আমাদের ছোটবেলায় মানে সত্তর দশকের শুরুতে বা শেষেও তো মোবাইল দূরে থাক ভিডিও-ও রাজ করতে শুরু করেনি। এলাকায় প্রথম টিভি এল, মানে প্রথম দুটো বিধানসভা এলাকায়; পেলে যখন খেলতে এলেন কসমস ক্লাবের হয়ে কলকাতায়। বেকেনবাউয়ার আমার খুব পছন্দের খেলোয়াড়। খেলা না দেখেই। কাগজে আর খেলার পত্রিকায় পড়ে। তখন তো তাই হতো। এ সেরা সে সেরা সব শুনে বা পড়ে। (এখন তো শুধুই শুনে বা হোয়াটসঅ্যাপ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে)। আমাদের বাড়ি থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে সেহারার লায়কাবাজারে মিল মালিক দুর্গা তা-র বাড়িতে টিভি এল। সে টিভি খেলার দিন দোতলার টাঙিয়ে দিলে। সে দেখতেও নাকি হাজার হাজার ভিড়। কেউ গেল খেলা দেখতে, বেশিরভাগ গিয়েছিলেন,আমার ধারণা, টিভি দেখতে।
এ-সব বাবার মতে আদেখলাপনা।
আর আমাদের সেসব করা বারণ।
তাই পেলে বেকেনবাউয়ার দেখা হল না। গেলেও যে হতো তার মানে নেই। তবে রেডিওতে এমনভাবে বললে, সে খেলা দেখাই হল।
পেলের পুরো নাম বলা ছিল তখন বাহাদুরির ব্যাপার। জিজ্ঞেস করার লোকেরও অভাব ছিল না।
কুইজ নাম শুনিনি তখন। বলা হত জেনারেল নলেজ। সেই নলেজের পরীক্ষা নিয়ে আপনার লেজ কাটার জন্য পথে ঘাটে কতজন তৈরি।
এই খোকা কোন ক্লাসে পড়িস?
বললেন।
সঙ্গে সঙ্গে, বল দেখি তবে, বলেই একটা বেমক্কা প্রশ্ন।
ইংরেজি, অঙ্ক বা জেনারেল নলেজ।
সিনেমা নিয়ে প্রশ্ন করতো না কেউ। কিন্তু সিনেমা দেখার আগ্রহ ছিল খুব। বায়োস্কোপে ১০ পয়সা দিয়ে দিল্লি তাজমহল দিলীপ কুমার সায়রা বানু, মীনা কুমারী, তাজমহল দেখে কী আর মন ভরে।
বায়োস্কোপের ব্যাপার ছিল এমন: বায়োস্কোপওয়ালা হাতল ঘোরাবেন আর বলে চলবেন:
চলে গেল চলে দিলীপ কুমার চলে গেল। সায়রা বানু চলে এল, সায়রা বানু চলে গেল, বৈজয়ন্তীবালা চলে এল। ড্যান্স দেখো ড্যান্স দেখো।
তবে চটের হলে সিনেমা হতো মাঘ থেকে চৈত্র মাসে।
নুরপুর পলাশন বৈঠারি ধারানে চটের সিনেমা হতো। মানে চট দিয়ে ঘিরে হল বানিয়ে। এক টাকা আর দু টাকা টিকিট। রঙিন হলে পয়সা বেশি।
ফুলেশ্বরী, ধন্যি মেয়ে, মৌচাক, দীপ জ্বেলে যাই, বালিকা বধূ, লালু ভুলু, রামের সুমতি, অগ্নীশ্বর, মরুতীর্থ হিংলাজ, সাড়ে চুয়াত্তর, যমালয়ে জীবন্ত মানুষ-- এইসব ছবি আসতো। হিন্দির মধ্যে 'হাতি মেরে সাথী'র খুব কদর। আর ছিল 'আনারকলি'। 'মুঘল ই আজম ' হবে হবে শুনতাম। একবার তো আমাদের গ্রামে হবে বলে দেওয়াল লেখাও হয়ে গেল। বাবার খুব প্রিয় ছবি। প্রিয় অভিনেতা দিলীপ কুমার। কিন্তু হল না। ডি এম অফিস থেকে নাকি তখন অনুমতি দিত। পাওয়া যায় নি। পরে অবশ্য আমাদের গ্রামে চটের হলে সিনেমা হয়েছে।
চটের সিনেমা হলে রিল ঘোরার একটা আওয়াজ হতো। মাঝে মাঝে কেটে যেত। সামনে দিয়ে কেউ হেঁটে গেলে পর্দায় তার ছবি দেখা যেত।
লোকে হাঁই হাঁই করে উঠতো। ছেলেমেয়েদের বসার জায়গা ছিল আলাদা। একসঙ্গে বসতে দিত না।
লোকে চোঙা ফুঁকতে আসতো, মহিলাদের বসিবার ও সাইকেল রাখিবার সুবন্দোবস্ত আছে। আপনারা সবাই যাবে।
যাবে। যাবেন নয়।
টেনে টেনে সুর করে বলতো।
আর রঙিন কাগজের লিফলেট ছড়াতো। আমরা বাচ্চারা সেই সাইকেলের পিছন পিছন ছুটতাম। আর পরে নকল করে বলতাম, আপনারা স বা ই যা বে এ এ এ।
বাড়ি বাড়ি এসে সিজন টিকিট বেচে যেতেন চেনা উদ্যোক্তারা।
গোলাপি ও সাদা রঙের কার্ড হতো।
তলায় দিনের খোপকাটা থাকত। গেটে কেটে নিয়ে ঢুকতে দিত।
বিদ্যুৎ নয় ডায়নামো বা জেনারেটরের সাহায্যে সিনেমা চলত। একদিকে সিনেমার রিল চলার আওয়াজ অন্যদিকে জেনারেটরের আওয়াজ। ঘ্যারঘ্যার।
তাতে কী, কেঁদে ভাসিয়ে দিতাম নায়ক নায়িকার দুঃখে।
'ধন্যিমেয়ে' আর 'ফুলেশ্বরী' মনে খুব দাগ কেটেছিল। দশম শ্রেণিতে 'দীপ জ্বেলে যাই' দেখে এক বন্ধু তো একজনের সঙ্গে প্রেম করেই বসল।
সেহারাবাজারে একটা টিনের তৈরি সিনেমা হল ছিল। সেখানে একবার 'শ্রীমান পৃথ্বিরাজ'। শুনে মনে হল, না দেখলে জীবন বৃথা।
কিন্তু সে সাহস ছিল না বলে সিনেমা যাওয়ার। তবে যাত্রা দেখেছি, রাতে লুকিয়ে পালিয়ে।ডাকাতের সামনেও পড়েছি।
সে গল্প পরে।
কত কত শব্দ হারিয়ে গেল। এখন তো সব বোরিং লাগে। আইঢাই করে না। খিদিবিদি লাগে না। খিদিবিদি মানে ছটফটানি।
এখন তো সেন্ট ওয়েল, সেন্টেড সোপ-- তখন বলা হত, বাসের সাবান, বাস তেল। গোবিন্দভোগ নয় খাস চাল বা বাস চাল। বাস মানে সুবাস। সুন্দর গন্ধ।
আলান্ত লাগত আমাদের। মানে ক্লান্ত। আরো কত কত শব্দ ছিল। কিছু পেশ করছি।
ঝিঙে --পড়ুল।
পৈঁঠে র বিকল্প শব্দ উসারা, পিঁড়ে, দাওয়া। আর দাওয়ার ধার কে বলতো ধারি।
সকালে নাস্তা, ১০ টার খাবারকে বলতাম, লাইরি, সময়কাল লাইরিবেলা। জলখাবার, পানিখাবারও চলতো।
কিছুজন মুখকে বলতো ব্যাঁত।
আঁত পড়ে যাওয়া ।
বৈঠকখানা-- দলিজ, খানকা।
শক্তিসাধন মুখোপাধ্যায় কথাপ্রসঙ্গে জানালেন এই শব্দগুলো:
কাঁটা ভুঁকে যাওয়া। ছেব গেলা। গ্যাঁড়া, গোড্ডিম ভাঙা, পেটে বাকর ঢোকা ....।।
উদয়শঙ্কর চট্টোপাধ্যায়ের কাছ থেকে মিলল:
এ নাচ ও নাচ, পারা, কেনে, জমিকে মাঠ বলা
কস্তুরী শোনালেন,
সকড়ি তোলা, পৈঁঠেয়ে বসা, নাবোয় বসা...
লাউ --কদু
আমরা
পেয়ারাকে বলতাম,আঞ্জির। বাড়ির পেছনকে পাঁদার।
মন খারাপ লাগলে কইতাম:
উদাস লাগছে।
আমার বাঙালিনী বন্ধু এই বিষয়ে লিখছি শুনে লম্বা তালিকা পাঠালেন:
1: চাষবাড়ি
2: ছাঁচকোল (চালার নিচে)
3: ধারি (বারান্দা)
4: আগনা
5: পলা
6: সকড়ি (এঁটো)
7: কাঁইচি
8: ছুনলি (খুন্তি)
9: ডাবু (হাতা)
10: ফুঁকলাল
11: সাঁজবাতি
12: বাকসা (বাক্স)
13: চিকি হানা (বিদ্যুত্ চমকানো)
14: ডোল
15: আঁজির (পেয়ারা)
16: তালকোয়া(তালশাঁস)
17: ডেহাপাকা(মাদার)
18: কুলুঙ্গি
19: চাঁছি
20: ছালি (সর)
21: ঘি করলা(কাঁকরোল)
22: ক্ষীর(পায়েস)
23: সয়দা (মুদিখানা), লটকোনা বলে বীরভূমে
24: পোখোর
25: নালি (নর্দমা)
26: কাড়া (মোষ)
27: বাগাল (রাখাল)
28: বিজলি (ইলেকট্রিক)
29: পোস্তু
30: বুঁদিয়া (বোঁদে)
31:0 লালমোহন (পান্তুয়া)
32:বিলিতি বেগুন (টমেটো)
33: রামঝিঙা (ঢ্যাঁড়স)
34: ডিংলা (কুমড়ো)
35: নিনুয়া, পোরোল (ধুন্দুল)
36: আখা (উনুন)
37: লাহির ডাল (অড়হর ডাল)
38: বিয়া
39: বিটিছিলা (ছোটো মেয়ে), বিটি (মেয়ে)
40: ব্যাটাছিলা (বাচ্চা ছেলে)
41: রেতের বেলা
42: সাঁজের বেলা
43: জাড় (ঠাণ্ডা)
44: ভাদর (ভাদ্র)
45:আমাবস্যা
46: পুণ্ণিমা
47: কোঠা (দোতলা)
48: আমশাম (আমাশা)
49: পাঁজি(পঞ্জিকা)
50: ডালি(ঝুড়ি)
51: খাটুলি (ছোটো খাটিয়া)
52: দাওয়াখানা (ডাক্তার খানা)
53: বেদনা (ব্যথা)
54: পেটে বাজছে (পেটে ব্যথা)
55: নাই খাবো,নাই যাব (খাবো না, যাবো না)
56: ক্যানে? (কেন)
57: গাঁহাক (গ্রাহক)
58: কপাট (দরজা)
59: টাটি (বেড়া)
60: থলি (ব্যাগ)
61: ঝাল (ঝাঁঝর)
কাদামাটির হাফলাইফ আমাদের পুরানো বেলা, পুরাতন জীবন, ফেলে আসা শব্দের অন্বেষণ করে।
আপনারাও যদি যোগ দেন।
(ক্রমশঃ)