টাকা জমা পড়ল সেই দিনই, কিন্তু এ কথা-সে কথায় অযথা কালহরণ করতেই থাকলেন হক সাহেব। এমনকি, পুজোর ছুটিও দিয়ে দিলেন নবযুগের অফিসে। আর তারপর, বন্ধুবান্ধব সহযোগে বরিশাল। যাবার সময় বরিশালে তাঁর বাড়িতে পুজোর ছুটি কাটাবার নেমন্তন্নও করে গেলেন নজরুল-মুজফ্ফরকে।
আর এই ছুটির মধ্যেই একদিন ডঃ শহীদুল্লাহ্র আগ্রহে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে গেল নজরুল। পিংলাও সঙ্গ ছাড়ল না।
ট্রেনে ওঠবার পর শহীদুল্লাহ্ সাহেব বললেন, একটা গান গাও কাজি। সেদিন তাড়াহুড়োয় তোমার গান শোনা হল না ঠিক মতো। আজ গাও। অনেকটা রাস্তা, গান শুনতে শুনতেই চলে যাব।
নজরুল যেন এই অনুরোধের জন্যেই অপেক্ষা করছিল। দ্বিতীয়বার বলতে হল না আর, চোখ বুজে শুরু করে সে, তুমি কেমন করে গান কর হে গুণী।
গান শেষ হলে শহীদুল্লাহ্ সাহেব বলেন, এই গানটাই আগের দিন শুনিয়েছিলে না? কোন জবাব দেয় না নজরুল। একটু হাসে, তারপর আবার, আমি বহু বাসনায় প্রাণপণে চাই, বঞ্চিত করে বাঁচালে মোরে। এবং এই গান শেষ হলেই, কত অজানারে জানাইলে তুমি।
একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটল। ট্রেন চলছে, রেল-লাইনে চাকার ঘর্ষণের শব্দ আর নজরুলের কণ্ঠস্বর – এর বাইরে যেন আর কোন শব্দই নেই পৃথিবীতে। কামরায় অন্য যাত্রী যারা, তারাও যেন আবিষ্ট। কথা বলছে না কেউ, শুধু কয়েকজোড়া চোখ নিবদ্ধ নজরুলের দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যে চাকার শব্দও কি মিলিয়ে গেল? যাত্রীদের কারো কানে চাকার শব্দও যেন যায় না, গানের অতলে কোথাও কি তলিয়ে গেছে সে শব্দও? ভিখারি একজন ভিক্ষে করছিল, সে-ও চুপ করে কামরার মেঝেতেই বসে পড়ে, ভিক্ষে চাইতে ভুলেই গেছে সে মনে হয়। শহীদুল্লাহ্ সাহেব ইঙ্গিতে ডাকেন তাকে, সে নীরবে কাছে যায়, কয়েকটা টাকা তাকে দেন শহীদুল্লাহ্ সাহেব, সে কোন কথা না-বলে তার বাটিতে রাখে সেই টাকা, তারপর আবারও মেঝেতে বসে শুনতে থাকে গান। ট্রেন চলতে থাকে, যাত্রীরা ওঠানামা করে, নামে যারা তারা শব্দ করে না, ওঠে যারা কয়েক মুহূর্তেই গানে মগ্ন হয় তারাও।
ট্রেন যখন থামল বর্ধমানে, স্টেশনের উচ্চকিত শব্দরাশি থামায় নজরুলকে। চোখ প্রায় বুজেই ছিল সে এতক্ষণ, এবার চোখ খুলে হাসে। নিঃশব্দ হাসিই যেন প্রত্যুত্তর শহীদুল্লাহ্ সাহেবের, তারপর কেলনারের প্রতিনিধিকে ডেকে চায়ের অর্ডার দেন তিনি।
তোমার কি পুরো গীতাঞ্জলিই মুখস্থ? – বিস্মিত শহীদুল্লাহ্ প্রশ্ন করেন, বলেন, সঙ্গে আমার গীতাঞ্জলি নেই এখন ঠিকই, কিন্তু শুনে তো মনে হচ্ছে তুমি পরপরই গেয়ে চলেছ, গীতাঞ্জলির ক্রম অনুযায়ীই।
ঠিক ঠিক গীতাঞ্জলির ক্রমে হচ্ছে কিনা জানিনা, নজরুল বলে, আমার যেমন যেমন মনে পড়ছে সেই ভাবেই গাইছি।
বর্ধমান ছাড়াবার পর নজরুল গান ধরেছে আবার, এমন সময় কামরায় উঠল তিন-চারজন বাউলের একটা দল। শান্তিনিকেতনের পথে রেলের কামরায় এই বাউলরা প্রায়ই ওঠে, আর উঠেই গান গায়। সঙ্গে থাকে তাদের একতারা, আর কোন কোন সময় পায়ে ঘুঙুরও। বাউল, ভিক্ষে করাই এদের পেশা, যাত্রীসাধারণেরও সেটা জানা। ফলে, ঠিক ঠিক চাইতেও হয়না ভিক্ষে, গান শেষ হলে অনেক যাত্রী নিজেরাই ডেকে সাধ্যমতো যা পারে, দেয়। আজ এই বাউলরা উঠে নজরুলের গান শুনে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। একটু পর, তাদের মধ্যে একজন গানের সঙ্গে একতারায় মৃদু আওয়াজ তোলে, ঘুঙুরের শব্দে তালও রাখে কেউ। নজরুল চোখ মেলে হাসে, তারপর চোখ বুজে গাইতে থাকে আবারও।
বোলপুর স্টেশনে সুধাকান্তবাবু আর তাঁর এক বন্ধু দাঁড়িয়ে ছিলেন, ওঁদের দেখে এগিয়ে এলেন। কবি পাঠিয়েছেন ওঁদের, অতিথিদের নিয়ে যাবার জন্যে।
কোনার্ক বাড়িতে ওঁদের হাতমুখ ধোয়া আর জলখাবারের ব্যবস্থা ছিল। সেখানেই সোজা নিয়ে গেলেন সুধাকান্ত, তারপর পিয়ার্সন আর অ্যাণ্ড্রুজ সাহেব থাকেন যে বাড়িতে, তার দোতলায়। কলাভবনের ক্লাস হয় সেখানে, আজ সেখানেই নজরুল-শহীদুল্লাহ্-রবীন্দ্রনাথের বৈঠক হবার কথা, অধ্যক্ষ অসিতকুমার হালদার কয়েকজন ছাত্রকে নিয়ে ব্যবস্থাপনায় ব্যস্ত। অসিতবাবুর সঙ্গে আলাপ করিয়ে শহীদুল্লাহ্ সাহেবকে বসিয়ে দেন সুধাকান্ত, নজরুল আর পিংলা ঘুরে ঘুরে দেয়ালে টাঙানো শিল্পকর্মগুলো দেখতে থাকে। নজরুলের আগমনবার্তা যারা পেয়ে গেছে এর মধ্যে, একে একে আসতে থাকে তারা, কেউ বসে, দাঁড়িয়ে থাকে কেউ। কবি ঢোকেন যখন, তড়িতাবিষ্টের মতো দাঁড়িয়ে থাকে নজরুল কয়েক মুহূর্ত, তার পরেই দৌড়িয়ে এসে তাঁর পায়ে মাথা রাখে। পায়ে-মাথা-রাখা অবস্থায় সময় কেটে যায় অনেকটা, কবিকে দেখে বোঝা যায় তিনি বিব্রত বোধ করছেন, তারপর সহসা নীচু হয়ে নজরুলের মাথায় হাত রেখে বলেন, ওরে পাগল, আমার পা যে ভিজে গেল। হাঁটু-ভাঙা অবস্থাতেই নজরুল মাথা তোলে, সেই অবস্থাতেই কবির মুখের দিকে তাকায়, তার চোখ-ভরা জল, বলে, আমি কাকে দেখছি? আল্লাহ্ যিশু ভগবান, কাকে? কবি হেসে বলেন, উন্মাদ তুই, রবি ঠাকুরকেই দেখছিস, আমি ওরকম সেজে থাকি!
সবাই বসবার পর প্রথম কথা বলেন শহীদুল্লাহ্ সাহেব, আজ আসবার সময় ট্রেন-এ সারা রাস্তাটাই নজরুল আপনার গীতাঞ্জলির গান গাইতে গাইতে এসেছে, একটার পর একটা গান।
বলেন কী! – বিস্মিত রবীন্দ্রনাথ, পুরো রাস্তাটাই? গীতাঞ্জলির ক'টা গান মুখস্থ তোর? – নজরুলকে আবার জিজ্ঞাসা করেন কবি।
নজরুল হাসে, জবাব দেন শহীদুল্লাহ্, সবটাই, গোটা গীতাঞ্জলি।
সে কী রে, এ ক্ষমতা তো আমারও নেই, আশ্চর্য স্মৃতিশক্তি তো, স্বগতোক্তির মতো শোনায় রবীন্দ্রনাথের গলা। তারপর সরাসরি নজরুলের দিকে তাকিয়ে বলেন, আমাকে কোন গান শোনাবি আজ?
আজ আর গান নয়, বলে নজরুল, আপনাকে একটা কবিতার আবৃত্তি শোনাই? অনুমতির অপেক্ষা করে না সে, তার বাবরি-ভরা মাথাটা ঝাঁকিয়ে শুরু করে সে,
একি রণ-বাজা বাজে ঘন ঘন –
ঝন রণরণ রণ ঝনঝন!
সে কি দমকি' দমকি'
ধমকি' ধমকি'
দামা-দ্রিমি-দ্রিমি গমকি' গমকি'
ওঠে চোটে চোটে,
ছোটে লোটে ফোটে!
বহ্নি-ফিনিক চমকি' চমকি'
ঢাল-তলোয়ারে খনখন।
একি রণ-বাজা বাজে ঘন ঘন
ঝন রণরণ রণ ঝনঝন!
পরের স্তবকের হৈ হৈ রব/ ঐ ভৈরব – আবৃত্তি করতে করতে উত্তেজনায় উঠে দাঁড়ায় নজরুল। স্তবকের পর স্তবক তার উত্তেজনা যেন ছড়িয়ে পড়ে সমবেত শ্রোতাদের মধ্যে। শেষ স্তবকে যখন পৌঁছোয় নজরুল, মনে হয় সে আত্মবিস্মৃত:
হিমালয়! জাগো! ওঠো আজি,
তব সীমা লয় হোক।
ভুলে যাও শোক–
চোখে জল ব'ক
শান্তির– আজি শান্তি-নিলয় এ আলয় হোক!
ঘরে ঘরে আজি দীপ জ্বলুক!
মা'র আবাহন-গীত চলুক!
দীপ জ্বলুক!
গীত চলুক!!
আজ কাঁপুক মানব-কলকল্লোলে কিশলয় সম নিখিল ব্যোম্!
স্বা-গতম্! স্বা-গতম্!!
মা-তরম্! মা-তরম্!!
ঐ ঐ ঐ বিশ্ব কণ্ঠে
বন্দনা-বাণী লুণ্ঠে –'বন্দে মাতরম্!!!'
রবীন্দ্রনাথ নিজে নজরুলের হাত ধরে বসান, তার পর বলেন, কবিতা লেখা আর গান গাওয়া ছাড়া আর কী করিস আজকাল?
আপনি জানেন না আমি দৈনিক নবযুগ পত্রিকার সম্পাদক?
ওঃ, কাগজের সম্পাদক? তাহলে তো তুই ব্যস্ত মানুষ। ক'দিন থাকতে পারবি আমাদের এখানে?
নজরুল জবাব দেবার আগেই শহীদুল্লাহ্ সাহেব বলেন, এবারটা থাকা যাবে না মনে হয়। আপনি আছেন খবর পেয়ে খানিকটা তাড়াহুড়ো করেই এসেছি, আমার একটা কাজ আছে, কাল সকালেই চলে যেতে হবে। তবে নজরুল হয়তো থেকে যেতেও পারে, আর সে ক্ষেত্রে নজরুলের এই বন্ধু পিংলাও – পিংলাকে দেখিয়ে দেন তিনি।
পিংলার দিকে তাকিয়ে হাসেন কবি। পিংলা সুযোগ পায়নি এতক্ষণ, এগিয়ে এসে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে। কবি জিজ্ঞেস করেন নজরুলকে, কী করবি তোরা দুজন? থেকে যাবি তো?
আমিও চলেই যাব গুরুদেব, বলে নজরুল, আমাদের কাগজ এখন বন্ধ, পুজোর ছুটি। হঠাৎ কবে খুলবে আমার জানা নেই। কাল-পরশু যদি খুলে যায়...
হুঁ, মাথা নাড়ান কবি, তাহলে তো তোদেরও যেতেই হবে। আমি তোর জন্যে কাজ ভেবে রেখেছিলুম।
কী কাজ, গুরুদেব?
ভাবছিলুম, আপাতত তুই দিনুর সঙ্গে গান গাইবি, আর আমাদের এই ব্রহ্মবিদ্যালয়ের বাচ্চাদের ড্রিল করাবি, ব্যায়াম করাবি। তুই তো পল্টন থেকে ফিরেছিস?
নজরুল বলে, শুধু ড্রিলে আমার মন ভরবে না গুরুদেব। কিছুদিন আগে হাওড়ায় গিয়ে বাঘা যতীনের এক সহযোগীর সঙ্গে পরিচয় হল, অনেক গল্প শুনলুম বাঘা যতীনের। মনে পড়ে গেল আসানসোলের স্কুলে আমাদের মাষ্টারমশাই নিবারণচন্দ্র ঘটকের কথা। তিনি বাঘা যতীনের শিষ্য ছিলেন। আমাকে বিপ্লবের দীক্ষা দেবেন বলেছিলেন, কিন্তু পুলিশ একদিন হঠাৎ ধরে নিয়ে গেল তাঁকে। আমার দীক্ষা নেওয়া হল না, যুদ্ধে চলে গেলুম। গত কয়েকদিন ধরে স্যরকে স্বপ্ন দেখছি। একবার স্যরের সঙ্গে দেখা না হলে শান্তি পাচ্ছি না। এখন অন্য কোন দায়িত্ব নিতে পারব না গুরুদেব।
কবি আর এ বিষয়ে কোন কথা বললেন না। শহীদুল্লা সাহেবের সঙ্গে অনেক বিষয়ে কথাবার্তা হল। শেষে শহীদুল্লা বললেন, গুরুদেব, আমার কিন্তু আপনার কণ্ঠে একটা গান শোনবার ইচ্ছে ছিল।
গান নয়, হেসে বলেন কবি, তবে গানই। কিছুদিন আগে লেখা এটা, আজকাল আর সুর মনে রাখতে পারি না। আবৃত্তি করেই শোনাই তোমাদের:
মাধবী হঠাৎ কোথা হতে এল ফাগুন দিনের স্রোতে।
এসে হেসেই বলে, 'যাই যাই যাই।'
পাতারা ঘিরে দলে দলে তারে কানে কানে বলে,
'না না না।'
নাচে তাই তাই তাই।
আকাশের তারা বলে তারে, 'তুমি এসো গগন-পারে,
তোমায় চাই চাই চাই,'
পাতারা ঘিরে দলে দলে তারে কানে কানে বলে,
'না না না।'
নাচে তাই তাই তাই।
বাতাস দখিন হতে আসে, ফেরে তারি পাশে পাশে,
বলে, 'আয় আয় আয়।'
বলে, 'নীল অতলের কূলে সুদূর অস্তাচলের মূলে
বেলা যায় যায় যায়।'
বলে, 'পূর্ণশশীর রাতি ক্রমে হবে মলিন ভাতি,
সময় নাই নাই নাই।'
পাতারা ঘিরে দলে দলে তারে কানে কানে বলে,
'না না না ।'
নাচে তাই তাই তাই।
উঠে দাঁড়াবার আগে কবি বললেন, আজ রাতে আপনারা আমার সঙ্গে খাবেন। সুধাকান্ত দেখিয়ে দেবে আপনাদের। তারপর সমবেত মানুষদের মধ্যে নীরবে বসে থাকা একজনের দিকে তাকিয়ে বললেন, অতুলবাবু, আপনাকেও নিমন্ত্রণ করলুম। আপনিও রাতে খাবেন আমাদের সঙ্গে। আর, কালীমোহন, তুমিও। এবার বেরিয়ে যাবেন কবি। বেরোবার আগে কী মনে করে দাঁড়ালেন একবার। এবার অতুলবাবুর দিকে আরেকবার ফিরে, আসবেন, ভুলবেন না কিন্তু, বলে হাসলেন। তারপর নজরুলের সঙ্গে আবার চোখাচোখি করেন কবি। হাওড়ার আর একজন মানুষ, বলে আবার হেসে বেরিয়ে যান।
রাতে খাবার সময় নজরুলকে বলেন কবি, তুই যে তোর মাষ্টারমশাইকে স্বপ্ন দেখে মন খারাপ করছিস, কী তুই চাস? মাষ্টারমশায়ের সঙ্গে দেখা হলে কী চাইবি?
সত্যি কথা বলব গুরুদেব? খবরের কাগজে আর মন লাগছে না আমার। আমি সত্যি সত্যি দেশের কাজে লাগতে চাই।
দেশের কাজ? কিছুক্ষণ নীরব থাকেন কবি। তারপর নজরুলকেই জিজ্ঞাসা করেন আবার, তুই জন্মেছিস কোন বছর, কত সালে?
আঠেরশো নিরানব্বই, গুরুদেব।
তোর যখন ছ' বছর বয়েস, মানে উনিশশো পাঁচ-এ, লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গের আদেশ জারি করলেন। মানতে পারলুম না আমরা। সে সময় মনুমেন্টের নীচে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করেছি, স্বদেশী গান লিখে রাস্তায় নেমে সে সব গান গাইতে গাইতে হিন্দু-মুসলমান সবায়ের হাতে রাখি বেঁধেছি, শুরু হয়েছে স্বদেশী আন্দোলন। সে কী মিছিল-মীটিঙের ঘটা। প্রভিনশিয়াল কনফারেন্স, এখানে-ওখানে বক্তৃতা, লেখালিখি, প্রায় জনজাগরণ! এই চললো কয়েকবছর। শেষে, মনে হল, স্বরাজ আসবে বন্ধনমুক্তি থেকে। আমাদের দেশের মানুষের আসল বন্ধন তো নিজেদের কাছে। বন্ধন শিক্ষাহীনতার কাছে। বন্ধন কুশিক্ষার কাছে। বন্ধন দারিদ্রের কাছে। বন্ধন অন্ধবিশ্বাসের কাছে। এসব বদলাতেই হবে। এই বদলই মুক্তি। এই মুক্তি আমাদের দেশের প্রতিটি মানুষের অধিকার। এই অধিকারবোধ না জাগলে স্বরাজ আসবে কোথা থেকে? মানুষকে সেই অধিকার এবং অধিকারবোধ ফিরিয়ে দেবার চেষ্টায় আছি আমি, আর আমার কিছু বন্ধুবান্ধব, কিছু ছাত্র। তোকে এই কাজেই জড়াব ভেবেছিলুম।
এবার কালীমোহনকে দেখান কবি। বলেন, এ কালীমোহন, কালীমোহন ঘোষ। অনুশীলন সমিতিতে যোগ দিয়ে প্রথম দেশসেবার কাজ শুরু করেছিল; সদ্য কলেজের পড়া ছেড়ে দিয়ে, সে উনিশশো ছয়-সাতের কথা। ঢাকার প্রভিনশিয়াল কনফারেন্সের সময় আমার সঙ্গে পরিচয়, তারপর পাবনার কনফারেন্সে পরিচয় নিবিড় হল। তারপর থেকেই আমার সঙ্গে কাজ করছে। ও আমার পুত্রবৎ।
এর পর অতুলবাবুকে দেখান কবি, ইনি অতুল সেন। হাওড়ায় বাগনানের স্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন। হাওড়ার সেই বাগনান, যেখানে তোর বাঘা যতীন শিক্ষকতা করছিল, পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল একবার সেখান থেকে, আর ফেরেনি। অতুলবাবু এখন আমাদের সঙ্গে কাজ করেন। শান্তিনিকেতনে ওঁকে পাওয়া যায় না সাধারণত, বিশেষ কাজে এসেছেন কয়েকদিন আগে। আবার চলে যাবেন। পাবনা জেলায় আমার পিতামহের যে জমিদারি আছে, কালীগ্রাম পরগণার পতিসরের গ্রামে, অতুলবাবু থাকেন সেখানে। সার্বিক গ্রামোন্নয়নের কাজ করেন। ওঁর সঙ্গীদের মধ্যে কয়েকজন আছে যারা আমাদের এখানকার ব্রহ্মবিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছিল, উনি এখান থেকেই তাদের নির্বাচন করেছেন গ্রামে কাজ করার জন্যে। তোকে এঁদের সবায়ের সঙ্গেই জুড়ে দিতে চেয়েছিলুম। আমি ভেবেইছিলুম তুই দেশের কাজই করতে চাইবি।
নজরুল নতমস্তকে নীরবে বসে থাকে।
খাওয়া শেষ হলে কবি জিজ্ঞাসা করেন শহীদুল্লাহ্ সাহেবকে, আপনারা কি কাল সকালেই যাবেন?
সেরকমই ভেবেছিলুম, বলেন শহীদুল্লাহ্ সাহেব, কেন, আপনি কি অন্য কিছু চাইছেন?
না না, ঠিক আছে, বলেন কবি, সে ক্ষেত্রে কাল সকালে জলখাবার খেয়ে যাবেন আমার সঙ্গে। কালীমোহনেরও কাল কলকাতায় যাবার কথা ছিল। কী কালীমোহন, এবার কালীমোহনের দিকে ফেরেন কবি, তোর প্রোগ্রামের কি বদল হয়েছে কিছু?
না, বদল নেই, কালই যাচ্ছি। সকালবেলা।
তাহলে অযথা আর সুধাকান্তর স্টেশনে যাবার দরকার নেই। তুইই ওঁদের সঙ্গে থাকিস। আমার একটু সুধাকান্তকে প্রয়োজন এখন। আর একটা কথা, কাল সকালেও তুই আর অতুলবাবু থাকবি। আমার সঙ্গেই জলখাবার খাবি।
নজরুল শহীদুল্লাহ্ সাহেব আর পিংলার রাত্রিবাসের ব্যবস্থাও কোনার্ক বাড়িতেই। অতুলবাবু সেখানে থাকেন না। বাইরে বেরিয়েই তিনি একটু জোর কদমে হাঁটতে থাকেন। পিংলা হঠাৎ খেয়াল করে সেটা। নজরুল আর শহীদুল্লাহ্ সাহেব কিছু বুঝে ওঠার আগেই দৌড়িয়ে সে পৌঁছিয়ে যায় অতুলবাবুর কাছে। স্যর, পিছন থেকে ডেকে সে দাঁড় করায় অতুলবাবুকে, তারপর প্রণাম করে তাঁকে।
আমার নাম পিংলা, বলে সে।
হ্যাঁ, একটু অন্যরকমের নাম। তুমি তখন বললে, শুনলাম। কিন্তু ঠিক বুঝতে পারিনি। পিংলা?
পিংলা তার নামের ইতিহাস, করাচিতে পৌঁছিয়ে যাওয়া, পল্টনের ব্যাটালিয়ানে নজরুলদের সঙ্গে থাকা থেকে এখনকার নবযুগ বিক্রির কাজ পর্যন্ত সবই বলে তাঁকে। ঈষৎ হাসিমুখে আগ্রহের সঙ্গেই শোনেন তিনি। পিংলা বলে, আমাকে আপনি গ্রাম উন্নয়নের কাজে নেবেন স্যর?
তোমার মা'র পছন্দ হবে সে কাজ? – জিজ্ঞেস করেন অতুলবাবু।
মা'র? মা নিজে এখনো হাওড়ার ম্যুনিসিপ্যালিটিতে কাজ করে। ময়লা পরিষ্কার করার কাজই। কিন্তু আমাকে করতে দেবে না। যে কাজ নিজে করে ওই একটা কাজ ছাড়া আর যে কাজ আমার নিজের পছন্দ, সেই কাজই পছন্দ হবে মায়ের। আমাকে নেবেন স্যর?
আমার কোন আপত্তি নেই, বলেন অতুল, বরং আগ্রহই হচ্ছে। কিন্তু গুরুদেব নিজে ছাড়াও আরও একজনের তোমাকে পছন্দ করতে হবে। গুরুদেবের এই গ্রামোন্নয়নের কাজে আমরা সবাই আছি ঠিকই, কিন্তু এই কর্মযজ্ঞের প্রাণকেন্দ্র যিনি, তাঁর সঙ্গে তোমাদের আলাপ হয়েছে আজ: কালীমোহন ঘোষ। শেষ পর্যন্ত যদি আমারই সঙ্গে কাজ কর, তবুও এই কাজে প্রথম দীক্ষাটা তোমায় কালীমোহনের কাছেই নিতে হবে। কাল সকালে আমাদের সবায়েরই দেখা হচ্ছে, তখন আলোচনা করব। যা সিদ্ধান্ত, তখনই নেওয়া যাবে।
অতুলবাবুই কথাটা তুললেন জলখাবারের সময়। কবি বললেন, আমি তো সবাইকেই দলে নিতে চাই, আপনি আর কালীমোহন যদি মনে করেন ও ঠিক মানিয়ে নিতে পারবে গ্রামের পরিবেশের সঙ্গে, তাহলে করুক না ও কাজ আমাদের সঙ্গে। কিন্তু বাবা, এ কথাটা কি চিন্তা করেছ যে গ্রামের মানুষ দরিদ্র? তাদের সঙ্গে থাকতে হলে ওই দারিদ্রটুকু মানিয়ে নিয়েই থাকতে হবে সেটা বুঝেছ তো? এই কাজ থেকে আর্থিক স্বাচ্ছল্যের কোন আশু সম্ভাবনা কিন্তু আমি দেখতে পাচ্ছিনা। অতুলবাবু যদি পতিসরের ব্রতীবালক সংগঠনের কাজে তোমাকে লাগিয়ে দেন, তাহলে কিন্তু তুমি একজন ব্রতীই। ধর্মীয় ব্রত পালনের মতোই এই ব্রতও ব্রতীর কাছ থেকে প্রধানত কষ্টসহিষ্ণুতাই দাবি করে। এই কষ্টের মধ্যে প্রাপ্তি এক ধরণের আছে নিশ্চয়ই, কিন্তু ওইটুকু প্রাপ্তিই যে সব, এই কথাটা ব্রতীকে অহরহই মনে রাখতে হয়।
আমি মনে রাখব গুরুদেব, জবাব দেয় পিংলা।
কালীমোহনের আজ কলকাতায় যাবার কথা, সে ফিরবে দু'দিন পর। ঠিক হল, পিংলা আজ ফিরছে না, সে অতুলবাবুর কাছেই থেকে যাবে। নজরুল জিজ্ঞেস করল, তোর মাকে খবর দিয়ে দেব?
এখনই দরকার নেই, বলে পিংলা, যখন খবর দেবার দরকার হবে, তখন দেখা যাবে।