটা অনেক সময়েই আর্থিক নয়, অনেকের নিজেরই যথেষ্ট আর্থিক সংস্থান আছে, যাঁদের নেই তাঁদের ক্ষেত্রে ছেলেমেয়েরা সাধারণত অর্থব্যয়ে কাতর নয়, কিন্তু করবেটা কী? তাদের পক্ষে এই বৃদ্ধবৃদ্ধাদের সঙ্গ দেওয়া প্রায়-অসম্ভব। এই স্বচ্ছল বৃদ্ধবৃদ্ধাদের জন্যে যদি আধুনিক নাগরিক জীবনযাপনের নানারকমের সুখসুবিধে সমেত আরামদায়ক একটা বৃদ্ধাবাস গড়ে তোলা যায়, বাণিজ্যিক প্রয়াস হিসেবে তার সাফল্য প্রায় নিশ্চিত। এই বৃদ্ধবৃদ্ধাদের মধ্যে যাঁরা চাইবেন, তাঁদের খুশিঝোরার নানারকমের সামাজিক প্রকল্পের সাথেও যুক্ত করে নেওয়া যায়। এতে শুধু যে সমাজের মঙ্গল তা-ই নয়, এই বৃদ্ধবৃদ্ধারাও ভালো কাজের অংশীদার হিসেবে যে মানসিক উদ্দীপনা পাবেন তারও সামাজিক মূল্য কম নয়।
কিন্তু স্বচ্ছল মধ্যবিত্তের উপকারের কথা ভেবে খুশিঝোরা তৈরি হয়েছে কী? – প্রশ্ন করে সুকান্ত।
সেটাই কথা, অনলাভ বলে, নিয়মিত আয় ঠিক আছে, কিন্তু সেটা যে উপায়ে হবে আমাদের ঘোষিত কার্যসূচির কমপ্লিমেন্টারি হতে হবে তো তাকে?
কমপ্লিমেন্টারিই তো, জবাব দেয় অরুণ, এই যে বৃদ্ধদের আমরা সুযোগ দেবো নানারকমের সামাজিক কাজ করার, ধরুন আদিবাসী বাচ্চাদের একটা পড়াশোনার ব্যবস্থা করলাম আমরা, আমাদের বৃদ্ধাবাসের ইনমেটরা সেখানে লেখাপড়ায় সাহায্য করলেন, তাতে কী জনজাতিদের শিল্প-সংস্কৃতি-শিক্ষার প্রসারের কাজ করলাম না আমরা?
করলাম হয়তো, বললো অনলাভ, কিন্তু ব্যাপারটা অনিশ্চিত। ধরুন বাচ্চাদের লেখাপড়া শেখানোর প্রজেক্ট একটা হলো, কিন্তু বৃদ্ধাবাসের ইনমেটরা সে ব্যাপারে যুক্ত হতে চাইবেনই, এ রকমটা আমরা নিশ্চয়ই ধরে নিতে পারিনা। আর যুক্ত হতে চাইলেই সবাই এ ব্যাপারে কম্পিটেন্ট হবেন তারই বা কী মানে আছে?
অরুণ জয়মালিকার দিকে তাকায়, যেন তার মতামতের অপেক্ষায়। জয়ি অবিশ্যি কথা বলে না।
কথা বলেন অমিতাভ সিংহল, আমি একটু নাক গলাতে পারি?
সুকান্ত বলে, বলুন না।
যে বৃদ্ধাবাসের প্রস্তাবটা অরুণ দিচ্ছেন, ধরুন সেই একই বৃদ্ধাবাসে একটা ব্লক তৈরি করা হলো যেটা নিঃশুল্ক। আর, সেই ব্লকটায় থাকবেন শুধুমাত্র একা-হয়ে-যাওয়া ট্রাইবাল মানুষজন। এই ধরণের বৃদ্ধাবাসে সাধারণত নিয়মিত চিকিৎসার জন্যে একটা ব্যবস্থা থাকে। এ ক্ষেত্রেও সেটা থাকবে, কিন্তু অন্য বৃদ্ধাবাসের তুলনায় এটা একটু অন্যরকমের হতে পারে। এমন হতে পারে যে বৃদ্ধাবাসের আবাসিক যারা নয়, স্থানীয় সেই সব মানুষদের জন্যেও আউটডোর চিকিৎসার ব্যবস্থা হলো এখান থেকে। সত্যি সত্যিই যদি এইরকমের ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে আপনাদের সমাজসেবার কাজটা এই বৃদ্ধাবাস দিয়েই শুরু হতে পারে।
কী মনে হয়? – চোখটা এক এক করে উপস্থিত সবায়ের দিকে নিয়ে যেতে যেতে হাসি হাসি মুখে প্রশ্ন করে অরুণ।
কমলাক্ষ তাকান সোজাসুজি অরুণের দিকেই, আমি অবিশ্যি এই বৃদ্ধাবাস প্রজেক্টের প্রস্পেক্টিভ ইনভেস্টর নই, তবুও একটা কথা মনে হলো। বলবো?
বলুন না, হাসিমুখেই বলে অরুণ।
মিঃ সিংহল যা বললেন সেটা যদি খুশিঝোরা মেনে নেয় তাহলে ঐ ট্রাইবাল বৃদ্ধদের অ্যাকাউন্টে আপনি নিশ্চয়ই কোন ফাণ্ডিং এজেন্সীকে এ ব্যাপারটায় ইনভল্ভ্ করিয়ে দিতে পারবেন। ঐ ব্লকটার জন্যে আর ঐ আউটডোর চিকিৎসার জন্যে তাহলে খানিকটা নিয়মিত ফাণ্ড আসবে। সে ক্ষেত্রে ইনিশিয়াল ইনভেস্টমেন্টটা অনেক কমে যেতে পারে।
সেটা তো পরের কথা, হয়তো পারি, বলেন অরুণ, আগে ওঁরা সিদ্ধান্তটা তো নিন।
সিদ্ধান্ত তো এতো সহজে নেওয়া যাবে না, সুকান্ত বলে, প্রস্তাবটা আমাদের পরিচালন সমিতিতে আলোচনা করতে হবে। অরুণবাবুর এই পয়েন্টটা খুব ইম্পর্ট্যান্ট যে নিয়মিত আয়ের একটা ব্যবস্থা খুশিঝোরার হওয়া দরকার। কিন্তু সেটা কোন্ কোন্ রাস্তায় হতে পারে আমাদের তা ভাবতে হবে। আপনাদের কারোর কী কোন অল্টার্নেটিভ সাজেশন আছে?
অল্টার্নেটিভ সাজেশন কিছুই এলো না। জয়িকে ক্যালকাটা ক্লাবের এই মীটিংটায় আসার জন্যে টেলিফোনে অনুরোধ করেছিলেন অরুণ চৌধুরি। বলেছিলেন, আপনাদের এগজিক্যুটিভ কমিটির নেতাদের নিয়ে চলে আসুন না। একটা লিউক্রেটিভ প্রোপোজাল আছে। পারলে ঐদিনই একটা মেমোর্যাণ্ডাম অব আণ্ডারস্ট্যাণ্ডিং সই হয়ে যেতে পারে।
লাঞ্চের পর ওরা তিনজন বেরিয়ে এলো, বাকিরা থেকে গেলেন।
সেদিনই ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করলো ওরা। ট্রেনে উঠে জয়ির প্রথম কথা, খুশিঝোরায় আমাদের কারোর পাকাপাকি থাকতে শুরু করা দরকার।
ঠিকই বলেছিস, বলে সুকান্ত, বোঝা যাচ্ছে অতি দ্রুত খুশিঝোরা লিউক্রেটিভ হয়ে উঠছে। বিফোর ইট ইজ টূ লেট আমাদের সবায়ের একবার বসে সীরিয়াস আলোচনা করে ডিসিশন নিতে হবে।
কেন, কাকু তো আছেনই, বলে অনলাভ।
এটা আর কাকুর ব্যাপার নেই, এটা এখন খুশিঝোরার ব্যাপার, জয়ির মন্তব্য, কাকু ফিজিকালি প্রোটেক্ট করছেন প্রপার্টিটা, কিন্তু খুশিঝোরা এখন শুধু একটা প্রপার্টিই নয়।
স্টেশনে সুকান্তকে নিতে এসেছিলো যে গাড়িটা তাতেই একসাথে উঠলো তিনজন। যাওয়ার পথে জয়িকে নামিয়ে দিয়ে সুকান্ত বলে, সামনের রোববার মীটিং ডাকতেই হবে খুশিঝোরায়। নীলিন আর তুলির সাথে তুই যোগাযোগ কর। বাকিদের আমি দেখছি। শনিবারই পৌঁছোব।
চমৎকার