আচ্ছা, এ বাড়িটা কি আটের এ?
‘কে?’ প্রশ্নের উত্তরে ভদ্রলোক এই জবাব দিলেন।
ঠক ঠক করে কেউ দরজায় আওয়াজ করছিল। টার্নার স্ট্রিটের এ বাড়িতে অচেনা-অজানা লোক কালেভদ্রেও আসে না, দরজাটা বন্ধও করা হয় না সাধারণত। একটা শার্ট গলাতে গলাতে মুজফ্ফর বাইরে এসে দেখে ধুতি-পাঞ্জাবি পরা গৌরবর্ণ মাঝারি উচ্চতার এক ভদ্রলোক। হ্যাঁ, আটের এ, বলতে বলতে দরজার সামনে পৌঁছিয়ে যায় সে, কাকে খুঁজছেন?
কাজী নজরুল ইসলাম থাকেন এখানে?
থাকেন তো, কিন্তু এখন নেই। আপনি?
আমার নাম ফকিরদাস। ফকিরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। আমি নজরুলের আত্মীয়।
আত্মীয়? ভিতরে আসুন না, বলতে বলতে আধখোলা দরজাটা পুরোটাই খুলে দিতে দিতে দ্রুত ভাবতে থাকে মুজফ্ফর, নজরুলের বন্ধু নয়, আত্মীয়! এদিকে বন্দ্যোপাধ্যায়! উচ্চকুলজাত বাঙালি ব্রাহ্মণ! এর নামও তো কখনও শুনিনি।
উঠোন পেরিয়ে ছোট সিঁড়ি দুটো ভেঙে বারান্দাটা পেরিয়ে ওদের একমাত্র ঘরে ঢুকে একটা চেয়ার এগিয়ে দিতে দিতে মুজফ্ফর বলে, কিছু মনে করবেন না, একটু ধোঁয়াটে থেকে গেল, মানে, আত্মীয় বললেন বলেই বলছি। বলতে বলতেই ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকায় সে, আর লক্ষ করে রহস্যময় একটা হাসি ভদ্রলোকের মুখে। যাই হোক, আগে বসুন তো, মুজফ্ফর বলে, সেসব কথা পরে শুনব। চা খাবেন তো?
চা তো নিশ্চয়ই খাব, বলে ঘরের চারপাশটা একটু ভাল করে দেখে ফকিরদাস, তারপর বলে, কিন্তু মনে তো হচ্ছে চা খেতে গেলে আপনাকেই বিড়ম্বিত করা হবে।
বিড়ম্বিত? কীসের বিড়ম্বনা? চা-টা তৈরি করার? আপনি খেলে আমিও তো খাব, বলতে বলতে ঘরের কোণের দিকে একটা ছোট জলচৌকির উপর রাখা ইলেকট্রিক হিটারটা জ্বালিয়ে একটা কেটলিতে খানিকটা জল গরম করতে দেয় মুজফ্ফর, বলে এটা আমারই ডিউটি, কাজী থাকলেও চা তৈরি করার কাজটা আমিই করতুম।
চা তৈরি করা, দুধ-চিনি মেশানো, বাইরে গিয়ে কাপ-ডিশ ধুয়ে এনে তারপর কাপ-এ চা ঢালা, এবং কাপের একপাশে ডিশের উপর দু’খানা করে বিস্কুট সাজাবার পুরো প্রক্রিয়াটা নীরবে লক্ষ করে ফকিরদাস, তারপর মুজফ্ফরের বাড়িয়ে দেওয়া হাত থেকে নিজের কাপ-ডিশটা তুলে নিয়ে বলে, হিন্দু তায় ব্রাহ্মণপুত্র, কীভাবে মুসলমানের আত্মীয় হতে পারি তাই নিয়ে কি আপনি ভাবিত?
ভাবিত ঠিক নয়, তবে অবাক তো একটু নিশ্চয়ই হয়েছি। বিশেষ করে, কাজী আমার ছোট ভাইয়ের মতো, একেবারেই নিজের ভাইয়ের মতো, ওর কাছে কখনও আপনার কথা, বা কারো সঙ্গে ওর বা ওদের পরিবারের এই ধরনের আত্মীয়তার কথা, কখনও শুনিনি আগে।
ও জানলে তো বলবে আপনাকে। যাই হোক, সে কথায় আসছি, তার আগে আপনার নামটা একটু শুনে নিই।
আমার নাম মুজফ্ফর আহ্মদ।
হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক ঠিক, আমারই ভাবা উচিত ছিল। বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির অফিসে নজরুলের নামের সঙ্গে আপনার নামটাই বলেছিল। কে জানে, আপনাকে দেখার পরেও আমার কেন সে কথা মনে পড়ল না। আপনি কাজী বলে উল্লেখ করছিলেন, ওই কাজীটা ওদের পারিবারিক উপাধি, কিন্তু কাজী নজরুল ইসলামের বাবার নাম আপনার জানা আছে?
বাবার নাম? – বলে মুজফ্ফর, দাঁড়ান, বাবার নাম, শুনেছি তো অনেকবার, উঁহু, ঠিক মনে করতে পারছি না।
কাজী ফকির আহ্মদ, বলে ফকিরদাস।
হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিক ঠিক, ফকির আহ্মদ, হ্যাঁ ফকির আহ্মদ, ও তা-ই বলেছিল, মনে ছিল না আমার।
আমার নামটা মনে আছে? এইমাত্র বললুম।
আপনার নাম ? কেন ফক—ফকি—হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ, আপনি ফকিরদাস আর ওর বাবা ফকির, সেই আত্মীয়তা?
সেটা কি কম আত্মীয়তা হল? – বলে ফকিরদাস, আমার মায়ের কাছে শুনেছি একজন ফকিরের আশীর্বাদে জন্মেছি আমি, তাই নাম দেওয়া হয়েছিল ফকিরদাস। বড় হতে হতে জানলুম আমাদের গাঁয়ের যে নদী, তার ওপারের গাঁয়ের কাজী ফকির আহ্মদের কথা। কাউকে কিছু জিজ্ঞাসাও করলুম না, ধরেই নিলুম এই নিশ্চয়ই সেই ফকির, যাঁর আশীর্বাদ আমার জন্মকে সুগম করেছে। যতদিন গ্রামের স্কুলে পড়েছি, এই পরিবারের খবর রাখতুম। নজরুল ইসলামের কথা শুনেছি তখন, বাবা মারা যাবার পর পেট ভরাতে ওই কচি বয়সেই বেচারা গ্রামে মোল্লাকি আর মসজিদে ইমামতি করত। আমি স্কুলে পড়তে চলে এলুম কলকাতায়। ছুটি-ছাটাতে গিয়েছি যখন নজরুল তখন একটু বড় হয়েছে। গিয়ে দেখি ওর তখন বেশ নাম-ডাক। আমাদের কয়লাখনি অঞ্চলের মানুষজন আমোদিত হত লেটোর গানে। ওদের কাজী-বংশের আহ্মদ সিদ্দিকী আর বজলে করিম বিখ্যাত লেটোশিল্পী ছিলেন। ও-ও নাকি লেটোর গান গায়। একবার এক লেটোর আসরে নজরুলের গান শুনেছিলুম। সেই বয়সেই রামায়ণ-মহাভারত-পুরাণের গল্পে আসর জমিয়ে দিত সে। ওর কবিত্ব আর গান গাওয়ার ক্ষমতা ছিল চমকে দেবার মতো। আমার বিশ্বাস ছিল বড় হয়ে এ ছেলে বিখ্যাত লেটোশিল্পী অন্তত হবেই।
মাঝে মাঝে যখন গ্রামে গেছি এরপর, নজরুলের খবর কখনও পেয়েছি, কখনও পাইনি। কখনও শুনেছি ও স্কুলে পড়ছে, আবার শুনেছি স্কুলে যাবার পয়সা নেই, ও টুকটাক এটা সেটা করছে, আর লেটোর গানও গাইছে। এরপর একবার শুনলুম, ও নাকি সৈনিক হয়ে যুদ্ধে চলে গেছে। আমারও ধীরে ধীরে গ্রামে যাওয়া কমে গেল, অনেক দিন ওর আর কোন খবর পাইনি।
কিছুদিন আগে আমার এক সহকর্মীর কাছে ‘মোসলেম ভারত’ নামে একটা পত্রিকা দেখছিলুম। আগে কখনও দেখিনি এই পত্রিকা, একটু উলটে-পালটে দেখতে গিয়ে একটা কবিতা চোখে আটকে গেল। কবির নাম কাজী নজরুল ইসলাম। ভাল কবিতা, বেশ নতুন ধরনের। তৎসম শব্দবহুল বাংলা নয়, অন্য ধরনের বাংলা। অন্ত্যমিলে অদ্ভুত একটা চমক আছে। তবে এই কি আমাদের সেই নজরুল?
কয়েকদিন আগে ওই একই সহকর্মী ‘নবযুগ’ নামে একটা নতুন দৈনিক পত্রিকার একটা লেখা পড়তে দিলেন আমায়। প্রবন্ধ। লেখক, আবার ওই কাজী নজরুল ইসলাম। ‘ধর্মঘট’ নাম লেখাটার। পড়ে বোঝা যায় যে অঞ্চলে আমাদের বাড়ি, সেই কয়লাখনি অঞ্চল সম্বন্ধে লেখকের ধারণা আছে। তবে কি এ-ই সেই কাজী নজরুল ইসলাম? আমার বন্ধুকে বলায় তিনি বললেন, ‘মোসলেম ভারত’-এর সম্পাদক কোথায় থাকেন তিনি জানেন। কাছেই। বত্রিশ নম্বর কলেজ স্ট্রিট। তাঁর কাছে গেলেই তো খবর পাওয়া যাবে। সেখানে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির একটা লাইব্রেরি আর রিডিং রুম আছে। আমাদের কলেজের তো একেবারেই কাছে। হাঁটাপথ।
কলেজ? আপনি কলেজে কাজ করেন? – জিজ্ঞেস করে মুজফ্ফর।
হ্যাঁ, সংস্কৃত কলেজ।
তাই নাকি? কী কাজ?
ওই, কলেজে যা করে লোকে, মাস্টারি। তো, বন্ধুর সঙ্গে গেলুম ওখানে। তখন ‘মোসলেম ভারত’-এর সম্পাদক আফজালুল হক সেখানে ছিলেন না। অন্য একজন ভদ্রলোক ছিলেন, কিছু একটা খাঁ হবেন। তিনি বললেন তিনিও ওখানে থাকেন। আমি জিজ্ঞেস করায় ভদ্রলোক বললেন, হ্যাঁ, এই নজরুল ইসলামই যুদ্ধে গেছিলেন। হাবিলদার ছিলেন। আমি জিজ্ঞেস করলুম, কোথায় পাওয়া যাবে ওঁকে? উনি থাকেন কোথায়? ভদ্রলোক বললেন, ‘দৈনিক নবযুগ’-এর অফিসে, অথবা যেখানে ওঁর বাসা। উনিই ঠিকানাটা দিলেন, বললেন, নজরুল ইসলামের এক হরিহর আত্মা বন্ধু আছেন, নাম মুজফ্ফর আহ্মদ, ওঁরা একই জায়গায় কাজ করেন, এক সঙ্গেই থাকেন। চলে এলুম। এসে ভালই হল, নজরুলকে পাওয়া গেল না ঠিকই, কিন্তু নজরুলের হরিহর আত্মা বন্ধু, যিনি ওকে নিজের ছোটভাই বলে মনে করেন তাঁর সঙ্গে তো বন্ধুত্ব হয়ে গেল। কিন্তু ও গেছে কোথায়? ফিরবে কখন?
গতকাল সকালে গেছে হাওড়ায় ওর এক বন্ধুর বাড়িতে। সেখানে গানের আসর আছে। যদিও গতকালই ফেরবার কথা ছিল, ও বলে গেছে ফিরতে একদিন দেরি হতেও পারে। আজ এসে যাবে নিশ্চয়ই, তবে কখন যে আসবে!
আরও কিছুক্ষণ বসে ফকিরদাস। নানা গল্পের মাঝে ‘দৈনিক নবযুগ’-এর কথা ওঠে। কী ধরনের লেখা, কারা লেখে, এইসব। এই তো কাগজ বেরোল সবে, মুজফ্ফর বলে, এরই মধ্যে কিন্তু পপুলার হয়েছে খুব। আমাদের যে প্রধান সেলিং এজেন্ট, সে বলে, মোড়ে মোড়ে লোকে নির্দিষ্ট সময়ে দাঁড়িয়ে থাকে কাগজ কেনবার জন্যে। কাজীর লেখার খুব ডিমান্ড। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, বড্ড গরম লেখে ও, এরই মধ্যে বেশ কয়েকবার ওয়ার্নিং পেয়েছি আমরা সরকারের কাছ থেকে।
ওয়ার্নিং? কীসের ওয়ার্নিং?
খবরের কাগজ বের করতে হলে সরকারি দপ্তরে হাজার টাকা জমা দিয়ে জামিন নিতে হয়। অপছন্দের লেখা-টেখা ছাপা হলে এক-আধবার ওয়ার্নিং দেবে সরকার, তারপর টাকাটা বাজেয়াপ্ত করে নেবে। আবার নতুন করে আগে যা ছিল তার ডবল টাকা জমা দিয়ে, তারপরেও অনুমতি মিললে, তবে আবার ছাপা যাবে কাগজ।
এই পর্যন্ত বলে হঠাৎ কয়েক মুহূর্তের জন্যে একটু চুপ করে যায় মুজফ্ফর, তারপর বলে, আপনাকে তো বলছি আসেনি কাজী, কিন্তু কে জানে, এসে হয়তো গেছে এতক্ষণে।
মানে? – বুঝতে একটু অসুবিধে হয় ফকিরদাসের – এসে গেলে তো দেখতেই পেতেন।
ভাবছি, সোজা যদি অফিসে পৌঁছে গিয়ে থাকে।
ও, সেটাও কি একটা সম্ভাবনা? – প্রশ্ন করে ফকিরদাস – মানে, আপনারা কি একসঙ্গে অফিস যান না?
প্রথম প্রথম যেতাম, এখন আর যাচ্ছি না, বলে মুজফ্ফর, আমাদের তো সান্ধ্য দৈনিক, দেখেইছেন এক পাতার কাগজ, ছাপা হয় সকালে, দুপুরের মধ্যে মার্কেটে চলে যায়। কাজী অফিসে যায় বারটা নাগাদ, কাজ-টাজ সেরে সন্ধে ছটায় বেরিয়ে পৌঁছে যায় কোনো-না-কোনো আড্ডায়। আমি ঢুকি সাড়ে তিনটে-চারটের সময়, যেসব লেখা পরের দিনের জন্যে যাবে সেগুলো পড়ে, এডিট করে, প্রয়োজন মনে করলে একটু টোন্ড্ ডাউন করিয়ে, প্রেসে দিয়ে রাত্তির সাড়ে ন'টা-দশটায় ফিরি। আপাতত এটাই ব্যবস্থা। কাগজটা বন্ধ যাতে না করে দেয় সেটা তো দেখতে হবে।
কিন্তু, বলে ফকিরদাস, আমি তো ওর ‘ধর্মঘট’ নামের প্রবন্ধটা পড়লুম, তেমন কিছু গরম বলে তো মনে হল না আমার।
আপনার বা আমার কী মনে হল সেটা কোনো ব্যাপার নয় ফকিরদাস বাবু, আসল কথাটা হচ্ছে হোম ডিপার্টমেন্টের কী মনে হয়। ‘নবযুগ’কে প্রথম থেকেই ওরা চরমপন্থী বলে ধরে নিয়েছে; সাধারণ মানুষের কথা যারা বলে, অথবা অন্যায়ের প্রতিবাদ যারা করে একটু-আধটু, তারা সবাই চরমপন্থী। তবুও, ‘ধর্মঘট’ প্রবন্ধটা বেরোবার পর ততটা চিন্তা ছিল না ওদের, কিন্তু তার পরেও একটা প্রবন্ধ লিখেছে কাজী, সেটাতে বাবুরা খুব খাপ্পা। ‘নবযুগ’-এর মালিক যিনি – ফজলুল হক সাহেব – কলকাতার হাইকোর্টের একজন নাম করা উকিল, তাঁর কাছে কাউকে পাঠিয়ে শাসিয়েছে খুব, বলেছে শেষ ওয়ার্নিং, এর পর কাগজ বন্ধ করে দেবে।
কী এমন লেখা যে এত অশান্তি?
‘মুহাজিরিন হত্যার জন্য দায়ী কে?’ – এই নামে নজরুলের একটা প্রবন্ধ বেরিয়েছে কয়েকদিন আগে, খুব খাপ্পা হোম ডিপার্টমেন্ট, বলে মুজফ্ফর। মুসলমানরা যখন খিলাফত আন্দোলনের ভবিষ্যত খুব একটা আশাব্যঞ্জক নয় বলে বুঝতে পারল, তখন প্রায় আঠের-বিশ হাজার ধার্মিক মুসলমান এ-দেশ ছেড়ে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত পেরিয়ে তাদের মতে যেখানে সত্যিকারের ধার্মিক মুসলমানরা থাকে, সেই দেশ খুঁজতে খুঁজতে নিজেদের দেশ ছেড়ে চলে গেল। এই স্বেচ্ছা-নির্বাসনের নাম হিজরত। স্বয়ং মুহম্মদ হিজরত করে মক্কা থেকে মদিনা গিয়েছিলেন। ধর্মের জন্যে এই দেশত্যাগীদের আরবি ভাষায় মুহাজির বলে, বহুবচনে মুহাজিরিন।
বাধা পড়ে কথায়। আপন মনে “এক সূত্রে বাঁধিয়াছি সহস্রটি মন” গুনগুন করে গাইতে গাইতে সুর ভাঁজতে ভাঁজতে হুড়মুড় করে যে ঘরে ঢুকে আসে, সে নজরুল। ফকিরদাসকে দেখে তার গলায় সুর বন্ধ হয়ে যায়, মুজফ্ফরের দিকে চোখে একটা প্রশ্ন নিয়ে তাকায়। হাসে মুজফ্ফর, বলে, তোমার জন্যে বসে আছেন ইনি। চিনতে পারো?
না, মানে ঠিক... বলতে বলতে তক্তপোশে বসে পড়ে নজরুল, সোজা ফকিরদাসের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, আপনার সঙ্গে কোথাও কি আলাপ হয়েছিল আগে?
চুনাজল নামটা চেনা লাগছে? – প্রশ্ন করে ফকিরদাস।
হ্যাঁ, চুনাজল তো জানি, অজয়ের এপারে আমাদের চুরুলিয়া, আর তার ঠিক উলটো পারেই চুনাজল, তবে ওটা বাঁকুড়া জেলা, আমাদেরটা বর্ধমান।
ঠিক, বলে ফকিরদাস, আমি চুনাজলের প্রসন্ন বাঁড়ুজ্জেদের বাড়ির ছেলে, আমার নাম ফকিরদাস।
ও হো আপনি? আপনার নাম তো জানি, আপনি পড়াশোনায় খুব ভাল ছিলেন, কলকাতার কোন একটা স্কুল থেকে ম্যাট্রিকে স্কলারশিপ পেয়ে পাশ করেছিলেন, আপনি তো বিখ্যাত লোক, ছোটবেলায় সবাই বলতো বড় হয়ে আপনার মতো হতে হবে। আমার বাবা মারা গেল কম বয়েসে...
সে সবই আমি জানি, শেষ পর্যন্ত কিন্তু বিখ্যাত হয়েছেন আপনি, আমি হয়েছি অখ্যাত এক মাস্টার। তবে আপনি যে একদিন বিখ্যাত হবেন তা আমার জানা ছিল, আমি মুজফ্ফর সাহেবকে বলছিলুম, আমার বিশ্বাস ছিল আপনি একদিন দেশবিখ্যাত এক লেটোশিল্পী হবেন। এখন তো দেখছি আপনি একজন দেশবিখ্যাত লেখক কবি এবং গায়ক, প্রায় ঠিকই ছিল আমার ধারণাটা। কিন্তু আপনি কি জানেন, ছেলেবেলায় আলাপ না হওয়া সত্ত্বেও আমি কেন আপনাকে মনে রেখেছি? আমার মায়ের কাছে শুনেছিলুম আমি নাকি এক ফকিরের আশীর্বাদে জন্মেছিলুম। ফকির মানে কী, আমি জানতুম না তখন। কিন্তু আপনার বাবা তো অজয়ের দুপারেই বিখ্যাত ছিলেন। আমি যখন শুনলুম তাঁর নাম ফকির আহ্মদ, কেউ না বলা সত্ত্বেও আমি ধরে নিলুম, ইনিই নিশ্চয়ই সেই ফকির, এঁর আশীর্বাদেই আমি জন্মেছি।
হা হা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে নজরুল, বলে দে গোরুর গা ধুইয়ে, আপনি ফকিরদাস, আর আমি তারাখ্যাপা, সে খবর রাখেন?
তারাখ্যাপা? একটা লেটোর আসরে কেউ আপনাকে দুখুমিয়া বলে পরিচয় দিচ্ছিল, আমি সেখানে ছিলুম, কত কষ্ট সেই ছেলেবেলাতেই আপনাকে করতে হচ্ছিল তা আমি শুনেছি, ভেবেছিলুম নামটা সার্থক। কিন্তু তারাখ্যাপা তো শুনিনি।
ওটা আমার মায়ের দেওয়া প্রাইভেট নাম, বলে নজরুল। আমাকে নাকি মা পেয়েছিল তারাপীঠের মায়ের আশীর্বাদে। বাবা-মা ছাড়া আর কাউকে তারাখ্যাপা নামে আমাকে ডাকতে শুনিনি।
হাসি-হাসি মুখে কৌতূহল মেটাচ্ছিল মুজফ্ফর এতক্ষণ, এবার হেসে বলল, চমৎকার, কুলীন বাঁড়ুজ্জের ছেলে হল ফকির আর মুসলমান কাজীবাড়ির ছেলে তারাখ্যাপা! তুলনাহীন!
এই কথাটাই আপনাকে আমি বলতে যাচ্ছিলুম ঠিক নজরুল যখন ঢুকল, বলে ফকিরদাস, ঠিক এই কথাটাই। আমি নিজে রাজনীতি করিও না বুঝিও না, তবে এটা জানি যে হিজরত আন্দোলন – মানে ওই মুহাজিরিনদের ব্যাপারটা – ওটা পরে শুরু হয়েছে। তার আগে খিলাফত। আমার প্রথম থেকেই মনে হয়েছে খিলাফত আন্দোলনটা আমাদের দেশের সাধারণ মুসলমানদের আন্দোলনই নয়, মুসলমানদের মধ্যে যারা এলিট, ওটা তাদেরই। অন্তত বাঙালি মুসলমানদের যে নয়, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। আমাদের ওদিকে গ্রামে দু’চারজনকে আমি জিজ্ঞেস করেও দেখেছি, তারা তো খিলাফত ব্যাপারটাই বোঝে না। খলিফা-টলিফাদের কোনো খবরই রাখে না তারা। একজন তো বলল ব্রিটিশ সরকার নিশ্চয়ই কোনো কথার খেলাপ করেছে, তা-ই নিয়ে এত গণ্ডগোল! কথার খেলাপ কেন করবে! তাই বড় বড় মৌলভিরা সব খিলাফত আন্দোলন শুরু করেছেন! ভাবুন!
তা-ই যদি হবে, নজরুল বলে, তাহলে শুধুমাত্র এলিটদের আন্দোলন এতদিন ধরে চলতে পারত? বলেই, হাতের ইশারায় ফকিরকে থামিয়ে ঘরের এককোণে রাখা একটা কুঁজো থেকে ঢক ঢক করে এক গেলাস জল খেয়ে, নজরুল বলে, ও সব পলিটিক্স-ফলিটিক্স এখন থাক, একটা কথা বলে দিই ফকিরদা, তুমি ফকিরদা আর আমি কাজী, দেখা যখন হয়েই গেল, তখন আপনি-আজ্ঞেটা ছাড়তে হচ্ছে।
সে তো বেশ ভালই প্রস্তাব, ফকির কিছু বলার আগেই মন্তব্য করে মুজফ্ফর, কিন্তু যে কথাটা উনি বলতে চাইছিলেন সেটা শেষ করতে দাও। ফকিরের দিকে ফিরে সে বলে, শুধুমাত্র কয়েকজন গ্রামবাসী যদি খিলাফত কথাটা না বুঝে থাকে, আর কাজে কাজেই সেই আন্দোলনে উৎসাহ না দেখায়, তাহলেই কি এই সিদ্ধান্ত করে ফেলা যায় যে আন্দোলনটা এলিট? হয়তো আমাদের বাংলায় এতটা হয়নি, কিন্তু উত্তর এবং পশ্চিম ভারতে খিলাফতি ভ্রাতৃত্ববোধ উসকে দেবার মোল্লা-মৌলভির অভাব আছে বলে মনে করেন আপনি?
হয়তো আছে, বলে ফকির, তা-না হলে ইংরেজের হয়ে লড়াই করতে স্পষ্ট খিলাফতি নিষেধ থাকা সত্ত্বেও আমাদের দেশের গরিব মুসলমান বাড়ির ছেলেরা কি দলে দলে যুদ্ধের সময় নাম লেখায়নি সৈন্যদলে? এই যে আঠের হাজার মুহাজির দেশ ছেড়ে গেল, তাদের মধ্যে আপনার-আমার বাড়ির ছেলেরা আছে? অন্য জায়গার কথা বলতে পারব না, কিন্তু আমাদের এই বাংলায় অন্তত পাশের বাড়ির গুরুজনের উপদেশের দাম এখনও ভিনদেশি মোড়ল-মুরুব্বির ফরমান-অনুশাসনের চেয়ে বেশি। তাই কাজীর বাড়ির ছেলে তারা-মায়ের আশীর্বাদ পায় আর কুলীন বামুনের ছেলের ফকিরের দোয়ায় জন্ম হতে কোন অসুবিধে হয় না।
শেষের কথাটা যে নজরুল আর মুজফ্ফর – দু’জনেরই মনের মতো, তা বুঝতে অসুবিধে হল না। মুজফ্ফর বলল, শুধু পাশের বাড়ির গুরুজন কেন, বাড়ির পাশের সবুজ খেত আর হেমন্তের পাকা ধানের গন্ধ? আপনাকে একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি। নিজে যদিও সরাসরি রাজনীতি করি না আমি, রাজনীতিতে উৎসাহ আমার বরাবরই আছে। অনেক মিছিল-টিছিলে হেঁটেছি। কংগ্রেস আর খিলাফত কমিটি, দুটোর তরফেই সদস্যপদ নেবার আমন্ত্রণ এসেছে, নিইনি। কিন্তু সুযোগ পেলেই মিটিং-ফিটিংয়ে যাই। একবার খিলাফত কমিটির একটা মিটিংয়ে একদল বাঙালি মুসলমান মজুরকে খিলাফত, হিজরত, এসব বোঝানো হচ্ছে। খুব মন দিয়ে শুনে একজন বলল, কিন্তু তাই বলে আফগানিস্তান? ওখানে কি ধান হয়? ভাত পাওয়া যায়? আরেকজন তাই শুনে মন্তব্য করে, শুধু তাই কেন? পাটের কল আছে ওখানে? পাটের চাষ হয়?
হো হো করে হেসে ওঠে নজরুল আর ফকিরদাস। তবু তার পরেও বলে নজরুল, কিন্তু এ কথা তোমাকে মানতেই হবে ফকিরদা, এতদিন ধরে চলছে তো আন্দোলনটা। সাধারণ মুসলমানদের সমর্থন না থাকলে এটা কি সম্ভব ছিল?
তোমার কথার উত্তর ঠিক ঠিক দিতে হলে রাজনীতিবিদ হতে হয়, বলে ফকির। আমি তো তা নই, কিন্তু তবুও এ ব্যাপারে আমার একটা থিওরি আছে। দেখ, উনিশশো পনেরোয় গান্ধি ফিরলেন। এসেই তিনি তাঁর অহিংস পথে পর পর তিন জায়গায় আন্দোলন করে সফল হলেন। চম্পারনে নীলকরদের বিরুদ্ধে আর তার পরেই খেড়া আর আহ্মদাবাদে। পরণে তাঁর প্রায় নাঙ্গা সাধুদের পোশাক, তাঁকে দেখে লোকে উত্তাল, দেশের মানুষের হৃদয়ের রাজা হতে আর বাকি কোথায়?
বলছি বটে বাকি কোথায়? – একটু দম নিয়ে বলে ফকিরদাস, কিন্তু গান্ধির বুদ্ধি সাধারণ স্তরের নয়, অনেক উপরে। তিনি বুঝলেন, আছে বাকি। তাঁর পোশাক-আশাক, চলন-বলন, ভোজ্য-পেয় তাঁকে প্রায় দেবতাদের স্তরে নিয়ে গেছে সংখ্যাগুরু হিন্দু জনসাধারণের মধ্যে, কিন্তু এই দেশে যে বিপুল সংখ্যক মুসলমান আছে, তারা? তারা তাঁকে চেনে না, সংখ্যাগরিষ্ঠের তিনি গান্ধিবাবা ঠিকই কিন্তু এই বিপুল সংখ্যক মুসলমানের তিনি পির ন’ন। চোখ মেলে চাইতে জানেন গান্ধি, এদিক-ওদিক তাকিয়ে স্পষ্ট চোখে দেখতে পেলেন খিলাফত আন্দোলন। আর, এ-ও বুঝলেন যে এই আন্দোলনের মাথায় যারা, তারা মুসলমান এলিট। গান্ধি যুক্ত হলেন খিলাফত আন্দোলনে, যদিও যুদ্ধের সেপাই খুঁজতে অহিংস গান্ধির অসুবিধে হয়নি গুজরাতের গ্রামে গ্রামে ঘুরতে। ষোল সালে লখনৌয়ের কংগ্রেস অধিবেশনে খিলাফত-কংগ্রেস প্যাক্ট হল। আমি তো এখন বুঝতে পারি না খিলাফত আন্দোলনের নেতা কি আলিভাইরা না গান্ধি। এখন তো গান্ধির অসহযোগ আন্দোলনের তোড়ে ভাসা দুই নৌকো পাশাপাশি, একটায় খিলাফত, আর অন্যটায় পূর্ণ স্বরাজ! পূর্ণ, তবে অবশ্যই রানির সাম্রাজ্যের মধ্যে!