এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  অন্যান্য  মোচ্ছব

  • আশা…গৃহ…সাপ - উপসংহার

    Samaresh Mukherjee লেখকের গ্রাহক হোন
    অন্যান্য | মোচ্ছব | ০৯ অক্টোবর ২০২৩ | ৭০৪ বার পঠিত
  • প্রাককথন:-
         ৫.১০.২৩ পোষ্টিত "আশা জাগায় গৃহবধূ এবং সাপ" লেখা‌টির মূল প্রতিপাদ‍্য ছিল একটি বিশ্বাস (EOTO)। গুরুর আড়াই‌লাখ ভিজিটর জেনে ভেবেছি যদি ৫% ভিজিটরের‌ও বিশ্বাস‌টা মনে ধরে, ছড়াতে চায়, তাতেও কিছু পরিবর্তন হতে পারে। কোনো বিশ্বাস আঁকড়ে থাকার মানুষ চিরকাল‌ই কম। গুরুতে একটা নমুনা দেখেছি নিম্নোক্ত পোষ্টে। তার ওপর ১৭ পাতা মন্তব্য হয়েছে ৫ বছর ধরে  :


     
     
    প্রত‍্যয়ের দৃঢ়তা প্রকাশ পায় নিম্নোক্ত মন্তব্যে:
     

     
     
    তবে ঐ প্রত‍্যয় হয়তো ঈশানের একার নয়। সে কিছু মুষ্টিমেয় প্রত‍্যয়ী মানুষের প্রতিভূ হয়ে ঐ পোষ্ট করেছে। সুনীল এবং নীললোহিত যেমন হরিহর আত্মা, তেমনি ঈশান এবং সৈকত। একাকী প্রয়াসে আত্মোন্নতি সম্ভব হলেও বৃহৎ পরিসরে প্রত‍্যয়ী মানুষের পক্ষে‌ও একা লক্ষ‍্যে পৌঁছনো কঠিন। তাই ঈশান‌ আগ্ৰহী মানুষ‌কে গুরুর মিশন ছড়িয়ে দিতে আহ্বান জানায়:
     

     
     
    ছড়ানোর আহ্বান ৭ বছর পরে‌ও প্রতিধ্বনি‌ত হয় কারণ একবার আহ্বানে কাজ হয় না - দিতে হয় বারবার :
     

       
      একটা বিশ্বাস আঁকড়ে যারা পেশাগত, সামাজিক, পারিবারিক দায়দায়িত্ব সামলেও ১৯ বছর ধরে লড়ে যাচ্ছে - তাদের উদ‍্যম‌ কুর্ণিশযোগ‍্য। জনশ্রুতি কিছু বাঙ্গালী একজোট হলে লিটল ম‍্যাগাজিন, ক্লাব ইত্যাদি করার পরে তাদের মধ‍্যে দেখা যায় ইজম, ইগো নিয়ে টানাপোড়েন। সেরিব্রাল বলে জাতটি‌র মধ‍্যে বৈপরীত্য‌ময় বৈশিষ্ট্য‌র সমাহার‌ পরিলক্ষিত হয়। সিরিয়াসনেসের সাথে ছ‍্যাবলামি, শালীনতা‌র সাথে কুরুচি, সুক্ষ্ম অনুভূতি‌র সাথে কর্কশ অসংবেদনশীল‌তা, আত্মবিশ্বাসের সাথে আত্মম্ভরিতা, উদারতার সাথে অসহিষ্ণুতা  ইত‍্যাদি, প্রভৃতি। এই পোষ্টের ওপরেও বর্ষিত হতে পারে বিদ্রুপ তবু চার দশক আগে কীভাবে EOTO বিশ্বাসে অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম, এতোদিন ধরে লোক বুঝে প্রয়োগ করে কেমন অভিজ্ঞতা হয়েছে - তার কয়েকটি উপাখ্যান উপসংহারে র‌ইলো - যাদের ইচ্ছে হবে পড়বে। 

              - - - - - - - - - - - - - - - - -  
    ১. মাঠায় রকেখড়ি - যাদবপুরে একটি পর্বতারোহণ ক্লাব ছিল JU Mountaineering & Hiking Club. আশির‌ দশকের শুরু‌তে তাদের সাথে ডিসেম্বরে পুরুলিয়ার মাঠা পাহাড়ে গেছি‌লাম বেসিক শৈলারোহন কোর্সে। দলনেতা যাদবপুরে‌র‌‌ প্রাক্তন সিনিয়র  মৈনাক বসু। মাঠা টপে নাইট আউটে আমরা আগুন ঘিরে বসেছি। মৈনাকদা Mountain Manners প্রসঙ্গে বললেন - "While at mountains  leave nothing but footprints, bring nothing but memories." কথাটা খুব নাড়া দিলো। হয়তো বাকিদের সেভাবে প্রভাবিত করেনি। তাই বাকি তিনদিনে‌ কয়েকজন চ‍্যূয়িংগাম, টফির র‍্যাপার, সিগারেটের প‍্যাকেট, পোড়া শেষাংশ এখানে ওখানে ফেললো। আমি কুড়িয়ে এনে ক‍্যাম্পের আগুনে ফেলেছি। 
     
           অনেক পরে জেনেছি মৈনাকদার সেই কথাটি প্রকৃতিপ্রেমী, পর্বতারোহী মহলে লোকগাথার মতো চলে আসছে। কে, কবে, কোথায় বলেছিলেন জানা নেই। বাক‍্যটির মর্মার্থ আমার মর্মে শিলালিপি হয়ে রয়ে গেছে। তাই আজ‌ও প্লাস্টিক, জঞ্জাল যত্রতত্র ফেলতে পারিনা। পাহাড়, প্রকৃতি‌তে তো নয়‌ই, শহরেও নয়। সেই তাড়নায় কখনো বলতে যাই কোনো সাধারণ গৃহবধূ, নেপালী দারোয়ান বা শিশুদের যেখানে মুখঝামটা খাওয়া‌র সম্ভাবনা কম। তবে তরুণদের এড়িয়ে চলি কারণ ঐ বয়সটা‌ হচ্ছে বয়সের সম্মান না দিয়ে বিদ্রুপ বর্ষণের মরশুম। কৃত্তিম নয়, তুখোড় জৈবিক বুদ্ধি‌মত্তা‌ও কখন কীভাবে প্রতিক্রিয়া করবে তা অনুধাবন করা ঈশ্বরের‌ অসাধ‍্য।

    ২. দেওরিয়া তাল - ২৯.৫.২০১৯ : ৩৫ দিনের একাকী ভ্রমণে গেছি‌ উত্তরাখণ্ড। ২৮শে গুপ্তকাশী থেকে শেয়ার জীপে গেলাম চোপতা। ওখান থেকে তুঙ্গনাথ গিয়ে রাতে থাকলাম। ২৯ সকালে চন্দ্রশিলা দেখে নেমে এলাম চোপতায়। শেয়ার জীপে চারটে নাগাদ পৌঁছলাম সারি গ্ৰাম। চা নাস্তা করে দু কিমি চড়াই পথে উঠতে শুরু করলাম দেওরিয়া তাল। লোকবিশ্বাস জ‍্যোৎস্নারাতে দেবতারা ঐ তালে আসেন স্নান করতে।
     
      বুকে পিঠে দুটো স‍্যাক নিয়ে ওঠার মাঝে একটু দাঁড়িয়ে দম নিচ্ছি। একটা দৃশ‍্য দেখে মুগ্ধ হলাম। পাহাড়, প্রকৃতি নয়। তিনটি মানুষ। মধ‍্যবয়সী পিতা তাঁর বছর দশেকের  কন‍্যা ও বছর আটেকের পুত্রকে নিয়ে নামছেন। তিনজনের হাতে‌‌ই বড় প্লাস্টিকের থলে। বনদপ্তর প্রবেশ পথেই দেওরিয়া তাল No Plastic Zone নোটিশ লিখে পর্যটকদের অনুরোধ করেছেন, যত্রতত্র প্লাস্টিক না ফেলতে। তবু  দায়িত্ব‌জ্ঞান‌হীন পর্যটক পথে অনেক প্লাস্টিক ফেলেছে। তিনজনে ফেরার পথে রাস্তা থেকে যতটা সম্ভব প্লাস্টিক কুড়িয়ে‌ আনছে। ক্ষুদেটির উৎসাহ বেশি। সে হাঁটু মুড়ে বসে গুটখার ছোট্ট প‍্যাকেট‌ও সরু আঙ্গুল দিয়ে খুঁটে  তুলছে। অভিভূত হয়ে পিতাকে বললাম, এদেশের অধিকাংশ পিতা যদি আপনার মতো তাদের সন্তানদের ছোট থেকে এহেন আচ‍রণে উদ্বুদ্ধ করেন তাহলে ভারত কখনো সুইজারল্যান্ড না হতে পারলেও একটু পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে পারে। দেশবাসী সচেতন, দায়িত্ব‌শীল না হলে জনবহুল দেশ কেবল সরকারি উদ্যোগে পরিচ্ছন্ন থাকতে পারে না। পিতা প্রশান্ত হাসেন। 
     
     কিছু বাণিজ্যিক পর্যটন সংস্থা‌ও Responsible Tourism Initiative হিসেবে ট্রেকারদের উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করেন। তারা নিজেরা তো ফেলেই না অন‍্যের ফেলা কচড়া কুড়িয়ে আনে। 

    সুইজারল্যান্ড, নর‌ওয়ে, নেদারল্যান্ডস গোছের উন্নত, কম জনসংখ্যার দেশ  পরিচ্ছন্ন বলে জানি। কিন্তু গুয়াতেমালার ওপর একটি দীর্ঘ ট্র‍্যাভেল ভিডিওতে দেখি বড় রাস্তা তো বটেই, অলিগলি‌ও বেশ পরিচ্ছন্ন। তুলনায় ভারতের সিলিকন ভ‍্যালির রাস্তায় হাঁটলে লজ্জায় মাথা হেঁট হয়।

    ৩. উখিমঠ  - ৩০.৫.২০১৯ :  দেওরিয়া তালে ২৯ রাতটা সঙ্গে নিয়ে যাওয়া টেন্টে থেকে সকালে‌ তালের সৌন্দর্য দেখে তৃপ্তিতে মন ভরে গেল। দুপুরে গেলাম উখিমঠ। বিকেলে আশপাশে ঘুরতে বেরিয়ে‌ছি। একদল ক্ষুদের সাথে আলাপ হোলো। তারা একটি জায়গা দেখাতে নিয়ে চললো। তার কিছু ধার্মিক স্থান‌মাহাত্ম্য‌র কথা‌ও বললো। ছবিতে ডাইনে সবুজ ফুলহাতা জামা পরা শিশু‌টি সারিকা - তাকে দেখতে‌ও যেমন মিষ্টি তার কথা‌গুলোও তেমনি আদুরে। যে পাথর‌টির সামনে ওরা হাত জোড় করে বসে আছে, ওটাই সেই স্থানমাহাত্ম‍্যের নিদর্শন - মাটিতে ত্রিশুল গাঁথা, লাল, হলুদ চেলি ঝুলছে।

       
    ভ্রমণপথে শিশুদের সাথে আলাপ হলে দেওয়ার জন‍্য সাথে টফি রাখি। ওদের দুটে করে টফি দিয়ে দেখতে চাই কী করে। যা ভেবেছি তাই। টফি মুখে পুরে‌ র‍্যাপার‌গুলো মাটিতে ফেললো। শুরু করি EOTO - বলি, তোমরা যেখানে থাকো সেখানে এভাবে কচড়া ছড়ানো কী ঠিক হোলো? একদম আগে বসা দলের বড় মেয়েটি নয়না বলে, কিন্তু সবাই‌ তো সিগারেট, গুটখার প‍্যাকেট মাটি‌তেই ফেলে। যারা এখানে বেড়াতে আসে তারাও। আমি‌ও ওদের সাথে টফি খেয়েছি‌লাম। বলি, আমি‌ও তো বেড়াতে‌ এসেছি, ক‌ই আমি তো ফেলিনি‌। এই দ‍্যাখো পকেটে রেখেছি। নীচে গিয়ে ডাস্টবিনে ফেলবো। 
     
       শিশুদের বোধবুদ্ধি কম হতে পারে কিন্তু ওদের মন এঁড়ে তর্কের প্রবণতা মুক্ত। ওরা বড়দের দেখে আনমনে ফেলেছে। এভাবে কখনো ভাবে নি। আমার কথা শুনে বোঝে ওটা ঠিক হয়নি। সবাই চটপট মাটিতে ফেলা র‍্যাপার‌গুলো তুলে নেয়। নয়না বলে, আঙ্কল, আমরা আর এভাবে ফেলবো না, অন‍্যদের ফেলতে দেখলেও বারণ করবো। বলি, বাঃ, তাহলে খুব ভালো হয়। দেখবে তোমাদের আশপাশ কেমন পরিস্কার থাকবে। এর জন‍্য তোমাদের আর একটা করে টফি তো দিতে‌ই হয়। এবার আর কেউ র‍্যাপার মাটিতে ফেললো না। 
     
    ৪. রামবন - ২৫.০১.২০২০ :  সেবার শীতে ৬৩ দিনের একাকী ভ্রমণে গেছি‌লাম মধ‍্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্রে। সাতনা থেকে রেওয়ার পথে নামলাম রামবন। গেস্টহাউসের শিক্ষিত, ভদ্র ম‍্যানেজার সাহেবের সাথে বেশ গল্প হোলো। জনবিরল, শান্ত পরিবেশ। ওখানে থাকা‌র পরিকল্পনা ছিল না। কিন্তু মনে হোলো একটি রাত থাকলে মন্দ হয় না। ম‍্যানেজার সাহেবের বদান্যতায় ঘর‌ও পেয়ে গেলাম।
     

     
    বিকেলে নির্জন সরোবরের পাশে ঘুরছি। পাশে প্রাচীন শিব মন্দির। আলাপ হোলো ছোট্ট শিবার সাথে। উখিমঠে যেমন EOTO এক্সপেরিমেন্ট করেছি‌লাম, শিবার সাথে‌ও করলুম। প্রতিক্রিয়া হোলো আশাপ্রদ। সেটা আর শব্দে লিখলাম না। ভিডিও করেছি‌লাম। লিংক রাখলাম নীচে - Resolution of Siva.
     
    ৫. জব্বলপুর - ১২.০২.২০২০ :  গেছি মদনমহল প‍্যালেসের নীচে ব‍্যালান্সিং রক দেখতে। অবিশ্বাস্য ভারসাম‍্যে টিকে থাকা পাথরটি দেখে অবাক হ‌ই। তবে ওখানে একটি মানুষ‌ও আমায় বেশ অবাক করেছি‌ল। 

    বছর পঞ্চান্নর স্বল্পশিক্ষিত রাজেশ ওখানে একটি চা, নাস্তা‌র স্টল চালান। শহুরে চোখা স্মার্ট‌নেসে কখনো হাবুডুবু খাই। ভ্রমণপথে কিছু সাধারণ মানুষের সাথে আলাপচারিতায় মনে বাতাস লাগে। কথা প্রসঙ্গে পরিবেশ দূষন, মানুষের অবিমৃষ‍্যকারিতা নিয়ে রাজেশের বলার ভঙ্গিতে তীব্র আক্ষেপ ফুটে বেরোচ্ছি‌লো। বলি আপনার বক্তব্য ভিডিও করে ছড়াতে পারি? রাজেশ আপত্তি করেনি। লিংক র‌ইলো নীচে - Anguish of Rajesh


                  রাজেশ ও তার পোষ‍্য ভোলা 

    ৬. নীলকণ্ঠ মহাদেব মন্দির - দৌসা - ০৭.০২.২০২৩ : সেবার‌ও শীতে দু মাসের একাকী ভ্রমণে মহারাষ্ট্র, মধ‍্যপ্রদেশ, রাজস্থান ঘুরে শেষপাতে তিনদিন ছিলাম দৌসা। ৬ তারিখ তিরিশ কিমি দুরে The most haunted Fort of India - ভানগড় কেল্লা দেখে এসেছি। ৭ তারিখ বিকেলে দৌসা শহরের মাঝে হেঁটে ঘুরতে গেছি তিন কিমি দূরে ছশো ফুট উঁচু পাহাড়শিরে নীলকণ্ঠ মহাদেব মন্দির।


     
    চড়া‌ই পথে আলাপ হোলো স্থানীয় এক আলাপী মানুষ বশিষ্ঠর সাথে। মন্দিরে কিছু কর্মকর্তা গোছের লোক ছিলেন। বশিষ্ঠ আমায় স্বাদু লাড্ডু প্রসাদ দিয়ে বললেন, পিছনের চত্বর‌টা ঘুরে দেখুন, ওপর থেকে চারপাশ সুন্দর দেখায়। আমার এদের সাথে কিছু কথা আছে। দেখলাম। বেশ লাগলো। সাড়ে পাঁচটা বাজে, অতোটা হেঁটে, এতোটা উঠে প্রাণটা চা চা করছে। দেখি একটা টেবিলে কল লাগানো ইনসুলেটেড স্টীলের ক‍্যান রয়েছে। পাশে রাখা পেপার কাপ‌। আশপাশে কিছু স্থানীয় লোক গল্প করছেন। একজনকে বলি, আমি একটু চা নিতে পারি? উনি বলেন, নিন না, এ‌ও বাবার প্রসাদ। সেই সুন্দর জায়গায়, শেষ বিকেলে চা পান করে মন জুড়িয়ে গেল। 
     
        চা খেয়ে কাপটা ডাস্টবিনে ফেলতে গিয়ে মন খারাপ হয়ে গেল। তাতে অল্প‌ কটা এঁটো কাপ‌, তার দশগুণ ছড়িয়ে আছে আশপাশে। সব কাপ কুড়িয়ে বিনে ফেলে কলের জলে হাত ধুয়ে চলে গেলাম মন্দিরের সামনে, যেখানে জুতো ছেড়েছিলাম। সুন্দর কাটলো বিকেলটা, এবার নামা যেতে পারে। বশিষ্ঠ ফোন নম্বর দিয়েছিল। না বলে চলে যাওয়া‌ অসৌজন্যতা। ফোন করে বলি, আমি তাহলে আসি? উনি বলেন, আপনি কোথায়? বলি, যেখানে জুতো ছেড়েছিলাম। উনি বলেন, একটু বসুন, আমি‌ও নামবো। একটু পরে বশিষ্ঠ ঐ লোকটি‌র সাথে এলেন, যিনি আমায় চা নি‌তে বলেছিলেন। বশিষ্ঠ বলেন, আলাপ করিয়ে দিই, ইনি মনোহর শুক্লা, সিনিয়র সেকেন্ডারি স্কুলের প্রিন্সিপাল। আর শুক্লাজী, ইনি মুখার্জী‌সাব, কলকাতার বাবুমশায়, ওনার শখ একাকী ভ্রমণ, এই বয়সে‌ও দু মাস ধরে একা ঘুরে বেড়াচ্ছেন। 
     
        শুক্লাজী বশিষ্ঠ‌কে বলেন, মুখার্জী‌সাবকে দেখে‌‌, কথা শুনেই মনে হয়েছিল পরদেশী। তবে উনি যা করলেন, দেখে আমি স্থানীয় হয়ে বেশ লজ্জিত হলাম। বশিষ্ঠ অবাক হয়ে বলেন, কেন? শুক্লাজী বলেন, আমরা এখানে প্রায়ই আসি, কতোবার চা, প্রসাদ খেয়ে কাগজের কাপ, প্লেট মাটিতে ফেলেছি, ভেবেছি মন্দিরের ঝাড়ুদার তো ঝাড়ু দেবেই। কিন্তু মুখার্জী‌সাব একদিনের জন‍্য এসে‌ও, চা খেয়ে, নিজের কাপ তো বটেই, কোনো শরম না করে মাটিতে পড়ে থাকা সব কাপ তুলে কুড়াদানে ফেললেন। দেখে এতো খারাপ লাগলো।
     
       বলি, আপনার যে খারাপ লেগেছে সেটা ভালো লক্ষণ। হয়তো ভবিষ্যতে আর করবেন না। যতক্ষণ না ঝাড়ু পড়ছে, পড়ে থাকা এঁটো কাপ জোর হাওয়াতে চতুর্দিকে ছড়াবে। আমি জন্মসূত্রে ব্রাহ্মণ, কিন্তু আমার পৈতে নেই। বহু ধর্মস্থানে গেছি সৌন্দর্য, পরিবেশ উপভোগ করতে কিন্তু পুজো দে‌ওয়া, চরণামৃত পান, ষাষ্ঠাঙ্গে প্রণাম এসব আমার আসে না। কিন্তু এঁটো কাপ কুড়িয়ে পুজো দেওয়ার মতোই তৃপ্তি পেলাম। রেল স্টেশনে লেখা থাকে না - Cleanliness is next to Godliness সেরকম আরকি। আর শরমের কথা যদি বলেন, যারা এঁটো কাপ ছড়ায় লজ্জা তো তাদের পাওয়া উচিত, আমার কেন হবে?
     
        বশিষ্ঠ অবাক হয়ে শুনছিলেন। আমার আবেগমথিত লেকচার শুনে শুক্লাজী‌‌ও আবেগতাড়িত কণ্ঠে বলেন, এই অভিজ্ঞতা আজীবন মনে থাকবে স‍্যার। স্কুলে সকালে প্রেয়ার হয়। তারপর কোনোদিন আমি কিছু বলি। কাল প্রেয়ারের পর বলবো, গতকাল এক পরদেশী বুজুর্গ মুখে কিচ্ছু না বলে চো‌খে আঙ্গুল দিয়ে আমার একটা ভুল দেখি‌য়ে দিলেন। এখন থেকে খেয়াল রাখবো এমন ভুল যেন আর না হয়। পারলে তোমরাও খেয়াল রেখো। বলি আমার কোনো খেলার খবরে‌ই আগ্ৰহ নেই কিন্তু ২০২২এ বিশ্বকাপ ফুটবলে জাপানি সমর্থকদের আচরণের খবর আমায় হতবাক করেছিল। আমরা বিশ্বকাপ, অলিম্পিক, T20 নিয়ে মাতামাতি করি কিন্তু এসব খবর মনে দাগ কাটেনা।
     
     
    ৭. উদয়পুর-জানুয়ারি ২০১১ : অফিস ট‍্যূরে গেছি। শুক্রবার কাজ হয়ে গেছে। রবিবার বিকেল ছটার ট্রেনে অফিসে‌র কাজেই যাবো কোটা। দুটো দিন ছুটি। প্রাতরাশ করে গেলাম সজ্জনগড় অভয়ারণ্যে‌র মাঝে পাহাড় শিরে মনসুন প‍্যালেস দেখতে। ফরেস্ট গেট থেকে কেল্লা চার কিমি চড়াই। আসা যাওয়া‌র জন‍্য জীপ আছে। একশো টাকা ভাড়া। কিন্তু আমার হেঁটে ঘুরতে ভালো লাগে। গতকাল‌ লোকাল বাসে ৭৬ কিমি দুরে কেল‌ওয়াড়া গিয়ে ওখান থেকে হেঁটে ঘুরে এসেছি ধাত্রী পান্না, রাণা প্রতাপের স্মৃতি‌ধন‍্য কুম্ভলগড় কেল্লা। যাতায়াতে হেঁটেছি ১৭ কিমি। এখানে ৮ কিমি কোনো ব‍্যাপার‌ই নয়। শীতের মিঠে সকাল। পাহাড়ি পথের পাশে বিশাল ফতেহ্ সাগর লেকের সুনীল জলরাশি। এমন জায়গাতে‌ই তো হেঁটে‌ সুখ। গতকাল কুম্ভলগড়ের পথেও রাস্তা থেকে বোতল কুড়িয়ে কেল্লার গেটে ডাস্টবিনে ফেলেছি। মাঠা টপে মৈনাকদার কথা মনে পড়লে কখনো এসব করি। জানি অর্থহীন। তবু ভালো লাগে। আশা করি যদি আমায় দেখে একজন‌ও অনুপ্রাণিত হয়।


    সজ্জনগড়ের পাকদণ্ডী - এমন পথে হেঁটে সুখ


    সজ্জনগড় মনসুন প‍্যালেস
     
        কুম্ভলগড় জনবিরল এলাকা। সজ্জনগড় শহরের পাশে। অনেক আসে। তাই পথের পাশে বোতল, প্লাস্টিকের ছড়াছড়ি। একটু পরেই ব‍্যাগ ভর্তি হয়ে গেল। একটি হুডখোলা জীপে ছয়টি তরুণ ছেলেমেয়ে জোরে গান চালিয়ে চলে গেল। অভয়ারণ্যে‌র মধ‍্যে জোরে মিউজিক চালানো উচিত নয়। সে বোধ ওদের নেই। ওরা আমায় রাস্তা থেকে বোতল কুড়োতে দেখেছি‌ল। উপরে কেল্লার ডাস্টবিনে বোতলগুলো ফেলে প‍্যাকেট‌টা ভাঁজ করে রাখলাম। নামার সময় আরো কিছু তুলে নীচের গেটে ফেলবো। 
     
         ঘন্টা দুয়েক ওপরে কাটিয়ে নামছি। আবার‌ও ব‍্যাগ ভরে আসছে। সেই হুল্লোড় পার্টি‌ পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় জীপ থেকে উড়ে এলো একটা পেপসি‌র বোতল। একটি ছেলে চেঁচিয়ে বললো - আঙ্কল, এ ভি লে যাও - হাঃ হাঃ হাঃ। দুটি মেয়ে হেসে গড়িয়ে পড়লো - ভারি মজার ব‍্যাপার হোলো যে। আমার মুখের ক্লিষ্ট‌তা তাদের সানগ্লাসে ঢাকা চোখে ধরা পড়ে না। বাঁকের মুখে জীপটা মিলিয়ে যায়। ছুঁড়ে ফেলা বোতলটা রাস্তা থেকে তুলি।

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • অন্যান্য | ০৯ অক্টোবর ২০২৩ | ৭০৪ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Kishore Ghosal | ০৯ অক্টোবর ২০২৩ ১৩:০৭524423
  • আপনার  অনন্য উদ্যোগকে আন্তরিক সমর্থন করি। 
    আমি নিজে এবং আমার পরিবারের সকলেই বেড়াতে গিয়ে যত্রতত্র "কাচড়া" ফেলি না। সঙ্গীরা আওয়াজ  দেয়, পেছনে লাগে। বলে তোর সবেতেই বাড়াবাড়ি - তুই একাই যেন সবকিছু সাফ রাখার ঠিকা নিয়েছিস।  এসব শুনে অন্য কাউকে  আর উপদেশ দেওয়ার সাহস হয় না। 
  • Samaresh Mukherjee | ০৯ অক্টোবর ২০২৩ ১৩:২৪524424
  • তাই তো শিক্ষিত মানুষের মূর্খতায়, অসংবেদনশীল‌তায় দশম পাশ রাজেশের কথায় ক্ষোভ, বিতৃষ্ণা ঝরে পড়ে। তবে এই ক্ষেত্রে প‍্যাঁক আমার গায়ে লাগে না। মৈনাকদার কথার মতো সৈকতে বালিতে আটকে যাওয়া স্টারফিশ তুলে জলে ফেলা বালিকা‌টির  কনভিকশন‌ও  ( " I made difference to this one" )  - আমার EOTO মিশনের চালিকাশক্তি।
  • guru | 115.187.***.*** | ০৯ অক্টোবর ২০২৩ ১৫:০১524425
  • @সমরেশবাবু 
     
                       আপনার এই উদ্যোগ সত্যি প্রশংসনীয় | এরকম কিছু একটা করতে আমারো ইচ্ছে করছে |
  • Samaresh Mukherjee | ০৯ অক্টোবর ২০২৩ ১৬:৪৩524426
  • @guru  - কিশোর‌বাবু আমার বিশ্বাসকে আন্তরিক সমর্থন জানি‌য়েছেন। কিন্তু বন্ধু‌বান্ধবদের উপহাস দেখে সেই বিশ্বাস ছড়িয়ে দিতে আর সাহস পান না।

    আপনার মনে‌ও বিশ্বাস‌টি আঁচড় কেটেছে। আপনি কিছু করতে‌ও চাইছে‌ন। খুব ভালো কথা। অনেকেই সর্বসমক্ষে কোনো অঙ্গীকার প্রকাশ করে না - নীরবে কাজে করে দেখায়। এভাবেই ছড়ায় - বেশী আশা করতে নেই। আড়াই লাখের মধ‍্যে দশ বিশ দশ জন অনুপ্রাণিত হলেও বা ক্ষতি কী? 

    Drop by drop bucket fills ● ● ● ● 
  • Sandip Banerjee | 2405:201:8011:3190:f80e:3164:7c7f:***:*** | ০৯ অক্টোবর ২০২৩ ২১:৩২524430
  • @সমরেশ মুখার্জী, 
    পরিবেশ রক্ষার পাঠ কেউ বাড়ীর অভিভাবকের থেকে পায়, কেউ বিদ্যালয় থেকে পায়, কেউ নিজের বোধ থেকে সামাজিক ভাবে aquire করে। মোদ্দা কথা হলো অনুসরণ করা, পাঁচজনকে অনুপ্রাণিত করা। আজকে Shiva নিজে শিখল, কাল ও পাঁচজনকে বারণ করবে.....এইভাবেই ধীরে ধীরে একটা প্রজন্ম আসবে যখন সত্যিই সুইজারল্যান্ড না হলেও আমরা পরিছন্নতর ভারত পাবো। 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা মনে চায় মতামত দিন