অথচ ওকে দেখে বাইরে থেকে বোঝাই যেত না একজন মানুষ কতটা জেদি হতে পারে, নিজের লক্ষ্যে অবিচল, ওর জীবনের কোনো কঠিন সমস্যাই টলাতে পারেনি, ওকে, কী ভয়ংকর সব যাপন-অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে কেটেছে ওর দিনগুলি, রাতগুলি। অজিতের অধিকাংশ পাঠক এখন সেসব সবটা না জানলেও অনেকটাই জানেন, নতুন করে বলবার কিছু নেই, তারপরও একটা সুখী, সচ্ছল ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবন কাটাবার সমস্ত হাতছানিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেই অজিত নিজেকে পরিণত করেছিল একজন হোলটাইমার লেখকে, এমন একজন হোলটাইমার লেখক যিনি হোলটাইমার হলেও পেশাদার নন, ফলে দারিদ্র্যের সঙ্গে তার নিয়ত লড়াই আর সে লড়াইয়ে একরোখা, জেদি অজিতই জিতে গেছে বারবার। অজিত আজীবন তাই লিখেছে যেটা ওর নিজের চয়েস, সেভাবেই লিখেছে যেভাবে ও লিখতে চেয়েছে। কোথাও-ই মাথা নত করেনি। অজিতকে হারিয়ে আমি আমার জীবনের একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ বন্ধুকে হারালাম, একথা বলতে আমার কোনো দ্বিধা নেই।
অথচ অজিতের সঙ্গে আমার পরিচয় খুব বেশিদিনের নয়। ২০১৭ সালের কলকাতা বইমেলায় ওর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা। সূত্রপাতটা হয়েছিল ফেসবুকের মাধ্যমে। কি আশ্চর্য যে আমি তখনো ওর ফেসবুকে লেখাগুলি ছাড়া কোনো বই-ই পড়িনি। আমার যেসব বন্ধুরা অজিতকে অনেক আগে থেকেই চিনতেন, লিখেছেন ওর সম্পাদিত 'শহর' পত্রিকায়, তাদের সঙ্গেও কখনো কথা হয়নি অজিতকে নিয়ে। কিন্তু মাত্র পাঁচ বছরের পরিচয়ে আমরা দু’জন দু’জনের অনেক কাছে চলে এসেছিলাম। ওর শহরে আমিও একজন নিয়মিত লেখক হয়ে উঠেছিলাম, লেখা চাইলে ওকে ফেরাতে পারতাম না। আর ও প্রত্যেক সংখ্যাতে আশা করত যে আমি লিখব, বিষয়বস্তু যাই হোক না কেন। আমি কলকাতায় গেলে যেখানে উঠতাম, অজিতও ওর ব্যাগ অ্যান্ড ব্যাগেজ চলে আসত। আমি যতদিন থাকতাম ও থেকে যেত।
নিজের বই ও পত্রিকা বিক্রির তাগিদে অজিত পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত লিটল ম্যাগাজিন মেলাগুলিতে যেত। সেই সূত্রে কোচবিহারেও এসেছে কয়েকবার। কোচবিহারের লিটল ম্যাগাজিন মেলার উদ্যোক্তারা প্রত্যেক বছর অজিতকে ধানবাদ থেকে টেনে আনবার জন্য আমাকে বলত আর আমি ফোন করলেই আসছি বলে চলে আসত অজিত। মেলার কদিন ওর ঠিকানা হয়ে যেত আমার বাড়ি। উদ্যোক্তাদের ঠিক করা জায়গায় ও যেত না। মেলা শেষে আমরা ডুয়ার্সের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতাম,সঙ্গে থাকত কোচবিহারের অন্যান্য কবি-লেখক বন্ধুরা। কত যে রাতের পর রাত জেগে আড্ডা হত আমাদের ! ডুয়ার্সকে ভালবেসে ফেলেছিল অজিতও।
অজিতের ডাকেই সাড়া দিয়ে কোচবিহার থেকে আমি আর তিতির পত্রিকার সম্পাদক, কবি ও লেখক সঞ্জয় সাহা গিয়েছিলাম ধানবাদে লিটল ম্যাগাজিন মেলায় যোগ দিতে। 'আমি অনন্যা' পত্রিকার সম্পাদক ও ধানবাদ লিটল ম্যাগাজিন মেলার অন্যতম উদ্যোক্তা ড. দীপক কুমার সেনও আমাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন সে মেলায় উপস্থিত থাকবার জন্য, সেও অজিতেরই ইচ্ছায়। প্রতি রাতে অজিত অন্যরা যখন ঘুমোচ্ছে, আমাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ত রাতের ধানবাদ দেখাতে। হন্টনে সে ছিল আমাদের এক অন্য অভিযাত্রা। ভোর রাতে হোটেলে ফিরে আসতাম আমরা। উঠতাম খানিকটা বেলা করে। সিংহের ডেরায় গিয়ে সিংহকে দেখেছিলাম আমি আর সঞ্জয়। অজিতের বাইকের পেছনে দু’জনে চেপে। তবে ওর বউ প্রেরণা বা মেয়ে স্নেহা সেসময় ছিল না। ফলে দেখা হয়নি ওদের সঙ্গে। প্রেরণার সঙ্গে অবশ্য পরে ফোনে কথা হয়েছে।
বর্ধমান লিটল ম্যাগাজিন মেলায় অজিত সম্বর্ধিত হবে। আমাকে ফোন করল যাবার জন্য। আরো একটা কারণেও সেবার বর্ধমান গিয়েছিলাম। দিল্লি থেকে এসেছিলেন নাট্যকার ও নাট্য পরিচালক বারীন চক্রবর্তী। বারীনদাও ফোন করে বললেন যে আমার 'নরকের থেকে এক টুকরো অনির্বচনীয় মেঘ' গ্রন্থের দিল্লি থেকে ইংরেজি অনুবাদ বের করবার ব্যাপারে আগে আমাদের মধ্যে যে কথা হয়েছে সেটাকেই ফাইনাল করবার জন্য বর্ধমানে যেতে। যদিও শেষ পর্যন্ত কাজটা আর হয়নি। তিনদিন একসঙ্গেই ছিলাম আমরা। বারীনদা পরে অজিতের একটা গল্প সংকলন বের করবার ব্যাপারে অজিতকে সাহায্য করেছিলেন।
আগেই বলেছি অজিতের সঙ্গে আমার সামনা-সামনি দেখা ২০১৭'র কলকাতা বইমেলায় লিটল ম্যাগাজিন প্যাভেলিয়নে শহরের টেবিলে। আমি 'যোজন ভাইরাস' কিনব বলে গিয়েছিলাম ওর টেবিলে। 'যোজন ভাইরাস'এর পাঠ প্রতিক্রিয়া আমি শহরেও লিখেছিলাম। পরে অনুজ বন্ধু তনুময় গোস্বামীর সম্পাদনায় 'যোজন ভাইরাস'-কে নিয়ে আরো অনেকের পাঠ প্রতিক্রিয়া একসঙ্গে বের হয় যোজন ভাইরাস ফ্রেগ্র্যাযন্সিতে যেখানে আমার লেখাটিও ছিল। সেখান থেকে সামান্য একটু অংশও না তুলে দিলে এই লেখা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। আমি যা লিখেছিলাম: "২০১৭-র কলকাতা বইমেলায় আমার এবারের প্রাপ্তিগুলোর অন্যতম অজিত রায়ের 'যোজন ভাইরাস'-এর ওই আশ্চর্য গদ্যশৈলী, শব্দের পর কত যে নতুন ও রকমারি শব্দ, বাংলা সাহিত্যের তাবৎ পরম্পরাকে চুরমার করে দিয়ে কি আশ্চর্য এই নির্মাণ, অথচ রিডে-বিলিটির চূড়ান্ত, কতটা ইমাজিনেটিভ হলে এসব সম্ভব এবং শ্রম, মেধা ও মনন এবং গল্প বলবার স্টাইলটাও যেখানে বিষয়ের বাইরে আরো একটি বিষয় হয়ে ওঠে জাঁ লুক গদারের সিনেমার মত, তাবৎ মধ্যবিত্ত প্রতিষ্ঠান-পোষ্য সাহিত্য মাস্তানদের প্যান্টের কাছা ও ধুতির চেন একটানে খুলে দেবার এই মুনশিয়ানা ও সিদ্ধি... অজিতের জাতটিকেও চিনিয়ে দিল আমাকে 'যোজন ভাইরাস'।
যৌনতা নিয়ে মধ্যবিত্ত তে ঢ্যামনা বাঙালির যে একটা ঢাউস ভিক্টোরীয় নেকুপনা আছে, এখনো যৌনতাকে ডিসকোর্সে নিয়ে এসে গল্প বা উপন্যাস বিদেশে তো আকছার বটেই,এমনকি বাংলা সাহিত্যেও যে আমরা পাইনি, তা নয়, তারপরেও 'পুত্রার্থে'র টঙে চড়ে মধ্যযুগীয় তঞ্চকতায় তারা বসে আছে কপালে চন্দন-তিলক এবং বাংলা সাহিত্যেও যাঁরা যৌনতাকে বিষয় করেছেন তাঁদেরও প্রায় সকলেরই আধিপত্যবাদী মধ্যবিত্ত মনস্ক-মানসে অন্তর্ঘাতটুকু ঘটাবার বাইরে অন্য কোনো পায়ের তলার সর্ষে ছিল কিনা সে প্রশ্নও উঠতে পারে... অজিত তাঁর সমস্ত পূর্বসূরিদের হাঁটা পথে না গিয়ে নিজস্ব তরিকায় যে 'যোজন ভাইরাস'-এ সেই বাঙালির নাকে একটা আস্ত ঝামা ঘষে দিতে পেরেছেন, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
গদারের মোতাবেক, যৌনতাকে বিষয় করা অত্যন্ত দুরূহ যদি সমাজতাত্ত্বিক সুলভ নিঃস্পৃহতা ও দূরত্ব বজায় রেখে বিষয়টির বিশ্লেষণ না হয় যা প্রায় অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলার সামিল। 'যোজন ভাইরাস'-এ অজিত যৌনতাকে যতটা না বিষয় হিসেবে ব্যবহার করেছেন তার চেয়ে বেশি একে ডিসকোর্সের মধ্যে এনে আসলে পৌঁছাতে চেয়েছেন কোথাও যা নইলে 'দর্শন' আসে না। জীবনটাকেই খুঁজেছেন অজিত। বাংলা সাহিত্যে যৌনতাকে বিষয় হিসেবে যাঁরা ব্যবহার করেছেন অজিতের আগে, অজিতের সঙ্গে তাঁদের পার্থক্যটা তাঁদের কাউকে খাটো না করেও এভাবে বলা যায় যে, অজিতের ট্রিটমেন্ট, ফোকাস ভঙ্গি, ভাবনার প্রবহমানতা, তদুপরি শব্দের যে এক বিরাট উল্লাস, হুল্লোড়, অজিতের স্বকৃত শব্দের ধুমধাড়াক্কা, তারপরেও যে রিডেবিলিটি এবং যে যৌন মনটাকে আমরা বয়ে নিয়ে বেড়াই কিন্তু নিজেদের ন্যাংটো করে দেখিনা কখনো, দেখার সাহস পাইনা, তারও কান্না তার হাহাকার, যৌনতার তৃপ্তি ও তার জটিলতা, অন্তত এদেশে অজিতের কোনো পূর্বসূরি নেই, অজিত নিজেই নিজেকে সৃষ্টি করেছেন, পাঠককে দাঁড় করিয়েছেন এক বিরাট প্রশ্নের মুখোমুখি, নিজের আত্ম জিজ্ঞাসায় দীর্ণ হতেই হয় অজিতের পাঠককে, যৌনতাকে ডিসকোর্সে এনে অজিত এ পর্যন্ত এগিয়ে যেতে পেরেছেন।''
অজিত যে শুধু গল্প-উপন্যাসই লিখেছে তা নয়। ওর গবেষণা মূলক কাজগুলোও স্বতন্ত্র আলোচনার দাবি রাখে এবং যে জন্য বিপদের মুখেও পড়তে হয়েছিল ওকে।
মলয় রায় চৌধুরী অজিতের গদ্য নিয়ে বলেছিলেন, "অজিত রায়ের গদ্য অসাধারণ। জীবিতরা কেউ ওর ধারে-কাছে যায় না।" আমি বিশ্বাস করি।
আগামীর কলকাতা বইমেলাগুলিতেও আমরা অনেকেই যাব। শুধু অজিত থাকবে না। এর চেয়ে হৃদয় বিদারক আমার কাছে আর কী হতে পারে ! তবে অজিত বাংলা সাহিত্যে থাকবে, অজিতের অন্য পাঠকদের মত আমিও এটা বিশ্বাস করি। অজিত আমার কাছে একটা বিস্ময় তো বটেই।