এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক  উপন্যাস  শনিবারবেলা

  • সীমানা - ১০

    শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
    ধারাবাহিক | উপন্যাস | ২৩ জুলাই ২০২২ | ৩৫০১ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • ছবি: সুনন্দ পাত্র


    ১০

    যাত্রা হল শুরু



    হাওড়া স্টেশনে গাড়ি পৌঁছোবার আগেই শহীদুল্লাহ্‌ সাহেব খোঁজ নেন নজরুল স্টেশন থেকে কোন দিকে যাবে। নজরুলের পক্ষে বত্রিশ নম্বর কলেজ স্ট্রীটেই প্রথম যাওয়া স্বাভাবিক, কিন্তু সে বলল, ভালো লাগছে না, আমি সোজা টার্ণার স্ট্রীটেই যাব। কালীমোহন যাবেন জোড়াসাঁকো, আর শহীদুল্লাহ্‌ সাহেব বসিরহাটে, শ্যামবাজার স্টেশন থেকে মার্টিন কম্পানীর রেলগাড়ি ধরবেন তিনি। শহীদুল্লাহ্‌-কালীমোহন, অতএব, একই দিকে।

    বাড়ি ফাঁকা। নজরুলের ভাবাই ছিল এমনটা, দিনের বেলা বাড়িতে বসে থাকার লোক মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ নয়। নজরুল নিজের জন্যে চা তৈরি করল। চা খেয়ে চান করে তার ঘুম-ঘুম পায় একটু। জানে, বিছানায় গা এলিয়ে দিলেই ঘুমিয়ে পড়বে সে। তার চেয়ে বাইরে বেরিয়ে কিছু খাওয়া-দাওয়া করা যাক। পাঞ্জাবিটা গলিয়ে মাহ্‌মুদের হোটেলে পৌঁছিয়ে যায় সে।

    খেতে খেতেই ভাবনাটা এল নজরুলের মাথায়, আচ্ছা, হঠাৎ অফিস খুলে নবযুগ আবার চালু করে দেননি তো হক সাহেব? যেমনটা করেন উনি, বিশু হয়তো গতকালই এসে ডেকে নিয়ে গেছে মুজফ্‌ফরকে! সেক্ষেত্রে বেচারা
    একা-একাই সামলাচ্ছে সবকিছু। নাঃ, সেটা ঠিক হবে না। কোনরকমে খেয়ে নিয়ে নজরুল পৌঁছোলো অফিসে।

    অফিসে ঢুকে অবিশ্যি মনে হল না কোন কাজকর্ম হচ্ছে। উদাস মুখে বিশু বসে আছে তার টুলে, একটা চেয়ারে বসে আছেন অপরিচিত এক ভদ্রলোক, পরনে পায়জামা আর শেরওয়ানি। নজরুলকে দেখে ভদ্রলোক একটু নড়েচড়ে বসেন, কথাবার্তা বলেন না। নজরুল প্রশ্ন করে তাঁকে, আপনি?

    আমার নাম আবুল কাসিম, জবাব আসে, আমাকে আবদুর রহীম বখ্‌শ্‌ ইলাহী সাহেব পাঠিয়েছেন। আপনিই কি মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ?

    না, আমার নাম কাজি নজরুল ইসলাম। মুজফ্‌ফর আহ্‌মদের সঙ্গে কোন বিশেষ কাজ থাকলে আমাকে বলতে পারেন, আমার সঙ্গে তাঁর দেখা হবে।

    না না, বিশেষ কিছু নয়। ঠিক আছে, আমি আসি তবে আজ, বলতে বলতেই উঠে দাঁড়ান ভদ্রলোক, নজরুলের কোন প্রতিক্রিয়ার জন্যে অপেক্ষা করেন না, বিশুর দিকেও তাকান একবার, তারপর হনহন করে বেরিয়ে যান।

    বিশু বলল, আজ সকালে স্যর আমাকে বললেন অফিস খুলতে। আপনাদের খবর দেবার কোন কথা বললেন না। আমি ভাবলুম, আপনারা জানেন নিশ্চয়ই। আমি তো সকাল থেকেই অফিস খুলে বসে আছি। এই আবুল কাসিম সাহেব এসেছেন বেলা বারটায়। এসেই আমাকে বললেন, তোমার সাহেবের সঙ্গে কথা হয়েছিল আজ আমি আসব। কই, তোমাদের বাবুরা তো কই এল না কেউ। বলে, বসেই রইলেন। দুবার চা খেলেন। তারপর তো এলেন আপনি।

    ঠিক আছে, নজরুল বলে, তোমাকে যখন অফিস খুলতে বলে দিয়েছেন হক সাহেব, তুমি নিশ্চয়ই খুলবে অফিস। রোজই খুলবে। আমরা কবে থেকে আসব জানতেই পারবে।

    অফিস থেকে বেরিয়ে এল নজরুল। ভাবল, একবার বত্রিশ নম্বর কলেজ স্ট্রীটে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির অফিসে যাবে। কিন্তু, এখন কি কাউকে পাওয়া যাবে ওখানে? মত বদলিয়ে, টার্ণার স্ট্রীটে নিজেদের বাসস্থানের উদ্দেশেই রওনা হয় সে।

    এবার ফিরে বাড়িতেই পাওয়া গেল মুজফ্‌ফরকে। তক্তপোশে শুয়ে। নিজেরটা এবং নজরুলেরটা – দুটো বালিশ পরপর চাপিয়ে চিৎ হয়ে শুলে মাথাটা বেশ খানিকটা উঁচু হয়ে যায়। সেই ভাবে শুয়ে আরাম করে মুজফ্‌ফর পড়ছিল একটা ইংরিজি বই, লেফট্‌উইং কম্যুনিজ্‌ম্‌: অ্যান ইনফ্যান্টাইল ডিজঅর্ডার। লেখক, ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন। নজরুলকে দেখে উঠে বসে সে, বালিশের পাশে আরও দুখানা বই। কার্ল মার্কসের লেখা তিন খণ্ড ক্যাপিটালের এক খণ্ডে সংক্ষেপিত একটি সংস্করণ, দ্য পীপ্‌ল্‌স্‌ মার্কস, লেখক, জুলিয়ান বোরখার্ট, আর লেনিনের হাউ উইল বলশেভিকস রিটেইন পাওয়ার। হেসে বলে, এই তিনখানা বই কিনলাম আজ। দশ টাকায়।

    দ-অ-শ টাকা? – ঠিক শুনেছে কিনা নজরুল বোধ হয় যাচাই করতে চায়। ধার করেছ তো?

    পাঁচ টাকা ধার। কার কাছে জান? চক্রবর্তী চ্যাটার্জি অ্যাণ্ড কম্পানী, পাবলিশার্স অ্যাণ্ড বূক সেলার্স।

    দিল?

    দিল তো। বেশ খাতির করেই দিল। প্রথমে গিয়েছিলাম গতকাল। মাখনবাবু খবর দিয়েছিলেন কিছু বিদেশী লেফট্‌উইং বই ওখানে এসেছে। এসব বই তো সোজাসুজি বিলেত থেকে আমদানি করা যায় না, অনেক দাম হয়ে যাবে তাহলে। তা ছাড়াও, কোথায় বিক্রি হল, কে কিনলো, এ সব অনেক খোঁচাখুঁচি করবে পুলিশ। ওদের বোধ হয় চোরা পথে বই আনবার কোন যোগাযোগ আছে, মাখনবাবু খবর রাখেন। বেশ মজা হল। আমি গিয়ে সোজাসুজি জিজ্ঞেস করলুম, বিলিতি বামপন্থী বই কিছু এসেছে নাকি? কিছুতেই সোজা উত্তর দেবে না। আপনি কোথা থেকে আসছেন, কী নাম আপনার – এই সব হাজারো প্রশ্ন। মাখনবাবুর নাম না বলে আমি বললাম, আমি মোহম্মদ মুজাম্মেল হক সাহেবের বন্ধু, উনিই আমায় পাঠিয়েছেন।

    কোন মুজাম্মেল হক? আমাদের বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির? – নজরুল জিজ্ঞেস করে।

    উনিই। আসলে, লিমিটেড কম্পানী তো, চক্রবর্তী চ্যাটার্জির কিছু শেয়ার হক সাহেবের আছে। পুরোনো অ্যালবার্ট হল যখন ভাঙা হল তখন তো ওদের উঠে যেতে হবে। ওই অঞ্চলের পি-ডবল্যু-ডি ইঞ্জিনীয়র তফজ্জুল আহ্‌মদ আমাদের মুজাম্মেল হকের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। উনি তফজ্জুলকে ধরে পড়লেন। এখন যেখানে চক্রবর্তী চ্যাটার্জি দেখছ, সেখানে ছিল সংস্কৃত কলেজের একটা আউট হাউজ। ওই আউট হাউজে দুটো ওপ্‌নিং তৈরি করে দিলেন তফজ্জুল, কলেজ স্কোয়ারের দিকে একটা, কলেজ স্ট্রীটে একটা। বইপাড়ার একেবারে বেস্ট লোকেশন হয়ে গেল ওদের। মুজাম্মেলের নাম বলতেই আমাকে কী খাতির! চা খাওয়াল, খাইয়ে শ্যামাচরণ দে স্ট্রীটে ওদের গুদামে নিয়ে গেল সোজা। অনেক বই দেখলাম। সব তো আর কিনতে পারব না, এই তিনখানা শর্টলিস্ট করে বলে এলাম পরের দিন এসে নিয়ে যাব। যা টাকাপয়সা ছিল আমার কাছে সব নিয়ে আবার গেলাম আজ। দাম-টাম তো বোঝা যায় না এসব বইয়ের, সবকটাতেই পাউণ্ড-শিলিং-পেন্সের হিসেব। ওরা হিসেব-টিসেব করে ডিসকাউন্ট-ফিসকাউন্ট দিয়ে বলল, তিনখানাই নিয়ে যান, দশ টাকা দেবেন।

    দশ টাকা কোথায় পাব বল, আমি বললাম, পাঁচ টাকায় যে বইটা হয় দিয়ে দিন।

    বলল, তিনটেই হয়। প্যাক করে দিল, বলল, আপনি পাঁচ টাকাই দিন এখন। পরে যখন সুবিধে হবে, আরও পাঁচ টাকা দিয়ে যাবেন। কোন তাড়া নেই, আপনার বন্ধু মুজাম্মেল হক সাহেব আমাদেরও বন্ধু।

    নজরুল বলে, একখানা বই তো তুমি ধরেই ফেলেছ, আমি তাহলে এই পিপ্‌ল্‌স্‌ মার্কসটাই নিই। রাজনীতি করাই যখন উদ্দেশ্য, পড়াশোনা তো খানিকটা করতেই হবে। যাই হোক, এই দুদিন তাহলে হক সাহেব – মানে, আমাদের আবুল কালাম ফজলুল হক সাহেব – তোমার সঙ্গে কোন যোগাযোগ করেননি?

    না, করেননি। আমিও করিনি। কিন্তু কেন?

    নজরুল তার অফিস ভ্রমণ এবং আবুল কাসেম ও বিশুর সঙ্গে কথোপকথনের পূর্ণ বিবরণ দেয়। এমতাবস্থায় কিং কর্তব্যং? – জিজ্ঞাসা করে সে।

    কর্তব্যং আর কী, বলে মুজফ্‌ফর, আমার মতে আরও দুদিন শুয়ে বসে এই বইগুলোই পড়া যাক। আর, এর মধ্যে হক সাহেব কী করেন চুপচাপ দেখা যাক।

    মুজফ্‌ফরের ভাবনাই দেখা গেল ঠিক। দুদিন পেরিয়ে সকালবেলায় এক দিন ঘুম ভাঙাল বিশু। অফিস তো খুলেই গেছে, সাহেব ডেকেছেন। যে ব্যবস্থা ওদের নিজেদের মধ্যে করাই ছিল সেই অনুযায়ী নজরুল অফিসে যায় সকালে, মুজফ্‌ফর তিনটে-সাড়ে তিনটের সময় গিয়ে পরের দিনের কাগজের পুরো লে-আউট তৈরি করে, কম্পোজিটর নুটবিহারী বাবু পরের দিন ভোরবেলায় এসে ছাপাবার ব্যবস্থা করেন। আজ অবিশ্যি দুজনেই গেল একসঙ্গে। শেষ যেদিন ছাপাতে শুরু হওয়া কাগজ হোম ডিপার্টমেন্টের সৌজন্যে ছাপাতে ছাপাতেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, সেই দিন থেকেই কিছু-ছাপা-কিছু-না-ছাপা কাগজ সেভাবেই পড়ে আছে। ছাপাখানা আর অফিস পরিষ্কার করতে করতেই বেলা তিনটে। ছুটির মধ্যে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের পাঠানো বুলেটিনের পর বুলেটিন ফাইল-না-করা অবস্থায় পড়ে আছে; টেবিলে একরাশ, মেঝেতেও কিছু। সেগুলো থেকে আজকের পক্ষে আকর্ষণীয় তেমন কিছু খবরের কথা ভাবা গেল না। নজরুল বলল, ছেড়ে দাও আজ। কাল থেকে দেখা যাবে। এতদিন ছুটির পর যেমন-তেমন একটা কাগজ কাল বাজারে ছাড়া ঠিক হবে না। কাল সকালে এসে নতুন করে ভাবব।

    অফিস থেকে ওরা সোজা যায় বত্তিরিশ নম্বরে, একটু আড্ডা ছাড়া মন ভালো হবার নয়। পবিত্র ছিল সেখানে, আফজালুল আর আলি আকবর খানও ছিল। গান-বাজনা আড্ডা-হৈ-হৈ খানিকটা মন ভালো করে দিল ওদের। কথায় কথায় দৈনিক নবযুগের কথাও উঠল। নজরুল যে নবযুগের ব্যাপারে খানিকটা বিরক্ত, সেটাও আর গোপন থাকল না কিছুক্ষণ পরেই। নজরুল যখন মুজফ্‌ফরের সঙ্গে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির একটা ঘরে থাকত পাশাপাশি, আলি আকবরও থাকত সেই সময়, অন্য একটা ঘরে। আলি আকবর বোধ হয় শিশু-সাহিত্যের ব্যবসায়ী ছিল, অনেক সময় নিজে-নিজেই ছোটদের জন্যে কবিতা-টবিতা লিখে নিজেই ছাপাত সেগুলো। ওর লেখা কবিতা দেখে মুজফ্‌ফরও একদিন মজা করে বলেছিল, আমাকে কবিতা প্রতি পাঁচ টাকা করে দেবেন, এমনকি আমিও আপনার চেয়ে ভালো কবিতা লিখতে পারব। সেরকমই এক দিন আড্ডা চলতে চলতেই নজরুল আকবরকে লিখে দিল লিচু চোর নামে ছোটদের একটা কবিতা: বাবুদের তালপুকুরে/ হাবুদের ডালকুকুরে/ সে কী বাস করলে তাড়া/বলি থাম, একটু দাঁড়া...! কবিতা পড়ে তো আলি আকবর বিস্মিত! মাত্র মিনিট পাঁচেক সময়ের মধ্যে আড্ডা মারতে মারতে লেখা যায় এমন কবিতা!

    আজকের আড্ডায় আলি আকবর বলল, আমি তো কবে থেকেই বলছি খবরের কাগজে চাকরি করে আপনি আপনার প্রতিভার অপচয় করছেন। ছেড়ে দিন ওসব চাকরি, আপনার উচিত সর্বক্ষণের সাহিত্যসেবী হওয়া। নজরুল পেট চাপড়িয়ে বলল, কিন্তু মধ্যপ্রদেশ কি রাজি হবে? আফজালুল বলল, ঠিক আছে, আমি আপনাকে একটা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি। আপনি যদি সাহিত্যের হোলটাইমার হন, আর আপনার যাবতীয় রচনা আমাকে দেন মোসলেম ভারত-এর জন্যে, আমি তাহলে আপনাকে প্রতি মাসে একশো টাকা দেবার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি। প্রমিস! আপনার প্রতিভার তুলনায় এ-টাকাটা কিছুই নয় আমি জানি, কিন্তু আপনার মধ্যপ্রদেশ মনে হয় শান্ত থাকবে এতে।

    পরের দিন সকালেই আবার অফিসে হাজির নজরুল আর মুজফ্‌ফর। যে ছেলেটি ফাইল-টাইল গুছিয়ে রাখে, খবর পেয়ে সে-ও এসে গেছে। মুজফ্‌ফরও লেগে গেল তার সঙ্গে ফাইল গোছাতে। গতকাল ওরা অফিস ছাড়বার পর এ পর্যন্ত তিনখানা বুলেটিন এসেছে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস থেকে। নজরুল সেগুলো থেকে হেডলাইন বানিয়ে একটা খবর লিখতে শুরু করেছে, এমন সময় – যা কখনও হয় না – সশরীর হাজির ফজলুল হক সাহেব। ওরে, চা কর রে, বিশুকে হুকুম দিতে দিতে একটা চেয়ার টেনে বসেন তিনি। হাতের কলম টেবিলে রেখে মুজফ্‌ফর আর নজরুল উৎসুক চোখে তাকায়। বসেই, হক সাহেব জিজ্ঞেস করেন, বাহা থিক্যা খায়েদায়ে আসছ, না গিয়্যা খাবে?

    ফিরে গিয়েই খাব, হেসে বলে মুজফ্‌ফর, এত সকালে কি আর খেয়ে আসা যায়?

    তাইলে এহেনেই দুগা চালেডালে..., হক সাহেব বলেন।

    দাওয়াত দিচ্ছেন? – মুজফ্‌ফর জিজ্ঞেস করে।

    হেই রহমই, বলতে বলতে হেসে ফেলেন হক সাহেব। তারপর বলেন, এ বারে বরিশালে গিয়ে খুব কলকাতার নিন্দেমন্দ শুনলাম। সবাই বলে, সেই যে কলেজে পড়ার নাম করে কলকাতায় গিয়ে বসলে, আর ফেরার নাম নেই। বলে, আমি নাকি একেবারেই কলকাত্তাইয়া লোক হয়ে গেছি। জিগাই, কলকাত্তাইয়া? হে কেমন? না, কলকাতায় কারো বাসায় কেউ গেলে নাকি জিজ্ঞেস করে, বাড়ি থেকে খেয়ে এসেছেন, না গিয়ে খাবেন? তো ভাবলাম, সত্যিই তো, এতদিন মুজফ্‌ফর-নজরুল আসছে, কোনদিন তো খাওয়ার কথা বলিনি তাদের। আজ তাই, ওই যে কী বলে, তোমাদের নেমন্তন্ন!

    পোলাও-মাংস-ফিরনীর এলাহি ভোজ সেরে আইঢাই অবস্থায় হাই তুলতে তুলতে পরের দিনের কাগজের লে-আউট পর্যন্ত সব কাজ শেষ করে অফিস থেকে বেরোতে যাবে, তখন প্রায় সন্ধ্যে। তখন খেয়াল হল, নুটবিহারীবাবুকে তো খবর দেওয়া হয়নি। যতক্ষণ না নুটবিহারীবাবু নিজে সব বুঝেসুজে নিচ্ছেন, ততক্ষণ তো নিশ্চিন্ত হওয়া যাবে না। অতএব বিশুকে পাঠাতে হল তাঁর বাড়ি, যেন আজ রাত্তিরে তিনি আসেন একবার। অতএব, হাঁটতে হাঁটতে বত্তিরিশ নম্বরের আড্ডায় পৌঁছলো ওরা। ওখানকার সান্ধ্য আড্ডায় বেশ কিছুক্ষণ কাটিয়ে আবার অফিসে ফিরে নুটবিহারীবাবুকে পরের দিনের কাগজের লে-আউট বুঝিয়ে সে দিনের মতো ছুটি।

    নবযুগ আবার বেরোয় আগের মতোই, দুবের মতে কাগজের চাহিদা কমেনি একটুও। একটু অভিযোগও আছে তার পিংলার এই রকম হঠাৎ কাজকর্ম ছেড়ে দেবার ব্যাপারে। নজরুলের লেখার ঝাঁঝ কমেনি যদিও, প্রায় রোজই সে মুজফ্‌ফরকে জানায় নবযুগ সে ছেড়ে দেবে। খবরের কাগজে সম্পাদকীয় লেখা তার কাজ নয়, সে দেশের কাজে পুরোপুরি নামতে চায়। সে তো নামতে চাই আমিও, বলে মুজফ্‌ফর, কিন্তু আরও একটু ভেবেচিন্তে এগোনোই কি ভালো নয়?

    সেই যে আবুল কাসেম নামের লোকটির সঙ্গে নজরুলের দেখা হয়েছিল একদিন মুজফ্‌ফরের অনুপস্থিতিতে, সেই লোকটি আবার হাজির একদিন। বেলা তখন তিনটে-সাড়ে তিনটে হবে, মুজফ্‌ফর এসে গেছে অফিসে, নজরুলের দৈনিক কাজ মোটামুটি শেষ, এবার সে বেরোবে, এমন সময় আবুল কাসেম হাজির। এসেই খালি একটা চেয়ারে বসে সে, বিশু তাকে দেখেই চায়ের জল বসিয়ে দেয়, হাসি হাসি মুখে সে তাকায় কর্মরত মুজফ্‌ফরের দিকে, এবং বিশুকে বলে সে চা খাবে। আমাকে কিছু বলবেন? – জিজ্ঞাসা করে মুজফ্‌ফর।

    নাঃ, তেমন কিছু নয়, বলে আবুল কাসেম, আমাকে পাঠিয়েছেন আবদুর রহীম বখ্‌শ্‌ ইলাহী সাহেব।

    মুজফ্‌ফর জিজ্ঞেস করে, আমার কাছে পাঠিয়েছেন?

    নাঃ, ঠিক সেরকম নয়, ঠিক আপনার কাছেই নয়।

    তা হলে?

    ওই আর কি, বলে বিশুর দেওয়া চা-য়ে প্রথম চুমুক দেন আবুল কাসেম।

    কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে মুজফ্‌ফর। বোঝে না লোকটার মতলব কী। তারপর এই মানুষটাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে নিমগ্ন হয় নিজের কাজে। কিছুক্ষণ বসে উঠে পড়ে আবুল কাসেম।

    সেদিন রাত্রে নজরুল আবার বলে, আমার আর ভালো লাগছে না আহ্‌মদ ভাই। আমি ছেড়ে দেব নবযুগের কাজ।

    ছেড়ে দিয়ে কী করবে সেটা ভেবেছ?

    কী করব সে তো তোমাকে আগেই বলেছি। আমি আসানসোল যাব। কথা বলব আমার মাষ্টারমশাই নিবারণচন্দ্র ঘটকের সঙ্গে। এতদিনে তিনি নিশ্চয়ই জেল থেকে বেরিয়ে এসেছেন। স্যরকে জিজ্ঞেস করব তিনি কী চান, কী আমার করা উচিত। স্যর যা বলেন তাই করব আমি।

    দেখ কাজি, বলে মুজফ্‌ফর, নবযুগে কাজ করতে আমারও যে খুব ভালো লাগছে তা নয়। কিন্তু এ কথা মনে রাখতে হবে যে নবযুগে আমরা এখনও আমাদের মনের কথা মোটামুটি লিখতে পারছি। যে সব বিষয়ে যতটা প্রতিবাদ জানাতে চাই তারও অনেকটাই পারছি, হক সাহেব কোন ব্যাপারে নাক গলান না। যতটুকু কাজ করতে পারছি এখানে, অন্তত ততটুকুও চালিয়ে যেতে পারব এ ভরসা না পেয়ে কাজ ছেড়ে দেওয়াটা কি খুব বুদ্ধিমানের কাজ হবে?

    এই একটি লোকের সঙ্গে তর্কে কোনদিন পেরে ওঠে না নজরুল। লোকটা একেবারেই পাথরের মতো কঠিন আর হিমের মতো ঠাণ্ডা। নজরুল জানে, মুজফ্‌ফর আহ্‌মদের চেয়ে বেশি শুভার্থী তার আর কেউ নেই। আর সেইজন্যেই তার বাঁধন থেকে বেরিয়ে আসতে চায় সে মাঝে মাঝেই। মুজফ্‌ফরকে মেরেই সে একদিন মরবে বোধ হয়। মুজফ্‌ফরের হাত থেকে তার মুক্তি চাই। হ্যাঁ, মুক্তিই চাই। কী করবে নজরুল? সে আর ভাবতে পারে না।

    পরের দিন সকালেই মুজফ্‌ফরকে বলে নজরুল, আমি আজ অফিসে যাচ্ছি না। দুখানা এডিটোরিয়াল লিখে আমার ড্রয়ারে রেখে এসেছি। ওগুলোকে দিয়ে আপাতত কাজ চালিয়ে নাও।

    মুজফ্‌ফর কোন কথা বলে না। কথা বলার প্রশস্ত সময় এখন নয়, সে জানে। তার সঙ্গ এখন নজরুলের পক্ষে ভালো হবে না। নজরুলকে এখন একা থাকতে দিতে হবে। নজরুলকে এখন হাঁটতে দিতে হবে। দৌড়োতে দিতে হবে। উদ্দাম পদচারণা এখন নজরুলের চিকিৎসা।

    নিঃশব্দে বেরিয়ে যায় মুজফ্‌ফর। তাকে অফিস যেতে হবে।

    মুজফ্‌ফর বেরিয়ে গেলে শুয়ে পড়ে নজরুল। হঠাৎ কী হয় তার? আঁখিপল্লবের আগল কি যায় খসে? এত জল ছিল চোখে তার! বালিশ ভিজে যায়, মাঝে মাঝে গলা থেকে অবাধ অস্ফুট শব্দও বেরোয়। নজরুল জানে না কী তার দুঃখ। নজরুল জানে না কী তার নিরাময়। এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে সে।

    ঘুম থেকে উঠে পাঞ্জাবিটা গলিয়ে সোজা মোহনলাল স্ট্রীট। তার নিজস্ব ভঙ্গীতে দরজা প্রায় ভেঙে ফেলার মতো করে শব্দ করতে থাকে নজরুল। দরজা খোলেন ত্রস্ত বারীন ঘোষ।

    কী ব্যাপার, আপনি? – নজরুল চেঁচিয়ে ওঠে, নলিনীদা কোথায়?

    সে তো গেল বৌবাজারে। তার বিজলীর সম্পাদকীয় দপ্তর তো এখন বৌবাজার। তিরানব্বইয়ের এক-এর এ বৌবাজার স্ট্রীট। আমি একটু দিবানিদ্রার আয়োজন করছিলুম, এমন অসময়ে তুমি কোত্থেকে?

    সেই যে কবে আন্দামানে গিয়ে কয়েকটা বছর কাটিয়ে এলেন, তারপর থেকে তো কোন সময়ই আর আপনার সময় নয়, সবই অসময়!

    তা তুমি ঠিক বলেছ ভায়া, আধমরা হয়েই বেঁচে আছি কোনরকমে, মরতেও সময় পাই না, আর বাঁচব কীভাবে তা-ও ভেবে পাইনা।

    গুরুদেব আপনাদের মতো আধমরাদের ঘা মেরে বাঁচাতে বলেছেন, সেই ঘা দিতেই এলুম।

    তোমার গুরুদেব আবার কে, রবি ঠাকুর নাকি? সে তো কত কথাই বলে থাকে, বলেই আধ-পাক ঘুরে নিজের পিঠটা নজরুলের সামনে ধরেন বারীন, দাও তাহলে ঘা, দেখি এক ঘা-য়ে সাবাড় করতে পার কিনা।

    আপনাকে সাবাড় করে লাভ কী? আমি যাচ্ছি আমার স্যরের কাছে, নজরুল বলে, খবরের কাগজের বিপ্লব অনেক হয়েছে, এবার সত্যিকারের বিপ্লব করতে চললুম। আপনার কোন বার্তা আছে স্যরের জন্যে?

    স্যর? তোমার আবার স্যর কে? ও, তুমি নিবারণের কথা বলছ? তো, দেখা হলে বোলো তাকে, তোমাকে যেন নিরস্ত করে। লেগে থাকলে ওই দুয়েকটা গান আর পদ্যেই বড় জোর একটু-আধটু বিপ্লব করতে পারতে তুমি, তোমার হাতে যেন বব্দুক-টন্দুক না দিয়ে দেয় আবার।

    আপনি তাহলে আপনার দেওঘরের কারখানার ঠিকানাটা দেবেন না আমায়?

    কারখানা? ও, বোমার কারখানা? তোমাকে তো বললুমই, ওখানে এখন ময়দান হয়ে গেছে। তবু যদি যেতে চাও, আমার দাদু রাজনারায়ণ বোসের বাড়ি আছে দেওঘরে। সে বুড়ো আর নেই, মরেছে, তবে আমার ছোট মামা আছে এখনো। তার নাম মণি। খোঁজ কোরো।

    আর একটাও কথা না বলে শৈলজার মেসের দিকে হাঁটতে থাকে নজরুল। শৈলজাকে তার দরকার।

    কালই যাবি? – সব শুনে শৈলজার অস্বস্তি স্পষ্টই।

    হ্যাঁ, কালই। কাল সকালে, বলে নজরুল।

    কিন্তু, শৈলজা বলে, আমার তো ঠিক এরকম কোন প্ল্যান নেই। বিপ্লবীদের সম্বন্ধে আমার শ্রদ্ধাভক্তি আছে ঠিকই, কিন্তু সবটাই দূর থেকে। সেই তখন যদি তুই-আমি একসঙ্গে যুদ্ধে চলে যেতে পারতুম, তা হলে কী হত জানিনা। এখন কিন্তু আমি লেখা-টেখা নিয়েই থাকতে চাই।

    সে তুই থাক না। তোকে কি আমি আমার সঙ্গে নিবারণবাবু স্যরের কাছে যেতে বলেছি? তুই শুধু জানবি আমি কোথায় গেলুম। আমি যে কোথাও হারিয়ে গেলুম এমন যেন মনে না হয় কারো।

    মনে না হয় কারো! এরম ব্যাপার? হঠাৎ মুজফ্‌ফর আহ্‌মদের মুখটা ভেসে ওঠে শৈলজার সামনে। মুখে বলে, ঠিক আছে, বুঝলুম। তাই। তবে, আসানসোল নয়, আমরা যাব অণ্ডাল। অনেক দিন অণ্ডালে যাওয়া হয়নি। বিকেলের গাড়ি ধরলে অণ্ডালে পৌঁছিয়ে রাতটা ওখানে আমার সঙ্গে কাটিয়ে পরের দিন তুই চলে যাবি আসানসোল। আর, স্যরের সঙ্গে দেখা করেই যদি বেরিয়ে না যাস তাহলে বিকেলে আবার অণ্ডালেই ফিরবি। তারপর কী হবে, সেটা পরে বোঝা যাবে, আগে যাই তো।

    ঠিক আছে, তাহলে তা-ই কথা রইল। কাল তোর এই মেসেই আসছি আমি। একেবারে তৈরি হয়ে। এখান থেকেই বেরিয়ে যাব।

    শৈলজার ঘর দোতলায়। সেখান থেকে নেমে কাজিকে একটু এগিয়ে দেবে সে। নীচে নামতে নামতে বলে শৈলজা, তাহলে রাড়ের ছেলে শেষমেশ তুই রাড়েই ফিরছিস, আর আমি একা-একা পড়ে থাকলুম এখানে। ঠিক আছে, যার যা বিধিলিপি, গলাটা বোধ হয় একটু ভারিই হয়ে আসে শৈলজার। এখন চল্‌, হাঁটতে হাঁটতে একটু হাতিবাগান অবধি যাওয়া যাক। তোকে ফেয়ারওয়েল দেব।

    ফেয়ারওয়েল? তো, তা দিতে হাতিবাগান কেন?

    খালি হাতে ফেয়ারওয়েল হয়? – বলে শৈলজা। মিত্র কাফেতে বসব দুজন। আজ তোকে ফিশ ফ্রাই খাওয়াব। দু প্লেট একসঙ্গে।

    নজরুল হাসে। তারপর মাথাটা নীচু করে ধীর পায়ে হাঁটতে থাকে শৈলজার পাশাপাশি। একটু পর মুখটা তুলে বলে, আজ না হয় না-ই হল ফেয়ারওয়েলটা। ওটা কালকের জন্যে তোলা থাক। আমি একা-একা ফিশ ফ্রাই খেতে পারব না রে শৈলজা। মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ সঙ্গে না থাকলে আমার কিছু ভালোমন্দ খেতে ইচ্ছে করে না রে। বত্তিরিশ নম্বরে যেদিন প্রথম থাকতে এসেছিলুম – তোর মনে আছে তোর মেস থেকেই গিয়েছিলুম ওখানে? – তারপর থেকে যখন যা খেয়েছি দুজনে ভাগ করেই খেয়েছি। আজ মিত্র কাফের ফিশ ফ্রাইটা একা একা খেতে গেলে আমার গলা দিয়ে নামবে না রে।

    শৈলজা হেসে বলে, তোর গলা ভেঙে গেছে কাজি। যতই বিপ্লব-বিপ্লব করে হল্লা করিস, মুজফ্‌ফরকে ছেড়ে তুই থাকতে পারবি কিনা আমি জানিনা। তাহলে এক কাজ কর। কাল সকালে তোরা দুজনেই আয় এখানে। আমরা তিনজনে এক সঙ্গে খাওয়াদাওয়া করব। তারপর মুজফ্‌ফর ফিরে যাবে নবযুগে, তুই-আমি দুই ভাই চলে যাব হাওড়া স্টেশনে।

    টার্ণার স্ট্রীটে ফিরেই কাগজ-কলম নিয়ে বসে নজরুল। একটা এডিটোরিয়াল সে লিখবে। তার লেখা নবযুগের শেষ এডিটোরিয়াল।

    মুজফ্‌ফর ফেরে যখন, নজরুলের এডিটোরিয়াল লেখা তখনও শেষ হয়নি। কী লিখছ, কবিতা? – জিজ্ঞেস করে মুজফফ্‌ফর।

    কবিতাই বটে, বলে নজরুল। তোমার নবযুগের জন্যে শেষ এডিটোরিয়াল লিখছি। কাল চলে যাব। যাবার আগে এডিটোরিয়ালটা দিয়ে যাব তোমায়।

    যাবেই যখন, একবার হক সাহেবকে বলে যেতেই পারতে।

    আবুল কাসেমকে খবরদারির জন্যে পাঠাবার আগে হক সাহেব কি বলেছিলেন তোমাকে অথবা আমাকে?

    মুজফ্‌ফর হাসে, তাহলে কালই যাবে? কিন্তু যাচ্ছ কোথায়?

    তোমাকে তো বলেইছিলাম আহ্‌মদ ভাই, আমার প্রথম কাজ হবে নিবারণবাবু স্যরের সঙ্গে দেখা করা। তারপর স্যর যা বলবেন, তা-ই করব।

    কখন যাচ্ছ?

    কখন যাচ্ছি সেটা নির্ভর করছে তোমার উপর। আমার সঙ্গে যাবে শৈলজাও। ও অবিশ্যি নিবারণবাবুর কাছে যাবে না। ও কয়েকদিন অণ্ডালে থেকে আসবে। ও নেমন্তন্ন করেছে তোমাকে। আমাদের দুজনকে ও হাতিবাগানের মিত্র কাফেতে ফিশ ফ্রাই খাওয়াবে কাল। কোন্‌ সময় গেলে সুবিধে হবে তোমার?

    কী ব্যাপার? – মুজফ্‌ফর বলে, মিত্র কাফেতে ফিশ ফ্রাই? সে তো অনেক খরচের ব্যাপার, বলতে বলতেই ব্যাপারটা বুঝে যায় সে, হেসে ফেলে, বলে, ও, ফেয়ারওয়েল? তোমাকে ফেয়ারওয়েল দিচ্ছে শৈলজা? তা, তোমার না হয় ফেয়ারওয়েল বুঝলাম, কিন্তু আমি কেন?

    সে তুমি ওকেই জিজ্ঞেস কোর, আমি তো শুধুই বার্তাবাহক।

    পরের দিন সকালে মুজফ্‌ফর বলে, দেখ কাজি, তুমি যেতে চাইছ, যাও, তোমাকে আমি বাধা দেব না। কিন্তু যাবার আগে তুমি একটা কথা আমায় দিয়ে যাও ভাই। যেখানেই যাও, কোন অসুবিধেয় পড়লে জানাবে আমাকে। আমি যেখানেই থাকি, ঠিক পৌঁছিয়ে যাব। তোমার মধ্যে কিছু একটা করার আকুতি তৈরি হয়েছে, আমি বাধা দিতে চাই না। কিন্তু আমি যে তোমার বন্ধু এ কথা তুমি ভুলো না কোনদিন।

    মুজফ্‌ফরকে অফিসেও ফিরে আসতে হবে, পরের দিনের কাগজও বের করতে হবে নিয়ম মতো, কাজেই ওরা ঠিক করল সকালেই ওরা চলে যাবে শৈলজার মেসে। মিত্র কাফে থেকে মুজফ্‌ফর ফিরে আসবে নবযুগের অফিসে।
    শৈলজার মেস হয়ে মিত্র কাফেতে পরের দিন পৌঁছল যখন ওরা, তখন সকাল দশটা। ফিশ ফ্রাইয়ের পক্ষে সকাল দশটা একটু বেশিই সকাল। কাউন্টারের ভদ্রলোক বললেন, এখন তো টোস্ট-মামলেট-চায়ের সময়। মাছ তো এই এল বাজার থেকে, সদ্য কাটা হয়েছে, এখন ম্যারিনেট করতে হবে, ঝামেলা আছে অনেক।

    কী কী ঝামেলা আছে শুনতে চাই না, বলে শৈলজা, কিন্তু ফিশ ফ্রাই না খেয়ে আমরা যাচ্ছি না আজ। নজরুলকে দেখিয়ে বলে, আমার এই বন্ধু – বাল্যবন্ধু একেবারে – আজ বাইরে চলে যাচ্ছে অনেক দিনের জন্যে। ওকে আজ ফেয়ারওয়েল দেব আপনার দোকানের ফিশ ফ্রাই খাইয়ে। আমরা বসছি, আমাদের জন্যে আপনার ওই
    মামলেট-চায়েরই অর্ডার দিন। সেগুলো খাই। এর মধ্যে আপনার ফিশ ফ্রাইও তৈরি হতে থাকুক। হয়ে গেলেই দিয়ে দেবেন গরম গরম। মোট কথা এই যে, আপনার দোকানের প্রথম কয়েক প্লেট ফিশ ফ্রাই আজ আমরাই খাব।

    ওরা যখন উঠল মিত্র কাফের থেকে তখন বারটা প্রায় বাজি-বাজি করছে। ট্রাম ধরবার আগে মুজফ্‌ফর জিজ্ঞেস করে, তোমাদের ট্রেন কখন?

    সময় ঠিক ঠিক জানি না, বলে শৈলজা, পাঁচটা নাগাদ হাওড়া স্টেশন থেকে একটা প্যাসেঞ্জার গাড়ি ছাড়ে,
    হাওড়া-সাঁইথিয়া প্যাসেঞ্জার। নামেই হাওড়া-সাঁইথিয়া, কিন্তু গাড়িটা যাবে বর্ধমান পর্যন্ত। আর বর্ধমানে দাঁড়িয়ে থাকবে একটা অন্য গাড়ি, সেটা যাবে সাঁইথিয়া, ভায়া অণ্ডাল।

    নজরুলকে একবার জড়িয়ে ধরে মুজফ্‌ফর, তারপর তার কাঁধে হাত রেখে বলে, ভালো থেকো কাজি, দেখা হবে আবার। ঢং ঢং করতে করতে শ্যামবাজার থেকে আসা একটা ট্রামে উঠে পড়ে সে। চলন্ত ট্রামটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে ওরা, তারপর হাঁটতে থাকে।

    একটু হেঁটে, শৈলজা বলে, পরের কাজটা। চল্‌।

    জয় ভারত খাদি বস্ত্রালয় নামের একটা দোকানের সামনে এসে দাঁড়ায় শৈলজা। নজরুল বলে, কী ব্যাপার? এখানে কেন?

    দরকার আছে, আয় না ভেতরে।

    গেরুয়া রঙের একটা চাদর কেনে শৈলজা, খাদির। বলে, তোকে দারুণ মানাবে। দেশের কাজ করতে যাচ্ছিস, তাই তোর জন্যে এটা কিনলুম।

    তুই কি পাগল হলি নাকি?

    পাগল তো তুই, বলে শৈলজা, সব কিছু ছেড়েছুড়ে দিয়ে সত্যি সত্যিই দেশের কাজে নিজেকে উৎসর্গ করতে যাচ্ছিস, এ করতে হলে পাগল হতে হয়। আর সেই পাগলের রং গেরুয়া, গলা ধরে আসে শৈলজার।

    অণ্ডালের জন্যে টিকিট কিনে, এনকোয়ারিতে ট্রেনের খবর নিয়ে, বিকেল পৌনে পাঁচটার সময় হাওড়া স্টেশনের আট নম্বর প্ল্যাটফর্মে যখন ঢুকতে যাচ্ছে ওরা, দেখল গেটের ঠিক বাইরেটাতেই দাঁড়িয়ে আছে মুজফ্‌ফর।

    কী ব্যাপার? – জিজ্ঞেস করে কাজি।

    কাঁধে ঝোলানো ব্যাগটার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে একটা বই বের করে আনে মুজফ্‌ফর, জুলিয়ান বোরখার্টের দ্য পীপ্‌ল্‌স্‌ মার্কস। বলে, এই বইটা ফেলে রেখে এসেছিলে, নিয়ে এলাম। বিপ্লবের স্বপ্ন বুকে নিয়ে বেরিয়েছ কাজি, এই বইটা ভুলো না। চলার পথে যখনই উদভ্রান্ত হবে, বইটা পোড়ো। নিজের সঙ্গে নিজে অনেক তর্ক করতে পারবে তখন। পোড়ো বইটা। চলে যাবার জন্যে পা-টা যেই বাড়িয়েছে মুজফ্‌ফর, শৈলজা বলে, এলেনই যখন, আর একটু দাঁড়িয়ে যান না। আমাদের ট্রেন এই-তো ছাড়বে।

    মুজফ্‌ফর বলে, উপায় নেই ভাই, কাগজটা তো কাল সকালের মধ্যে প্রেসে চাপাতে হবে। যতদূর সম্ভব লম্বা লম্বা পা ফেলে স্টেশনের বাইরের দিকে হাঁটতে থাকে মুজফ্‌ফর।


    ক্রমশ...

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ২৩ জুলাই ২০২২ | ৩৫০১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Ranjan Roy | ২৩ জুলাই ২০২২ ২০:৪২510201
  • জমে ক্ষীর!
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা মনে চায় প্রতিক্রিয়া দিন