ভূদেবদা বললেন, সুবর্ণসুযোগ। তুমি তো মানুষের কাছেই পৌঁছোতে চাইছিলে জয়ি। নিলীনবাবুকে আমি চিনিনা, কিন্তু যে প্রকাশকের নাম তুমি বললে তারা যদি ছাপায়, ও বই বিক্রী হবে। বাঙালি গুণীজনের হাতে পৌঁছোবে বইটা, পত্রপত্রিকায় আলোচনা-সমালোচনা বেরোবে। ভালো ভালো লাইব্রেরিতে, কলেজ-য়্যুনিভার্সিটিতে, পৌঁছোবে। এক কথায়, বাঙালিদের মধ্যে চিন্তাশীল-বুদ্ধিজীবি যাঁরা, তাঁরা অনেকেই তোমার কাজের এবং নামের সাথে পরিচিত হবেন। এটা ঠিকই, ঠিক আর্ট-ক্রিটিকের আলোচ্য তুমি হয়ে উঠবে না এই বইয়ের মাধ্যমে, কিন্তু যত লোক তোমার সম্বন্ধে জানবে, সেটা ফেলনা কিছু নয়।
যে চারটে ছবি নিলীন দেখেছে খবরের কাগজে, তার মধ্যে একটা বিক্রি হয়ে গেছে, বললো জয়ি। বাকি তিনটে যদি ও চায়, দেবো কীভাবে? সব ছবিই তো এগজিবিশনের জন্যে মাউন্ট করে ফ্রেম করা হয়েছিলো।
সেটা একটা কথা বটে। সেই অরিজিনালটাই যদি চায় তোমাকে হয়তো আবার ফ্রেমমুক্ত করতে হবে ছবিটা। তবে তুমি তিরিশটাই তো আঁকোনি, অনেক এঁকেছিলে। সেগুলোও তো পছন্দ হতে পারে ওঁর। আর তাছাড়া, তোমার এগজিবিশনের ছবিই যদি ওঁর পছন্দ হয়, নিজের ছবির একটা নকলও তো এঁকে দিতে পারো তুমি।
তাহলে দিয়েই দি, কী বলেন?
আমি তো বললামই, সুবর্ণসুযোগ। এটার পর বলতেই হয় বোম্বের এগজিবিশনের ফল তুমি একেবারে হাতে গরমে পেতে শুরু করেছো!
সুদেশ বললো, তাহলে চলো, বাইরে বেরিয়ে নিলীনবাবুকে একটা ফোন কোরে আসা যাক। বেরোবার জন্যে ভূদেবের অনুমতি নিতে গেলে ভূদেব বললো, ফোনটা তো এখান থেকে করলেই পারতিস। মেদনীপুরে অত সহজে লাইন পাবি নাকি? ডায়াল করতে করতে আঙুলে ব্যথা হয়ে যাবে। তার চেয়ে অপারেটরকে বল্ নিলীন মিত্রকে লাইনে ধরে আমার ঘরে দিয়ে দিতে। আমি ডেকে দেবো তোদের।
নিলীন জিজ্ঞেস করে, আপনি কোথায়? কোথা থেকে কথা বলছেন এখন?
কলকাতায়, বললো জয়ি।
আপনি যদি আজকের দিনটা থেকে যেতে পারেন, আমি কাল সকালেই পৌঁছোতে পারি।
আমি এখানেই আছি এখন, কিন্তু আমার সব ছবি তো এখানে নেই। বোম্বের এগজিবিশন থেকে যে ছাব্বিশটা ফেরত এসেছিলো শুধুমাত্র সেগুলোই আছে।
ঠিক আছে, আপাতত সেগুলোই দেখা যাক। তা ছাড়া পাবলিশারের সাথেও কথা বলিয়ে দেওয়া যাবে আপনাকে। বাকি ছবি দেখার দরকার হলে পরে দেখা যাবে।
ঠিক হলো পরের দিন বেলা বারোটা নাগাদ সুদেশের বাড়িতে আসবে নিলীন, ছবিগুলো সুদেশের বাড়িতেই রয়ে গেছে বোম্বে থেকে ফেরার পর থেকে। অতগুলো ছবি তো আর কোথাও টেনে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়, তাই সুদেশের বাড়িতেই।
সুদেশের বাড়িতে কখনও যায়নি জয়ি, তার একটু সঙ্কোচ হয়। সুদেশ বলে, মা তোমার ব্যাপারে সবই জানে, চিন্তা নেই কিছু তোমার। তোমার ছবির এগজিবিশনের জন্যেই আমরা বোম্বে গিয়েছিলাম, তা-ও জানে মা। মা-র শুধু একটাই ক্ষোভ, সেটাই বলে আমাকে মাঝে মাঝে: আমি বেঁচে থাকতে থাকতে বিয়েটা করছিস না তোরা, মরার আগে বৌটাকে একবার চোখের দেখাটাও দেখে যেতে পারবো না। তা, সে আক্ষেপও কেটে যাবে এবার, তোমাকে দেখে নেবে কাল !
সেটাই কথা, ছেলের অবিবাহিতা বৌ হয়ে যাওয়া !
ও কিছু নয়, মা হয়তো তোমাকে খেয়ে আসার কথা বলতে পারে, পারলে সেটা মেনে নিও।
যেমনটা কথা ছিলো, পরের দিন ঠিক সকাল দশটায় প্রাচী সিনেমার সামনে আসে জয়ি। জয়িকে দেখে প্রায় চেনাই যায় না, বহুদিন পর শাড়ি পরেছে সে, মুখে হালকা প্রসাধনও।
একটু হেসে সুদেশ বলে, পাশেই বাজার, চাইলে এখ্খুনি গোড়ে মালা কেনা যায়। দেখো, চান্স নেবো?
কোন কথা না বলে সুদেশের দিকে চোখটা তুলে একটু হাসে জয়ি। চোখটা তুলে ! এ চোখ কী আগে কখনও দেখেছে সুদেশ ! এক মুহূর্তের জন্যে নিজের শরীরের উপর যেন নিয়ন্ত্রণ হারায় সে, একটা শিহরন বুঝি ! তারপর বলে, চলো।
সুদেশের বাড়ি সারপেন্টাইন লেনে। মিনিট তিনেক হেঁটেই ওরা পৌঁছিয়ে যায়। ঠিক এরকম বাড়ি কখনও দেখেনি জয়ি। ছোট দরজাটা প্রায় রাস্তার ওপর। সেটা দিয়ে ঢুকলে সামনেই একটা সিঁড়ি। সিঁড়িটা সিমেন্টের, যথেষ্ট অপরিসর, এবং পুরোপুরি শুকনো নয়। সিঁড়িটার আংশিক ভিজে থাকার কারণটা বুঝতে সময় লাগে না। সিঁড়ির পাশেই একটা খোলা জায়গা, জায়গাটা ভিজে, এবং সেখানে দু-তিনটে লোহার বালতি। খোলা জায়গাটার শেষে প্লাস্টার-খসা যে দেয়ালটা ওপরে উঠে গেছে, রং-চটে যাওয়া সেই দেয়ালের নীচের অংশে খানিকটা ক্ষয়ে যাওয়া একটা দরজা। বোঝা যায় ওটার ভেতরটায় স্নান করার জায়গা, যেখানে কোন জানলা আছে বলে অন্তত বাইরের থেকে বোঝা যায় না। খোলা জায়গাটা ভেজা কেন, এবং কেনই বা ওখানে বালতিগুলো, সেটা বোঝা যায় এবার। পুরুষরা ব্যবহার করে খোলা জায়গাটাই, এবং মেয়েরা নেহাতই উপায়ান্তরহীন হয়ে বন্ধ বাথরূমের বদ্ধ পরিসরে কাজটা সারতে বাধ্য হয়। তারপর ভিজে পায়ে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে সিঁড়িতে রেখে যায় জলের চিহ্ণ। সুদেশ সাবধান করে জয়িকে, একটু সাবধানে উঠো। ওপরে উঠেই একটা বারান্দা, সেখানে সিঁড়ির সামনেই দাঁড়িয়ে আছেন সুদেশের মা, জয়িকে দেখে হেসে বলেন, এসো মা। ওদের স্টীল-প্লান্টের শহরের বন্ধুদের মায়েদের তুলনায় এই মা-র চেহারা অন্য রকম। তুলি বা জুঁই-অনলাভ বা সুজয়ের মায়েদের চেহারায় এক ধরণের পালিশ আছে, যে পালিশটা এমনকী কালিঘাটের জ্যাঠাইমার চেহারাতেও, সে কী কলেজে-পড়া পালিশ ! জয়ির নিজের মা একেবারে অন্যরকমের। বয়েসের তুলনায় অনেক বুড়িয়ে যাওয়া সে চেহারায় স্থায়ী দুঃস্থতার যে ছাপ তা এখনকার অপেক্ষাকৃত আর্থিক স্বাচ্ছল্যও মুছে দিতে পারে না। কিন্তু সুদেশের মা এঁদের সবায়ের থেকে আলাদা। পরিষ্কার সাদা থান পরা, ঈষৎ ঝুঁকে পড়া মানুষটা ফর্সা, মুখের হাসিটা এমন মায়া জড়ানো যে দেখলেই কতদিনের চেনা বলে মনে হয়। স্বামীর মৃত্যুর পর তাঁর দারিদ্রজনিত জীবনসংগ্রামের কথা শুনেছে জয়ি সুদেশের মুখে, অথচ দেখে মনে হয় পৃথিবীর কারো উপর কোন অভিযোগ নেই তাঁর। জয়ি পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে তাঁকে, তারপর তাঁর পিছন পিছন ঢুকে পড়ে একটা ঘরে।
ঘরটায় দুয়েকটা চেয়ার আর শান্তিনিকেতন প্যাটার্ণের দুটো মোড়া। একধারে দেয়াল-পর্যন্ত-ঠেলে-দেওয়া একটা তক্তপোশ, সেটা জুড়ে একটা মাদুর। এক কোনে চারটে পিচবোর্ডের বাক্স, অ্যাঢেসিভ টেপ দিয়ে বন্ধ, একটার ওপর একটা দাঁড় করানো। জয়ির ছবিগুলো বোম্বে থেকে ফেরত এসেছিলো এতে, খোলা হয়নি।
বারোটা বেজে গিয়ে একটা বেজে গেলো, নিলীন আসেনি এখনও। সুদেশের মায়ের ক্রমাগত অনুরোধে ওরা খেতে বসে যায়। খাওয়ার জন্যে আলাদা কোন জায়গা নেই এখানে। বাড়িতে ঢুকে প্রথমেই যে ঘরে বসেছিলো ওরা, তারই পাশে আর একটা ঘর, আর তার পরেই ছোট এক চিলতে একটা রান্নাঘর। পাশের ঘরটাই এ বাড়িতে বড়ো, সেখানে পুরোনো আমলের একটা খাট পাতা, তাতে পরিপাটি বিছানা করা। নীচে পাশাপাশি চাটাইয়ের আসন পাতা হয়েছে দুটো। সুদেশ আর জয়ি বসে সেখানে, সুদেশের মা পরিবেশন করেন। ভাত-শুক্তো-ডাল-বেগুনভাজা-মাছ-আমের অম্বল দিয়ে রোজকার তুলনায় অনেক বেশি আইঢাই খাওয়ার পর জয়ি বলে, এবার বোধ হয় ঘুমোতে হবে।
নিলীন আসেনি এখনো। সুদেশ বলে, আমি একটু বাইরে বেরিয়ে দেখি। সুদেশ বাইরে যায়, জয়ি জোর করে খাওয়াতে বসে সুদেশের মাকে। তাঁরই নির্দেশ মতো এ মীটসেফ, ওই আলমারি, সেই তাক থেকে থালাবাটি-ভাত-ডাল-তরকারি বের করে যত্ন করে পরিবেশন করে খাওয়ায় তাঁকে। খাওয়ার পর একটা একটা করে ওর ছবিগুলো বের করে দেখাতে থাকে খুশিতে ভরপুর এই বৃদ্ধাকে।
ঘন্টাখানেক পর নিলীনকে সঙ্গে নিয়ে ফেরে সুদেশ। সকালবেলা আমহার্স্ট স্ট্রীটে এক বন্ধুর বাড়িতে গিয়েছিলো নিলীন। তাকে নির্দেশ দেওয়া ছিলো সন্তোষ মিত্র স্কোয়ারে পৌঁছিয়ে সারপেন্টাইন লেন খোঁজ করার। কলকাতার রাস্তাঘাটে অনভ্যস্ত বেচারা রাস্তা গুলিয়ে ফেলে কিছুতেই সন্তোষ মিত্র স্কোয়ার খুঁজে পাচ্ছিলো না। অবশেষে একজন বয়স্ক ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করায় বোঝা গেলো সে সন্তোষ মিত্র স্কোয়ারের কাছাকাছিই ছিলো, কিন্তু পুরোনো সেন্ট জেম্সের নামেই এখনো পার্কটাকে চেনে স্থানীয় লোকজন, তাই এই বিভ্রাট। ভদ্রলোক বিরক্ত হয়ে বললেন, এই হয়েছে এক কায়দা আজকাল। চৌরঙ্গীতে দাঁড়িয়ে জহরলাল নেহরু রোড খোঁজ করুন না, কেউ দেখাতে পারবে না!
এমনকি সারপেন্টাইন লেনেও বয়স্ক ভদ্রলোক সঙ্গে কোরে নিয়ে আসছিলেন ওকে, এমন সময় সুদেশের সঙ্গে দেখা।
বাড়িতে ঢুকলো যখন ওরা, ছবিগুলো সুদেশের মাকে দেখাচ্ছিলোই জয়ি। নিলীনও বসে গেলো।
গোটা পাঁচেক ছবি পছন্দ করলো নিলীন। তারপর বললো, চলুন না আমার পাবলিশারের কাছে যাই। দেখা যাক্, কটা ছবি সে দিতে রাজি হয়। তা ছাড়া আপনার টার্মসটাও তো ঠিক করতে হবে। সে সব হয়ে গেলে সেই অনুযায়ী কোন্ কোন্ ছবি, কটা ছবি, ফাইনালাইজ করবো।
পাবলিশার ভদ্রলোক নিলীনকে বললেন, আপনার বই, কতগুলো ছবি দেবেন, কোথায় কোথায়, সে সব আপনার সিদ্ধান্ত। তবে আপনি যা বলছেন, তাতে তো মনে হচ্ছে না আপনি ছোট ছোট ইলাস্ট্রেশনের কথা ভাবছেন। যতগুলো ছবি দেবেন সেই অনুযায়ী পাতার সংখ্যা বাড়বে, দামও। আপনার সাথে যা টার্মস তা-ই থাকবে, সেখানে কোন অদল-বদল করছি না। আর প্রচ্ছদ আর সাধারণ অলঙ্করণের জন্যে আর্টিস্টের সাথে কথা হয়েই গেছে, সেটাও কিন্তু বদলাচ্ছি না। জয়মালিকা দেবীর সাথে আমি আলাদা করে বসবো, টার্মসের জন্যে আটকাবে না। তারপর একটা দম নিয়ে বললেন, আর হ্যাঁ, রঙীন ছবি চলবে না, লাইন-ড্রয়িং করবেন, না হলে ছাপার খরচ বেড়ে গিয়ে সব এস্টিমেট ওলোটপালোট হয়ে যাবে।
পাবলিশারের সাথে কথা শেষ করে কফি হাউজে ঢোকে ওরা। নিলীন জিজ্ঞেস করে, খাড়িয়াদের নিয়ে কতো ছবি এঁকেছেন আপনি?
অনেক, তা শ দেড়েক তো হবেই।
এত? এত ছবি কী আঁকলেন, কী ভাবে?
কীভাবে চোরোর সাথে আলাপের সূত্রে খাড়িয়াদের গ্রামে পৌঁছোলো ও, দু দফায় ওদের সাথে ওদের গ্রামে কাটালো, ফাগু উৎসব, বিয়ে, মধু-সংগ্রহের অভিজ্ঞতা আর ক্যামেরায় ছবি তুলে নেওয়া, সব কিছুই শোনালো নিলীনকে। নিলীন জিজ্ঞেস করে, আপনাদের শহরে যাওয়া যাবে? সব ছবিগুলো দেখা যাবে?
জয়ি বললো, কেন নয়? চলে আসুন না। ছোটখাটো একটা গেস্ট হাউজ আছে, আগের থেকে খবর দিলে বুক করে রাখতে পারি। তারপর সুদেশের দিকে তাকিয়ে বললো, এই সুযোগ। এবার তুমিও এসো একসাথে।
সেটাই ঠিক হলো। সুদেশ আর নিলীন একসাথেই যাবে। সুদেশ কবে ছুটি পেতে পারে জেনে নিয়ে নিলীনকে জানিয়ে দেবে।
হাতের ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে নিলীন বললো, আমি তাহলে উঠি আজ। এখন বেরিয়ে গেলে ফিরে যাওয়ার ট্রেন পেয়ে যাবো।
বললো বটে উঠি, কিন্তু ঠিক তখনই উঠলো না ও। অনেকক্ষণ ধরেই কিছু একটা বলার চেষ্টা করছিলো নিলীন, কিন্তু খানিকটা সঙ্কোচেই বোধ হয় বলা হয়ে উঠছিলো না। একটু ইতস্তত কোরে এবার বলেই ফেললো, সরাসরি জয়ির দিকে তাকিয়ে, আচ্ছা, আপনার পদবি কী? আলাপ হওয়ার পর থেকে শুধু জয়মালিকাই শুনছি, কিন্তু পদবিটা?
পদবি দিয়ে কী করবেন? আমি শুধু জয়মালিকাই বলি।
তা বলুন, কিন্তু একটু কৌতূহল হচ্ছে। যদি মনে হয় সীমানা লঙ্ঘন করে অহেতুক কৌতূহল দেখাচ্ছি তাহলে না হয় না-ই বললেন।
সেন। আমার নাম জয়মালিকা সেন।
সেটাই ভাবছিলাম। চেহারা দেখে সেরকমই মনে হচ্ছিলো, উচ্চ বর্ণের বাঙালি। কিন্তু যে কাগজটায় আপনার ছবিগুলো দেখেছিলাম তারা লিখেছিলো আপনি নাকি ট্রাইবাল।
হ্যাঁ, ট্রাইবালই তো।
মানে? এদিকে বলছেন সেন, আবার ট্রাইবাল !
হুঁ, প্রশ্ন উঠতেই পারে আপনার মাথায়, বিশেষ করে আপনি যখন য়্যুনিভার্সিটির অ্যানথ্রোপলজির প্রফেসর !
সে আপনি যা-ই বলুন, রহস্যটা কিন্তু থেকেই যাচ্ছে।
তাহলে শুনেই নিন, একসাথে কাজ করার সিদ্ধান্ত যখন নেওয়া হয়েই গেছে আপনাকে অন্ধকারে রেখে লাভ নেই। আসলে আমার ঠাকুরদা, মানে বাবার বাবা, সম্ভবত স্বাধীনতা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে পুলিশের নজর এড়াতে এক ওরাওঁ ট্রাইবাল অঞ্চলে পালিয়ে যান, সেখান থেকে আর ফেরেননি তিনি। শেষ পর্যন্ত তিনি বিয়ে করেন একটি ওরাওঁ মেয়েকে। কনের নাম শুনবেন? ইন্টারেস্টিং। কীবা। মানে —
তুষার। ওরাওঁদের ভাষার নাম কুরুখ। সেই কুরুখ ভাষায় কীবা মানে তুষার। আনইউজুয়াল নাম। মেদনীপুর-বাঁকুড়া-পুরুলিয়ায় বিস্তর ওরাওঁ পরিবার থাকে। সাঁওতালদের মতো অত না হলেও অনেক। উত্তরবঙ্গ এবং আসামেও এদের অনেককেই চা-বাগানের কুলির কাজের জন্যে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো, এখনও আছে অনেক। আমি অনেক মিশেছি এদের সাথে, কিন্তু কীবা নাম শুনিনি কোন মেয়ের।
বাবার কাছে শুনেছি ওরাওঁদের মধ্যে আমার ঠাকুমা একটু ফর্সা গোছের ছিলেন, তাই বোধ হয় তাঁর এরকম নাম দেওয়া হয়েছিলো।
ট্রাইবাল লিঙ্কটা বুঝলাম। কিন্তু আপনার চেহারায় আপনার ঠাকুমার ছাপ নেই একটুও।
আমার বাবার চেহারায় আছে। একেবারেই ট্রাইবাল চেহারা, তাই সহজেই মিশতেও পারে ওদের সাথে। কিন্তু আমার মা ব্রাহ্মণকন্যা, আমার এক পাতানো-দাদুর কাছে শুনেছি গরীবের মেয়ে, কিন্তু যৌবনে অসাধারণ সুন্দরী ছিলেন।
বোঝা যাচ্ছে আপনাদের বংশে সবাই মাতৃমুখো, হেসে বলে নিলীন।
একসাথেই বেরিয়ে এলো ওরা। নিলীন গেলো হাওড়ার বাস ধরতে, জয়ি আর সুদেশ ঝালমুড়ি কিনে কলেজ স্কোয়ারের এক বেঞ্চে বসলো।
জানো, আজ তোমাদের বাড়িতেই ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে।
আমাদের বাড়িটা লক্ষ্য করেছো ভালো কোরে?
কী লক্ষ্য করার কথা বলছো, তোমাদের ঐ বাথরূম?
বাথরূমের কথা বলছি না তোমাকে, ওসবে তোমার অসুবিধে হয়না আমি জানি। বাড়ির ভেতরটা নয়, বাড়ির বাইরেটার কথা বলছি।
বাইরেটা মানে?
যদি ভালো কোরে খেয়াল করো তাহলে দেখবে একশো ছাপ্পান্নোর এক থেকে একশো ছাপ্পান্নোর পাঁচের কিউয়ের চোদ্দ পর্যন্ত পার্টিশন করা বাড়িটা প্রায় একশো বছর আগে যিনি তৈরি করেছিলেন, তিনি কতো বড়ো বাড়ি হাঁকিয়েছিলেন। এখন অগুন্তি শরিকের, তাদের বংশধরদের, বংশধরদের ভাড়াটেদের এবং খদ্দেরদের মিলিয়ে ঐ একশো ছাপ্পান্নো নম্বর বাড়িটার জনসংখ্যা যে কতো তা কোন এক জন লোকের পক্ষে বলা শক্ত। অথচ ঐ জনসংখ্যার প্রায় সবাই এরই মধ্যে জেনে গেছে, সুদেশের সাথে একটি মেয়ে আজ একশো ছাপ্পান্নোর তিনের সি-তে ঢুকেছিলো, এবং প্রায় ছ ঘন্টা একটানা বাড়ি থেকে বেরোয়নি। এদের মধ্যে কেউ কেউ কোন আশ্চর্য যাদুবলে এও জেনেছে যে মেয়েটির নাম জয়মালিকা এবং সে আর্টিস্ট। এবং আমি আশ্চর্য হবো না – তুমি-আমি জানি বা না-ই জানি – এদের মধ্যে কেউ কেউ ঠিক কতো তারিখে কোন্ লগ্নে জয়মালিকার সাথে সুদেশের বিয়ে হবে তা-ও যদি জেনে বসে থাকে ! এবং এরা যে এত কিছু জানে, অতি ক্ষিপ্র এবং অব্যর্থ কোন বার্তাবাহী মাধ্যম আমার মাকে এর মধ্যেই নিশ্চিতভাবে এ ব্যাপারে অবহিত করেছে। এই হচ্ছে কলকাতা শহরের নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘিঞ্জি অঞ্চলের সংস্কৃতি। ওখানেই তোমার ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে?
আমার কী ইচ্ছে করছে আমি বলেছি। তুমি নিয়ে যেতে চাও না তা-ই বলো।
জয়ি, তুমি কবে আমাদের বাড়িতে – অবিবাহিতা নয় – বিবাহিতা বৌ হয়ে আবার যাবে তার জন্যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে আমার মা।
এককথায় অসাধারণ, নেশা হয়ে যাচ্ছে
দুর্দান্ত