চার অক্ষরের গালাগালটা দাঁতের মধ্যে পিষে গিলে ফেললেন মিস্টার বাজোরিয়া। বললেন, মিস্টার মণ্ডল, পারছি না বললে তো চলবে না। কাজটা শুরু করতেই হবে আপনাকে। এনিহাউ।
মিস্টার মণ্ডল বললেন, পারছি না স্যার। চেষ্টা তো চালিয়েই যাচ্ছি। একেবারে অন্যরকম এক্সপিরিয়েন্স, বিশ্বাস করুন। না হলে আমি পারব না এমন কাজ পৃথিবীতে নেই স্যার।
মিস্টার বাজোরিয়া বললেন, হুম এই সব গালগল্প দিয়েই তো কাজটা বাগিয়ে ছিলেন। এখন কার্যক্ষেত্রে দেখছি উল্টো। আপনি একটি ওয়ার্থলেস মিঃ মণ্ডল। দু’দিনের মধ্যে কাজ শুরু না করতে পারলে প্রজেক্ট আমার হাত ছাড়া হয়ে যাবে। আর আপনি জানেন সেটা আমি কিছুতেই হতে দেব না। অতএব আপনার বদলে আমাকে অন্য কাউকে ভাবতে হবে।
মিস্টার মণ্ডল প্রায় লাফিয়ে উঠলেন, এটা করবেন না স্যার। মরে যাব। নামে অফিসার। আসলে তো দালাল স্যার। ওই কমিশনের কটা টাকায় সংসার চলে। আসলে আমার কী মনে হয় স্যার, আমাদের একটা অংশ নিয়েই কাজ শুরু করে দেওয়া উচিত। যদি বলেন ঝপাঝপ কাজ নামিয়ে দেব। আমাদের তো ডকুমেন্টেশনটা উদ্দেশ্য। সত্যিটা আর কি এতো দিন কেউ মনে রেখেছে?
মিস্টার বাজোরিয়া বললেন, মিঃ মণ্ডল আপনাকে যে কাজটা দেওয়া হয়েছে, সেটুকু নিয়েই আপনার ভাবা উচিত। কী করলে কী হবে, তা ভাবার অন্য লোক আছে।
হ্যাঁ স্যার, আসলে ওটা তো হন্টেড হাউজ। আপনি দূর থেকে আর কীভাবে বুঝবেন আমার কী অবস্থা হচ্ছে। একেবারে হুমড়ি খেয়ে পড়ছি স্যার। নাক মুখ থেতো হয়ে গিয়েছে। যাকে বলে ঘাড়ে ধাক্কা। বিশ্বাস না হয় ছবি পাঠাব স্যার?
বাজোরিয়া বললেন, আপনার থোতা মুখ ভোতা হয়েছে, বেশ হয়েছে। সে মুখের ছবি দেখে আমি কী করব?
স্যার, তাহলে ভাল মুখের ছবি পাঠাই। বিউটি উইথ ব্রেন? আপনার মতো মানুষের জন্য তো আর শুধু বিউটি হলে চলবে না।
সেই। আপনার রেকমেন্ডশনের জন্যেই বসে ছিলাম আর কী! ভ্যানতারা কষা বন্ধ করবেন?
কী তারা স্যার? শুকতারা? আমি শুকতারা ওঠার আগে থেকেই শুরু করছি কিন্তু সন্ধ্যাতারা উঠে যাচ্ছে কাজটা করে উঠতে পারছি না।
আপনি চালাক না বোকা?
বোকা স্যার, বোকা। বোকার হদ্দ।
উঁহু। মনে হচ্ছে আপনি অন্য পার্টির কাছে টাকা খেয়ে আমার কাজটা ডিলেড করাচ্ছেন। সরি মিঃ মণ্ডল, আমি অন্য কারো সঙ্গে নিগোসিয়েট করছি।
জয়দেব মণ্ডল এবার কাচুমাচু করে বললেন, আমায় আর একটু সময় দিন স্যার। আমি শেষ চেষ্টা করে দেখছি। আমি কোনো ভ্যানতারা করিনি। যা সত্যি, তাই বলার চেষ্টা করছিলাম।
মিস্টার বাজোরিয়া বললেন, বেশ। আর চব্বিশ ঘণ্টা সময় দিচ্ছি আপনাকে।তারপর আমি আপনার কাছ থেকে প্রজেক্ট তুলে নেব।
মিঃ মণ্ডল বললেন, ওকে স্যার। শেষে একটা কথা জিজ্ঞাসা করি স্যার? বাচালতা মাফ করবেন। আপনি এত ভাল বাংলা বলেন কী করে?
বাজোরিয়া বললেন, কেন? বাংলা কি আপনার একার সম্পত্তি নাকি?
না মানে একে বাজোরিয়া, তাই আবার ইউএসএ। লিংকটা খুঁজে পাচ্ছি না স্যার।
বাজোরিয়া বললেন, বহিরাগত তাই তো? ভাষা হল নদীর মতো। তাকে ফ্লো করাতে না পারলে মরে যায়। এটা বুঝবেন কবে? এনিওয়ে আমার মা বাঙালি আর আমরা তিন পুরুষ ধরে কলকাতার বাসিন্দা ছিলাম। যাক। তাহলে ওই কথাই রইল। মাঝখানে একদিন। তারপর আমি আপনার কাছ থেকে রিপোর্ট নিচ্ছি।
ওকে স্যার। বলে ফোনটা নামিয়ে রেখে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন জয়দেব মণ্ডল। না, একটা উপায় বার করতেই হবে। না হলে কাজটা হাত থেকে চলে যাবে। সদলবলে গিয়ে কাজ নেই। যা থাকে কপালে, আজ তিনি একাই যাবেন। হ্যাঁ, এখুনি।
হাতে একটা সাত ব্যাটারির টর্চ নিয়ে, পায়ে গাম বুটখানা গলিয়ে পথে বের হলেন জয়দেব মণ্ডল। ক্ষমাসুন্দরী বালিকা বিদ্যালয়ের মস্ত টিনের দরজা তার মাঝখানে কেটে আর একটা ছোট দরজা মাথা নিচু করে ঢুকবার। জয়দেব সাবধানে মাথা গলালেন। তাঁর লোকজন বাইরের ঝোপঝাড় কিছুটা পরিষ্কার করে রেখেছে। ব্লিচিংও ছড়িয়ে রেখেছে। না হলে সাপখোপের ভয়ও তো কম নয়। যদিও তাঁদের ছোটবেলার মতো ভয় এখন নেই। এখন সাপখোপ কমই আছে পৃথিবীতে। তবু। পুরনো ভয়টা এখনো মন থেকে যেতে চায় না। এসময়টায় না এলে যে তার দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। দেখা পেলে তবে না বোঝানোর প্রশ্ন। স্যার তো বুজরুকি বলে চালিয়ে দেবেন কিন্তু তাঁকে তো কাজটা করতে হবে। ভয়ে ভয়ে জয়দেব টর্চ মারলেন সামনে। জীবনটা সিনেমা নয়। কোনো অশরীরী সুন্দরী নারী সামনে এসে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা নেই। তাঁর মনে কোনো রোমাঞ্চ অনুভব হচ্ছে না। শুধু কাজটা কীভাবে হাসিল করা যায় সেই চিন্তা। একটা হাওয়া চারপাশ দিয়ে পাক খেয়ে গেল জয়দেবের। জয়দেব বললেন, জয় মাতাদি। কোনো রেসপন্স না পেয়ে বললেন, আপনি কি জানেন, আমার এখানে আসার উদ্যেশ্য? না কোনো খারাপ উদ্যেশ্য নয়। আমাকে কি দেখেছেন আমি কোন বুলডোজার নিয়ে এই বাড়ি ভাঙতে এসেছি? আসলে আপনিও যেমন আপনার কাজের প্রতি ডিভোটেড আমিও তেমনি। আপনি শুধু আমার প্রজেক্ট প্ল্যানিংটা শুনুন ম্যাডাম। ম্যাডাম ডাক শুনেই ছায়ামূর্তি যেন একটা অবয়ব পেল। কালো পেটানো চেহারা, এই লম্বা। শুকনো খটখটে, যেন একটা খেজুর গাছ। একটা কাপড় আড় ফেত্তা জড়ানো। ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল, কী হবে এখানে? লঙ্গরখানা? দম দেবে এখানে আর নেত্ত করবে স্বর্গে? কতজনকে খেদিয়েছি এখান থেকে। তোমরা এ জা’গার মর্ম বুঝবে কি হে আজকালকার ছোঁড়া? এটাকে কী বলে জানো? ইস্কুল, ইস্কুল। তোমাদের ওই মন্দির, মসজিদ, গির্জা সবের থেকে পবিত্র থান। এখানে হাজার হাজার বাচ্চা খেলা করত একসময়। বিদ্যার দেবী সরস্বতী নিজে হেঁটে বেড়াতেন এই মাঠ জুড়ে। আর মানুষের বুদ্ধি তাকে পোড়ো বাড়ি বানালে। সেই সব দিনের কথা ভাবলে এখনো হু হু করে আমার বুকের ভেতরটা।
জয়দেব বললেন, আমি সব জানি মহামান্যা। আমি না পড়লেও আমার দাদারা পড়েছে ইস্কুলে। সে একটা দারুণ জায়গা ছিল শুনেছি। তাই জন্যেই তো আমাদের স্যারের এই প্রজেক্ট। আপনি যদি একটু শোনেন।
ছায়ামূর্তি বলল, অনেক প্রজেক্ট দেখলাম! স্কুলবাড়িগুলোকে ভেঙে গুড়িয়ে দিলে তোমরা। বাচ্চাগুলো কে কী বলে তোমাদের ওই ট্যাব না কী ধরালে, ল্যাপটপ ধরালে। তোমাকে আর কী বলব, তুমি তো দু’দিনের ছোকরা, নিজেই জানো না ইস্কুল কাকে বলে। পড়াশোনা তোমরা হয়তো করেছ, কিন্তু আনন্দ কী জিনিস তোমরা জানোনি।
জয়দেব বলল, তা ঠিক। কিন্তু ওই রকম অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে পড়াশোনা করাটাও তো নিরাপদ নয়। তবে হ্যাঁ ব্যবস্থাটার মধ্যে একটা গ্রাঞ্জার ছিল। সে কথা মাথায় রেখেই তো..
জয়দেব কে কথা শেষ করতে দিল না ছায়ামূর্তি, বলল, আজকের দিনে সত্যি তোমাদের অমনটা মনে হয় বটে কিন্তু পৃথিবীটা এমন ছিল না। সেই একটা কালো ধোঁয়ার মতো সময় এল। দিব্যি ইস্কুল হচ্ছিল। হৈ হৈ করে ক্লাস চলছিল। ঢং ঢং.. মস্ত বড়ো পেতলের ঘণ্টায় ইয়া বড়ো হাতুড়ি দিয়ে ঘণ্টা বাজাতাম আমি। মাঠ দিয়ে সেই শব্দ গড়িয়ে গড়িয়ে চলে যেত ঘর থেকে ঘরে। আর টিফিনের সময় সে যে কী অপূর্ব দৃশ্য! ঘণ্টা বাজলে হুড়মুড় করে থালা হাতে ক্লাস থেকে বেরত বাচ্চাগুলো। সয়াবিন আর আলুর ঝোল দিয়ে কী গোগ্রাসে ভাত খেত সে যদি তুমি দেখতে! আহা, খিদে কাকে বলে! এখন বাচ্চাগুলোকে বাড়িতে ঠিক মতো খেতে দেয় কিনা কে জানে!
জয়দেব মরিয়া হয়ে বলল, কেন দেবে না? ওদের খাবার তো বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হয় এখন।
ছায়ামূর্তি বলল, কী জানি! মানুষের তো লোভ, শিশুর খাবারটাও বিক্রি করে দেয় হয়তো। আর জানো যেদিন ডিম দেওয়া হতো খুশিতে চকচক করত মেয়েদের চোখগুলো। যেন স্বর্গ নেমে আসত এই মাঠটার ওপরে। কথাটা হাওয়ায় ভাসছিল। কী এক রোগ ছড়িয়েছে দেশে দেশে। সে এক ভয়ংকর ছোঁয়াচে রোগ। মানুষ মানুষের কাছে ঘেঁষতে পারবে না। হাঁচি-কাশি এমনকী কথার সঙ্গে বাতাসে উড়ে যাওয়া থুতুতে ছড়িয়ে পড়ছে এক অজানা জ্বর। শ্বাসকষ্ট। তারপর ঘনিয়ে আসছে মৃত্যু। কোনো ওষুধ নেই এ রোগের। এখন উপায়! তড়িঘড়ি বন্ধ হয়ে গেল স্কুল-কলেজ বাজার হাট। দরজা জানলা এঁটে ঘরে বসে থাকল মানুষ। প্রথমে মানুষ ভেবেছিল অল্পদিন পরেই ঠিক হয়ে যাবে সব। কিন্তু হল না।মাসের পর মাস গড়াল, বছরের পর বছর। ইস্কুলের মাঠগুলো ভরে গেলো জঙ্গলে। দেওয়ালের গা বেয়ে গজাল আগাছা।পলেস্তারা পড়ল খসে। শ্যাওলা জমে পিচ্ছিল হল পথ। শুরু হলো বইখাতার বদলে ইস্কুলে ওই ট্যাব দেওয়া। তারপর অনলাইন ক্লাস। আমার ঘণ্টা বাজানোর চাকরিটা গেল। যদিও আমি অভ্যাসবসত সকাল-দুপুরে এসে একবার ঘণ্টা বাজিয়ে যেতাম। কী আর করব বল আমি? ইস্কুলের পাশে আমার ওই একচিলতে ঘর। আমার না ছিল একটা ছেলে না ছিল একটা মেয়ে। ওই ইস্কুলের মেয়েগুলোই ছিল আমার প্রাণ। ইস্কুলটা আঁকড়ে ধরেই না আমি বেঁচে থাকতাম। আমি তো পারমেন্ট ছিলাম না। কটা টাকা মাত্র মাইনা পেতাম। তাও আমি কোনোদিন অন্য কাজে যাইনি। অথচ চোখের সামনে দেখলাম ইস্কুলটা ধীরে ধীরে পোড়ো বাড়ি হয়ে গেল।
সবাই বলল ভ্যাক্সিন নাও। তবে ইস্কুল খুলবে। কিন্তু তাও আর খুলল না স্কুল। ভ্যাক্সিন নিলেও নাকি আর অমন গাদাগাদি করে এক ক্লাসের মধ্যে বসে পড়াশোনা করা যাবে না। সিস্টেমই নাকি পালটে ফেলতে হবে। প্রথম প্রথম স্কুল থেকে আমায় মাইনা দিত। তারপর ইস্কুলই চলল না আর আমায় মাইনা কোথা থেকে দেবে। বন্ধ হয়ে গেলো সব। বুড়ো বয়সে না খেতে পেয়েই প্রায় মরলাম। কিন্তু ইস্কুলবাড়িটাকে ছাড়তে পারলাম না। সেই থেকেই এখানে ঘুরে ঘুরে বেড়াই। তবে বেশির ভাগ স্কুল বাড়িগুলোই তো ভেঙে গুড়িয়ে কিছু না কিছু বানিয়ে তুলেছে সরকার। আমি এখানে সেটা হতে দিইনি। যে-ই এখানে ঢুকতে গেছে তার মাথায় মেরেছি আদলা ইটের বাড়ি।
এবার গলা খাকড়ি দিল জয়দেব, বলল, যদি আমার কথাটা একটু শুনতেন। তারপর যদি পছন্দ না হয় তাহলে আমায়ও না হয় আদলা ইটের বাড়ি মেরে তাড়াবেন।
কী মনে করে ছায়ামূর্তি বলল, বেশ শুনি তোমার কথা। কী এমন আলাদা কথা বলবে তুমি শুনি।
ছায়ামূর্তির কানের কাছে ফিসফিস করে যা বলল জয়দেব, তাতে সোঁ করে একবার পাক খেয়ে গেল হাওয়ার ঘূর্ণি। তারপর ছায়ামূর্তি বলল, তা মন্দ তো নয় তোমার কথা। তা আমাদের কালে একটা কথা ছিল দুধের স্বাদ ঘোলে মেটা, এও তো দেখি খানিক তাই। তা বেশ ছোকরা তোমায় না হয় শুরু করতে দিলাম কাজ, কিন্তু যদি দেখি উল্টোপাল্টা করেছ তবে তোমাকে আর তোমার স্যারকে ঘেঁটি ধরে ওই তেঁতুল গাছের ডালের থেকে ঝুলিয়ে দেব, এই আমি বলে দিলাম। আর কাজ হয়ে গেলে আমার একটা পিন্ডি দিও তো বাবা। এই ঘোরাঘুরি আর ভাল লাগে না। এবার একটু শান্তিতে ঘুমাব।
কোন রকমে ঢোক গিলে জয়দেব বলল, জি আজ্ঞে।
ডান, বাজোরিয়াকে মেসেজ সেন্ড করেই ঘুমিয়ে পড়ল জয়দেব। সারারাত জাগা গিয়েছে। কয়েক ঘণ্টা ঘুমিয়ে নিয়েই কাজে নেমে পড়তে হবে। নির্দেশ মতো কাজ শুরু হয়ে গেল পরদিন থেকেই। হ্যাঁ, দেশের বেশির ভাগ স্কুল বিল্ডিংগুলোই ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। শুধু মুষ্টিমেয় কয়েকটা রক্ষা করা হয়েছে হেরিটেজ বিল্ডিং হিসাবে। সেগুলোর মধ্যে থেকে এই দুটি স্কুলকে লিজ নিয়েছেন বাজোরিয়া। ট্যুরিজম ইন্ডাস্ট্রি ডেভেলপ করবেন বলে। এরকম স্পট সহজে মেলে না। পাশাপাশি গার্লস আর বয়েস স্কুল। টোটাল খেলাটা হবে লাইট আর সাউন্ডের মাধ্যমে। লোক লাগিয়ে দিয়েছে জয়দেব। জঙ্গল সাফ করা হয়েছে। কলি চুনের পোচ পড়েছে দেওয়ালে দেওয়ালে। সাবেকি টাচ রাখার জন্যে কোনো দামি পেইন্ট ব্যবহার করা হয়নি। চেয়ার, বেঞ্চ সব নতুন করে সাজানো হচ্ছে। টিফিনের ঘণ্টা, মিড ডে মিলের খাওয়া দাওয়া, সরস্বতী পুজো থেকে জানলা দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে গার্লস ইস্কুল আর বয়েজ স্কুলের প্রেম – সবই থাকবে তার মধ্যে। ক্লাসটিচিং থেকে পিটি, বৃষ্টির জল জমা মাঠে স্কার্ট তুলে মেয়েদের ছপছপ করে হেঁটে বেড়ানো আর বয়েজের মাঠে ছেলেদের দেদার ফুটবলে লাথি এভরিথিং এক সিটিংয়ে। এইজন্যে দুই স্কুলের বাউন্ডারি ওয়ালটা ভেঙে দেওয়া হবে।
প্ল্যান মতো সব কাজই ঠিকঠাক এগোল। প্রজেক্ট ওপেন করার জন্যে বাজোরিয়া এলেন। সঙ্গে এলেন পর্যটনমন্ত্রী নিজে। সকলে মুগ্ধ হয়ে গেল অনুষ্ঠান দেখে। নিয়মবিধি, দূরত্ববিধি মেনে টিকিট বুকিংয়ের ব্যবস্থা করা হল। ভিড় বাড়তে লাগল হুড়মুড় করে। কেউ জানল না জয়দেব কতখানি প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে রাতের অন্ধকারে ছায়ামূর্তির কাছ থেকে কত খুটিনাটি টিপস নিয়ে গেছে। সবাই ধন্য ধন্য করতে লাগলো এমন ডিটেলিংয়ে। অনেকে অনুষ্ঠান দেখতে দেখতে চোখ মুছতে লাগল, আহা এমন স্কুল জীবন যদি তারা পেত! মনটা জয়দেবেরও খারাপ খারাপ করতে লাগল। সত্যি খুব কি ক্ষতি হত স্কুলগুলো থাকলে? অবশ্য সেই সব মরকের দিন, গল্প শুনলেও যে শিউরে উঠতে হয়। তবে না এইবার তার কাজ শেষ। প্রজেক্ট রান করানোর দায়িত্ব অন্যের হাতে দিয়ে সে চলে যাবে অন্যত্র। তার আগে ছায়ামূর্তির পিণ্ড দানের ব্যবস্থা করবে সে। সে যে কথা দিয়েছে।
গঙ্গার পাড়ের দিকে হাঁটতে লাগল জয়দেব। পুরুতমশাইকে বলা আছে ওখানেই অপেক্ষা করবে। হঠাৎ শোঁ শোঁ করে হাওয়ার ঘূর্ণি। তারপর এক নাকিকান্নার সুর। ছেড়ে দে জয়দেব, আমাকে ছেড়ে দে। আমি মুক্তি চাই না। কথা আমি ফিরিয়ে নিলাম। ওই যখন ঘণ্টাধ্বনির সঙ্গে শুরু হয় প্রার্থনা সঙ্গীত, কলকল করে ওঠে ছেলেমেয়েগুলো – তার চেয়ে শান্তি আমার আর কিছুতে নেই। আর তাছাড়া কতজনের পিন্ডি দেবে তুমি? ওরা সব যে বেঁচে উঠেছে। তাকিয়ে দেখো তুমি। আসলে একটা সময় থমকে ছিলো। পর্দা পড়ে গিয়েছিল সবকিছু ওপর। তোমার সোনার কাঠির ছোঁয়ায় আবার সব জেগে উঠেছে আগের মতো। আর ওরা জেগে উঠলে আমিও কি আর দূরে থাকতে পারি? তুমি ভেব না। আমি ঠিক ওদের মাঝে জায়গা করে নেব। শুধু একটা শরীরের অপেক্ষা। বলে ভুস করে মিলিয়ে গেল হাওয়ার ঘূর্ণি। জয়দেব কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে গলার মাফলারটা ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে ফিরতে লাগলো বাড়ির দিকে। আনন্দে তার চোখে চকচক করতে লাগল জলের কণা।