ঢেউ আর ঢেউ। কালো কাদাবালি-মাটিতে এসে ভেঙ্গে পড়ছে। সাদা ফেনায় ঢেকে যাচ্ছে এদিক, ওদিক, যতদূর চোখ যায়। দু একটা উচ্চাশী জলের কণা উচ্ছ্বসিত হয়ে সটান ছিটকে উঠছে আকাশের দিকে। ওঠাটুকু স্পষ্ট দেখা যায়। উদ্ধত, সতেজ। তারপর? যে ওঠে তার নেমে আসাই বিধান। তাছাড়া আর কি গতি হতে পারে? তবে সে পর্ব আর কেউ তাকিয়ে দেখে না।
জানলাটার কাঠের ফ্রেমটা এবড়ো-খেবড়ো, কোনওকালে রং চড়েছিল তার গায়ে, আজ রং-চটা। ফ্রেমের সঙ্গে লাগানো কাচটাও নোংরা। খুবই নোংরা। গভীর কালচে ছোপ ধরেছে। জানলার একটা পাল্লা খোলা। অন্য পাল্লাটা আঁটা। খোলা যায় না। বন্ধ পাল্লার কাচের উপর এসে বসেছে একটা উজ্জ্বল হলুদ রঙের বোলতা। তার থেকে খানিকটা নীচে অনেকক্ষণ ধরেই বসে আছে একটা প্রজাপতি। ধূসর রংয়ের একটা বড় ছিটে। আর দুয়ের থেকে প্রায় সমদূরত্বে উড়ে এসে বসল একটা চকচকে সবুজ স্বচ্ছ-ডানার ফড়িং। নীলি সকৌতূহলে এই রঙ্গিন ত্রিভুজ দেখছিল। কান ছিল রেহানার কথার দিকে। রেহানা এসেছে ঘরের পাশের দিকটা দিয়ে। রেহানা আর নীলির মাঝখানে জানলার ওপারের একফালি ঘাসের জঙ্গল। তারপর সার দিয়ে রাংচিতার ঝোপ। সেই ঝোপের মধ্যে দাঁড়িয়ে কথা বলছে রেহানা। ইস্কুলের গল্প।
-আইজ বেজায় মজা হইছে। নবীনমাস্টার এ্যকটা প্রিজম লয়্যা আসথ্যালো।
ইসস! আগের হপ্তাতেই নবীন মাস্টার প্রিজমের কথা বলেছিল। তার মধ্যে দিয়ে আলো গেলে নাকি রামধনু রং দেখা যায়! নীলি শুনেই উত্তেজনায় ফুটছিল! কেমন একচোখো মাস্টার দেখ, একটা দিন ও ইস্কুলে গেল না, আর সেদিনই প্রিজম নিয়ে এল! ক্লাসে বাকি সবাই দেখে নিল, মাঝখান থেকেই ও-ই বাদ! ইসস! ইসস!
-তোনে দেকলু? উত্তেজনায় মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায় নীলির। তারপরই সামলে নিয়ে বলে, সব্বাই দেখলি?
-আমো সব্বাই দেখিছু। ওই গেড়িয়াধারে যায়্যা। প্রিজমটা ঘুরাই ফিরাই ক্যামন রোশনাই হইথলো! কত্ত ঝলক! বহুত রোঙ্গের বাহার!
রেহানার কথা শুনে নীলির চোখে কষ্ট উঁকি মারে। তবু ঝামড়ে উঠে বলে, “তুই ফের অমন করে কথা বলছিস? নবীনমাস্টার মানা করছে না?” তারপর ডাঁট দেখিয়ে বলে, “ও তো আমি কতই দেখেছি। কচু পাতার উপর বৃষ্টির ফোঁটা যখন জমে থাকে, তার উপর আলো পড়লে কেমন ঝলকানি দ্যায়, দেখিসনি নাকি? ওসব আলোর রোশনাই তোরাই দেখগে যা, আমার এই ঘরেই বলে রঙের রোশনাই মজুত। ” তারপরই বলতে বলতে নীলি দেখে, রেহানার নাকের ডগাটা কেমন বোলতা, প্রজাপতি আর ফড়িং তিনটে থেকেই সমান দূরত্বে। এই বিন্দুগুলো সব কটাকে যদি আলাদা আলাদা তল দিয়ে জুড়ে দেওয়া যেত! তাহলে সেটার কি নাম হত! তাই দিয়েও কি রামধনু-রং তৈরি করা যেত? প্রশ্নটা মাথায় জমিয়ে রাখে নীলি। পরে নবীন মাস্টারকে জিজ্ঞেস করতে হবে। নবীন মাস্টারকে নীলি খুব ভালোবাসে। সে যা বলে, সব নীলি অক্ষরে অক্ষরে শোনে।
আগের বছর নীলি ছিল অনুপমমাস্টারের হাতে। খুব বদমাশ মাস্টারটা। খালি চোখ পাকায়। আর ক্লাসে এসে বাজখাই গলায় চেঁচানি জোড়ে, “চুপ, চুপ, একদম চুপ!” । নবীন মাস্টার বকা দেয়না। খালি হাসে আর বলে, “চেষ্টা কর, চেষ্টা কর না, তুইও পারবি।” ওদের পড়ায়, সঙ্গে কত গল্প শোনায়। আর ওদের সবার কথা শোনে। সক্কলের। পয়লা সারির থেকে মাঝের সারি হয়ে শেষ সারি অবধি সবার। এইতো সেদিনই জনে জনে জানতে চেয়েছিল, ওরা বড় হয়ে কে কি হতে চায়! কি হতে চায়? এমন প্রশ্ন তো কেউ আগে শুধায়নি। বড় হয়ে বড়ই হতে হবে এমনটাই তো জেনে এসেছে এতকাল। নীলি, রেহানা, শান্তি এক বেঞ্চিতে ঠাসাঠাসি করে বসে। ওরা একে অপরের মুখের দিকে তাকায়। কি হতে চায়? কেউ তো জানে না। আর তখনই নবীনমাস্টারের চোখ পড়ে ওদের বেঞ্চের দিকে। “এই মেয়েরা, তোরা বল দেখি। নীলি কই মুখ খুলছিস না কেন? বল, তুই-ই বল!” কথা মুখে জড়িয়ে যায়, তবু মরীয়া হয়ে নীলি বলে বসে, কেন বলে নীলি জানে না, “আমি দিদিমণি হব সার। কচিদের পড়াবো। জ্যামিতি!” ক্লাস শুদ্ধ সবাই হেসে ওঠে। নবীনমাস্টার কিন্তু হাসে না। সবার হাসি থামলে বলে, “তাহলে তো তোকে ভাল করে পরীক্ষা দিতে হবে রে! বৃত্তিটা একবার যদি পেতে পারিস ব্যস! আর তোকে দেখে কে! তোর বাবাকে বলব, তোকে দাঁতনের স্কুলে ভর্তি করে দিতে। কিরে, হোস্টেলে থাকতে পারবি না? অঙ্ক নিয়ে পড়বি তুই। মাস্টার্স করবি, পিএইচডি করবি, অনেক অনেক পড়বি তুই।” চোখ বড় বড় করে শুনেছিল নীলি। দাঁতন! সে তো অনেক দূর! অতটা দূর ও ভাবতে পারে না। বুঝতেও পারে কি?
না বোঝে না। বোঝে না আরও কত কিছু। তলপেটের এই ঘ্যানঘেনে অস্বস্তিটাকেই কি আর বুঝতে পারছে? কেমন একটা টনটনে ভাব। সকালে ঘুম ভেঙ্গে থেকে এটা কেমন অঙ্গে জড়িয়ে আছে। সেই নিয়েই কুয়োর থেকে জল তুলেছে। মুখে চোখে জল দিয়েই এসে বসেছে তোলা উনোনের পাশে ওর বরাদ্দ জায়গায়। সর-চিনি দিয়ে গোল করে পাকিয়ে রুটি খাচ্ছে। দাওয়ার রেডিওটা রোজের মতনই চালানো রয়েছে। কদিন ধরেই সমুদ্দুরে নিম্নচাপ তৈরি হচ্ছে। রেডিওতে বারে বারে ঝড়ের কথা বলছে। জেলেদের নৌকা নিয়ে জলে যেতে মানা করছে। আজকে আকাশটাতে কেমন চাপ চাপ মেঘ জমে আছে। ঘুম ভাঙ্গা চোখে মেঘলা সকাল দেখতে ভাল লাগে নীলির। আজও লাগত, যদি না এই তলপেটে ভার ভাবটা থাকত। খাওয়া শেষে পিঁড়ের থেকে উঠতে গিয়েও কেমন চাপ লাগল। ফ্রকের তলা দিয়ে আগেই গড়িয়ে নামা রক্তের দাগটা তখন শুকোনোর পথে। অনভ্যস্ত নীলির চোখেও পড়েনি। পড়বি পড়, বাজৈয়েরই চোখে পড়ল! আর সঙ্গে সঙ্গে বেঁকা মাজা নিয়ে যথাসম্ভব সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ালো। তেড়ে-ফুঁড়ে কি সব বলে গেল! নীলি সেসব বুঝলে তো! নীলি খালি থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে গেল আর মন দিয়ে দেখল, কথার বেগে বুড়ির মুখ থেকে লালা-থুথুর বন্যা বেরিয়ে মাটিতে পড়ছে। সোজা নীচে নয় কিন্তু, কেমন একটা গোলচে হয়ে বেশ খানিকটা দূরে গিয়ে পড়ছে।
বুড়িটার মাথার শণের নুড়ির মতন জটা পড়া চুল। তোবড়ানো গাল আর পাকানো শিরা-ওঠা আঙুল। চোখ দুটো হাজারটা ঝুলে পড়া চামড়ার ভাঁজের ফাঁক দিয়ে ধ্বকধ্বক করে জ্বলে যেন। রোজ রোজ বুড়িকে দেখে আর নিজের মনেই নীলি গালি দেয়, ডাইনি কোথাকারের! জোরে বলার সাহস নেই। বাপ যতই ভালো বাসুক, আদর দিক, নিজের মাকে ডাইনি বুড়ি বললে কার সহ্য হবে! নীলিরই পিঠে সাগর-ভাসা কাঠ ভাঙ্গবে। এটুকু জ্ঞানগম্যি নীলির আছে। অবশ্য বুড়িও নীলিকে যে বিশেষ পছন্দ করে না। প্রথম যেদিন বাবার সঙ্গে ওদের ভিটেতে এল, ওই বড় রাস্তার থেকে অনেকটা পথ হেঁটে এসে হা-ক্লান্ত, এসেই রান্নাঘরের দাওয়ার ঠেকনোতে পিঠ ঠেকিয়ে বসে হাঁপাচ্ছিল আর মাজাটা টানটান করছিল, ঠিক তখনই নীলি ফিরেছিল ইস্কুল থেকে। পিঠের ব্যাগটা দাওয়ায় ধপ করে নামিয়ে দিয়েই দুপদুপিয়ে জালা থেকে জল তুলে খেতে গিয়েছিল, অমনি বুড়িটা খরখরিয়ে কি যেন বলে উঠেছিল! নীলি কিছুই বোঝে নি। কথাগুলো যে ওকে বলা তাও বোঝেনি মোটে। মা তখনও হেঁটে-চলে বেড়াত, সেও বুড়ির কথা বুঝতে না পেরে থতমত খেয়ে গেল। বাবা পাশের ডোবা থেকে হাত-পা ধুয়ে মুছতে মুছতে এসে সব শুনেই নীলিকে ধমকালো। আবার রাস্তা থেকে এসেই সেই কাপড়ে জলের জালা ধরেছিস?
বাবা বলেছে, বুড়িটা নীলির ঠাকুমা, বাজই। এতকাল পাহাড়েই ছিল। নেপালে, যেখানে নীলির বাবার জন্ম। পাহাড়ের গল্প বলে বাবা। অনেক উঁচু, উঁচু। সেখানে বাবার গাঁও ছিল। নীলি তো কোন ছাড়, নীলির মাও কখনো সে গ্রাম চোখে দেখেনি। শ্বশুর-শাশুড়িকেও না। নীলি শুধু দাদুকেই দেখেছে। দাদুর ছিল সমুদ্র-অন্ত প্রাণ। সকাল থেকে সাঁঝের বেলা অবধি দাদু বুড়ো নিমগাছটার তলায় বসে সমুদ্রের দিকে চেয়ে থাকত, আর গুনগুনিয়ে কীর্তন গাইত। মা বলে, আরও ছোটবেলায় নীলি নাকি দাদুর কোলের থেকে নামালেই মরাকান্না জুড়তো। সেসব নীলির মনে নেই। নীলির শুধু মনে আছে, ও সন্ধ্যেবেলা দাদুর কাছে গল্প শুনত। কত গল্প, ভক্ত পেল্লাদ, রাম-সীতা, বেহুলা-লক্ষিন্দর। এছাড়াও কত ভিন গাঁয়ের, শহরের গল্প। দাদু বয়সকালে কীর্তন গাইত, এসব জায়গায় গেছে। শেষবার ভিনদেশী মানুষটাকে সঙ্গে করে ফিরেছিল। মা বলে, ভাগ্যিস মানুষটা এসেছিল। দাদু বাড়ি ফিরল বটে, তার বিষয়কর্মে মন লাগে না। ঘরেও মন টেঁকে না। অথচ জমি জিরেত, খেতি-খামারের নিত্যি ঝামেলা! নীলির বাবার ঘাড়েই আস্তে আস্তে সব গিয়ে পড়েছিল। দাদুও হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল। জমিজিরেতের ভার সেই মানুষটার হাতেই তুলে দিল। আর শেষে নিজের মেয়েকেও তার হাতে তুলে দিল। এদিকে বিদেশী মানুষ, কুল-মেল, জাত-গোত্রের ঠিক নেই, গাঁঘরে কথা কম নাকি! শেষে পঞ্চজনাকে বড় ভোজ দিতে হল। তবে সবাই মানল। এসব গল্প শুনতে নীলি বড় ভালবাসে। মা যতবার বলে, নীলির শুনতে না নেই।
এসব কথা, দাদু যখন সুস্থ ছিল, তখনকার। তারপর তো দাদু বিছানায় পড়ল। মা বলে, শরীরের অসুখ না, দাদুর মন উঠে গেল অন্য কারণে। ওই যে আর গাঙ দেখতে পেল না! সেই দুঃখেই দাদু শেষ নিঃশ্বাস ফেলল। তারপর মা’র অসুখ শুরু হল। কে ঘর সামলায়, মাকে দেখাশোনাই বা করে কে! নিজে মরতে বসলেও নীলিকে মা স্কুল কামাই করতে দেয় না যে। তাই না বুড়িটা এসে জুড়ে বসল। নীলির বাবাই সঙ্গে করে নিয়ে এল তাকে। এতগুলো বছর পরে বৌ-নাতনিকে চোখের দেখা দেখল বুড়ি। অথচ এসে থেকে যেন নীলিকে বিষনজরে দেখেছে। মাকে যত্ন আত্তি করে বটে, নীলিকেও একেবারে করে না তা নয়, তবে বিষটুকুও ঝাড়ে নীলির উপর। কেন যে বুড়িটা এল!
বাজই যখন উত্তেজিত হয়ে হড়বড়িয়ে কথা বলে, বাবা ছাড়া আর কেউ বোঝে না। আজও বাবাই শুধু বুড়ির কথা বুঝল। তারপর ঘরে ঢুকে মাকে কী যেন বলল। একটা চাটাই, পুরোন বালিশ, ছেঁড়া চাদর নিয়ে এসে ওর সামনে মাটিতে ফেলে বলল, এগুলো তুলে নিয়ে ওই কোঠিতে যা, এই কটাদিন ওখানেই থাকবি। নীলি তো হাঁ। কোথায় থাকবে? বাবা আঙ্গুল দিয়ে দেখাচ্ছে বাগানের এক কোণের আধভাঙ্গা ঘরটার দিকে। ক’দিন আগেই ওটা সারাই-ঝাড়াই সাফ-সুরত করছিল না বাবা?
-“কেন? ওখানে থাকব কেন?” তীরের মতন প্রশ্নটা বেরিয়ে এল নীলির মুখ দিয়ে।
-“তুই এখন অশুচ। কাউকে ছুঁবি না। রান্নাঘরে বা অন্য কোথাও পা দিবি না। শুধু ওই ঘরে থাকবি। বাইরে পা রাখবি না। এখন ঘুরে বেড়ালে, কাউকে ছুঁলে বাড়িতে কুদৃষ্টি পড়বে। যা চলে যা। তোকে সময়মত খাবার, জল দিয়ে আসব।”
-“মা!” – জোরে চেঁচিয়ে উঠেছিল নীলি! সঙ্গে সঙ্গে শয়তান বুড়িটার আবার মুখ ছুটেছিল। নীলি ছুটে মায়ের কাছে যেতে চেয়েছিল, কিন্তু বাবা এক বজ্রহুংকারে ওখানেই থামিয়ে দিয়েছিল। “খবরদার, ঘরে আর পা দিবি না। সব অশুচ হয়ে যাবে। এসব রীতকানুন না মানলে ডাইনের নজর পড়বে! তোর মার অসুখ তাহলে আরও বাড়বে! তাই চাস নাকি তুই?”
বাবার আদুরে মেয়ে নীলির চোখ ফেটে জল চলে এসেছিল। বাবার ধমক খুব কম খেয়েছে নীলি। তার সঙ্গে জুড়ল মার জন্য অজানা ভয়। এইসব বাজইয়ের বুদ্ধি। স-অ-ব, সব। তার এতদিনের চেনা বাবাটা কেমন অচেনা হয়ে গেছে! ফোঁপাতে, ফোঁপাতে বিছানা পত্র তুলে নীলি ছুটতে ছুটতে এই ঘরে এসে দোর দিয়েছিল। শয্যাশায়ী মায়ের হালকা ‘কী হইচে’ আর্তনাদ ঘরের দরজা, দাওয়া পেরিয়ে ছুটন্ত নীলির আর কানেও আসেনি।
আকস্মিক ধাক্কায় একটু ঘাবড়ে গিয়েছিল বটে। কিন্তু নীলি তো সত্যি সত্যি হাবা না। আর ওর সমবয়সী বন্ধুদের সকলেরই প্রায় মাসিক শুরু হয়ে গেছে। তাই বুঝে নিতে অসুবিধা হয়নি। ওরই খালি এতদিন হয়নি! নীলিও তাহলে শেষ পর্যন্ত বড় হয়ে গেল! কিন্তু বুড়িটা… ওই বুড়িটাকে দেখে নেবে নীলি! এই ঘর থেকে একবার বেরোক নীলি। ওই বুড়িটাকে ঠিক ধুতরো ফুলের বীজ বেটে খাইয়ে দেবে। ডাইনি বুড়ি একটা। একেই ওর ইস্কুলে যাওয়া বন্ধ হল, তার উপর এই ঘরে আটকে থাকা! কই রেহানা তো মাসিক হলে ঘরে আটকে থাকে না। ওর কোন বন্ধুই তো থাকে না। সব্বাই স্কুলে যায়। সবাই মিলে ছোঁয়াছুঁয়ি করে লুকোচুরিও করে। কুনজর লাগার হলে কবেই লেগে যেত! আর নবীন মাস্টার কি ওদের ক্লাসে বলেনি যে নজর লাগা বলে কিছু হয় না? এ সব ভুল কথা! স-ব বুড়িটার শয়তানি!
ওদের ঘর গ্রামের শেষ সীমানায়। তারপর বালির ঢাল নেমে গেছে সরসরিয়ে, বেশ খানিকটা নীচে। তারও পর একটা সরু ঝাউবনের সারি। ঝাউয়ের সারি পেরিয়ে চিকচিকে, ঝিকমিকে বালুতট। মা বলে, মায়ের ছোটবেলায় সমুদ্র ছিল আরও দূরে। এখন যেন অনেকটা ভিতরে ঢুকে এসেছে। মাঝে মাঝেই দেখা যায় ঝাউয়ের মাথার ছায়ার অল্প দূরে ভিজে ভিজে বালি। আর সদ্য ঢালা ঝিনুকের কুচির টানা দাগ। নীলিদের ঘর- বাগান জলের থেকে অনেকটাই উঁচুতে। দু মানুষ সমান হবে। ঘরের পিছনে বিশাল জায়গা - মেলা গাছ, গাছের ভিড়ে বোঝা যায় না বটে, তবে এখানেও জমিন তেরছা হয়ে উঠে গেছে। ঘরের লাগোয়া জমিতে বিভিন্ন সবজি বুনত মা। এখন তো মায়ের অসুখে, অসুখে সবজিবাগানের সবই গেছে। তারপরে অনেকটা জায়গা জুড়ে বাগান - নারকেল, সুপারি, কাজু কী নেই সেখানে। তারও পরে বেড়া। সমুদ্রের ধার থেকে পায়ে চলা রাস্তা গেছে ওদের জমির সীমানা বরাবর। তারপর বেড়ার পাশ বরাবর বেঁকে উত্তরমুখো হয়েছে। সেই পথ ধরে আরও খানিকটা গেলে তবে গ্রাম। এই পথ ধরেই নীলি রোজ ইস্কুলে যায়। বাবাও জমিতে যায়। এই দুজনের যাতায়াত নিয়ম-বাঁধা। তাছাড়া এদিকটায় লোকের আনাগোনা খুব কম। স্কুলে যাওয়ার সময় নীলি রোজ রেহানার বাড়ির সামনে গিয়ে ডাক দেয়। তারপর দুজনে মিলে গল্প করতে করতে যায়। পথেই আরও কিছু সঙ্গী সাথী জোটে। আজ নীলির ইস্কুলে যাওয়া হয়নি। রেহানা কি ভাববে? একটিবার ওর খবর নিতে আসবে না? যদি আসে তো বাঁচা যায়! অসহ্য এই সারাটা দিন মুখ বুজে থাকা! আশায় আশায় নীলি জানলা দিয়ে বাইরে চেয়ে থাকে। রেহানা যদি আসে! এই পথের উপরেই ধরতে হবে ওকে।
রেহানা আসেও। জানলা দিয়ে ডাক দেয় নীলি। রেহানা প্রথমে বুঝতেই পারে না। তারপর ঠাহর করতে পারে। ঝোপ ঠেলে যতটা পারে কাছে আসে। সরল বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করে, তুই এঠিটা কেনি? নীলির আবার পুরোন রাগটা ফিরে আসে, সে ফুঁসে ওঠে, সে কথা ওই ডাইনি বুড়িকে শুধাও! তারপর বলে, আমিও তোদের মতন বড় হয়ে গেছি। ঈষৎ লজ্জা, ঈষৎ গর্ব, আরও কি একটা ছিল গলার স্বরে, রেহানা ঠিক বুঝে ফেলে। দুই সখীর চোখে চোখে ঝিলিক দেয়। গল্প জমে ওঠে। সমুদ্রের থেকে পাক খেতে খেতে আসা বাতাসের টানে শব্দেরা উড়ে যায়। রেহানার বিনুনি ওড়ে, স্কুলের জামা ওড়ে, পিঠের ব্যাগটাও যেন ডানা মেলে উড়ে যেতে চায়। হাড় কখানা ছুঁয়ে শনশন করে হাওয়া বয়। রেহানা বলে ওঠে, জোর ঝড় উঠিবু। আমি ঘর পালাই। আকাশের চেহারা ভাল না। দূরে আকাশের উল্টোকোণে মোটা মোটা, আলো-শুষে-নেওয়া মেঘ একটার পিঠে একটা চেপে বসছে, জমছে তো জমছেই।
রেহানা পালায়। নীলির চোখের জল শুকিয়ে গেছে অনেক আগেই। নিজের মনে মনে আর কাঁহাতকই বা অন্য কাউকে গাল পাড়া যায়! এখন দুটো দেওয়ালের জোড়ের জায়গাটায় বসে দুই দেওয়ালে কাঁধ ছুঁইয়ে বসে আছে নীলি। একবার এ দেওয়ালে ঠেসান দিচ্ছে, আবার ওই দেওয়ালে ভর করছে। অন্যদিন সূর্য ডোবার আগে অনেকক্ষণ তার আলো এই রাংচিতার মাথাগুলো ছুঁয়ে থাকে। তারপর সেখান থেকে হড়কে নামতে থাকে রাস্তার দিকে, পাল্লা দিয়ে বাগানের দিকের ছায়া দীর্ঘতর হয়। আজ আলোর খেলা করার সময় নেই। ঘোলাটে আকাশ সবকিছু দখল করে নিয়েছে। আলোর ক্রম-অভাব চুঁইয়ে আসছে নোংরা কাচের মধ্য দিয়ে। সময়ের আন্দাজ পাওয়া দায়। একটা পাখিও উড়ছে না আজ। দেখতে দেখতে শেষ আলোও মুছে গেল চৌকো ফ্রেমবন্দী আকাশের থেকে। পাঁশুটে থেকে ঘন বেগুনি হতে হতে আকাশের রং ঘোর কালো হয়ে গেল। আর কিছুই দেখা যায় না। বাতাসের ফোঁস ফোঁস বাড়ছে ক্রমশঃ। সেই সঙ্গে মিশেছে একটা অন্যরকম শব্দ। রোজকার সমুদ্রের পাড়ে এসে আছড়ে পড়ার আর সরসরিয়ে সরে যাওয়ার শব্দ আর নেই। কেমন যেন অন্যরকম, হিংস্র, ভয়-ধরানো।
হাওয়া ছোবল দিচ্ছে। হিসহিস করে আছড়ে পড়ছে দরজার উপর। সেই সঙ্গে শুরু হয়েছে বৃষ্টিও। প্রাণপনে টেনে জানলার খোলা পাল্লাটা বন্ধ করে দিতে চেষ্টা করে নীলি। পারে না। তলপেটের ঘিষঘিষে অস্বস্তিটা আছেই। মাঝে মাঝেই এক একটা চিড়িক দিয়ে তীক্ষ্ণ ব্যথাও উঠছে। আকাশে চমকে চমকে উঠছে বিদ্যুৎ। এলোমেলো হাওয়ার দাপটে ঘরের মধ্যে জলের ঝাপটা ঢুকে আসছে। জানলাটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। টিনের একপাল্লার দরজার কপাটটা নড়ে উঠছে আবার ঝনঝনিয়ে এসে পড়ছে লোহার ফ্রেমের উপর। কবজাগুলোও যুদ্ধ করতে করতে আলগা হয়ে যাচ্ছে। নীলি ভয় পাচ্ছে। মাথার ঢেউ-টিনের ছাদটাও উঠছে আর নামছে। এত বিভিন্নরকম শব্দের মাঝে নীলির আর দিশা থাকে না। আরও দেওয়ালে সিঁটিয়ে যায় সে। ওই দেওয়ালগুলোই এখন একমাত্র আশ্রয়। মা মা, তুমি কোথায়? কেন তুমি ওদের বারণ করলে না? আমাকে এখানে একা পাঠাতে দিলে কেন?
কেউ শোনে না। শুনতে পায় না। চরাচর জুড়ে শুধু শোনা যায় এক জান্তব গোঁ গোঁ আওয়াজ। সঙ্গে মিলেছে দূর থেকে ভেসে আসা গুম গুম শব্দ। যেন যুদ্ধের কাড়া-নাকাড়া বাজছে। ফোঁপাতে ফোঁপাতে নীলি দেখে বিপুল একটা দমকায় দরজার পাল্লাটা কব্জা থেকে খুলে ছিটকে গেল কোথায়। আর ক্ষ্যাপা মোষের মতন হাওয়া দমকে দমকে ঘরের মধ্যে ঢুকে পাকের পরে পাক খেতেই লাগল। বেরোবার পথ খুঁজছে। বাগানের ঘরে নীলিকে আটকে রাখা যায়। কিন্তু হাওয়াকে কে কবে আটকে রাখতে পেরেছে! জানলার বন্ধ পাল্লা হাওয়ার তোড়ে খুলে গেল, বাইরের হাওয়া তাকে কব্জা উপড়িয়ে উড়িয়ে নিয়ে গেল কোথায়! বাকি হাওয়া ঘুর্ণির মতন পাক খেতে লাগল। নীচ থেকে উপর দিকে। ছোট থেকে বড় বৃত্তাকারে। সঙ্গে ঘুরে মরছে পাতা-পুতি, ধুলো-কাগজ, জলের দানা। হাওয়ার তীব্র ঝাপটা এসে লাগছে নীলির ধনুকের মতন পিঠের উপরে। দেয়ালের দিকে মুখ করে বসে আছে ও । হাঁটুর-মধ্যে মুখ-গুঁজে, প্রায় গোল হয়ে। ঢেউ-টিনের সঙ্গে বাতাসের যুদ্ধ শুরু হয়েছে। মড়াৎমড়াৎ, শোঁ-শোঁ, মচমচ – ঢেউ-টিনকে হার মানতেই হল একসময়। এতক্ষণ আটকে থাকা বাতাস ছাদ দিয়ে বেরিয়ে গেল টানা তীক্ষ্ণ শব্দ করতে করতে। ইস্কুলের পাশের রান্নাদিদিদের ছাউনি থেকে যেমন প্রেসারকুকারের সিটির শব্দ ভেসে আসে, অনেকটা যেন তেমনই, শুধু আরও অনেকগুণ জোরে। নীলির পেটটাও যেন খামচে ধরল কেউ। আতংকে, যন্ত্রণায় নীলি হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল। মা গো মোর খুব যন্তরণা হউছি। হাওয়ার আঘাতে আঘাতে ঘরটাও তখন কাঁপছে থরথর করে।
তারপর একসময় সব শান্ত হয়ে গেল। হাওয়া বন্ধ। শুধু সেই দূরের গুমগুমে আওয়াজটা যেন আরও অনেকটা কাছে। নীলি পেটের ব্যথার পরোয়া না করে, জামার হাতায় ভিজে নাক-মুখ সাপটে নিয়ে কোনমতে উঠে দাঁড়ালো। দেওয়াল ধরে ধরে এগিয়ে গেল হাঁ-মুখটার দিকে। আগে এখানে দরজা ছিল। চৌকাঠে পা রেখে যা দেখল, যা শুনল তার জন্য নীলি তৈরি ছিল না মোটে। সামনে শুধু একটা কালো চাদর বিছানো। ওদের বেড়ার সামনের যেখানে ঢালটা গড়গড়িয়ে নীচে নেমে গেছে, সেই জায়গাটা থেকে গুমগুম, সরসর শব্দ উঠছে। বিশাল একটা দানব যেন সেখানে শরীর মোচড়াচ্ছে, ওলট পালট খাচ্ছে, ল্যাজ ঝাপটাচ্ছে। কয়েকটা খন্ড মুহূর্ত। তারপর আকাশের এমাথা থেকে ওমাথা জুড়ে বিদ্যুৎ ঝলসে উঠল। শুরু হল গুরুগুরু শব্দ। বিদ্যুতের আলোয় নীলি দেখল, জল উঠে এসেছে প্রায় বাড়ির সীমানার বেড়ার কিছুটা নীচ অবধি, এই মুহুর্তে সামনেটা প্রায় শান্ত, ঢেউহীন, শুধু গোটা জলতলটা জুড়ে কে যেন বড় বড় চৌখুপি এঁকেছে, চৌখুপিগুলো তালে তালে হালকা দুলছে – দূরের থেকে একটা অচেনা আওয়াজ শুনে নীলি তাকাল। দেখল, দূরে, অনেকটা দূরে জলের উপর দিয়ে একটা দেয়ালের মতন কি যেন এগিয়ে আসছে। তার মাথায় আলোর কুচির মুকুট, এগিয়ে আসছে দ্রুত, খুব দ্রুত – সেই দ্রিমি দ্রিমি আগমনবার্তা শোনা যাচ্ছে দূর থেকে কাছে … নিশিতে ডাকা মানুষের মতন বিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়েই থাকে নীলি। নবীনস্যার বলেছে, সমুদ্রের ঢেউয়ের মধ্যেও জ্যামিতি আছে। অনেকগুলো বল এক এক করে গড়িয়ে দিয়ে ভগবান জলের দানাগুলোকে তাদের মাথায় মাথায় লাফিয়ে লাফিয়ে এগোতে বলেন। তাতেই ঢেউ তৈরি হয়। আরও অনেক অঙ্ক লুকিয়ে আছে ওই কালো জলের গভীরে। সব জানতে চায় নীলি! কে শেখাবে ওকে? কবে? কিভাবে?
যতই যাই হোক, পৃথিবীর আহ্নিক-বার্ষিক গতির কোন বদল হয় না। পৃথিবী নিজের ছন্দে ঘুরতেই থাকে। ছোটখাট যা দুয়েকটা বদল আসে, তা নেহাতই ছোট ছোট বৃত্তে। যেমন, স্কুলের যাওয়ার সময় রেহানাকে এখন আর কেউ ডাকতে আসেনা। একা একাই রওনা দেয় রেহানা। পায়ের শব্দে গিরগিটি সরসরিয়ে সেঁধিয়ে যায় কালকাসুন্দে ঝোপের আড়ালে। সেই ধাক্কায় কচুপাতার উপর জমে থাকা জলের ফোঁটাটা টুপ করে ঝরে পড়ে। সে তো আরও কতই ওরকম ঝরে পড়ে!
.