পেরেছি, পেরেছি, ডান। প্রায় আর্কিমিডিসের ইউরেকা বলে ছুটে আসার উচ্ছ্বাস নিয়ে মেয়েকে ফোন করলেন সুলেখা। যুদ্ধজয়ের তৃপ্তি তার চোখে-মুখে। বেশ কিছুদিন হল বাস্তবিকই ঘুম উড়ে গিয়েছিল তাদের। ঘড়ঘড় সড়সড় শব্দ যেন আতঙ্কের মতো তাড়া করে ফিরছিলো সর্বক্ষণ। শ্যেন দৃষ্টিতে স্বামী স্ত্রী মিলে লক্ষ্য রাখছিলেন ঘরের আনাচে-কানাচে। মুহূর্তে চোখে পড়লেই হারে রে রে রে রে করে তেড়ে যাচ্ছিলেন, পজিশন নিচ্ছিলেন আক্রমণ শানানোর কিন্তু কব্জা করতে পারছিলেন না। প্রতিপক্ষ যতই ক্ষুদ্র হোক যখন সে প্রাণ রক্ষার জন্য ছুটে বেড়ায় তাকে প্রতিহত করা কঠিন। এক্ষেত্রে কে কার জমি দখল নিতে এসেছে তা নিয়ে বিতর্ক থাকতেই পারে। তাহলে একটু খোলাসা করেই বলা যাক।ঘটনার সূত্রপাত ধরা যাক প্রায় বছর খানেক আগে। কিংবা হয়তো তারও আগে, সুতো গুটাতে গুটাতে জীবনের তল খুঁজে পাওয়া ভার।
গত একটা বছরে সারা পৃথিবীব্যাপী ঘটে গেল এক অভূতপূর্ব ঘটনা। তার প্রভাব কোনো-না-কোনোভাবে এসে পড়ল প্রায় সব পরিবারে। সুলেখা আর তন্ময়ের সংসার ও তার ব্যতিক্রম নয়। যদিও তাদের জীবনের উত্থান-পতন এত আগে থেকেই শুরু হয়েছিলো, এত রকমের ঘটনা ঘটে গিয়েছিল বিগত কয়েক বছরে যে নতুন করে বিস্মিত হতেও তারা যেন ভুলে গিয়েছিলেন। গত বছরের গোড়ার দিকে শোনা যাচ্ছিল কী এক অজানা রোগ ছড়াচ্ছে চারিদিকে। জ্বর, শ্বাসকষ্ট, এন্তেকাল ঘনিয়ে আসছে মানুষের। চীন থেকে ইতালি হয়ে ভারতের কেরালাতেও ঢুকে পড়েছে সেই রোগ। যদিও সবাই তখন ভাবছিলেন তাদের এলাকায় তেমন কিছু ঘটবে না। সুলেখা আর তন্ময় দুজনাই কলেজে পড়াতেন। অবসর নিয়েছেন বহুদিন আগেই। ছেলেমেয়েরা যে যার জায়গায় প্রতিষ্ঠিত।এখন তাদের সর্বসময়ের সঙ্গী ওই টিভি। টিভি দেখে দেখে দুজনেই আতঙ্কিত হয়ে উঠছিলেন ক্রমেই। ছেলে ফোন করে বলল, ওসব কিছু না, মিডিয়া আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। তোমরা বরং আমার এখান থেকে ঘুরে যাও কদিন। আমি পাশের বড় শহরে ফ্ল্যাট কিনেছি। বাসা বদল করতে হবে। রুমকি বাচ্চা নিয়ে একা একা সব পেরে উঠবে না। তোমরা এলে খানিক সাহায্য হবে। তোমাদেরও মাথাটা হালকা হবে ওই সব আজেবাজে চিন্তা থেকে।
আজ যাব কাল যাব করে যদি বা দেরি করছিলেন সুলেখা হঠাৎ শুনলেন ট্রেন, বাস, সবকিছু বন্ধ হয়ে যেতে পারে। মানে কার্ফু। এইরে ছেলে তো খুব রেগে যাবে না গেলে, তড়িঘড়ি ট্রেনের টিকিট কেটে রওনা দিলেন তারা ছেলের বাড়ির উদ্দেশ্যে। মাসখানেক থেকে ছেলেকে সব গুছিয়েটুছিয়ে দিয়ে ফিরে আসবেন, এই ইচ্ছা। কার্ফু আর কদিনই বা থাকবে।
তারাও গেলেন আর শুরু হয়ে গেল সম্পূর্ণ লকডাউন। স্তব্ধ হয়ে গেল জনজীবন। দোকানপাট, অফিস কাছারি, রাস্তার গাড়ি বাস সব বন্ধ। এমনকি মানুষের বাড়ি থেকে বেরোনোও নিষিদ্ধ হয়ে গেল। কাজের মানুষ, রান্নার লোক, এরাও আর বেরোতে পারল না কাজে । স্কুল বন্ধ তাই বাচ্চাকে পড়ানোর কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল ছেলের বউ রুমকি। হেঁশেলের দায়িত্ব চেপে গেল সুলেখার ওপর। রান্না-বান্না করতে তিনি ভালোই বাসেন কিন্তু তাঁর বয়স হয়েছে, ছেলে, বৌমা, নাতনি, বৌমার বাবা, তারা স্বামী-স্ত্রী মিলে মোট ছ জন। একা হাতে তরকারি কেটে, মসলা বেটে, রান্না করা, কাহিল হয়ে পড়ছিলেন তিনি। এত ধকল নিতে পারছিলেন না।কিন্তু ফিরে আসার ও কোন উপায় ছিলো না। লকডাউন বাড়ছিল উত্তরোত্তর। করোনা পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছিল ক্রমশ।
খাঁচায় পড়া বাঘের মত আটকে গেছিলেন সুলেখা আর তন্ময়।সবচেয়ে বড় কথা মফস্বল শহরে মস্ত বড় দোতলা বাড়িতে হাত-পা ছড়িয়ে থাকতে অভ্যস্ত তারা। এইটুকু ফ্ল্যাটে গা ঘেষাঘেষি করে এতগুলো মানুষ, সুলেখার যেন দম আটকে যায়। তন্ময় চিরকালই নির্বিকার। কোন কিছুতেই তার তাপ উত্তাপ নেই কিন্তু সুলেখা যে অন্যরকম, তার একটু একা থাকতে ভালো লাগে, গুন গুন করে গান গাইতে ভালো লাগে, আনমনে ঝুল বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াতে ভালো লাগে,সব সময় এই এত হট্টগোল তার ভালো লাগে না। অবশ্য ভালো লাগে না বললেই আর শুনছে কে! জীবন এমন অদ্ভুত যে ঘাড়ে ধরে সবকিছু শুনিয়ে নেয়, মানিয়ে নেয়। না হলে তার মন মতো আর কোন কাজটা হয়েছে বিগত এতগুলো বছরে! সে আমলের এমএ পাস, অধ্যাপনা করা মেয়ে সুলেখার বিবাহ ঠিক করার সময় তার একটা মতামতের ও অপেক্ষা করেননি তার বাবা। অজানা অচেনা একটা লোকের সঙ্গে বিয়ে ঠিক করে এসে তাকে জানিয়েছিলেন মাত্র। আর বিয়ের মাসখানেকের মধ্যেই সুলেখা আবিষ্কার করেছিলেন মানসিকতা, রুচি, কৃষ্টিতে তাদের মধ্যে ব্যবধান যোজনখানেক। কিন্তু তাতে কী বা করতে পেরেছিলেন তিনি! বরং মানাতে মানাতে নিজেকে বদলে ফেলার চেষ্টা করেছিলেন অবিরত।
দুই মেয়ে তাদের। স্বামীর তন্ময়ের অসহনীয় লাগত ব্যাপারটা। একটা ছেলে তার চাই ই চাই। অথচ বয়স বেড়ে যাচ্ছিল সুলেখার। তৃতীয় সন্তান আসছিলোই না তাদের। তন্ময়ের আকাঙ্ক্ষার নিবৃত্তি চাইছিলেন তিনি মনেপ্রাণে। কিন্তু তন্ময় আশা ছাড়বার পাত্র নন। তাই প্রৌঢ় বয়স পর্যন্ত ইচ্ছার বিরুদ্ধে সুলেখাকে মেনে নিতে হতো তন্ময়ের অন্যায় আবদার। হ্যাঁ প্রায় চল্লিশ বছর বয়সে তৃতীয়বার সন্তানসম্ভবা হয়েছিলেন সুলেখা। লজ্জায় তিনি কলেজে যেতে পারতেন না, তার মেয়েরা তখন কত বড়, শুধু তাই নয় শরীরও যেন নিতে চাইত না সন্তান বহন করবার ধকল। তবু তিনি সবটুকুই মেনে নিয়েছিলেন মুখ বুঁজে। কখনো তিনি গুনগুন করে গান গাইলে যখন তন্ময় ধমকে উঠতেন, আহ! বন্ধ করো তো নাকি কান্না। তখন তিনি চুপ করে যেতেন। নিভৃত অন্ধকারে কখনো হয়তো চোখের কোণ দিয়ে গড়িয়ে আসত দু ফোটা জল। হাতের চেটোতে সেই জল মুছে নিয়ে তিনি স্বামীকে ভাত বেড়ে দিতেন।
দিন গেলে বাবার পর ব্যাটন হাতে নিল ছেলে। বৃদ্ধ বয়সের সন্তান। তন্ময় একটু বেশিই দুর্বল ছিলেন ছেলের প্রতি। ফলস্বরূপ যা হবার তাই, একটু বড় হতে না হতেই ছেলে গেল বিগড়ে। বন্ধু বান্ধবের পাল্লায় পড়ে তার মতি গতি হল ছন্নছাড়া। কোনরকমে একটা বি এ পাশ করেই সে বায়না আরম্ভ করল ব্যবসা শুরু করবার। মা-বাবার জমা টাকার প্রায় সবটা নিয়ে সে লাগালো ব্যবসায়,আর তারপরেই অহরহ চাপ দিতে লাগল বাড়ি তার নামে লিখে দেবার জন্য।
সুলেখা নিমরাজি ছিলেন। দুই মেয়েকে বঞ্চিত করে বাড়ি ছেলের নামে লিখে দিতে তার বিবেকে বাধছিলো। কিন্তু বাবা আর ছেলের যৌথ চাপে সে কাজ করতে বাধ্য হলেন তিনি। অথচ সে বাড়ি থাকলো না। বাড়ির হাতে পেতেই ছেলে বাড়ি বন্ধক রেখে তুলল মোটা অঙ্কের ঋণ, তথাপি তার ব্যবসা লাটে উঠতে দেরি হলো না। বন্ধুবান্ধব অংশীদারির টাকা আত্মসাৎ করে কেটে পড়ল। ব্যাংক অনাদায়ী দেনার দায়ে নিলামে তুলল বাড়ি। বড় শখ করে এ বাড়ি তৈরি করেছিলেন সুলেখা। বলতেন ঘর হবে বড়ো বড়ো। আর জানলা থাকবে দেওয়াল জোড়া। আলো-বাতাস খেলবে পর্যাপ্ত। হাত পা ছড়িয়ে থাকা না গেলে তা আবার একটা বাড়ি হলো!আর থাকবে সুবর্ণলতার মত দক্ষিণের ঝুলবারান্দা।
সেই বাড়িঘর জায়গা জমি ছেড়ে শহরের উপকণ্ঠে একটা পায়রার খোপের মতো ছোট্ট দু কামরার ফ্লাটে তাদের উঠে যেতে হল। এদেশি মেয়ে সুলেখা। যখন দেশভাগ হয়েছে তখন তার বয়স দুই। সে পাশের বাড়ির কাকিমা জেঠিমাদের কাছে শুনেছেন ভিটেমাটি ছেড়ে আসার যন্ত্রণা। বই পড়ে জেনেছেন উদ্বাস্তু হবার কষ্ট। কিন্তু এ জীবনে তাকেও যে এইভাবে সে কষ্ট পেতে হবে তিনি ভাবেন নি। ঘর ছেড়ে বেরোবার সময় শেষবার যখন দরজায় মাথা রেখে কাঁদছিলেন সুলেখা ধমকে উঠেছিল ছেলে মৃন্ময়, আহ, আদিখ্যেতা করো না। এখন কেউ আর মফস্বলে এমন ঢ্যাপসা বাড়ি রাখতে চায় না। শখ করেই লোকে ফ্ল্যাট কিনে চলে যাচ্ছে কলকাতা শহরে আর তুমি এমন করছো…!
সুলেখা কোনো কথা বলেননি। চোখের জল মুছে দ্রুত পা বাড়িয়ে ছিলেন। তিনি কী করে বোঝাবেন যে তার বুকের পাঁজর গুলো ভেঙে যাচ্ছিল মট মট করে। ছেলে বিয়ে করেছে। ওইটুকু ফ্ল্যাটে চারটি প্রাণী, শুধু তাই নয় এতদিন অত বড় বাড়িতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এত বড় বড় ফার্নিচার। সেগুন খাটের মস্ত বড় তিনখানা খাট, এত্ত বড় সোফা, আলমারি, শোকেস। কিছু বিক্রি করে দিয়েছিলেন কিছু খরিদ্দার পাননি। তাছাড়া শ্বশুরবাড়ি বাপের বাড়ির আত্মীয় পরিজনের আসা-যাওয়া লেগেই ছিল তার বাড়িতে। এত বিছানা-বালিশ, গদি,লেপ, কোথায় রাখবেন তিনি? ফেলে দেবেন? সবকিছু ডাঁই করে রাখা হলো ওই অতটুকু ফ্ল্যাটে।জিনিসের ভারে তাদের যেন আর চলাফেরা জায়গা নেই।
সব হারানোর পর ভগবান বোধ হয় মুখ তুলে চাইলেন খানিক। কিছুদিনের মধ্যেই ছেলে একটা ছোটখাটো চাকরি পেয়ে বউ নিয়ে চলে গেল উত্তরের এক শহরে। যদিও ছেলে তাদের অবসর গ্রহণের পর প্রাপ্য টাকা পয়সার সবটাই প্রায় নিজের নামে করে নিয়েছে ততদিনে তথাপি মনে-মনে খানিক নিশ্চিন্ত হলেন সুলেখা, যাহোক ছেলের একটা হিল্লে হল, পেনশনের টাকা টা তো আছে, তাদের দিব্য মতো চলে যাবে।
ছেলে থিতু হলো। একটা বাচ্চাও হলো তাদের। অপত্য স্নেহের এমনই টান যে সুলেখা আর তন্ময় মাঝেমাঝেই ছুটে যান ছেলের কাছে। এছাড়া আছে নাতনিটা। বড় মায়া। ছেলের হুকুম তলব হলে তো কথাই নেই, আজ বউয়ের শরীর খারাপ, চলে এসো। কাজের লোক এক মাসের ছুটি নিয়েছে, চলে এসো। বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ছোটেন ছেলের সংসার সামলাতে।এবারও তেমনি গিয়েছিলেন। আর গিয়ে পড়ে গিয়েছিলেন লকডাউনের যাঁতাকলে। পাক্কা এগারো মাস।
দীর্ঘ দিন পরে নিজেদের ডেরায় ফিরে যখন দরজা খুললেন সুলেখা তখন এখান দিয়ে পালিয়ে গেল টিকটিকি, ওখান দিয়ে পালিয়ে গেল ইঁদুর, দেওয়ালের কোন ধরে নেমে এলো মাকড়সা। তন্ময় বললেন, বাব্বা ফ্ল্যাট তো নয় যেন বায়োডাইভারসিটি হটস্পট। তারা মফস্বলে থাকা মানুষ ইঁদুর বাদুড় দেখে চট করে অত ভয় পান না। কিন্তু যখন রাতে মশারির উপর দিয়ে তন্ময়ের পায়ের বুড়ো আঙ্গুলে দাঁত বসিয়ে দিলো ইঁদুর তখন খুবই ঘাবড়ে গেলেন দুজনে। মাথার কাছের টর্চ ছিলো বলে তারা দেখতে পেয়েছিলেন না হলে তো আননোন বাইটের চিকিৎসা করতে হতো । চলল ওষুধ ইনজেকশন। কিন্তু স্তূপাকৃতি জিনিসপত্রের মধ্যে কোথায় যে লুকিয়ে পড়ছিল ইঁদুরটা তা তারা বুঝে উঠতে পারছিলেন না। ভয়ে আতঙ্কে রাতে ঘুমাতে পারছিলেন না ভালো করে। ইঁদুর না মারলেই নয়, কিন্তু কেমন করে মারবেন!
কত রকমের বিষ দেওয়া হলো চপের সঙ্গে মিশিয়ে, কিম্বা এমনি, কিন্তু ইঁদুর সে খাবার মুখেও দিল না। কেনা হলো খাঁচা,পাতা হলো ঘরের মাঝখানে। দুজনের ঝুঁকে পড়লেন খাঁচার সামনে কিন্তু শূন্য খাঁচার মধ্যে শিস দিয়ে পার হয়ে গেলো বাতাস। ক্রমশ হতাশ হয়ে উঠছিলেন তারা। এক ধেড়ে ইঁদুর নাস্তানাবুদ করে তুলছিল তাদের। ইঁদুর মানেই প্লেগ, কেমন যেন এই ভয়ঙ্কর আতঙ্ক চেপে বসেছিল সুলেখার মাথার ভেতরে। যেমন করে হোক মারতে হবে ইঁদুরটাকে, মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন তিনি।
শেষ পর্যন্ত ইঁদুরটা নিজের চক্রব্যূহে নিজেই ঢুকে পড়ল একদিন। রান্না ঘরে গ্যাসের নিচে তাকে আবিষ্কার করে উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন সুলেখা। এইবার বাছাধন পালাবে কোথায়! চিৎকার করে ডাকলেন তন্ময় কে তারপর দুজনায় রান্না ঘরের মধ্যে ঢুকে ভালো করে আটকে দিলেন দরজাটা। ফাঁকফোকর গুলো আটকে দিলেন কাপড় দিয়ে। গ্যাস ওভেন সরাতেই ইঁদুর লাভ দিয়ে পালালো দেয়ালের অন্যকোণে। ঝাঁটা দিয়ে সজোরে একটা বাড়ি বসাতে গেলেন তন্ময়। ইঁদুর হাঁচড় পাঁচড় করে উঠতে চাইল দেওয়াল বেয়ে।ফের বাড়ি মারলেন তিনি। ইঁদুরটা নালির দিকে ছুটে গেল,নালি বন্ধ। দরজার দিকে ছুটে গেল, দরজা বন্ধ। ততক্ষণে কেরোসিন তেল নিয়ে তৈরি সুলেখা। ইঁদুরটা গিয়ে ঢুকে পড়ল খাড়া করে রাখা শিলপাটার পিছনে। শিলপাটা দিয়ে ইঁদুরটাকে দেওয়ালের সঙ্গে ঠেসে ধরলেন তন্ময়। অত বড় কালো ইঁদুর, তার এত জোর যেন টাল রাখতে পারছিলেন না তিনি। তবু প্রাণপণ শক্তিতে ভারী শিলপাটা দিয়ে সেটাকে বারবার ঠেসে ধরতে লাগলেন দেওয়ালের সঙ্গে। ওপর দিয়ে গবগব করে কেরোসিন ঢালতে লাগলেন সুলেখা। খানিকক্ষণ মিয়া বিবি তুমুল যুদ্ধ করার পর নেতিয়ে পড়ল প্রতিপক্ষ। তখন সুলেখা লাঠি দিয়ে ঠুসে ঠুসে মৃত্যু সুনিশ্চিত করলেন ইঁদুরটার।
মেয়েকে হত্যালীলার দ্বৈরথ অনুপুঙ্খ ব্যাখ্যা করার পর খানিক দম নিলেন সুলেখা, বললেন, শেষ পর্যন্ত পারলাম।
মায়ের কথা শুনতে শুনতে আনমনা হয়ে যাচ্ছিল ব্রততী। অনেক পুরনো একটা ঘটনা মনে পড়ে যাচ্ছিল তার। দৌড়ে ট্রেনে উঠতে গিয়ে প্লাটফর্মে পড়ে পা ভাঙলো তন্ময়ের। প্রায় কোমর থেকে প্লাস্টার, ট্রাকশনে ঝুলানো পা। কলেজ থেকে ছুটি নিয়ে তার পরিচর্যা করতেন সুলেখা। খেতে দিতে একটু দেরি হলে অন্য পা বিছানায় ঠুকে ঠুকে তন্ময় বলতেন, লাথি মেরে সব উল্টে দিতে হয়। কুঁড়ে,অকম্মা! সুলেখার সেই পা দু'হাতে ধরে তাকে উঠাতেন, বেডপ্যান দিতেন, স্নান করাতেন, তারপর মেয়ের কাছে ফোন করে কাঁদতেন,বলতেন সেই সব দুঃখের কথা। বলতেন নিজের মনটাকে টিপে টিপে মারি ব্রতী। পিষে পিষে মারি। সারা জীবন মেরেছি। প্রথম প্রথম খুব পালাতে চাইতাম। একদিনের জন্যও চাইনি এই সংসারটায় পড়ে থাকতে। ভেবেছি যে কোন উপায়ে আমাকে বাঁধন কেটে বেরোতে হবে। কিন্তু পারিনি,তোদের জন্য, সমাজ সংস্কারের জন্য। একসময় ক্লান্ত হয়ে সবটাই মেনে নিয়েছি। প্রাণহীন মৃত শরীরের মতো পড়ে থেকেছি এক কোণে।
হঠাৎ ব্রততী খেয়াল করে তার চোখ থেকে নামছে জলের ধারা। অতীত এসে মিশে যাচ্ছে বর্তমানে। মা কাকে মেরেছ তুমি! তুমি যে তোমাকেই মেরেছ! ঐ ইঁদুরটার সঙ্গে তো তোমার কোন তফাৎ নেই। যে ঘরটা কে ও নিজের ঘর ভেবেছিল সে ঘরটা ওর নিজের ঘর ছিল না কোনদিন।
যথার্থ l অপছন্দের সংসারে মানিয়ে নিতে গিয়ে নিজেকে বদলে ফেলার চেষ্টা - খুউব কষ্টের
লক্ষ কোটি মেয়েদের মনের কথা । বহু চাকুরিজীবী মেয়ে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা পেলেও সামাজিক স্বাধীনতা পায়নি । অধ্যাপক সুলেখা এই বিবাহ মেনে নিল কেন ? এ প্রশ্ন থাকলেও উত্তর খুঁজতে অনেক সংস্কারের গভীরে হাতড়াতে হয় ।।যা এক কঠিন যাঁতাকলের মতো ।
মেয়েদের বহু আকাঙ্খা সংসারের চাপে হারিয়ে যায়।
অপূর্ব সুন্দর গল্প। চমৎকার মেসেজ। অভিনন্দন অনেক।
Read it. Good
অসাধারণ একটি গল্প ,অর্থনৈতিক স্বাধীনতা পেলেও সবসময় মেয়েরা স্বাধীন নয় এখনো অব্দি ...সংসারের পাঁচ জন কে সুখে রাখতে গিয়ে নিজের মননশীলতা , সৃষ্টিশীলতা , নিজস্ব ইচ্ছা এমন কি অপছন্দ- সব কিছুতেই চেপে রাখতে হয় আজও বহু মেয়েকে ..যেন মনে মনে নিজ গৃহে পরবাসী। সমাজ অনেকটা বদলাচ্ছে , রাখি মেয়েরাও নিজের ইচ্ছের উপর ভর করে ইচ্ছে ডানা মেলে দেেবে ..