মা মৃত্যুর পরের এই দু’-মাসে যেন আরো জীর্ণ, শীর্ণ হয়েছে। হাতের চামড়া আরো ঝুলে গেছে, মুখ দু;দিকে সরু হয়ে এখন ভীষণ লম্বাটে। কথা বলতে গেলে আগের মতই জড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সেই প্রাচীন স্বভাব, জিজ্ঞাসা করলেই বলছে, ভালো আছি তো।
- ভালোই যদি আছো, তাহলে ফিরে এলে যে? ভালো থাকলে কেউ ফেরে!
- তুই তো বলেছিলি কষ্ট হলেই ফিরে আসতে। আর তুই যে আমার কথা ভেবে মন খারাপ করিস, কাঁদিস চুপ চুপ করে, সেও আমি টের পাই। আমারও খুব কষ্ট হয় রে!
- আমি কাঁদি আর তুমি টের পাও! কী করে! অত সহজে যদি সব টের পাওয়া যেত, তাহলে তো হতই। আমি মোটেও কাঁদি না। এখনো বিরক্তি আর ক্লান্তি কাটেনি আমার।
মা মোড়ায় বসে একটুক্ষণ চুপ করে থাকে। কি বলবে ভাবে যেন দু’-দণ্ড। তারপরই বলে বসে সেই কথাটা, যা শুনলে আগেও আমার গা-পিত্তি জ্বলে যেত।
- বুকের দুধ খাইয়ে বড় করেছি। গু-মুত ঘেঁটেছি। অসুখ বিসুখে রাত জেগেছি, দাঁতে কুটোটি ছোঁয়াতে পারিনি, তোদের মনের কথা আমি বুঝব না, তো কে বুঝবে বল!
একে কি ইমোশনাল ব্ল্যাক-মেইল বলে না? সব মায়েরাই তো ছেলেপুলেদের জন্য এসব করে, আমার মা কোন স্বর্গীয় ব্যতিক্রম! কী বিশ্রী মানসিকতা, যেন কবে লগ্নি করেছিলাম, এখন সুদে আসলে পুষিয়ে নিতে চাই। আমিও কট-কট করে ধমক দিই,
- সে তো করেছ তোমার চার ছেলেমেয়ের জন্যই, আমাকে বেছে বেছে এসব শোনাচ্ছ কেন, মা? বুকের দুধের দাম ধরে দিতে বলছ নাকি? জানই তো, একার সংসারে কত ঝামেলা নিয়ে থাকি, তবু আসো কেন ছুটে ছুটে! এখনও কি আমায় মুক্তি দেবে না! একবার যদি তোমার জেদি বৌমা বলে, এত সে একা সামলাতে পারবে না, কুটুকে আর আমাকে ফেলে চলে যাবে বাপের বাড়ি, তাহলে আমার হাল কী হবে ভেবে দেখেছ? সকালে উঠে রেডি হয়ে সাতটা দুইয়ের লোকাল ট্রেন ধরি। বাড়ি ফিরতে রাত দশটা। কুটুকে কে দেখবে, মা!
মায়ের মুখটা মলিন হয়ে যায়। যেন বলতে চায়, দেখতে তো সবাইকেই হয় বাবা। কাউকেই কি আর ফেলে দেওয়া যায়! কিন্তু বলে না। যেন আমার কথা কানেই ঢোকেনি, এমন ভাবে ইতিউতি তাকায়, হাই তোলে। দন্তহীন মাড়ি ফাঁক হয়ে ভেজা আলজিভ অবধি দেখা যায়।
সত্যি, নিজের ওপরেই আমার খুব রাগ হয়! আমার হয়েছে এই এক মুশকিল! সব ছেলেমেয়েদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মায়ের আঁচল-ধরা ছিলাম বলে, মুখে উচ্চারণ করবার আগেই ওঁর মনের কথা জেনে যাই। বরাবরই যেতাম। চোখের কোণটা একটু কোঁচকাল, অবরুদ্ধ কান্নায় নাকের পাটা ফুলে উঠল, বা নিচের ঠোঁটটা একটু কাঁপল, ব্যস আমি বুঝে গেলাম মা এবার কী বলবে বা করবে। এত বুঝলে মুশকিল হয়। ঠিক জানি কোন গুলি-গোলা ছুটে আসবে আমার দিকে। আমার শরীর শক্ত হয়ে ওঠে, রাগ ও বিরক্তির ব্যারোমিটার চড়তে থাকে চড়চড় করে।
সারাক্ষণ কান্নাকাটি, ভাগ্যকে দোষারোপ, শরীরের যন্ত্রণায় কোঁকানো – মা শেষদিকে আমার জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। সব দায়িত্ব আমার আর বীণার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে অন্যেরা তখন কেমন নিশ্চিন্তও ছিল, সুখেও ছিল। ওদের এই নিশ্চিন্তি আর সুখ আমার মনে জ্বালা ধরিয়ে দিত। তার ওপর বীণার ট্যাঁকস ট্যাঁকস সত্যি কথা। ওর মা-বাবার জন্য আমি কতটুকু করেছি, তার ছ্যাঁকা-লাগানো খতিয়ান। জলের মত টাকা-পয়সা খরচ। সব মিলিয়ে, মা বেঁচে থাকতেই আমার নরক-দর্শন হয়ে গিয়েছিল। তাই যেদিন নার্সিং-হোমে জবাব পেয়ে মাকে বাড়িতে নিয়ে এলাম, খুব চাইছিলাম, মা এবার চলে যাক। অনেক তো শারীরিক মানসিক যন্ত্রণা পেয়েছে, এবার মা নিজে একটু শান্তিতে ঘুমোক, আমাকেও একটু শান্তি দিক।
মা তিনদিন পর সত্যি সত্যি চলে গেল, কিন্তু শ্মশান থেকে ফিরে আগুন ছুঁয়ে বাথরুমে স্নান করতে করতেই বুঝলাম, বুড়ি কোথাও যায়নি। প্রথমেই নাকের পাশটা সুড়সুড় করছিল বলে একটু ঘষে দিলাম। তারপরই আয়নায় তাকিয়ে দেখি, সেখানে এক খয়েরি আঁচিলের জন্ম হয়েছে। ঠিক যেমনটি মায়ের ছিল। এখনো ছোট, কিন্তু ঠিক জানি, এটা তত বড়ই হবে, যত বড় মায়েরটা ছিল। কান্না পেয়ে গেল। ওমা! দেখি, যেমন ভাবে মায়ের ঠোঁট তিরতির নড়ত কান্না চাপার সময়, অবিকল সেই ভঙ্গিতে আমার ঠোঁট নড়ছে। তাজ্জব হয়ে গেলাম, আমার তো কান্না পাবারই কথা নয়, আমি তো রাবার ক্লথের ওপর গু-মুতের তীব্র গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে মা-কে আর আয়াকে বেদম ধমকাতাম আর রোজ চাইতাম বুড়ি এবার আমায় রেহাই দিক!
শুধু আঁচিল বা একরকম ভাবে কান্নার দমক সামলানো নয়, এরপর থেকে অবাক হয়ে দেখলাম আমার প্রতিটা ব্যাপারে মা ঢুকে পড়ছে। শেষদিকে ডাক্তারের নির্দেশমত ভাতের পরিমাণ, জলের পরিমাণ বেঁধে দিলে, মা কাঁদতে কাঁদতে শাপমন্যি করত আর মিষ্টি খেতে দিচ্ছি না বলে আয়াকে অনেক নালিশ করত আমার আর বীণার নামে। পরে ভেবে দেখেছি, এই যে নিষ্ঠুরের মত ঝাঁপিয়ে পড়ে ডাক্তারের নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলা, এর পেছনেও আমার একটা হিসেবি মন কাজ করত নিশ্চয়ই। বেশি খেলে মা বেশি পটি করবে, সারাদিনে এক বোতলের বেশি জল দিলে বিছানা বালিশ ভিজিয়ে থৈ থৈ করে দেবে। কে সামলাবে সে সব! বীণা ওষুধপত্র সবই নিজের হাতে রাখত, সময় হলে আয়াকে খাওয়াতে বলত, কিন্তু গু-মুত কাচাতে পারত না। স্বাভাবিকভাবেই, এ ব্যাপারে ওর প্রচণ্ড ঘেন্না। আমারও। নিজের মা হলে কী হবে, আয়া না এলে, কলতলায় ডাঁই কাঁথাকানি নাড়তে নাড়তে তীব্র দুর্গন্ধে ওয়াক এলে, আমারও মনে হত, এর থেকে আমার মরে যাওয়াও ভালো। কিন্তু বীণা-কুটুর কী হবে তাহলে! নিরুপায় হয়ে আমি মনে মনে মায়ের মৃত্যু কামনা করতাম। অনেক তো হল, এবার যাও মা! যাও!
অথচ আধপেটা খেয়ে খেয়ে মা মরে যাবার পর আমারও কেমন মিষ্টি খেতে ভয় করে, পেট পুরে খেলেও মনে হয়, ছোটবেলার মত বকবে মা। বলবে, আমাকে এত কষ্ট দিয়ে এখন পেট পুরে খাওয়া হচ্ছে!
রেগে গিয়ে খুন্তি ছুঁড়ে দেবে এমন কায়দা করে, যে ওটা কখনোই আমার গায়ে লাগবে না। ইচ্ছে করেই লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়া আর কি, যেমনটা ছোটবেলায় মা প্রায়ই করত। তখনও মা দেদার ভয় দেখিয়েছে, এখন এই বুড়ো বয়সেও দেখাচ্ছে। আমার অবস্থা যেন, বল মা তারা, দাঁড়াই কোথা!
বীণা, পাড়ার দোকান থেকে আনা সরভাজায় কামড় দিয়ে, সেদিন বলল, খাও, বসে আছ কেন!
আমাকে শিউরে উঠতে দেখে চোখ পাকিয়ে বললে, তোমার মায়ের মৃত্যুর পর থেকে তোমার কী হয়েছে বল তো? রোগা হয়ে যাচ্ছ, কিছু খেতে চাইছ না। মাঝে মাঝেই মা মা বলে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছ! ব্যাপারটা কী? তুমি যে এত মাতৃভক্ত, তা তো বুঝতে পারিনি আগে। এখন এত পস্তানোর বদলে, বেঁচে থাকতে যদি দু’টো বেশি কথা বলতে, তা হলেই ভাল হত না কি?
আমি আবার শিউরে উঠলাম। সত্যি, মায়ের সঙ্গে কথা বলাই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল শেষ দিকে। আর কী-ই বা বলব, রাতদিন এখানে ব্যথা, ওখানে জ্বালা বলে কান্নাকাটি করা মা তো আর মানুষ ছিল না, একটা মানুষের ছায়া হয়ে গিয়েছিল। ছায়ার সঙ্গে কি মানুষ অফিস, ক্রিকেট, সিনেমা, বাচ্চার পড়াশুনো, টিভি সিরিয়াল, খবরের কাগজ নিয়ে কথা বলতে পারে! বীণাও রোগের ভয়ে কুটুকে মায়ের ঘরে ঢুকতে দিত না, কড়া নজরে রাখত।
আমি সভয়ে বীণাকে বলি, দ্যাখো তো, আমার থুতনির দু’-পাশের দাগগুলো, ঠিক মায়ের মত হয়ে যাচ্ছে, তাই না? কিরকম যেন উল্টো ওয়াই শেপের! দ্যাখো দ্যাখো, ঠিক মায়ের মত। কে জানে কেন, বীণা হঠাৎ করে রেগে আগুন হয়ে গেল – “সারাক্ষণ ম্যা ম্যা করবে না ছাগলের বাচ্চার মত। বেঁচে থাকতে দাঁতকপাটি, মরলে দেবে শেতলপাটি!”
এই এক কথা, দু’-কথায় প্রচণ্ড ঝগড়া লেগে গেল। আমি চেঁচালাম, বীণা চেঁচাল। কুটু অসহায়ের মত ঘরের কোণে দাঁড়িয়ে কাঁদছে দেখে এমন মাথা গরম হয়ে গেল, যে অগ্রপশ্চাৎ না ভেবে বীণাকে বলে বসলাম, শেষ তিনদিন তুমি মা-কে প্রেসারের ওষুধটা দাওনি। আমি গুণে দেখেছি। পাতায় তিনটে ওষুধ বেশি আছে। দিলে মায়ের হয়তো এত তাড়াতাড়ি হার্টফেল হত না!
বীণার মুখ মুহূর্তে ছাই হয়ে গেল। তাকে বিড়বিড় করতে শুনলাম, তুমি গুণে দেখেছ! সারা শরীরে বেডসোর নিয়ে শুকিয়ে ছোট্ট হয়ে যাওয়া একটা মানুষকে আমি ইচ্ছে করে প্রেসারের ওষুধ না দিয়ে মেরে ফেলেছি! এত সন্দেহ তোমার!
আমার তখন গোঁ চেপে গেছে, গোঁয়ারের মত বললাম, তাহলে তিনটে ট্যাবলেট বেশি থাকল কী করে? ভাবো আমি কিছু বুঝি না! কোনো দিন ভালো করে কথা বলেছ আমার মায়ের সঙ্গে!
বীণা হাঁ করে আমার দিকে চেয়ে রইল খানিকক্ষণ, তারপর বলল – “ও বাবা, ঝগড়াও করছ তো একেবারে নিজের মায়ের মত করে। যেমন মা, তার তেমন ছা! রইল তোমার সংসার। আমি কুটুকে নিয়ে দক্ষিণেশ্বরে বাপের বাড়ি চললাম। তুমি যে আবার ওষুধ গুণে-গেঁথে দেখেছ, এটাই আমার পক্ষে যথেষ্ট অপমানের!”
রাগে গা চিড়বিড় করছিল, তার মধ্যেও মনে হল, সত্যি তো, আমি মায়ের মত করেই ঝগড়া করছি। বীণা ভালো করে কথা বলে না – কথাই বলে না – তার আবার ভালো আর মন্দ, এইটা কিন্তু মা ঝগড়া লাগলেই বলত। মনে হয়, মায়ের এই আক্ষেপ আমারও মাথায় বসে গেছে। তাই ঝগড়ার সময় মা যা যা বলত, তাই-ই বেরিয়ে এসেছে মুখ দিয়ে।
কিন্তু ব্যাপারটা অত সরল নয়। বীণা, কুটু চলে যাবার পর, খালি বাড়িতে আমি আরো মায়ের মত হয়ে যেতে লাগলাম। হাঁটুতে ব্যথা নিয়ে ঠিক মায়ের মত খোঁড়াতে লাগলাম। মায়ের মত, এক বাসন চারবার ধুতে লাগলাম। রাতে একলা শুয়ে মনে মনে মায়ের মতই নিজের ভাগ্যকে শাপমন্যি করতে লাগলাম। ওই ভাবেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, আর বাঁচতে চাই না।
আরো মুশকিল, ইদানীং মা প্রায়ই আমার কাছে ফিরে আসতে লাগলো, এই কাহিনীর শুরুতেই যেমন বলেছি, তেমন ভাবেই। কোনো ঝামেলা বা সিরিয়াস ঝগড়া করত না। কোণের চেয়ারে বা বারান্দার মোড়ায় চুপটি করে বসে থাকত। শুধু থেকে থেকে আজাইরা তর্ক করে যেত, যেমন বেঁচে থাকতেও হরদম আমার সঙ্গে করত।
- তুই যে আগে বলতিস, কষ্ট হলেই তোর কাছে ফিরে আসতে! আমি তো তোর দিদিদের বাড়িতে বেশিদিন থাকতেই চাইতাম না। জামাই-বাড়ি কেউ থাকে! রাগ করে চলে গেছি কতবার, আবার ফিরে এসেছি আমার সবচেয়ে ন্যাওটা সন্তানের কাছে। মন্দিরের দোরধরা ছেলে আমার!
এবার তুই কী করে ভাবতে পারলি যে আমি আর ফিরবো না!
এসব অভিমানের কথার তো কোনো উত্তর হয় না, আমি ছাড়া কেউ শুনছেও না। তাই চুপ করে থাকি, খবরের কাগজ নাড়াচাড়া করি, আর বাড়ি থেকে বেরনো কমিয়ে দিই। বাইরে বেরোলেই সবাই মায়ের জন্য চুকচুক শব্দ তুলে সহানুভূতি জানায়, বীণা, কুটুর কথা জিজ্ঞাসা করে। আমার অসহ্য লাগে। এছাড়াও আর একটি ভয় মনের ইঁদুর-গর্ত থেকে মুখ তোলে। এই যে মা এত আসা-যাওয়া করছে, পাড়ার কারোর সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে, আবার আগের সব কথা সাত-ব্যাখনা করে বলতে না বসে যায়! মা যা পেট পাতলা আর ভয়ানক বাজে বকার অভ্যেস! কাজের মেয়ে মেঝে মুছত আর মা শুয়ে শুয়ে জিজ্ঞাসা করত, সে আজ কী রান্না করেছে, তাকে আমরা কত টাকা মাইনে দিই, এইসব। অনেক বলেও আমরা মায়ের এই অভ্যেস শোধরাতে পারিনি। তাই শেষদিকে মা-কে কেউ দেখতে এলে বীণা ঠায় মায়ের বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে থাকত। ঠিক তো নেই, কী বলতে আবার কী বলে বসবে!
অফিসে ক্রমাগত কামাই করছি দেখে এমপ্লয়িজ ক্লাবের সেক্রেটারি সুজিত চক্রবর্তী একদিন না-বলে-কয়ে আমার বাড়িতে এসে হাজির হল। ছোকরা এসেই প্রথম কথা যেটা বলল, সেটা হল, একি, বসাকদা, আপনাকে ছোট চুলে ঠিক মাসিমার মত দেখতে লাগছে! কী আশ্চর্য, এত সিমিলারিটি আগে বুঝিনি তো!
তাকে আপ্যায়ন করে বসালাম, চা করে দিলাম, কিন্তু ভুলেও বারান্দার দিকের দরজা খুলিনি। মা-কে তো চিনি, কে এসেছে এই কৌতূহলে হয়তো এতক্ষণ মোড়ার ওপরে এসে বসে পড়েছে!
চক্রবর্তীর তাড়নাতেই এই কুন্তী বস্তির হোম-স্টে-তে এসেছি দিন পাঁচেক থাকব বলে। আমরা অফিসের মোট দশজন। আমি আর ডেসপ্যাচ সেকশনের গোপেশ বাবু একটা ঘর শেয়ার করে আছি। ব্যবস্থা ভালো, জায়গাও খুবই সুন্দর। একটু দূরে টিলার ওপর দাঁড়ালেই দেখি ধাপে ধাপে রঙিন টিনের চালে ছাওয়া বাড়ি উঠে গেছে পাহাড়ের গলা অবধি। সবুজ গাছে ভর্তি চারধার, লম্বা পাইন-ই বেশি, আর তাদের পা জড়িয়ে জড়িয়ে উঠে আসছে মোটা অজগরের মত চলমান কুয়াশার প্রবাহ। মাথায় লটকে আছে সাদা ধোঁয়ার মত মেঘ। মোটা সোয়েটারের নিচে আমার গায়ে কাঁটা দেয়। কেন যেন মনে হয়, এই পরিবেশ, এই কুয়াশায় ঝাপসা সবকিছু – মৃতদের জন্য একেবারে পারফেক্ট। সবকিছু অস্পষ্ট যখন, প্রিয়জনের মুখও তারা নিশ্চয়ই স্পষ্ট দেখতে পায় না। কুয়াশার ভেতরেই লুকিয়ে রাখা যায় জ্যান্ত মানুষদের মুখে আঁকা সীমাহীন নিষ্ঠুরতার চিহ্ন, উদাসীন চোখ আর চামড়ায় বিরক্তির একশ’ ভাঁজ। এটাই ঝামেলার ব্যাপার। শতেক মুখঝামটা ভুলে মৃতদের আবার আগের মতই গাঢ় ভালবাসতে ইচ্ছে করতে পারে পেছনে ফেলে যাওয়া জ্যান্ত মানুষগুলোকে! এইরকম মখমলি পর্দা টানা আবহাওয়ায় যা বিশ্বাস করতে ভালো লাগে, তাই-ই বিশ্বাস করা যায়! মা ভেবে বসতে পারে আমি ছোটবেলার মতই এখনো মা-কে মিস করি, মায়ের হাতের রান্না হলে দু’-গরাস বেশি খাই।
এই সব ভাবতে ভাবতে আমি ভ্যাবলা হয়ে পাইন গাছের গায়ে জমে থাকা পুরু শ্যাওলা, মস দেখতে থাকি। গোপেশের অনুরোধে মোবাইলে তার ছবি তুলে দিই। কিন্তু সারাক্ষণই মনে খুব ভয়, ভালবাসা বেশি চাগাড় দিয়ে উঠলে মা আবার আমার পিছু পিছু এখানেও চলে আসবে না তো!
সূর্য ডুবে গেলে এইখানে ট্যুরিস্টদের আর কিছু করার থাকে না। আমরা দশজন মদের বোতল নিয়ে চেয়ারে গোল হয়ে বসি। চক্রবর্তী গাড়ি নিয়ে গিয়ে নিচের বাজার থেকে প্রচুর মাল নিয়ে এসেছে, যার যা পছন্দ! একঘরে থেকেও আমি হোয়াইট রাম খাচ্ছি, গোপেশ বাবু ভদকা। হোম স্টে-র একমাত্র কাজের ছেলে যোশেফ নানা অনুপানের ট্রে সাজিয়ে কেবল আসছে আর যাচ্ছে। কখনো মাছের ডিমের বড়া, চিকেন কাবাব, কখনো শশা-চীনেবাদাম-মাখা। চিরকালই মদ পেটে গেলে আমি গম্ভীর হয়ে যাই। তাই সবাই যখন গানের তালে নাচছে, হুঁকোর সুগন্ধি ধোঁয়া টেনে আরো আবছা করে দিচ্ছে চারপাশ, তখন আমি চুপচাপ অন্ধকারে চোখ চালিয়ে কী যে খুঁজছিলাম তা নিজেও জানি না! ঘোর ভাঙল চক্রবর্তীর কথায়, আরে বসাকদা, কী ভাবছেন! মা বাবা কি কারো চিরকাল থাকে! আমাদের মধ্য দিয়েই তারা বেঁচে থাকে। মনে রাখবেন, খাও পিও জিও, এছাড়া এ জগতে আর কোনো সত্য নেই।
গভীর দার্শনিক উপলব্ধি! মদ খেলে অনেকেরই হয় শুনেছি। শরতের মেঘের মত বেশিক্ষণ টেকেও না। তবে চক্রবর্তীর কাছে আমি কৃতজ্ঞ। মায়ের আওতা থেকে আমায় অল্পদিনের জন্য হলেও বার করে এনেছে। বীণাকে নিয়ে আর ভাবছি না। এখানে আসার আগে ভয়ে ভয়ে ফোন করেছিলাম। ধরেছে যে এই আমার ভাগ্যি। গলার স্বর একটু গম্ভীর, কিন্তু কথার মাঝখানে ফোন কেটে দেয়নি। আবার কুটুর সঙ্গে কথা বলতে চাইলেও ফুঁসে উঠল না। বিনা প্রতিবাদে ছেলেকে ডেকে দিল। এগুলো সবই বরফ গলার লক্ষণ। ফিরে গিয়েই দক্ষিণেশ্বর যেতে হবে।
হোম স্টে-র মালিক কারো কিছু লাগবে কিনা জিজ্ঞাসা করতে এসেছিল। চক্রবর্তীর কথা শুনে থমকে দাঁড়াল।
-কারো মা মারা গেছেন নাকি রিসেন্টলি?
লোকটা নেপালি, কিন্তু বাংলা বলে বাঙালির থেকেও ভালো। শিলিগুড়িতে ছিল অনেক কাল। সবাই ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকাচ্ছে দেখে সে বলল, দাদা, আমাদের এখানে রলি নদী আছে, তাতে প্রদীপ ভাসিয়ে দিলে মৃতের আত্মার সদগতি হয়। আর সে ফিরে আসতে চায় না এই পৃথিবীতে। একেবারে শিওর শট। আশেপাশের গ্রামে ভুতের উপদ্রব হলে সবাই এই নদীতে প্রদীপ ভাসাতে চলে আসে। অনেকটা আপনাদের গয়া ধামের মত।
কেউ যদি যেতে চান, তো বলবেন। যোশেফ কাল বিকেলে নিয়ে যাবে।
সবাই হৈ হৈ করে উঠলে, আমি অবাক হয়ে দেখলাম গত দু’-বছরে সবাই-ই কোনো না কোনো আপনজনকে হারিয়েছে। তাই তাদের সদগতি করবার জন্য খুবই ব্যস্ত। ঠিক হল কাল বিকেলে আমরা রলি নদীতে যাব। এখান থেকে হাঁটা পথ, বড় জোর হাফ কিলোমিটার। আমি গোপেশ বাবুর নাক ডাকা শুনতে শুনতে রাত-ভর হেব্বি প্যাঁচ কষলাম। এইবার তোমাকে বাগে পেয়েছি, মা। গিয়েও যেতে চাও না তুমি, আমার সোনার সংসার ছারেখারে যায় কেবল! এবার প্রদীপ ভাসিয়ে তোমার সদগতি করে তবেই কলকাতায় ফিরব। ফুর্তিতে আমার কিশোর বেলার সিনেমা মনে পড়ে যায়, অমিতাভ বচ্চন নটবরলাল হয়ে গান গাইতে গাইতে রেখাকে জাপটে ধরল। শুয়ে পড়ল পাহাড়ি নদীর ধারে। আমিও কম্বল টেনে কোলবালিশ জাপটে ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পড়লাম।
একটু বাদেই ছাড়া ছাড়া ঘুমের মধ্যে শুনলাম, একটা পাখি অপূর্ব শিস দিচ্ছে। মাথার কাছের পর্দা সরিয়ে দেখি, মেঘ একেবারে কম্বলের মত ঢেকে রেখেছে কুন্তী বস্তিকে। রলিতে যাবার সময়ও কি এইরকম বৃষ্টি হবে! মন খারাপ করে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম।
সত্যিই সারাদিন তুমুল বৃষ্টি হল। লাঞ্চের সময় সবাই গজগজ করছিল, শালা পচাটে বৃষ্টি, নাড়িভুঁড়ি অবধি পচিয়ে দিল! কিন্তু কী আশ্চর্য, বেলা তিনটে নাগাদ ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ সরে যেতে লাগল আরো দূরের পাহাড়ে! সোনা রঙ রোদের আভাস এসে পড়ল জুম চাষের ধাপগুলোতে। সেখানে দারুণ ঝাল লোকাল লংকা ডল্লে খোরসানি অগুনতি লাল, কমলা রঙে ফুটে আছে। অনেকদিন বাদে খুব চনমনে লাগছিল। সরু পাহাড়ি রাস্তা, গাড়ি যাবে না। আমরা সবাই পাহাড়ি ভেড়ার মত লাইন করে যোশেফের পেছন পেছন যাচ্ছিলাম, সকলের হাতেই মোম-ভরা প্রদীপ, মুখের কাছে তুলোর সলতে একটু করে বেরিয়ে আছে।
বর্ষার নদী তো, তাই রলির গর্জন শোনা যাচ্ছিল অনেক দূর থেকে। কাছে গিয়ে দেখি, জলের কী তোড়! পাহাড় থেকে সদ্য নামা বৃষ্টির জল, যেমন ঠান্ডা, তেমনি ক্ষুরধার! তীরের নুড়ি পাথর মাড়িয়ে যখন জলের দিকে যাচ্ছি, দেখি মাথার অনেক ওপরে এক পাহাড়ের চূড়া থেকে আর এক পাহাড় অবধি টানা ঝুলন্ত ব্রিজের ছায়া এসে পড়ছে আমাদের সবার গায়ে। আর হু-হু করা বাতাস। সব এলোমেলো করে দিচ্ছে, মোমের প্রদীপ নিভে যাচ্ছে, সে এক লন্ডভন্ড কাণ্ড! ভাগ্যিস যোশেফ সঙ্গে ছিল। সে একটা লাইটার যোগাড় করে, অনেক চেষ্টার পর হাতের পাতা কায়দা করে মুড়ে, একটা একটা করে প্রদীপ ধরিয়ে আমাদের হাতে দিতে লাগল। সেই সাথে সাবধান-বাণী, আমরা যেন জলে না নামি।
জলে ছাড়া মাত্র প্রদীপগুলো বেশির ভাগই উলটে গেল পাথরে ধাক্কা খেয়ে, কোনটা উছলে ওঠা জলকণায় নিভে গেল। তার মধ্যে আমারটিও আছে। এ অবশ্য আমি আগে থেকেই জানতাম, মা কী আর অত সহজে আমায় ছাড়বে! শুধু দু’-একটা প্রদীপ জলে জেগে থাকা পাথর কাটিয়ে, বাতাস এড়িয়ে জ্বলতে জ্বলতে অনেক দূর গেল। সেগুলো চোখের আড়াল হলে তাদের মালিকরা হৈ হৈ করে উঠল, যেন একটা বিরাট সাফল্যের কাজ করে সেলিব্রেট করছে। পূর্বজদের স্বর্গের রাস্তা দেখিয়ে দিয়েছে, এ জন্মের সব দায় ঘুচেছে।
আমিও ওদের পেছন পেছন ফিরেই আসছিলাম, হঠাৎ কে যেন দূর থেকে ফিসফিস করে ডাকল, “খোকা! আমায় এইখানে একা ফেলে চলে যাবি, বাবা!”
পেছন ফিরে দেখি, মা! উত্তাল রলি নদীর তীরে, ঝুলন্ত ব্রিজের ছায়ায় সাদা শাড়ি পরা আমার বুড়ি মা কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে! সঙ্গের লোকেরা খেয়াল করবার আগেই আমি ছিটকে পিছিয়ে এলাম। এতো রাগ হচ্ছিল, মা-কে ধাক্কা দিয়ে নদীতে ফেলে দেবার জন্য যেন হাত নিসপিস করে উঠল। আমার জীবনের সমস্ত অশান্তির মূল এই অবুঝ মহিলা! কী করলে একে ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলা যায়! মরেও মরবে না, বরং পুরুষ্টু জোঁকের মত সারাক্ষণ আমার গায়ে, মনের মধ্যে লেগে থাকবে, এইভাবে কী চলে! কিন্তু এগিয়ে যেতে যেতে দেখি রলি নদী ঢেকে যাচ্ছে ঘন কুয়াশায়, পাহাড়ের মাথা থেকে অজস্র মেঘ হুড়মুড়িয়ে নেমে আসছে, যেন দিনান্তে ঘরে ছোটা গরুর দল। তার মধ্যে মায়ের সাদা শাড়ি মিলেমিশে আর কিছু দেখা যাচ্ছে না।
আমার খুব ভয় করতে লাগল, মা কী তবে সত্যি রলির জলে পড়ে ভেসে গেল! বুকের মধ্যেটা মুচড়ে উঠছিল, যেন কেউ আমার হৃৎপিণ্ড দু’হাতে ধরে প্রবল চাপ দিচ্ছে। আমি হাঁপাতে হাঁপাতে উল্টো বাগে ছুটছিলাম, মনে পড়ে যাচ্ছিল – একবার মেলায় হারিয়ে যাবার পর মাইকে ঘোষণা শুনে মা মেলা অফিসে এসে আমায় ফিরে পায়। তখন হয়তো আমার পাঁচ বছর বয়স, কিন্তু মায়ের সেই উথালপাতাল কান্না দেখে আমি নিজে চুপ হয়ে গিয়েছিলাম, এ আমার স্পষ্ট মনে আছে। ঝুলন্ত ব্রিজের ওপর থেকে কপালে একটি বৃষ্টির ফোঁটা উড়ে এসে বসল, মনে হল মা পরীক্ষা দিতে যাবার সময় ঠান্ডা আঙুলে ঘরে পাতা দইয়ের ফোঁটা পরিয়ে দিচ্ছে। কড়ে আঙুল আলতো কামড়ে এখনি বলে উঠবে দুর্গা দুর্গা !
এই নির্জন পাহাড়ে, পাইন বনের ভেতরে, আবার বৃষ্টি নামবার ঠিক আগের মুহূর্তে আমার অতীত যেন ঐ কুয়াশার মতই পাকিয়ে পাকিয়ে আমার ভেতরে ঢুকে পড়তে লাগল। আমার বিশ্বাসঘাতকতা, স্বার্থপরতা, সব আমি মা হয়ে গিয়ে বুঝতে পারছিলাম। শেষ আশা আঁকড়ে ধরার ব্যর্থ চেষ্টা, অপমানবোধ, অসহায়তা সব নিজের মাথায় ছুঁচ হয়ে ফুটে যাচ্ছিল। অনেক খুঁজে-পেতে যখন গিয়ে অন্ধের মত মায়ের হাত ধরলাম কুয়াশার ভেতর, মনে হল যেন ডান হাত দিয়ে নিজের বাঁ হাত আঁকড়েছি। এমন কি নিজের বাঁ কব্জির কাটা দাগটা অবধি আঙুলে টের পেলাম। চোখের জল মুছতে গিয়ে আঁচিলটায় হাত পড়ল। দেখি সেটা কখন ফুলে-ফেঁপে উঠেছে। একদম মায়ের সাইজ!
এ সব কী হচ্ছে! এই পুরো আমিটা কী তবে মা হয়ে গেল, না কি মা-ই সম্পূর্ণ আমার ভেতরে ঢুকে পড়ল!
তবুও মাথা ঠান্ডা রেখে মুখে বললাম, চলো মা, চলো। এই নির্জন ঠান্ডা জায়গায় সারা রাত থাকলে তুমি মরে যাবে। মা কষ্টের গলায় বলল, আমি তো মরেই আছি, বাবা।
সারাজীবন যেমন মায়ের কোনো কথাকে পাত্তা দিইনি, তেমনি আজকেও না দিয়ে ঝাঁজিয়ে বললাম, চলো তো এখন। দেখছো না অন্ধকার হয়ে আসছে!
বাতাসে দূর থেকে চক্রবর্তীর গলা ভেসে আসছিল, ও বসাকদা, পিছিয়ে পড়লেন কেন! পা চালিয়ে আসুন। আরে দাদা, আপনি না এক কালে রাজ্যস্তরের ফুটবলার ছিলেন!
ওরা কী করে জানবে, রলি নদীতে প্রদীপ ভাসাতে এসে, মা আমার ভেতরে পুরোপুরি ঢুকে পড়ার পর, আমার ক্লান্ত পা দু’টোর বয়স এখন আশি! এই নুড়ি পাথরের ওপর দিয়ে তাদের টেনে নিয়ে যাওয়া কি সহজ কথা!