আসল পরিচয়
ডঃ শহীদুল্লাহ্ বললেন, এক সময়ে আমার নাম ছিল সিরাজউদ্দৌল্লা, জানেন?
সিরাজউদ্দৌল্লা? বাঃ বেশ নাম তো, হাসে পবিত্র। বলে, বদলাল কীভাবে?
বদলায়নি তো, শহীদুল্লাহ্ বললেন, যারা আমাকে সিরাজউদ্দৌল্লা নামে ডাকত, তাদের মধ্যে আজও যারা বেঁচে আছে, তারা বোধ হয় এখনও ওই নামেই ডাকবে। তারা কারা জানেন?
আড্ডা চলছিল বত্রিশ নম্বরে, ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য’ পত্রিকার অফিসে। দশ-বার জন আড্ডাধারীর মধ্যে মুজফ্ফর আহ্মদ, নজরুল ইসলাম, আফজালুল হক ছাড়াও অন্য অনেকের সঙ্গে আছেন পবিত্র গাঙ্গুলি, শৈলজানন্দ, ‘হিতবাদী’ পত্রিকার সম্পাদক যোগীন চাটুজ্জে মশাই, আর কাজী আবদুল ওদুদ।
ইশকুল জীবনের শেষ ক’টা বছর আমার কাটে হাওড়ায়, বলতে থাকেন শহীদুল্লাহ্ সাহেব, পড়তুম জেলার একমাত্র গভর্নমেন্ট স্কুল, হাওড়া জেলা স্কুলে। আঠেরোশো পঁয়তাল্লিশের স্কুল, আমাদের ইউনিভার্সিটির চেয়েও পুরোনো, সেটাকে বেশ এলিট স্কুলই ভাবা হত সে সময়ে। সংস্কৃতে প্রতিটি পরীক্ষাতেই পেতুম ফুল মার্ক্স, একশোয় একশো। আমাদের ক্লাসের ফার্স্ট বয় যে, সে আমারও ঘনিষ্ঠ বন্ধু, একবার পণ্ডিত মশাইকে জিজ্ঞাসাই করে ফেলল, পণ্ডিত মশাই, আমরা সব বামুন-কায়েত-বদ্যিদের বাড়ির ছেলে, সব বিষয়েই ভাল ভাল নম্বর পাই, কিন্তু সংস্কৃতে একশোয় একশো আপনি কখনো আমাদের দেননি। অথচ ও মুসলমানের ছেলে, ভর্তি হবার পর থেকে সব পরীক্ষাতেই ওকে আপনি একশোয় একশো দিচ্ছেন!
কী করি বাবা, কাঁচুমাচু মুখে বলেন পণ্ডিত মশাই, সিরাজউদ্দৌল্লা যা লেখে সবই ঠিক, কোথাও কলম ছোঁয়ানো যায় না! সেই থেকে সিরাজউদ্দৌল্লাই নাম হয়ে গেল আমার ইশকুলে, শহীদুল্লাহ্ নামটা কিছুতেই মনে রাখতে পারতেন না পণ্ডিতমশাই।
এটা কিন্তু ঠিক, শৈলজানন্দ বলে, আমিও মুসলিম নাম কিছুতেই মনে রাখতে পারি না। নুরু আমার ছেলেবেলার বন্ধু; নুরু, শৈলেন ঘোষ আর আমি। থ্রি মাসকেটিয়ার্সের একজন মুসলমান, একজন ক্রিশ্চান আর আমি কুলীন ব্রাহ্মণ-সন্তান। নুরুর নামটায় অসুবিধে হয় না, কিন্তু অন্য মুসলমানের নাম ঠিক ভুল করে বসি।
নুরুর কথা আলাদা, পবিত্র বলে, ওর বাবা অনেক মাথা খাটিয়ে ওর নাম রেখেছেন এমন, যে প্রথম ভাগের বিদ্যেতেই ঠিক বানানে লেখা যাবে – কাজী নজরুল ইসলাম – একটা যুক্তাক্ষর পর্যন্ত নেই, ভুলবি কী করে? কিন্তু বেশির ভাগ মুসলিম নামেই তো ল-এর সঙ্গে ল-এর যুক্তাক্ষর, অথবা হ-য়ের নীচে একটা হসন্ত, কিংবা জ-এর উচ্চারণ ইংরিজি z-এর মতো, অথবা খণ্ড ৎ-এর কঠিন উচ্চারণ!
পবিত্রর মন্তব্যে মজা পায় সবাই, অট্টহাসি না হলেও মজা-পাওয়া নানা মুখভঙ্গী আড্ডাকে আরও প্রাণবন্ত করে তোলে। যোগীন চাটুজ্জে বলে ওঠেন, কঠিন উচ্চারণের দোহাই দিয়ে যা বললে ওটা কিন্তু বর্ণহিন্দুদের একটা অহেতুক উন্নাসিকতা। আসলে মুসলমানদের নাম মনে রাখতে চাও না। তাই মনে থাকেও না। আহ্লাদিনী, কল্লোলিনী, পুণ্ডরীকাক্ষ আর প্রতিটি মন্ত্রের শেষে নমহ্ উচ্চারণ ঠিকঠাক করতে পারলে, সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতমশাই মুসলমানি নাম শহীদুল্লাহ্ মনে রাখতে পারেন না বা উচ্চারণে ঠেকে যান, মেনে নেওয়া কঠিন।
এবার থেকে পারবেন, এবার থেকে পারবেন, “কাণ্ডারী এ তরীর পাকা মাঝি মাল্লা, / দাঁড়ি-মুখে সারি গান লা শরিক আল্লাহ্!” – এমন অন্ত্যমিল যাঁরই চোখে পড়বে তিনিই পারবেন, বলতে বলতে চশমা-চোখে ধুতি-পাঞ্জাবি পরা নির্ভুল এক বাঙালি যুবক প্রবেশ করেন আড্ডাস্থলে। বোঝা যায় ইনি অনেকেরই পূর্ব-পরিচিত, বিশেষ করে যাঁর তক্তপোশ জুড়ে আড্ডাটা চলছিল সেই আফজালুল হকের তো বটেই। এক গাল হেসে আগন্তুককে স্বাগত জানান আফজালুল, আসুন মোহিতবাবু, আপনারই অপেক্ষায় আছি, আপনার সঙ্গে আলাপ করাবার জন্যেই আজ শহীদুল্লাহ্ সাহেবকে বিশেষ করে আমন্ত্রণ করে এনেছি এখানে।
তক্তপোশে আর জায়গা নেই, একটা চেয়ার টেনে বসতে বসতে আগন্তুক মোহিতবাবু উপস্থিত সবাইয়ের দিকে তাকাতে তাকাতে নজরুলের দিকে চোখ পড়তে হেসে বলেন, ইনিই কাজী নজরুল ইসলাম, ঠিক তো?
জবাব দেন মুজফ্ফর, চিনলেন কীভাবে?
আপনার দেওয়া বিবরণটাই একেবারে নির্ভুল শনাক্ত করল নজরুলকে। এমন টকটকে ফরসা রং, সুঠাম শরীর এবং চপল-হরিণী-চোখ উইদ আ লিট্ল্ লাল আভা! আউটস্ট্যান্ডিং! কিন্তু দাঁড়ান, এখানে এসে ডঃ শহীদুল্লাহ্-র সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে এমনটা আগে ভাবিনি, বলতে বলতে দু’হাত জোড় করে নমস্কার করেন মোহিতলাল ডঃ শহীদুল্লাহ্কে, আপনি আমাকে চেনেন না স্যার, আমি কিন্তু আপনাকে দেখেছি আগে, আজ পরিচিত হতে পেরে ভাল লাগছে, আমার নাম মোহিতলাল মজুমদার।
আপনাকে নামে চিনি, প্রতিনমস্কার করে বলেন শহীদুল্লাহ্ সাহেব, আপনার অনেক লেখাই পড়েছি, আমি আপনার গুণমুগ্ধ পাঠক। আর কাজীর সম্বন্ধে যা লিখেছেন এবারের ‘মোসলেম ভারত’-এ, সেটাও পড়লুম। আপনার সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ একমত।
কাজীর সম্বন্ধে যা লিখেছেন মোহিতলাল ‘মোসলেম ভারত’-এ, কাজীর সেটা পড়া ছিল, একটু সলজ্জ হাসিতে বলল, আমি কিন্তু খুবই সাধারণ কবি, এখনও ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য’ পত্রিকাতে কবিতা পাঠিয়ে ভয়ে ভয়ে থাকি কবিতাটা যেন ‘কোরক’-এ না ঢুকে যায়, কাজেই আপনি যে হাবিলদার কবি কাজী নজরুল ইসলামকে ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকার সর্বশ্রেষ্ঠ কবি বানিয়ে দিলেন, এতে আরও ভয় পেয়ে গেলুম।
ভয় পেয়ে গেলেন? – হাসতে হাসতে বলেন মোহিতলাল, আপনাকে দেখে যদিও মনে হয় না ‘কোরক’-এর বয়স আপনি পেরিয়েছেন এখনও, কিন্তু এখানে যাঁরা উপস্থিত আজকে, তাঁদের যে-কাউকে জিজ্ঞেস করে দেখুন, বিশ্বনিন্দুক মোহিতলাল যখন একবার আপনাকে শ্রেষ্ঠ কবির লিখিত সার্টিফিকেট দিয়ে বাংলার সারস্বত মণ্ডপে আহ্বান করেছে, তখন আপনাকে ‘কোরক’-এ ঠেলবার আগে স্বয়ং ডঃ শহীদুল্লাহ্ও একটু চিন্তা করে নেবেন। কী, ঠিক বলিনি শহীদুল্লাহ্ সাহেব?
চকিতে একবার মুজফ্ফর আহ্মদের দিকে তাকিয়ে সোজা মোহিতলালের দিকে চোখ ফেরান শহীদুল্লাহ্। বলেন, দু’জন সম্পাদকের মধ্যে একজন হিসেবে আমার নাম যদিও ছাপা দেখেছেন আমাদের সাহিত্য পত্রিকায়, ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য’ পত্রিকার আসল মালিক কিন্তু এই মুজফ্ফর আহ্মদ। ও-ই আমাদের পত্রিকার সর্বক্ষণের কর্মী, থাকেও এখানে, আর পত্রিকার যাবতীয় ঝামেলা প্রায় একাই সামলায়। বসিরহাট ছেড়ে যখন কলকাতায় এলুম, সেই সময় কয়েকদিন থেকেছি এখানে, মুজফ্ফরের ঘরেই ওর পাশের তক্তপোশে আমার বিছানাও থাকত, এখন তো আর আসার সময়ও পাই না। তবে, ‘কোরক’ নামে যে স্তম্ভটা আছে আমাদের পত্রিকায়, ওটা আমাদের আর এক সম্পাদক যিনি আছেন, মহম্মদ মোজাম্মেল হক সাহেব, তাঁর বিশেষ পছন্দের বিভাগ। উনি মনে করেন সাহিত্য পত্রিকার অন্যতম কর্তব্য হল তরুণ লেখকদের উৎসাহ দেওয়া, তৈরি করা। কাজী নজরুল যতই বিনয় দেখাক, ও জানে, ও ‘কোরক’-এর স্তরের কবি নয়। শুনেছি, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও ওর কবিতা পড়ে প্রশংসা করেছেন।
‘কোরক’-এর কথা উঠলই যখন, মোহিতলাল বললেন, তখন বলি, মোজাম্মেল হক সাহেবের সঙ্গে আমিও একমত। বাংলা সাহিত্যের, বিশেষত কবিতার, যে হাল হয়েছে এখন, সচেতন সম্পাদকরা লেগে না থাকলে বাংলা কাব্য অচিরেই যে মর্কটমুখী কাব্য হয়ে উঠবে তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
মর্কটমুখী? স্বতঃস্ফূর্ত বিস্ময় যোগীন চাটুজ্জে মশায়ের কণ্ঠে, মর্কটমুখী কাব্য?
এ ছাড়া আর অন্য কোনও বিশেষণ ভাবতে পারলুম না চাটুজ্জে মশাই। প্রতিভাবান কোনও কবির একটি কবিতা প্রকাশ হলেই দেখবেন দিস্তে দিস্তে কবিতা সেই কবিতার ভাব, ছন্দ এমনকি শব্দচয়নেরও অপপ্রয়োগ করে এমন সব হাস্যকর কবিতা ছাড়ছে বাজারে যে তাকে কিচ-কিচি কিচ-কিচি মর্কটস্য শব্দক্রীড়া ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারি না। দেখুন না, এমনকি রবীন্দ্রনাথকে ঘিরেও যে মর্কটবলয়, কবিতার নামে কী যে তারা ছাইপাঁশ লেখে সে কি তারা নিজেরাই জানে! এমন অবস্থায় সম্পাদকরাই ভরসা। তরুণ কবিদের রচনায় একটু-আধটু কলম চালিয়ে, তাদের মাঝে মধ্যে ডেকে সতর্ক করে দিয়ে, ছন্দ, ভাব ও শব্দের যথার্থ সম্মিলনের উদাহরণ আলোচনা করে সম্পাদক মশাইরাই বাংলা কবিতাকে চারুচতুরদের চালাকি থেকে মুক্ত করতে পারবেন। এ বিষয়ে বিশেষ করে মুসলিম পত্রপত্রিকার একটা বিরাট দায়িত্ব আছে।
কাজী আবদুল ওদুদ এতক্ষণ নীরবেই বসে ছিলেন। মোহিতলালের দিকে তাকিয়ে এবার মৃদুকণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, বিশেষ করে মুসলিম পত্রপত্রিকার কথা বলছেন কেন?
দ্যাট্স্ আ ভেরি ইন্টারেস্টিং কোয়শ্চেন, বলেন মোহিতলাল, ‘মোসলেম ভারত’-এ আমি কাজী নজরুলের কবিতা প্রসঙ্গে যে আলোচনা করেছি, তাতে এ-কথাটাই বারবার বলার চেষ্টা করেছি। আমাদের মাতৃভাষা, আমাদের এই সুললিত বঙ্গভাষায়, যাঁরা কথা বলেন, তাঁদের মধ্যে সংখ্যাগুরুই তো মুসলমান। মধ্যযুগের বাংলা লোকসাহিত্য লক্ষ্য করুন, সে সাহিত্যে মুসলিম ধর্মানুসারী বঙ্গভাষী যে অবদান রেখেছেন, তার তুলনায় আজ কিন্তু তাঁরা অনেকটাই নিষ্ক্রিয়। এর অনেক কারণই থাকতে পারে, সে বিশ্লেষণে আমি যাচ্ছি না। কিন্তু কিছুদিন ধরে দেখতে পাচ্ছি শিক্ষিত বাঙালি মুসলমান আবার বাংলা লিখছেন, নানা পত্রপত্রিকায় তাঁদের লেখা প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাস, কবিতা দেখা যাচ্ছে। এই দ্বিতীয় পর্যায়ের বাঙালি মুসলমান লেখকদের কাছে আমাদের আশা অনেক। এখানে আসার সময় সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে শুনতে পাচ্ছিলুম মুসলমানদের নাম মনে রাখতে পারেন না বলে দুঃখ করছিলেন অনেকে। পারবেন কীভাবে? ক’জন মুসলমান বাঙালিকে আমরা ব্যক্তিগতভাবে চিনি? ক’জনের সঙ্গে মিশি? আজ কাজী নজরুল ইসলামের মতো উদীয়মান কবিরা ঘাড় ধরে আমাদের তাঁদের দিকে তাকাতে বাধ্য করবেন। আরব এবং পারস্যের ভাষা-সমাজ-সৌন্দর্য এখন বাংলা সাহিত্যের ঐশ্বর্যবর্ধন করবে। লক্ষ্য করুন নজরুল কেমন লিখেছেন। মাল্লার সঙ্গে এখন পাল্লাকে মেলাতে হবে না আর, “লা শরিক আল্লাহ্” এখন বাংলা কবিতায় স্বাগত।
প্রতিষ্ঠিত এবং অতি প্রশংসিত বাঙালি কবির প্রতি কুরুচিকর এবং অনাবশ্যক শ্লেষটা লক্ষ্য করেও উপেক্ষা করলেন সমবেত আড্ডাধারীরা। আফজালুল হক বললেন, আমি অনেকটাই একমত আপনার সঙ্গে, মুসলমানরাই যদি তাদের সংস্কৃতির সঙ্গে অমুসলমান বাঙালিদের পরিচয় না ঘটিয়ে দেয়, তাহলে করবেটা কে? আমাদের পত্রিকায় আমরা মুসলমানদের নানা ভাবে উৎসাহ দিই লেখবার জন্যে, আর আমাদের হিন্দু লেখকগোষ্ঠীও সেই উৎসাহদানে শরিক, কাজীকে তো বলেই দিয়েছি ও যে কবিতাই লিখুক, সবই আমরা ছাপব।
এক সময় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে নিয়মিত যাতায়াত করতুম, এখনও যে যাই না তা নয়, বলে উঠলেন ডঃ শহীদুল্লাহ্, কিন্তু সত্যি কথা বলতে কী জানেন মোহিতবাবু, মন উঠত না। কেমন একটা ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্স গোছের ছিল। শিল্প-সাহিত্য-ভাষা ইত্যাদি নিয়ে বেশ উঁচু মানের আলোচনাই হত সেখানে, হিন্দু-মুসলমান ভেদ যে ছিল তা-ও নয়, মুজফ্ফর তো যতদূর জানি এখনও ওখানকার এক্জিক্যুটিভ কমিটির মেম্বার, কিন্তু কেমন যেন মন ভরত না। কেমন ছিল জানেন? ঠিক যেমন বড়লোকের বাড়ির গরিব আত্মীয়রা, যত্নআত্তি সৌজন্যের অভাব নেই, কিন্তু তবুও কীসের একটা সঙ্কোচ থাকতই। সেই সময়েই আমরা বুঝতে পারি আমাদের নিজস্ব একটা সাহিত্য-সমিতি থাকা দরকার। তৈরি হল বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি। পরে পত্রিকাও বেরল, ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’। ঠিক মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা আমরা বলতে চাইনি এটাকে, কিন্তু কেমন যেন একটা সাহসের অভাব আমাদের অনেকের মধ্যেই ছিল। মুসলমান সাহিত্য সমিতির পত্রিকা কি অমুসলমানরা পড়বে? পড়বে সত্যিই? না-ই যদি পড়ে, তাহলে ‘মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’ নাম দিলে অন্তত মুসলমানদের তো আগ্রহ হতেও পারে। এই দেখুন না, আফজালুলের কাগজ। ওর মধ্যে কি ছিটেফোঁটাও মুসলিম সাম্প্রদায়িক ভাবনা আছে? কিন্তু যা আছে তা হল সাহসের অভাব, তাই পত্রিকার নাম ‘মোসলেম ভারত’, মোসলেম শব্দটার উপর জোর দেন শহীদুল্লাহ্।
‘মোসলেম ভারত’-এর এই মোসলেম অংশটা আফজালুল হক সাহেবের একটু ছোট্ট সঙ্কোচের জায়গা। প্রসঙ্গটা একটু ঘুরিয়ে দেবার জন্যেই বোধ হয় তিনি সোজাসুজি শহীদুল্লাহ্ সাহেবকেই বলেন, স্যার, একটা কথা বলি আপনাকে। কাজী সাহেব এরই মধ্যে যতটা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন, তাতে লেখক হিসেবে শুধুমাত্র তাঁর নাম থাকলেই এখন পত্রিকায় পাঠকের অভাব হবে না; ‘সওগাত’, ‘সাহিত্য পত্রিকা’, ‘আমাদের কাগজ’, ‘প্রবাসী’ – যেখানেই তিনি লিখছেন সেখানেই পরের সংখ্যার জন্যে আর পাঠকরা অপেক্ষা করতে পারছে না, শান্তিনিকেতন থেকে সুধাকান্ত রায়চৌধুরি আমাকে দু’খানা চিঠি দিয়েছেন এর মধ্যে, কিন্তু যে কথাটা আপনি বা মোহিতবাবু বোধ হয় জানেন না তা হল কাজী সাহেবের গান। যে একবার শুনেছে, সে-ই পরের বার দলবল নিয়ে চলে আসে আসর বসাতে। কাজী সাহেব তো এখানেই থাকছিলেন প্রথম প্রথম, এই কলেজ স্ট্রিট অঞ্চলের নানা মেসবাড়িতে যে সব কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা থাকে, তাদের কাছে আর অফিস-আদালতের কর্মচারী যারা তাদের মধ্যে, উনি এখনই একজন জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী।
যে আড্ডায় কাজী থাকে সেখানে সাধারণত সে-ই মধ্যমণি। তার গলা ছেড়ে গান গাওয়া, হা-হা হো-হো অট্টহাসি আর কারণে-অকারণে ‘ঘি-চপচপ কাবলি মটর’ অথবা ‘দে গোরুর গা ধুইয়ে’ হুঙ্কার জমজমিয়ে রাখে যে-কোন আড্ডা। আজ আফজালুল হকের তক্তপোশের এই ভদ্রজনোচিত সমাবেশ একটু সঙ্কুচিত করে রেখেছে কাজীকে। একবার মাত্র বিনয় সহকারে মোহিতলালের অতি-প্রশংসার মৃদু প্রতিবাদ ছাড়া তার কণ্ঠস্বর এখনো পর্যন্ত শোনেইনি কেউ। তার পাশেই বসেছিল মুজফ্ফর, বলল, কী কাজী, হবে নাকি?
হবে কী করে, গোপীর হারমোনিয়মটাই তো নেই।
হারমোনিয়ম ছাড়াই তো...মোহিতলাল বলার চেষ্টা করেন কিছু একটা।
না না, হারমোনিয়ম দিয়েই হবে, আফজালুল বলে ওঠেন, হারমোনিয়ম আছে তো, আপনি আর মুজফ্ফর সাহেব টার্নার স্ট্রিটে চলে যাবার পর একদিন এলেন গোপীবাবু, ওঁর যা যা যন্তর-টন্তর ছিল নিয়ে গেলেন, যাবার আগে আমাকে বললেন, হারমোনিয়মটা রেখেই যাই। কাজী তো মাঝেমধ্যে আসবেই, তখন বাজাতে পারবে।
তক্তপোশের নিচেই ছিল হারমোনিয়মটা, দেখবার জন্যে হাঁটু গেঁড়ে নিচু হতে যাচ্ছেন আফজালুল, নজরুল এগিয়ে এসে মাথাটা দিলেন গলিয়ে। মুজফ্ফর আহ্মদ রোগাপাতলা ছোটখাটো মানুষ, তিনিও লাগালেন হাত। বের হল হারমোনিয়ম। সেটাকে রাখা হল একটা টেবিলের ওপর। ডঃ শহীদুল্লাহ্ বললেন, শুরু হোক তাহলে।
সকলের অনুমতি নিয়ে পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা পানের ডিবে বের করে কাজী, একটা খিলি মুখে পুরে চোখ বুজে কিছুক্ষণ টেপাটিপি করে কয়েকটা রিড। একটু দ্রুত চালায় বেলোজ, হয়তো শব্দটাই পরীক্ষা করছে। তারপর চোখ খোলে একবার, সবায়ের মুখের ওপর দিয়ে বুলিয়ে নেয় চোখ, তারপর আবার চোখ বুজে শুরু করে, “আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণধুলার তলে”।
গান শেষ করে চোখ যখন খোলে কাজী, নিস্তব্ধ ঘরে আবিষ্ট কয়েক জোড়া চোখ নিবদ্ধ ওর দিকে। কয়েক মুহূর্তের নিস্তব্ধতা ভেঙে হঠাৎ ঢং ঢং ঘন্টা শোনায় কলেজ স্ট্রিটে চলন্ত এক ট্রাম। শহীদুল্লাহ্ বলেন, এমন গান শিখলেন কার কাছে?
নজরুলকে জবাব দিতে না দিয়ে মুজফ্ফর আহ্মদ বলে ওঠেন, নিজের কাছেই। ও যখন প্রথম এখানে আসে তখন ওর সঙ্গে যা যা ছিল তারই মধ্যে ছিল বিরাট এক রবীন্দ্রসঙ্গীতের স্বরলিপির বই। ওই স্বরলিপির জোরেই রবীন্দ্রনাথের গান শিখেছে ও। আর রবীন্দ্রনাথের এত গান ওর মুখস্থ যে ওকে আমি একটা উপাধি দিয়েছি, রবীন্দ্রসঙ্গীতের হাফিজ।
তাহলে হয়ে যাক আর একখানা, বলে ওঠেন মোহিতলাল।
হ্যাঁ, আর একখানা গাইব। তবে রবীন্দ্রনাথের নয়। মিঞা-কি-মল্লার। হিন্দিতে, বলে কাজী।
চোখ বুজে গানটা ধরে সে, “পিয়া বিনা মোর জিয়া না মানে/ বদরি ছাইয়ি রে”।
একই পংক্তি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে গায় বারবার, মন্ত্রমুগ্ধের মতো বসে থাকে ঘরের সবাই। মিনিট পনেরো পর যখন চোখ খোলে কাজী, এক মুহূর্তের জন্যে নিস্তব্ধ ঘর, তারপর স্বতঃস্ফূর্ত হাততালি। হাততালি থামলে হারমোনিয়মটা বন্ধ করতে করতে হঠাৎ দরজার দিকে চোখ যায় কাজীর, সেখানে নিঃশব্দে প্রস্তরবৎ দাঁড়িয়ে পিংলা।
কখন এলি?
এই তো। সিঁড়ি ভেঙে উঠে ভেজানো দরজাটা খুলে ঢুকতে যাব, দেখি তুমি চোখ বুজে গান গাইছ, আর সবায়ের চোখ শুধু তোমার মুখের দিকে, কেউ কোন শব্দ করছে না। আমিও তাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলুম এখানেই।
বেশ করেছিস, ভেতরে আয়, বলতে বলতে পিংলার দিকে এগিয়ে যায় কাজী, ওর ঘাড়ে হাত দিয়ে ভেতরে নিয়ে আসে, পরিচয় করিয়ে দেয় সবার সঙ্গে, এ পিংলা, আমার বন্ধুও, ছোট ভাইও। মুজফ্ফর আহ্মদ, পবিত্র গাঙ্গুলি আর শৈলজানন্দ ছাড়া কেউ ওখানে চেনে না পিংলাকে, কাজেই পিংলার সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেয় কাজী, করাচিতে আমাদের ব্যারাকে থাকত, যদিও কম্ব্যাটান্ট সেপাই ছিল না ও। এখন ব্যারাক ভেঙে গেছে, আমাদের মতো ও-ও চলে এসেছে এখানে। ও এখন হাওড়ায় আমাদের ‘দৈনিক নবযুগ’-এর সোল সেলিং এজেন্ট।
এ খবরটা পবিত্রর জানা ছিল না, শৈলজানন্দরও।
পবিত্র বলল, কবে থেকে?
কাজী উত্তর দেবার আগেই উঠে দাঁড়ান ডঃ শহীদুল্লাহ্, বলেন, আমার এবার যাবার সময় হল। যাবার আগে একটা কথা তোমাকে বলি কাজী। আমার মনে হয় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে এখন তোমার পরিচয় হওয়া দরকার। সুধাকান্তবাবু বলেছেন রবীন্দ্রনাথ নিজেও তোমার সঙ্গে পরিচিত হতে চান। কবে যে ওঁকে পাওয়া যাবে আমি ঠিক জানি না। শুনেছি, বিদেশ থেকে কয়েকদিন আগে ফিরেছেন। ইদানীং প্রায়ই বিদেশে যাচ্ছেন, কাজেই এর পরের বিদেশ যাত্রার আগেই ধরতে হবে। আমি যোগাযোগ করছি, এক-দেড় মাসের মধ্যেই ধরতে চাই। জোড়াসাঁকোয় নয়, চেষ্টা করব শান্তিনিকেতনে গিয়ে দেখা করতে, সেখানে উনি অনেক খোলামেলা। তুমি আমার সঙ্গে আসবে তো?
আসব না মানে? শান্তিনিকেতনে যাওয়া মানে তো আমার তীর্থ দর্শন। ছেলেবেলা থেকে রবীন্দ্রনাথকে পুজো করেছি। এখন দেবদর্শনের সুযোগ কি ছাড়তে পারি?
পিংলা বলে ওঠে, আমাকেও নিয়ে যেও কাজীদা, অনেকদিন আগে হাওড়া ময়দানে কংগ্রেসের এক সভায় শরৎচন্দ্রকে দেখেছিলুম মঞ্চে, কিন্তু প্রণাম করতে যেতে সাহস হয়নি। শান্তিনিকেতনে যদি রবীন্দ্রনাথকে সামনা-সামনি দেখতে পাই, প্রণাম করার সাধটা মিটিয়ে নেব।
ঠিক আছে ঠিক আছে, সে হবে’খন, হাসতে হাসতে বেরিয়ে যান শহীদুল্লাহ্, আর তাঁর পেছন পেছন যোগীন চাটুজ্জে, আফজালুল হক, কাজী আবদুল ওদুদ, আর আরও কয়েকজন। মোহিতলাল ওঠেন না, বলেন, আমি কাজী সাহেবের সঙ্গে আর একটু গল্প করে যাব।
সবাই চলে গেলে মুজফ্ফর আহ্মদ বললেন, ব্যাপারটা কী হল? পিংলা কবে থেকে ‘নবযুগ’-এর সোল সেলিং এজেন্ট হল? পিংলা বলল, আমিও তো বুঝলুম না সেটা।
কেন বুঝলি না? – নজরুল ধমকায়, তোকে তো আমি বলেই ছিলুম ব্যবস্থা হয়ে যাবে। পুরোনো সাইকেল একটা জোগাড় করবি বলেছিলি, করেছিস?
কিন্তু কাজী, ব্যবস্থা করে ও করবেটা কী ? দুবে তো বলেছে অন্তত একশো টাকা জমা না রাখলে অতগুলো কাগজ ও ধারে দেবে না, মুজফ্ফর বলেন।
সে তো দর বাড়িয়ে বলেছিল। আমি চেপে ধরতে শেষ পর্যন্ত বলেছে, পঞ্চাশ টাকাতেই হবে।
তা-ই বা পিংলা পাবে কোথায়? পঞ্চাশ টাকা কম হল?
আফজালুল হকের তক্তপোশ লাগোয়া একটা টুল ছিল, খানিকটা বেড-সাইড টেবিলের মতো। সেখানে কাচের জগে খানিকটা জল, পাশে একটা গেলাস। মুজফ্ফরের কথার উত্তর সঙ্গে সঙ্গে না দিয়ে হেঁটে টুলটার কাছে যায় কাজী, জগ থেকে জল ঢেলে গেলাসটা ভর্তি করে, ঢক ঢক করে খেয়ে নেয় সবটা। মুজফ্ফরের দিকে ফেরে তারপর, মনে আছে তুমি আমায় পঞ্চাশ টাকা দিয়েছিলে?
আমি? পঞ্চাশ টাকা? কোথায় পাব? একসঙ্গে পঞ্চাশ টাকা দেখিইনি কতদিন।
দিয়েছিলে দিয়েছিলে। মনে করিয়ে দিচ্ছি তোমায়। পল্টন থেকে যখন লেখা পাঠাতুম তোমার কাছে, সেগুলো ছাপানো হত ঠিকই, কিন্তু তার বদলে টাকা পাব এ-কথা ভাবিনি কখনো, পাইওনি। ফিরে এসে আস্তানা গাড়লুম এই বত্তিরিশ নম্বরে। সবাই ছিলেন, সবায়ের সঙ্গে আলাপ-পরিচয়, হৈ হৈ, সবই হল। কিন্তু তোমাদের সাহিত্য পত্রিকার একজন ছিলেন না এখানে তখন। মনে পড়ছে? মঈনুদ্দিন হুসয়ন সাহেব। তিনি তখন বিশেষ কাজে তাঁর দেশের বাড়িতে।
উত্তেজনায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে মুজফ্ফর আহ্মদের চোখ দুটো। ঠিক ঠিক, বলে ওঠে সে, এখন মনে পড়ছে। একটা মুখবন্ধ খাম হুসয়ন সাহেব পাঠিয়েছিলেন আমায় রেজিস্ট্রি করে। তোমাকে খামটা দিয়ে দিতে বলেছিলেন। পঞ্চাশ টাকা ছিল তাতে, হ্যাঁ, পঞ্চাশই। কিন্তু, এতদিন পর সে টাকাটা আবার পেলে কোথা থেকে? খরচ হয়ে যায়নি?
যায়নি। পিংলার ভাগ্যেই যায়নি। খামটা আমি হারিয়ে ফেলেছিলুম। ভয়ে তোমাকে বলতেও পারিনি। গতকাল সকালে দুবের সঙ্গে কথা বলে, ওকে পঞ্চাশ টাকায় রাজি করিয়ে, বাড়ি ফিরেছি। মনে মনে খুব অসহায় দুশ্চিন্তা। পঞ্চাশ টাকাই বা পাই কোথায়? অথচ আজ পিংলার আসার কথা, ওর সঙ্গে কাল সকালে হাওড়ায় যাব, ওদের পাড়ায় এক বস্তিতে গান শোনাবার কথা আছে আমার। ওকে বলেছিলুম, ওর একটা ব্যবস্থা আজকের মধ্যেই করব। কী যে করি! ফজলুল হক সাহেবের কাছে ধার চাইব? উনি দেবেন কি? এইসব ভাবতে ভাবতে আমার সব অশান্তির আরাম ‘সঞ্চয়িতা’, সেটা খুলেছি। খুলতেই দেখি একটা খাম, যত্ন করে রেখে-দেওয়া সঞ্চয়িতার ভাঁজে। তার মধ্যে জলজ্যান্ত পঞ্চাশটা টাকা জ্বলজ্বল করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে!
মোহিতলাল এতক্ষণ আফজালুলের তক্তপোশে বসে নজরুলের কথা শুনছিলেন। কোনও কিছু না ভেবে প্রায় যন্ত্রের মতো উঠে দাঁড়ান তিনি, জড়িয়ে ধরেন তাকে। নজরুল দীর্ঘকায়, মোহিতলাল তা নন। আলিঙ্গনাবদ্ধ অবস্থাতেই মোহিতলালকে নিয়ে তক্তপোশে বসে পরে নজরুল।
আবেগে প্রায় বুজে এসেছে গলা, মোহিতলাল বলেন, আপনি শুধু বড় কবি নন কাজীসাহেব, বড় মাপের মানুষও। বাঙালির ভাগ্যে আপনি বাংলার ঘরে জন্মেছেন।
মোহিতলালের হাতটা ধরে উঠে দাঁড়ায় নজরুল, হা হা করে হেসে উঠে বলে, চলোপ্পানসি,
সিঁড়ি বেয়ে তর তর করে নামতে থাকে সবাই।