প্রাণে-ধরে পিংলার চিঠিটা শেষ পর্যন্ত নিশ্চিহ্ন করতে পারল না কাজি, খানিকটা ঝুঁকি নিয়েই রেখে দিল ওই হারমোনিয়মের বাক্সেই, চিঠিটা ওর মাঝে-মাঝেই পড়া দরকার। ওই একটা হারমোনিয়ম, জেলখানার অনেক কিছুই বদলিয়ে দিয়েছে ওটা। কাজি স্পষ্টই বুঝতে পারে আজকাল জেলখানার প্রধান ফাটকের বাইরে রীতিমতন জনসমাগম হয় সকাল থেকে সন্ধ্যে, ভেতরে যে গান চলছে প্রায় সর্বক্ষণ, তা-ই বোধ হয় শোনে জনগণ। ভৌমিক সাহেব পাহারাদারদের কী নির্দেশ দিয়েছেন কে জানে, জেলখানার ঠিক সামনেই এরকম জনসমাগম – জায়গাটা নিষিদ্ধ অঞ্চল নিশ্চয়ই – অথচ পাহারাদাররা কোন আপত্তিই করে না। সবাইকে অবাক করে দিয়ে খাকি পুলিশি পোশাকের একজন এক দিন – ঠিক দুপুরের খাওয়ার ঘন্টাটা পড়েছে যেই – অতি দ্রুত হেঁটে এসে কাজিকে একটা নমস্কার করে একটা কাগজ দেয় তার হাতে। কোন গোপনীয়তা নেই, কাগজটা দিয়ে দাঁড়িয়েই থাকে লোকটা। কাগজের দিকে চোখ রাখে কাজি, গানের ফরমাশ! গোটা দশেক গানের প্রথম পংক্তি লেখা তাতে।
কী ব্যাপার এগুলো? – জিজ্ঞেস করে কাজি।
এই গানগুলো গাইতে হবে।
কেন?
না, মানে পাঁচজনে অনুরোধ করল।
পাঁচজনে অনুরোধ করল? আর আপনি?
না, মানে আমি তো জেলখানার কর্মচারি, আমি কি করে অনুরোধ করব?
তার মানে, যারা অনুরোধ করল, আর অনুরোধগুলো পাঠিয়ে দিল আপনাকে দিয়ে, তারা জেলখানার কর্মচারি নয়, তাই তো? তাহলে, আপনাকে তারা পেল কোথায়?
আমি তো বড় ফাটকের বাইরে পাহারায় থাকি, ফাটকের বাইরে থেকে আপনাদের গলা শোনা যায়। আপনাদের গান শুনতে পেয়ে অনেক লোক ভীড় করে দাঁড়িয়ে যায় ফাটকের বাইরে। এক একজন তো দাঁড়িয়েই থাকে দাঁড়িয়েই থাকে। তারাই সব কাগজে লিখে আমাকে দিল, বলল কাজি নজরুল গান গাইছেন, এই কাগজখানা দিয়ে আসুন; বলুন এই গানগুলো গাইতে।
ওরা বলল আর আপনি নিয়ে এলেন, বলে কাজি, কাজটা ঠিক করলেন কি? এমন করলে আপনার চাকরি থাকবে?
সে আপনি ভাববেন না স্যর, জেলখানার সবাই জানে।
হো হো করে হেসে ওঠে কাজি – দে গোরুর গা ধুইয়ে – জেলখানার সবাই জানে, হা হা হা।
অতএব গান হয়। কাজী একা নয়, তার সঙ্গী কারাবাসীরাও তার সঙ্গে। গান গেয়ে মজা করে একটু-আধটু দুয়েকজনের পেছনে লেগে দিব্যি কেটে যায় বহরমপুর জেলের সময়। আর, এই সব হৈ হৈ-এর হাত থেকে একটু মুক্তি পেলেই পিংলার চিঠিটা নিয়ে বসে কাজি, মাঝে মাঝেই তার মনে হয় পিংলা হয়তো সত্যি কথাই বলেছে। জেল থেকে মুক্তি পেলে সে কবির সঙ্গে দেখা করবে শান্তিনিকেতনে গিয়ে। কবি যদি তাকে চলে আসতে বলেন, সে চলে যাবে শান্তিনিকেতনে।
একদিন কোথা থেকে কাগজ-পেনসিল যোগাড় করে রবীন্দ্রনাথের উদ্দেশে একটা চিঠি লিখতেও বসে সে। খানিকটা লেখার পর তার মনে হয়, সময় নষ্ট হচ্ছে। শান্তিনিকেতনে তার মন বসবে না। কাজি নিজেই অনুভব করে শান্তিনিকেতনে মন বসাবার জন্যে যে মানসিক স্থৈর্যের প্রয়োজন তার তা নেই। তার জীবনের একটা প্রয়োজনীয় চালিকা শক্তি উচ্চকিত উচ্চারণ। আর, সেই উচ্চারণ ভেবেচিন্তে আসে না। হঠাৎ হঠাৎ কোন কোন শব্দবন্ধ বাক্যবন্ধ উদিত হয় মনের কোন কোণে, তারপরেই সে বাক্যবন্ধ ছন্দরূপ পরিগ্রহণ করে। সৃষ্টি হয় একটা গান অথবা কবিতা। কোন বিশেষ পরিবেশের প্রয়োজন হয় না কাজির, সে সুতীব্র কণ্ঠে ঘোষণা করে, সৃষ্টি হয়েছে; নতুন একটা-কিছুর সৃষ্টি হয়েছে পৃথিবীতে! আর নজরুলের বিষয়ে এ-কথা রবীন্দ্রনাথ নিজেও জানেন। তাই, একবারের ছোট্ট একটা অনুরোধেই ধূমকেতুর জন্যে অমন একটা আশীর্বাণী লিখে দিয়েছিলেন তিনি। চমক মেরে অর্ধচেতনদের জাগানোই তার উপযুক্ত কাজ, সুরুল-শান্তিনিকেতনের সুশৃঙ্খল লেগে-থাকা-সরল পথ তার জন্যে নয়!
জেলখানায় সশ্রম কারাদণ্ডের বন্দীদের জন্যে প্রতি মাসে তিন দিনের ছুটি বরাদ্দ। সেই জমানো ছুটি কারামুক্তির সময় হিসেবে আসে। নজরুলের এক বছরের কারাদণ্ড, কাজেই এই এক বছরের হিসেব কোনমতেই এগার মাসের বেশি হতে পারে না। সেই হিসেবে উনিশশো তেইশের পনেরই ডিসেম্বর নজরুলের মুক্তি হবার কথা। কিন্তু জেলে তো নেহাৎ ভালোমানুষের মতো থাকেনি কাজি। তার বিরুদ্ধে জেল-আইন ভাঙবার অভিযোগ আছে। অতএব তেরই ডিসেম্বর তাকে বহরমপুরের সদর বিচারকের আদালতে তোলা হল। বহরমপুরের বিখ্যাত আইনজীবী ব্রজভূষণ গুপ্ত নজরুলের হয়ে সওয়াল করলেন। জানুয়ারির ন'তারিখে পরের শুনানির দিন পড়ে; তবে নির্দিষ্ট দিনেই, অর্থাৎ পনেরই ডিসেম্বরে তাকে মুক্তি দেবার রায়ও দেয় আদালত।
যার গান শোনবার জন্যে সকাল থেকেই জেলখানার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে শহরের লোকজন, সে যেদিন ছাড়া পাবে সেদিন জেলের বাইরে ভীড় হবে না? ছাড়া পাওয়ার দিন সই-সাবুদ করে জেলের বাইরে এসে দাঁড়ায় কাজি, কোথায় যাবে, যাবে কীভাবে এই সব চিন্তা মাথায় নিয়ে। কিন্তু জেলের প্রধান ফাটক দিয়ে বেরোতেই কী একটা যেন ঘটে গেল। কয়েকজন যুবকের স্কন্ধবাহিত হয়ে বহরমপুরের রাস্তা দিয়ে চলেছে সে। কারা তাকে নিয়ে যাচ্ছে, কোথায় – সে বিষয়ে কোন ধারণাই নেই তার। রাস্তার দুপাশে সারিবদ্ধ মানুষের হর্ষধ্বনি, পুরুষ-মহিলা নির্বিশেষে, আর গান – কারার ওই লৌহ-কপাট / ভেঙে ফেল, কররে লোপাট!
কাজিকে সোজা নিয়ে আসা হল কৃষ্ণনাথ কলেজের সায়েন্স মেস-এ। এবং কোন কথা কাজিকে বলবার সুযোগ না দিয়ে ডজন খানেক বহরমপুরের বিখ্যাত ছানাবড়ার একটা পাত্র ধরা হল কাজির সামনে।
কাজি দেখল, এবং তারপর খানিকটা কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে বলল, দেখুন মশাই, অনেক সয়েছি সকাল থেকে। মগজ ও বপুর বাইরে নিজের হস্তপদাদি কিছু বাড়তি অঙ্গ আছে কিনা সে বিষয়েও সন্দেহ হচ্ছে এখন। কেমন করে আকাশে-আকাশে উড়তে-উড়তে, পড়ে যাই-পড়ে যাই শঙ্কা নিয়ে এখানে এসে পৌঁছলুম তা-ই বুঝতে পারলুম না। এখন এই পাহাড়-প্রমাণ মিষ্টি নিয়ে এসে খেতে বলছেন! আমাকে কি বকরাক্ষস পেয়েছেন?
বিনয়ের অবতার এক যুবক বলে, বলেন কী কাজিদা, আমরা আপনার দাসস্য দাস, বহরমপুরের রাস্তার ধুলো আপনার শ্রীচরণারবিন্দদ্বয়ে লাগতে দেব কেন? ক্ষমতা থাকলে জেলখানার প্রধান ফাটক থেকেই আপনাকে উড়িয়ে আনতাম পুষ্পক রথে, কিন্তু সেই ত্রেতা যুগও নেই, সেই রাম-রাবণও নেই, কাজেই আমাদের কাঁধই আমাদের ভরসা। আসতে আপনার কষ্ট হয়নি তো?
নজরুল হেসে ফেলে। বলে, আপনাদের অনেক ধন্যবাদ। কিন্তু, বুঝতেই পারছেন, আমার এখন কিছুদিনের জন্যে বিশ্রাম দরকার। নিশ্চুপ নিরুপদ্রব ঘুম। তারপর, গান-বাজনা যা আপনারা বলেন, সে ব্যাপারে কী করা যায় দেখা যাবে।
সায়েন্স মেসের এক-একটা ঘরে পাঁচ থেকে আটজন ছাত্র থাকে। তারই মধ্যে একটা ঘর ছেড়ে দেওয়া হল কাজির জন্যে। ক্যান্টিনে নিয়ে গিয়ে তাকে খাইয়েও আনল ছেলেরা, এবং ডজনখানেক ছানাবড়া থেকে দুটি মাত্র খেয়ে তৃপ্ত হল নজরুল।
জেল থেকে বেরিয়ে অবধি কাজির মনে পড়ছে দুলির কথা। সমস্তিপুর থেকে কুমিল্লায় ফিরেই গ্রেপ্তার হয়েছিল ও। সে সময় মাসিমাকে ও বলে এসেছিল, ছাড়া যখনই পাব, চলে আসব আমি, সে যতদিনেই হোক না কেন। কাগজ-পত্রে জানতে পারবেন সবই। দুলিকে বলবেন, ওর জন্যে আমি অপেক্ষা করে থাকব। দুলি অপেক্ষা করে আছে, ওকে যেতেই হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।
কিন্তু বিকেল থেকেই জনসমাগম। বহরমপুর কোর্টের জনাদশেক আইনজীবীকে সঙ্গে নিয়ে এলেন ব্রজভূষণ গুপ্ত। নজরুলের সঙ্গে কোনই পরিচয় ছিল না ব্রজবাবুর। উনি নিজে থেকেই ওর হয়ে লড়েছেন। নিজেকে কাজির গুণমুগ্ধ বলে পরিচয় দিলেন। আর বারবার করে ওকে বলে দিলেন, ও যেখানেই থাকুক না কেন, জানুয়ারির ন' তারিখে বহরমপুরের কোর্টে ওকে হাজির থাকতেই হবে। সশরীর। এখানে প্রক্সি চলবে না, অসুস্থ হলেও না। আমি একটা সাজেশান দিই আপনাকে, বলেন ব্রজবাবু, আপনি আট তারিখেই চলে আসুন। একটা রাত না হয় আমার বাড়িতেই থেকে যাবেন।
পরের দিন সকালে প্রায় চুপিচুপি সায়েন্স-মেস থেকে বেরিয়ে পড়ে কাজি, লক্ষ্য কলকাতা। শেয়ালদাগামী ট্রেনে ওঠার পর প্রথম, জীবনে এই প্রথম, কাজি নিজের দিকে ফিরে তাকায়। সে কলকাতায় যাচ্ছে। কলকাতায় কোথায়? তার থাকবার জায়গা কোথায়? কার কাছে যাচ্ছে সে? বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকায় তার কবিতার প্রকাশের সূত্রে মুজফ্ফর আহ্মদের সঙ্গে দূর থেকে তার প্রথম পরিচয়, মুজফ্ফরেরই আহ্বানেই তার কলকাতায় পদার্পণ এবং মুসলমান সাহিত্য পত্রিকার বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা। সেই সাহিত্য পত্রিকা এবং মুজফ্ফরের সূত্রেই কলকাতায় তার একটা শিকড়-গোছের গজানো, বন্ধুবান্ধব এবং বিচিত্র পরিচিতির সূত্রপাত। সেই সূত্রেই সাহিত্য পত্রিকার বাড়িতে আফজালের ঘরে দ্বিতীয়বারের মতো আবার। আজ মুজফ্ফর কারাগারে; ধূমকেতুর প্রকাশক হিসেবে আফজালের গ্রেপ্তারে সমাজে-প্রতিষ্ঠিত-আফজালের-আত্মীয়রা তাকে মুক্ত করিয়ে নিয়ে যাবার পর, সে এখন কোথায় কাজির জানা নেই। তাহলে কলকাতায় কোথায়? কোথায় যাবে সে? হ্যাঁ, আরও একজন আছে। শৈলজা। শৈলজা তার বাল্যবন্ধু। সান্ধ্য-দৈনিক নবযুগের অন্যতম সম্পাদক কাজি নজরুল, টার্ণার স্ট্রীটের একতলা বাড়িতে দুই-বন্ধুর গরীবের সংসারের কনিষ্ঠ সভ্য কাজী নজরুল, হঠাৎ একদিন শৈলজার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অনিশ্চিতের পথে শিয়ারশোল অভিমুখে রওনা দেবার পর থেকে শৈলজার কোন খবর কোনদিন নেয়নি যে কাজি নজরুল, কলকাতায় আজ তার কে আত্মীয়?
তবুও শেয়ালদায় নেমে প্রায় অভ্যাসচালিত কাজি হাঁটতে হাটতে সেই বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির বাড়িতেই। ঢুকেই দু-দুটো পরিচিত মুখ। এক, আবদুল হালীম, সে রিডিং-রূমে তার প্রিয় চেয়ারটিতে বসে কিছু-একটা পড়ছে। অনতিদূরে একটা তক্তপোশে বসে কিছু একটা লিখছেন মঈনুদ্দীন হুসয়ন সাহেব। মঈনুদ্দীনকে দেখেই মন ভালো হয়ে যায় কাজির। তাঁর একমুখ দাড়ির ফাঁক দিয়ে উঁকি-মারা খুশির হাসি দেখলে মন ভালো হবে না এমন কেউ নেই। কাজির যখন প্রথম কবিতা প্রকাশ হয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকায় তখন তিনি কলকাতার বাইরে, বীরভূমে তাঁর গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলেন। কাজিকে তিনি চিনতেন না, তবুও প্রথম-প্রকাশের জন্যে কাজিকে তিনি অভিনন্দিত করেছিলেন তার জন্যে পঞ্চাশটা টাকা পাঠিয়ে দিয়ে। সেই টাকাই পরে নবযুগের সোল-সেলিং এজেন্ট দুবের কাছে পিংলার ব্যবসা-শুরুর জমানত হয়েছিল।
কাজিকে কিছু বলতেই হল না। সে যে সাহিত্য সমিতির বাড়িতে থেকে যাবে এটাই যেন স্বতঃসিদ্ধ। দুপুরে কাজি আর আবদুল হালীমকে চাঁদনীর এক রেস্টোর্যান্টে খাওয়াতে নিয়ে গেলেন হুসয়ন সাহেব। কাজিকে বললেন আমি ভেবেছিলাম আপনি জেলখানা থেকে দাড়ি নিয়ে ফিরবেন। জেলখানাই অনেকের দাড়ি-গজানোর পটভূমি।
খাওয়া-দাওয়া হাসিঠাট্টা সবই হচ্ছে, কাজির মন তবু বিক্ষিপ্ত। সে জানে, তাকে এখনই কুমিল্লায় যেতে হবে কিন্তু গিয়ে কী করবে সে বুঝতে পারে না। মাসিমা আর দুলিকে বাদ দিলে তার মা বিরজাসুন্দরী অথবা কান্দিরপাড়ের অন্য কেউ তার আর দুলির নতুন সম্পর্কটার খবরটা কি জানে? এবার কাজি যদি কুমিল্লায় যায়, এ খবর চাপা থাকবে না, থাকা উচিতও নয়। তাহলে? তাহলে কী করবে কাজি? সে ভেবে পায় না।
তাহলে কি কুমিল্লার বাইরে অন্য কোথাও – দুলি যদি না-ও হয় – মাসিমার সঙ্গে দেখা করা যায়?
কোথায়, সমস্তিপুরে?
কিন্তু, সে না হয় পৌঁছিয়েই গেল সমস্তিপুর, মাসিমা সেখানে আসবেন কীভাবে?
ভেবে ভেবে কূল পায় না কাজি, প্রতিটা মুহূর্ত কেটে যায়, কাজির মনে হয় কতদিন হয়ে গেল!
অবশেষে ভিক্টোরিয়া কলেজের এক ছাত্রর কথা মনে পড়ে। এর সঙ্গে কান্দিরপাড়ের বসন্ত মজুমদারের বাড়িতে এক গানের আসরে আলাপ হয়েছিল। ভিক্টোরিয়া কলেজে এসে কোন-একটা গানের রিহার্সালে কাজির দেরি হয়ে যাবার আশঙ্কা ছিল, তাকে দিয়ে একটা চিঠি পাঠিয়েছিল কাজি দুলিকে, তার ফিরতে দেরি হবে জানিয়ে। তাকে কি আবার কাজে লাগানো যায়?
অবশেষে দুলিকে একটা ছোট্ট চিঠি লিখে ফেলে কাজি, জেল থেকে ছাড়া পেয়েছি। তেওতা অথবা সমস্তিপুরে দেখা করা যায়? মাকে বোলো নীচের ঠিকানায় লিখতে। বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির ঠিকানা দেয় কাজি।
হোস্টেলবাসী ছেলেটাকেও লেখে কাজি: স্নেহাস্পদেষু, মুখবন্ধ খামটা কান্দিরপাড়ে আশালতাকে পৌঁছে দিতে হবে। আশালতারই হাতে। তোমার ওপর ভরসা করছি। কাজিদা।
তারপর প্রতীক্ষা। বিকেলে বারীন দাদার বাড়ি যায় কাজি, দেখা হয় নলিনীদা'র সঙ্গেও। একটু হাসি-মজা, গানও হয়।
প্রতীক্ষা আবারও। অবশেষে কুমিল্লা থেকে আসে উত্তর। মাসিমা লিখেছেন। তেওতা হয়ে সমস্তিপুর যাব। তিরিশ তারিখে তেওতায় এলে তোমার সঙ্গে দেখা হতে পারে। সমস্তিপুরে অতটা প্রাইভেসী নেই।
তিরিশ তারিখ? – একটু ভাবে কাজি। বহরমপুরে ব্রজবাবু বলে দিয়েছেন আট তারিখে তাকে পৌঁছতেই হবে সেখানে। তিরিশ তারিখে তেওতায় গিয়ে আট তারিখে আবার বহরমপুর? তার মানে, সমস্তিপুর যাওয়া চলবে না তার। এর আগে তেওতায় সে গিয়েছিল কিরণশঙ্করের সঙ্গে। শেয়ালদা থেকে ঢাকা মেইলে ঢাকায় পৌঁছবার পর জমিদার বাবুর জন্যে অপেক্ষমান একটা ভাড়ার গাড়িতে সেবার তেওতার জমিদার বাড়িতে পৌঁছেছিল কাজি। এবার অবিশ্যি অন্য ব্যবস্থা। কাজী ঢাকায় পৌঁছল যখন শীতের ভোরে তখনও আলো ফোটেনি ভালোভাবে। মানিকগঞ্জের যাত্রীর খোঁজে ঢাকা স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে ঘোরাঘুরি করছে গাড়ির চালকরা। এমনই একজন নজরুলকে নিয়ে এল তার গাড়ির সামনে। আরও কয়েকজন যাত্রী জোটবার পর ছাড়ল গাড়ি। তেওতা অবধি আসবে না এ গাড়ি, এরা কাজিকে নামিয়ে দিল আড়িচাঘাট নামের এক জায়গায়। কপালে থাকলে এখান থেকে জমিদার বাড়ি যাবার জন্যে গোরুর গাড়ি পাওয়া যায়। কপালের উপর ভরসা না করে হাঁটতে থাকে কাজি। শীতের সকালের রোদ্দুর গায়ে মেখে যখন তেওতায় পৌঁছোয় সে, তার জন্যে তখন অপেক্ষা করছে দুলি। দুলি আর তার মা, মাসিমা।
কাজিকে দেখে খুশি গিরিবালা, খুশির আনন্দ তাঁর চোখমুখ ছাপিয়ে উপচিয়ে পড়ছে; জিজ্ঞাসা করেন, পথে কষ্ট হয়নি তো বাবা? দুলি কিন্তু স্তব্ধবাক, তার আবাল্যপরিচিত কাজিদাদাকে সে চিনতেও পারছে কিনা কে জানে! একটু কি রোগা হয়ে গেছে কাজীদাদা? কই, হৈ হৈ করে দে গোরুর গা ধুইয়ে বলে মাঝে মাঝেই সে চিৎকার করে উঠছে না তো। জেলখানায় সে অনেকদিন না-খেয়ে জেলের নিয়মের প্রতিবাদ করেছিল, সে খবর তো কাগজে কাগজে বেরিয়েছে; সবার মতো দুলিও তো পড়েছে সে খবর। কিন্তু কাজিদাদার চোখেমুখে এক ধরণের খিদে, শরীর আগের তুলনায় ক্ষীণ, এ সব কি নজরে পড়ছে না কারো? মা শুধু জিজ্ঞাসা করল পথে কষ্ট হয়েছে কিনা। কিন্তু পথের কষ্ট নয়, কাজীদাদার চোখেমুখে কী যে একটা কষ্টের ছাপ দুলি স্পষ্ট দেখতে পায়!
দুলিকে শেষ দেখেছিল কাজি গত বছর, মানে উনিশশো বাইশের পুজোর সময়। তারপর এক বছরেরও বেশি হয়ে গেল দুলির সঙ্গে দেখা হয়নি তার। এই বয়েসের মেয়ের পক্ষে এক বছর যথেষ্ট দীর্ঘ সময়, জানে কাজি; কিন্তু সময়ের এই দৈর্ঘ্যটুকু তার মধ্যে এত পরিবর্তন এনে দেয়? ছিপছিপে দুলি ছিপছিপেই আছে, কিন্তু তার শরীরে এতো বদল! নীল রঙের যে শাড়িটা পড়েছে সে, সেটা লতার মতো পাকিয়ে উঠেছে দুলির শরীর বেয়ে; নীলাম্বরীটা হয়তো ভেবেছিল দুলির প্রভাবে সে আরও সুন্দর হয়ে উঠবে, কিন্তু শাড়ির ওই আবরণ দুলির ষোল বছরের শরীরটাকে ঢাকতে গিয়ে কেমন জানি স্ফূটনোন্মুখ তৈরি করেছে শরীরটাকে – ওঃ, চোখ ফেরাতে পারে না কাজি।
আগের দিন এখানে পৌঁছেছে দুলিরা। কাজির জন্যে এখানে এখন গরম জল তো তৈরি। যদিও একদিকে যমুনা নদী আর অন্যদিকে জমিদারবাবুদের পুকুর হাতছানি দেয় তাকে, গিরিবালার শাসনে সাঁতারের তৃপ্তির বদলে স্নানের ঘরের ঘেরাটোপের উষ্ণতার আরামই বেছে নিতে হল তাকে। আগের দিন রাত্তিরেই খেজুর গুড়ের পায়েস আর পাটিসাপ্টা তৈরি করা হয়েছিল, কাজির জন্যে আজ সকালের জলখাবার তা-ই।
গ্রামের মানুষরা রোজ বাজার করে না, তাদের বাড়িতেই যেটুকু শাকসবজি ফলে, পুকুরে যে মাছ পাওয়া যায়, এসব দিয়েই নিত্যদিনের খাওয়া জুটে যায় গ্রামের মানুষের, তা সে ধনীই হোক বা নির্ধন। নিয়মিত কেউ না-থাকার ফলে তেওতায় বসন্ত সেনগুপ্তর বাড়িতে কোন ফলন নেই। পাশের গাঁয়ে আজ হাটের দিন। জলখাবারের পর সেখানে যাবেন গিরিবালা, সঙ্গে যাবে দুলিও, দুলির সঙ্গে পেতলের একটা পাত্র, ছোট কলসি বা ঘটের মতো, খেজুর গুড় পাওয়া গেলে কিনবে বোধ হয়। নজরুল জিজ্ঞেস করে, আমিও যদি যাই, অসুবিধে আছে?
অসুবিধে আর কী, বলেন গিরিবালা, তুমি এতটা দূর থেকে এসেছ, রাতে ট্রেনে নিশ্চয়ই ভালো ঘুম হয়নি, শুধু শুধু কষ্ট করবে কেন?
এ প্রশ্নের উত্তর দু'ভাগে দিতে হবে; কাজি বলে, প্রথম, শুধু শুধু নয়, গাঁয়ের হাট দেখিনি অনেকদিন, আগে যা-ও দেখেছি সে আমাদের রাঢ় এলাকার, পুব বাংলার হাট তো দেখিইনি, শখ হল তাই। আর দু'নম্বর, এতে কষ্ট আমার একটুও হবে না, রাত্তিরে আমি ট্রেনে ভালোই ঘুমিয়েছি।
তবু রাজি হন না গিরিবালা, গ্রামের লোকদের কৌতূহল অনেক বেশি। মা-মেয়ে ঠিক আছে, সঙ্গে এক যুবক। কে সে? নাম কী? কোথায় থাকে? জিজ্ঞেস করবেই লোকে, আর, জিজ্ঞাসা না করে যদি, নিজেই মনে মনে একটা কারণ তৈরি করে নেবে, যেটা মনে না থেকে ছড়িয়ে যাবে চতুর্দিকে মুহূর্তের মধ্যে। তবুও নজরুলকে সে-কথা সোজাসুজি বলতে পারেন না তিনি। বলেন, থাক না, অন্য একদিন হবে। বীরেন-টিরেন আসুক, তখন হাট দেখো বাবা।
বীরেন-টিরেন বলায় বোধ হয় কানে একটু জল ঢোকে কাজির, আর জোরাজুরি করে না।
মা আর মেয়ে নদী ঘেঁসে হাঁটতে হাঁটতে যায়। যতক্ষণ দেখা যায় কাজি দেখতে থাকে, তার পর বাড়ির ভিতরে ঢুকে নিয়ে আসে তার ব্যাগখানা। ব্যাগ থেকে একটা খাতা আর পেনসিল নিয়ে জমিদার বাড়ির বকুল গাছটার নীচে বসে খাতাটা খোলে। ভাবতে হয় না কাজিকে, লিখতে থাকে:
নীলাম্বরী শাড়ি পরি নীল যমুনায়
কে যায়, কে যায়, কে যায়?
যেন জলে চলে থল-কমলিনী
ভ্রমর নূপুর হয়ে বোলে পায় পায়।।
কলসে কঙ্কণে রিনিঝিনি ঝনকে,
চমকায়, উন্মন চম্পা বনকে
দলিত অঞ্জন নয়নে ঝলকে
পলকে খঞ্জন হরিণী লুকায়।।
অঙ্গের ছন্দে পলাশ-মাধবী অশোক ফোটে,
নুপুর শুনি বন-তুলসির মঞ্জরী উলসিয়া ওঠে।।
মেঘ-বিজড়িত রাঙা গোধূলি
নামিয়ে এল বুঝি পথ ভুলি।
তাহারই অঙ্গ তরঙ্গ-বিভঙ্গে
কুলে কূলে নদীজল উথলায়।
গান লেখা শেষ হলে উঠে দাঁড়ায় কাজি। গতবার যখন এসেছিল এখানে গমগম করছিল জমিদারবাড়িটা। জমিদারবাবু সপরিবার থাকেন কলকাতায়, বাড়ি এখন নিঃঝুম। যে মঠকে ঘিরে দোলের সময় উৎসব হয়েছিল সেই মঠ এখন তালা দেওয়া। মঠ পেরিয়ে কাছারি বাড়ি। সেদিকটাও হেঁটে হেঁটে যায় কাজি, কোন মানুষ দেখতে পায় না। কিরণশঙ্কর জানেন এসব, আগের বারেই কাজিকে বলেছিলেন, তিনি যখন থাকেন না, নায়েব মশায়ের গ্রামের বাড়িই তখন কাছারি। বাড়িতে বসেই কাজ চালান তিনি, কাছারিবাড়ি পর্যন্ত আসবার পরিশ্রম করেন না। এসব মেনেই নিতে হয় শহরবাসী জমিদারদের। পুকুরটা কিন্তু পরিষ্কার, ওই যে গ্রামের মানুষদের অনুমতি দেওয়া আছে ছিপ দিয়ে মাছ ধরবার, মাঝে মাঝে তারাই হয়তো আসে, তাই কি?
কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে বকুলতলায় ফিরে আসে কাজি, তারপর সেখানেই চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে সে, আকাশ পর্যন্ত পৌঁছোয় না তার চোখ, বকুলের ডালে ডালে ভরা আকাশ ঢাকা থাকে ঢেউ-তোলা সবুজ পাতার শান্তিতে, আর এখন এই ডিসেম্বরের শীতেও এক-আধটা তারার মতো বকুল ঝরে পড়ে তার গায়ে মুখে মাথায়। বাঁশিটা হাত বাড়িয়ে ব্যাগ থেকে বের করে আনে কাজি, শুয়ে-শুয়েই সুর তোলে তাতে, কী সুর কে জানে! নীলাম্বরীর পায়ে পায়ে কি ত্রিতালের ছন্দ? চোখ বুজে আসে কাজির...
কাজির ঘুম ভাঙে দুলির স্পর্শে। ছোট ছোট নরম আঙুলের টোকা তার কপালে, কানের ভিতরে আলতো সুড়সুড়ি, দাড়ি কামাতে গিয়ে সকালে একটুখানি কেটে গিয়েছিল গালে যেখানটায়, সেখানে এসে একটা আঙুল যেন একবার একটু থামে, তারপর অতি মোলায়েম ঈষৎ কম্পন সেখানে, আঃ, এই স্বপ্ন যেন না ভাঙে...
স্বপ্ন নয় মশাই, তোমার ঘুম ভেঙে গেছে দিব্যি, দুলির নিম্নস্বরে ঘুম ভেঙে যায় কাজির।
মা বললো, তুই ফিরে যা দুলি, ছেলেটা একা-একা কী করছে কে জানে, আমার ফিরতে দেরি হবে না।
দুলিকে ছুঁতে ইচ্ছে করে কাজির। তার ডান হাতের পাতাটা দুলির সম্পূর্ণ মুখটাকে বেড় করে ঘুরে ঘুরে স্থির হয়ে যায়, দুলির ঠোঁটদুটো কাজির খোলা হাতের চেটোর ঠিক মাঝখানটাতে তখন। বাঁ-হাতে সামান্য আকর্ষণ করে কাজি, সামান্যই; জোর করে টানবার প্রয়োজন হয় না, দুলি যেন কাজির স্থির দ্রবণে সম্পূর্ণ দ্রবীভূত।
মিনিট পনের পর স্থির দ্রবণটিতে কাঁপন লাগে। কাঁপন, তারপর সব কিছু স্থির। শব্দহীন স্থিরতা। কাজি বলে, ভুল হয়ে গেল দুলি, ভুল। মা ফেরেনি তো? এখন ভেতরে যাও, তুমি বেরোলে আমি যাব।
রাতের খাওয়ার পর দুলি ঘুমিয়ে পড়ে আগে। কাজি বলে, মাসিমা, আমি কাল সকালেই যাব। আট তারিখের মধ্যে আমাকে বহরমপুর যেতে হবে। কোর্টে কেস আছে। সমস্তিপুরে আমাকে ছাড়া যেতে পারবেন না আপনারা?
পারব।
কী আপনি বুঝেছেন আমি জানিনা মাসিমা। খুব ভুল হয়ে গেছে, আমরা নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছি। কিন্তু আপনাদের অসম্মান আমি হতে দেব না, এ-কথা প্রতিজ্ঞা করে বলছি। দুলিকে আপনি কিছু বলবেন না। আমি তিন-চার মাসের বেশি সময় নেব না। ঠিক সময়ে, সব ব্যবস্থা করে আপনাকে জানাব।