বিকেলে নির্জন সরোবরের পাশে ঘুরছি। পাশে প্রাচীন শিব মন্দির। আলাপ হোলো ছোট্ট শিবার সাথে। উখিমঠে যেমন EOTO এক্সপেরিমেন্ট করেছিলাম, শিবার সাথেও করলুম। প্রতিক্রিয়া হোলো আশাপ্রদ। সেটা আর শব্দে লিখলাম না। ভিডিও করেছিলাম। লিংক রাখলাম নীচে -
Resolution of Siva. ৫. জব্বলপুর - ১২.০২.২০২০ : গেছি মদনমহল প্যালেসের নীচে ব্যালান্সিং রক দেখতে। অবিশ্বাস্য ভারসাম্যে টিকে থাকা পাথরটি দেখে অবাক হই। তবে ওখানে একটি মানুষও আমায় বেশ অবাক করেছিল।
বছর পঞ্চান্নর স্বল্পশিক্ষিত রাজেশ ওখানে একটি চা, নাস্তার স্টল চালান। শহুরে চোখা স্মার্টনেসে কখনো হাবুডুবু খাই। ভ্রমণপথে কিছু সাধারণ মানুষের সাথে আলাপচারিতায় মনে বাতাস লাগে। কথা প্রসঙ্গে পরিবেশ দূষন, মানুষের অবিমৃষ্যকারিতা নিয়ে রাজেশের বলার ভঙ্গিতে তীব্র আক্ষেপ ফুটে বেরোচ্ছিলো। বলি আপনার বক্তব্য ভিডিও করে ছড়াতে পারি? রাজেশ আপত্তি করেনি। লিংক রইলো নীচে -
Anguish of Rajesh রাজেশ ও তার পোষ্য ভোলা
৬. নীলকণ্ঠ মহাদেব মন্দির - দৌসা - ০৭.০২.২০২৩ : সেবারও শীতে দু মাসের একাকী ভ্রমণে মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান ঘুরে শেষপাতে তিনদিন ছিলাম দৌসা। ৬ তারিখ তিরিশ কিমি দুরে The most haunted Fort of India - ভানগড় কেল্লা দেখে এসেছি। ৭ তারিখ বিকেলে দৌসা শহরের মাঝে হেঁটে ঘুরতে গেছি তিন কিমি দূরে ছশো ফুট উঁচু পাহাড়শিরে নীলকণ্ঠ মহাদেব মন্দির।
চড়াই পথে আলাপ হোলো স্থানীয় এক আলাপী মানুষ বশিষ্ঠর সাথে। মন্দিরে কিছু কর্মকর্তা গোছের লোক ছিলেন। বশিষ্ঠ আমায় স্বাদু লাড্ডু প্রসাদ দিয়ে বললেন, পিছনের চত্বরটা ঘুরে দেখুন, ওপর থেকে চারপাশ সুন্দর দেখায়। আমার এদের সাথে কিছু কথা আছে। দেখলাম। বেশ লাগলো। সাড়ে পাঁচটা বাজে, অতোটা হেঁটে, এতোটা উঠে প্রাণটা চা চা করছে। দেখি একটা টেবিলে কল লাগানো ইনসুলেটেড স্টীলের ক্যান রয়েছে। পাশে রাখা পেপার কাপ। আশপাশে কিছু স্থানীয় লোক গল্প করছেন। একজনকে বলি, আমি একটু চা নিতে পারি? উনি বলেন, নিন না, এও বাবার প্রসাদ। সেই সুন্দর জায়গায়, শেষ বিকেলে চা পান করে মন জুড়িয়ে গেল।
চা খেয়ে কাপটা ডাস্টবিনে ফেলতে গিয়ে মন খারাপ হয়ে গেল। তাতে অল্প কটা এঁটো কাপ, তার দশগুণ ছড়িয়ে আছে আশপাশে। সব কাপ কুড়িয়ে বিনে ফেলে কলের জলে হাত ধুয়ে চলে গেলাম মন্দিরের সামনে, যেখানে জুতো ছেড়েছিলাম। সুন্দর কাটলো বিকেলটা, এবার নামা যেতে পারে। বশিষ্ঠ ফোন নম্বর দিয়েছিল। না বলে চলে যাওয়া অসৌজন্যতা। ফোন করে বলি, আমি তাহলে আসি? উনি বলেন, আপনি কোথায়? বলি, যেখানে জুতো ছেড়েছিলাম। উনি বলেন, একটু বসুন, আমিও নামবো। একটু পরে বশিষ্ঠ ঐ লোকটির সাথে এলেন, যিনি আমায় চা নিতে বলেছিলেন। বশিষ্ঠ বলেন, আলাপ করিয়ে দিই, ইনি মনোহর শুক্লা, সিনিয়র সেকেন্ডারি স্কুলের প্রিন্সিপাল। আর শুক্লাজী, ইনি মুখার্জীসাব, কলকাতার বাবুমশায়, ওনার শখ একাকী ভ্রমণ, এই বয়সেও দু মাস ধরে একা ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
শুক্লাজী বশিষ্ঠকে বলেন, মুখার্জীসাবকে দেখে, কথা শুনেই মনে হয়েছিল পরদেশী। তবে উনি যা করলেন, দেখে আমি স্থানীয় হয়ে বেশ লজ্জিত হলাম। বশিষ্ঠ অবাক হয়ে বলেন, কেন? শুক্লাজী বলেন, আমরা এখানে প্রায়ই আসি, কতোবার চা, প্রসাদ খেয়ে কাগজের কাপ, প্লেট মাটিতে ফেলেছি, ভেবেছি মন্দিরের ঝাড়ুদার তো ঝাড়ু দেবেই। কিন্তু মুখার্জীসাব একদিনের জন্য এসেও, চা খেয়ে, নিজের কাপ তো বটেই, কোনো শরম না করে মাটিতে পড়ে থাকা সব কাপ তুলে কুড়াদানে ফেললেন। দেখে এতো খারাপ লাগলো।
বলি, আপনার যে খারাপ লেগেছে সেটা ভালো লক্ষণ। হয়তো ভবিষ্যতে আর করবেন না। যতক্ষণ না ঝাড়ু পড়ছে, পড়ে থাকা এঁটো কাপ জোর হাওয়াতে চতুর্দিকে ছড়াবে। আমি জন্মসূত্রে ব্রাহ্মণ, কিন্তু আমার পৈতে নেই। বহু ধর্মস্থানে গেছি সৌন্দর্য, পরিবেশ উপভোগ করতে কিন্তু পুজো দেওয়া, চরণামৃত পান, ষাষ্ঠাঙ্গে প্রণাম এসব আমার আসে না। কিন্তু এঁটো কাপ কুড়িয়ে পুজো দেওয়ার মতোই তৃপ্তি পেলাম। রেল স্টেশনে লেখা থাকে না -
Cleanliness is next to Godliness সেরকম আরকি। আর শরমের কথা যদি বলেন, যারা এঁটো কাপ ছড়ায় লজ্জা তো তাদের পাওয়া উচিত, আমার কেন হবে?
বশিষ্ঠ অবাক হয়ে শুনছিলেন। আমার আবেগমথিত লেকচার শুনে শুক্লাজীও আবেগতাড়িত কণ্ঠে বলেন, এই অভিজ্ঞতা আজীবন মনে থাকবে স্যার। স্কুলে সকালে প্রেয়ার হয়। তারপর কোনোদিন আমি কিছু বলি। কাল প্রেয়ারের পর বলবো, গতকাল এক পরদেশী বুজুর্গ মুখে কিচ্ছু না বলে চোখে আঙ্গুল দিয়ে আমার একটা ভুল দেখিয়ে দিলেন। এখন থেকে খেয়াল রাখবো এমন ভুল যেন আর না হয়। পারলে তোমরাও খেয়াল রেখো। বলি আমার কোনো খেলার খবরেই আগ্ৰহ নেই কিন্তু ২০২২এ বিশ্বকাপ ফুটবলে জাপানি সমর্থকদের আচরণের খবর আমায় হতবাক করেছিল। আমরা বিশ্বকাপ, অলিম্পিক, T20 নিয়ে মাতামাতি করি কিন্তু এসব খবর মনে দাগ কাটেনা।
৭. উদয়পুর-জানুয়ারি ২০১১ : অফিস ট্যূরে গেছি। শুক্রবার কাজ হয়ে গেছে। রবিবার বিকেল ছটার ট্রেনে অফিসের কাজেই যাবো কোটা। দুটো দিন ছুটি। প্রাতরাশ করে গেলাম সজ্জনগড় অভয়ারণ্যের মাঝে পাহাড় শিরে মনসুন প্যালেস দেখতে। ফরেস্ট গেট থেকে কেল্লা চার কিমি চড়াই। আসা যাওয়ার জন্য জীপ আছে। একশো টাকা ভাড়া। কিন্তু আমার হেঁটে ঘুরতে ভালো লাগে। গতকাল লোকাল বাসে ৭৬ কিমি দুরে কেলওয়াড়া গিয়ে ওখান থেকে হেঁটে ঘুরে এসেছি ধাত্রী পান্না, রাণা প্রতাপের স্মৃতিধন্য কুম্ভলগড় কেল্লা। যাতায়াতে হেঁটেছি ১৭ কিমি। এখানে ৮ কিমি কোনো ব্যাপারই নয়। শীতের মিঠে সকাল। পাহাড়ি পথের পাশে বিশাল ফতেহ্ সাগর লেকের সুনীল জলরাশি। এমন জায়গাতেই তো হেঁটে সুখ। গতকাল কুম্ভলগড়ের পথেও রাস্তা থেকে বোতল কুড়িয়ে কেল্লার গেটে ডাস্টবিনে ফেলেছি। মাঠা টপে মৈনাকদার কথা মনে পড়লে কখনো এসব করি। জানি অর্থহীন। তবু ভালো লাগে। আশা করি যদি আমায় দেখে একজনও অনুপ্রাণিত হয়।
সজ্জনগড় মনসুন প্যালেস
কুম্ভলগড় জনবিরল এলাকা। সজ্জনগড় শহরের পাশে। অনেক আসে। তাই পথের পাশে বোতল, প্লাস্টিকের ছড়াছড়ি। একটু পরেই ব্যাগ ভর্তি হয়ে গেল। একটি হুডখোলা জীপে ছয়টি তরুণ ছেলেমেয়ে জোরে গান চালিয়ে চলে গেল। অভয়ারণ্যের মধ্যে জোরে মিউজিক চালানো উচিত নয়। সে বোধ ওদের নেই। ওরা আমায় রাস্তা থেকে বোতল কুড়োতে দেখেছিল। উপরে কেল্লার ডাস্টবিনে বোতলগুলো ফেলে প্যাকেটটা ভাঁজ করে রাখলাম। নামার সময় আরো কিছু তুলে নীচের গেটে ফেলবো।
ঘন্টা দুয়েক ওপরে কাটিয়ে নামছি। আবারও ব্যাগ ভরে আসছে। সেই হুল্লোড় পার্টি পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় জীপ থেকে উড়ে এলো একটা পেপসির বোতল। একটি ছেলে চেঁচিয়ে বললো -
আঙ্কল, এ ভি লে যাও - হাঃ হাঃ হাঃ। দুটি মেয়ে হেসে গড়িয়ে পড়লো - ভারি মজার ব্যাপার হোলো যে। আমার মুখের ক্লিষ্টতা তাদের সানগ্লাসে ঢাকা চোখে ধরা পড়ে না। বাঁকের মুখে জীপটা মিলিয়ে যায়। ছুঁড়ে ফেলা বোতলটা রাস্তা থেকে তুলি।