এ্যান ইভিনিং ওয়াক
আজ বিকেলে একটু বেড়িয়েছিলাম, জামাইষষ্ঠীর বাজার দেখতে। গরমে একেই শরীর নাজেহাল, তার ওপর পাব্বনের আগুনে গরম বাজারের তাপ শরীরে এসে লাগলে পরিস্থিতি আরও ঘেঁটে যেতে পারে ভেবে আমি গোড়ায় একটু আপত্তি তুলে গাইগুই করতেই ওপার থেকে জবাব আসে – এই অজুহাত দেখিয়ে এতোকাল তো কাটিয়ে দিলে। এখন সেই পুরনো চালে কাজ হবেনা। চলো! আমি রেডি হচ্ছি।
এ একেবারে সরাসরি রণে আহ্বান। এরপরেও লেজ গুটিয়ে বসে থাকলে নির্ঘাত কাপুরুষ অকর্মণ্য বলে অপবাদ সইতে হবে ভেবে একটু সচল হয়ে উঠি। আসলে কিছুদিন আগে তেনার একজন জামাই বাবাজীবন প্রাপ্তি হয়েছে । তবে তিনি সুদূর প্রবাসী হওয়ায় পয়লা বছরেই তাঁকে আপ্যায়নের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতে হচ্ছে। এটা মেনে নিতে পারাটা খুব সহজ নয়। যাইহোক জামাইষষ্ঠীর জমায়েত দেখতে কত্তা গিন্নি বেরিয়ে পড়লাম।
চেনা পায়ে অচেনা ভিড়ে
আমাদের শহরতলির চেনা চেহারা গুলো দ্রুত হারে বদলে গেছে এই কয়েক বছরের মধ্যে। যাঁরা কদাচিৎ এদিকপানে এলে এলাকার তথাকথিত গ্রাম্যতা নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতো, তাঁরাই এখন এখানে এসে বেশ গদগদ স্বরে বলে ওঠেন - “কি ভালো জায়গা তোমাদের! কত দোকান বাজার মল! কত কত হাইরাইজ এ্যাপার্টমেন্ট! রাস্তাঘাট একেবারে গমগম করছে লোকজনের ভিড়ে। ফাস্টফুডের দোকানে দোকানে ছয়লাপ গোটা চত্বর! খুব ডেভেলপমেন্ট হয়েছে তোমাদের এখানে।” এই বিষয়টি নিয়ে আমি কখনও জবাবদিহি করতে বসিনি, কেবল চ্যাপলিন সাহেবের মতো হালকা চালে ঘাড় নেড়ে গিয়েছি। যা বোঝার তা তোমরাই বুঝে নাও বাপু!
সদর রাস্তা আজ ভিড়ে ভিড়াক্কার। এদেশে রাস্তায় বাজার নামিয়ে আনাটাই নিয়ম। যাইহোক আমার তিনি এমন অবস্থাতেও দিব্যি স্বচ্ছন্দ গতি। আমাদের আমলের চূনী গোঁসাইয়ের মতো ডাইনে বাঁয়ে করে এগিয়ে চলেছেন। আমি এমনিতেই সাবধানী। তার ওপর এখন আর ঝুঁকি নিতে চাইনা।খান দুই ঝোলা ব্যাগ হাতে নিয়ে জামাইষষ্ঠীর ইতিবৃত্ত ভাবতে ভাবতে চলেছি । আগে আগে তিনি, আর পিছু পিছু আমি। এই জমানায় এমনটাই দস্তুর। অন্যথায় বিবাদ বিসম্বাদের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। সাধ করে কে আর অশান্তি ডেকে আনে ?
দেবী ষষ্ঠীর কথা
দেবী ষষ্ঠী হলেন এক লোকায়ত দেবী। জনমানসেই তাঁর আস্থান। তবে তিনি নিছকই বঙ্গীয় গ্রামদেবী এমনটা নয় , প্রবল জন ভিত্তির জোরে তিনি নানা নামে, নানান রূপে দেশের অন্যান্য প্রদেশেও পূজিতা হন মহাসমারোহে।বহু বহু বছর ধরে এমনটাই হয়ে আসছে। আসলে মা ষষ্ঠী হলেন প্রজননের দেবী । মা ষষ্ঠীর কৃপায় সন্তানহীনতার জ্বালা ঘোচে , ষষ্ঠী মায়ের কৃপাতেই সুস্থ সবল থাকে তাঁরা। তাই ষষ্ঠীর দিন মায়েরা উপোসী থেকে সন্তানের মঙ্গল কামনায় ব্রত উদযাপন করেন।
আমাদের ছেলে বেলায় দেখেছি জৈষ্ঠ্য মাসের শুক্লা ষষ্ঠীর দিনটিতে, যা একালে জামাইষষ্ঠী নামেই সমধিক পরিচিত, মা ঠাকুমারা সকাল সকাল স্নান সেরে দুব্বো ঘাসের চামর দিয়ে পূত পবিত্র জল ছিটিয়ে দিতেন আমাদের গায়ে, মাথায় । নতুন তালপাখা জলে ধুয়ে সেই পাখায় বাতাস করতেন। আর তারপর আম,জাম, লিচু, জামরুল ইত্যাদি নানান মরশুমী ফল তুলে দিতেন আমাদের হাতে। হাতে বেঁধে দিতেন লাল সুতোর ধাগা। মায়েদের বিশ্বাস ছিল এই রক্ষাকবচের জোরে নিরাপদ থাকবে তাঁর আদরের সন্তানেরা। ঘাসের চামচের সাথে বাঁধা থাকতো খান দুই লালচে রঙের করমচা এবং গোটা দুই দেশি খেজুর। কিন্তু মায়ে পোয়ের এমন ঘরোয়া অনুষ্ঠানের মাঝে জামাই বাবাজীবনদের অনুপ্রবেশ ঘটলো কী করে? যেখানে পুরনো প্রবচনে বেশ হেঁকে ডেকে বলা হয়েছে - যম, জামাই,ভাগনা // এই তিন নয় আপনা। কালান্তক যমের সঙ্গে যার একাসনে ঠাঁই, সেই জামাইকে নিয়ে এতো তোয়াজ, তোল্লাবাজি কেন?
অরণ্য ষষ্ঠীই একালের জামাইষষ্ঠী
আসলে এর পেছনেও এক সামাজিক প্রেক্ষিত রয়েছে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে মেয়েরা চিরকালই উপেক্ষিতা। বাড়িতে কন্যা সন্তান জন্ম নিলে সেকালে অনেক পরিবারেই ধুন্ধুমার কাণ্ড বেঁধে যেত। ( হায়! এখনও বাঁধে) জন্মদাত্রী মায়ের কপালে জুটত অশেষ গঞ্জনা। আবার শাস্ত্রে বলেছে “পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা” অর্থাৎ বংশকে পুত্র সন্তান উপহার দিতেই নাকি পুরুষের দার পরিগ্রহণ। অথচ নিজের আদরিণী কন্যাকে কি আর কোনো মা দূরে সরিয়ে রাখতে পারেন? পুত্রের মতো কন্যাটিও যে তাঁরই অংশ, আত্মার পরমাত্মীয় আত্মজা। শ্বশুরবাড়িতে নিজের কন্যার দেখভাল করার দায়িত্ব বর্তায় প্রাথমিকভাবে জামাতা নন্দনের ওপর। সে যেন কন্যার প্রতি বিশ্বস্ত থাকে, তাঁর প্রতি সদয় ও বিশ্বাসভাজন হয় সেই উদ্দেশ্যেই জামাইদের এই বিশেষ দিনটিতে একটু আদর আপ্যায়ন খাতির করে
তোয়াজ করা হয়। আর এ কথাতো অস্বীকার করার উপায় নেই যে কন্যার জামাতাটিও শ্বাশুড়ি মায়ের কাছে সন্তান তুল্য। তাই বছরভর নানান ষষ্ঠীর ব্রত পালনের মধ্যে নিজের সন্তানের মঙ্গল কামনার ভাবটি নিহিত থাকলেও এই জৈষ্ঠ্য শুক্লা তিথির ছয় নম্বর দিনটিতে বাড়ির জামাইদের ডাক পড়ে শ্বশুরালয়ে। উপহার দেবার পাশাপাশি থাকে ঢালাও ভূরিভোজের আয়োজন। জামাইষষ্ঠীর দিন তাই হালফিলের সমাজে হয়ে উঠেছে একটি আড়ম্বরপূর্ণ পারিবারিক মিলনোৎসবের দিন, ফ্যামিলি গেট টুগেদার।
তা এই হাঁসফাঁস করা গরমে জামাই আদরের ঘটা কেন? আর কি সময় জুটল না? আসলে জামাইয়ের পাতে হরেকরকম রসালো ফলের সম্ভার তুলে দিতেই নাকি এমন আয়োজন, যদিও একালের শহুরে জামাইরা কতদূর ফলাহারী সে বিষয়ে ঘোরতর সন্দেহ আছে। আগে এই দিনটিকে অরণ্য ষষ্ঠী হিসেবে পালন করার রেওয়াজ ছিল। বাড়ির মেয়েরা জৈষ্ঠ্য মাসের প্রবল দাবদাহে দগ্ধ মাঠঘাট যাতে পর্যাপ্ত বর্ষণে সিক্ত হয়ে উঠে কৃষির সহায়ক হয়ে ওঠে সেই কামনায় অরণ্যভূমে পালন করা হতো ষষ্ঠী মায়ের ব্রত । তবে পরবর্তীতে নানান সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঘটনার আবহে অরণ্য ষষ্ঠীই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে জামাই বাবাজীবনদের আপ্যায়নের জন্য নির্ধারিত ষষ্ঠী ব্রত হিসেবে।
দম ফাঁস বাজারের ভিড়ে
এসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে ভিড় ঠেলে প্রায় থপথপিয়ে পথ চলছি। তিনি তো আমার থেকে বেশ কয়েক কদম এগিয়ে রয়েছেন। আমাকে পিছিয়ে পড়তে দেখে প্রায় রাগত কন্ঠে বলে উঠলেন - তোমার হাল দেখে আমার করুণা হয়।”
আমি একটুও রাগিনা। খালি মনে মনে বলি - দেবী! তোমার এই করুণা আমার বাকি দিনগুলোতেও যেন বজায় থাকে। রাস্তায় আজ মেলা পায়ের কুচকাওয়াজ। এরই মাঝে লক্ষ্মীকান্ত বাবুর সঙ্গে দেখা।
– কি, জামাইষষ্ঠীর বাজার হচ্ছে বুঝি ? তা বেশ।
আমিতো ক্যাটারার কে বলে দিয়েছি। ওরাই
সব ব্যবস্থা করবে।এসব হ্যাপা এখন আর গিন্নি
সামলাতে পারেনা।আর্থারাইটিসের রোগী। হাত
পা নাড়তেই বেলা কাবার, তা জামাইদের
আপ্যায়ন করবে কীভাবে? তবে হ্যাঁ….
এই বলে একটু রহস্যের ভঙ্গিতে আমার কানের
কাছে মুখ এনে, গলার স্বরটিকে যথাসম্ভব
নামিয়ে এনে বলেন, গিন্নির গলার তেজ এখনো
সেই আগের মতই আছে, শুনলে মনে হবে এই
বুঝি তেজগাঁও থেকে এলেন।
আমি কোনো জবাব দিইনা। অবশ্য লক্ষ্মীকান্ত বাবু তার জন্য অপেক্ষা না করেই বলেন, “যাই মিষ্টির দোকানের লাইনের টোকেন নিয়ে এসেছি। একবার ফসকে গেলে আবার গোড়া থেকে লাইন দিতে হবে।” কথাকটি উগড়ে দিয়ে তিনি হনহনিয়ে মিষ্টির দোকানের দিকে পা বাড়ান। আমরা দোঁহে আবার কাছাকাছি এসে দাঁড়াই।
– শোনো, দুজনের একসাথে ঘোরাঘুরিতে অনেক
সময় লেগে যাচ্ছে। আমি বরং ওদিকে চললাম,
তুমি ততক্ষণে মুদি দোকানের কেনাকাটা সেরে
ফেলো।
এই বলেই তিনি চলমান ভিড়ে উধাও হয়ে গেলেন। আর আমি চললাম মুদি দোকানের দিকে। সে ঠাঁইয়ে গিয়েও দেখি আসর সরগরম ষষ্ঠীর বাজার নিয়ে। দোকানের মালিক সুদীপ দত্ত। বছর কয়েক আগেও ভাইয়েরা সবাই মিলে মিশে দোকান চালাতো। ভাইরা ছাড়াও ছিল বাঁধা মাইনের কর্মচারী। লকডাউনের সময় ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে অনলাইন কেনাকাটার চল শুরু হতেই কপাল পুড়লো এদের। ভাইয়ে ভাইয়ে মন টানাটানিতে ব্যবসার ক্ষেত্রে পারিবারিক সম্পর্কটাই টুটে ফুটে চৌচির হয়ে গেল। এখন দুই ভাই দুই ভিন্ন দোকান চালাচ্ছে। দোকানের সামনে দাঁড়াতেই খাতির করে দেওয়ালে টাঙানো ফ্যানের মুখ আমার দিকে ঘুরিয়ে দিতে দিতে বলে – ষষ্ঠীর বাজারে খদ্দেরের টানাটানি। কাল ষষ্ঠীর দিনে মেয়ে জামাই আসবে। আমার ভাগ্নি আর ভাগ্নি জামাইয়েরও আসার কথা । জোগাড়তো করতেই হয়েছে – ইলিশ, চিংড়ি,পমফ্রেট, খাসির মাংস। এছাড়া পাঁচ রকমের ফল, আর দৈ মিষ্টি।
আমি বললাম – এতো বিশাল আয়োজন। একেবারে রাজসূয় যজ্ঞ!
একটু ম্লান হেসে সুদীপ বাবু বলেন – এসব তো লোকাচারের ব্যাপার। ব্যবস্থা না করলে সমাজে মান মান্যতা থাকবেনা। নিজের মেয়ে জামাইয়ের জন্য খরচ করতে কার না ভালো লাগে। অথচ ব্যবসার যা হাল ….।
সব ভালো যার শেষ ভালো
ও দিকের কাজ ঠিকঠাক সম্পন্ন করে তিনি এসে হাজির হয়েছেন অকুস্থলে। সব জিনিসের কথা তালিকা অনুযায়ী বলা হয়েছে কিনা ঝটিতি তা যাচাই করে আরও কিছু জিনিসপত্র সংযোজিত তালিকায় ঢুকিয়ে দেন। এদিক ওদিক ঘোরাঘুরির অবকাশে এসবের কথা মনে পড়েছে। পুরো এলাকা টহলদারি করে তাঁর যা অভিজ্ঞতা তা ঝটিতে নিবেদন করেন।
সব দোকানেই আজ বেজায় ভিড়। কাপড়ের দোকানে দেখা তনয়ার মায়ের সঙ্গে। কোন্ কাপড়টা কিনলে ভাল হয় সে বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন। তনয়ার মা সেটাই অনুমোদন করেছে।
কালী বাড়িতে বেজায় লাইন । ভিড় ঠেলে এগনো দায়।
মিষ্টির দোকানে আগামীকাল সকালের জন্য টোকেন দেওয়া চলছে।
ফলের বাজার আগুন। লিচু,আম কিছুতেই হাত ঠেকানো যাচ্ছে না।
পনিরের দাম পঞ্চাশ টাকা বেড়ে গেছে। ষষ্ঠীর কারণেই নাকি এমন মূল্যবৃদ্ধি।
কোল ড্রিঙ্কসের বড়ো বোতল শেষ।
কথা আরও বাড়তো। সুদীপ বাবু আমাদের বিল তৈরি করে ফেলেছেন। আমি বিলটি নিয়ে পয়সা মিটিয়ে দিই। জামাইষষ্ঠীর কেনাকাটা সেরে এবার ভালোয় ভালোয় বাড়ি ফিরে যেতে হবে।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।