কে ডাকে কাতর প্রাণে, মধুর তানে
আয় চলে আয় --
ওরে আয় চলে আয়, আমার পাশে
মহা সিন্ধুর ওপার থেকে
কি সঙ্গীত ভেসে আসে।
ঐ মহাসিন্ধুর ওপার থেকে কি সঙ্গীত ভেসে আসে।
আজকাল সত্যিই ভেসে আসে সেই সুর। মধুর তানে কেউ যেনো কানের কাছে এসে বলে, হেথা নাইকো মৃত্যু, নাইকো জরা। হেথা বাতাস গীতি গন্ধভরা, চির স্নিগ্ধ মধুমাসে। হেথা চির শ্যামল বসুন্ধরা, চির জ্যোৎস্না নীল আকাশে। মনটা উচাটন হয়ে ওঠে, এই পৃথিবী যে বড়ই রুক্ষ, বড়ই নিষ্ঠুর, একাকীত্বে ভরা এই পৃথিবী। কবিগুরু কেনো যে বলেছিলেন, "মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে"। যৌবনে কবিগুরুর কথা মনে দাগ টানলেও এখন সেই দাগ আর খুঁজে পাওয়া যায় না। অস্পষ্ট হয়ে কবেই সেই দাগ মিলিয়ে গেছে। কবিগুরুরও কি বার্ধক্যে তাঁর সেই কথা সত্যি বলে মনে হতো? আমার খুবই মনে হয়, কবিগুরু এখানে তাঁর সৃষ্টির মাধ্যমে মানবের মাঝে বেঁচে থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। মানব চেহারায় অমরত্বের দাবী তিনি করেননি। শস্য-শ্যামলা এই বসুন্ধরা প্রাকৃতিক সবুজ রঙে রঞ্জিত হলেও অন্তরে বড়ই রক্তপিপাসু। সে মানুষের সমাজগত, সংসারগত সম্পর্ক বোঝে না। তিক্ততা, হানাহানিকে প্রশ্রয় দেয়। চারিদিকে জীবের রক্তে লাল হয়ে গেলেও তার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। মরণ, তু আও রে আও। কবিগুরুও মৃত্যুকে সম্ভাষণ করেছেন, সাদরে আমন্ত্রণ করেছেন, "মরণ রে, তুঁহু মম শ্যাম সমান" বলেছেন।
মরণ, তু আও রে আও।
ভুজপাশে তব লহ সম্বধয়ি,
আঁখিপাত মঝু আসব মোদয়ি,
কোরউপর তুঝ রোদয়ি রোদয়ি,
নীদ ভরব সব দেহ।
চারিদিকে মৃত্যুর সারি, সম্পর্কের হানাহানি দেখে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সেই গানের কথা মনে পড়ে, "হেসে নাও, দুদিন বইত নয়"। জন্মের পরে খুব বেশী হলে পাঁচ বছর হলো হাসির সময়। সেই হাসি ম্লান হতে খুব বেশী হলে দশ বছর সময় লাগে। তারপরে বোঝা যায় পৃথিবীর রুক্ষতা। চারিদিকের প্রতিযোগিতা, হানাহানি, সম্পর্কের টানাপোড়েন দেখতে দেখতে উপলব্ধি হতে থাকে নিজের একাকীত্বের। এসেছি একা, যাবোও একা। মাঝে কিছু সম্পর্ক তৈরী হয়েছে মাত্র। সংসার, সমাজ বড়ই নিষ্ঠুর, সম্পর্কের দাম বোঝে না, দেয়ও না। শ্বেতশুভ্র বসনা নয়, সে বসনে শুধুই লাল, গাঢ় লাল। সংসারগত, সমাজগত সম্পর্কের টানাপোড়েনে ক্ষত বিক্ষত হতে হতে নিজের একাকীত্ব দানবিক চেহারা প্রাপ্ত হয়।
সমাজের এবং সংসারের রুক্ষতাই যৌথ পরিবারকে ভাঙতে ভাঙতে অতি ক্ষুদ্র পরিবারে এনে দাঁড় করিয়েছে। সম্পর্কের ফাটল বড় হতে হতে এখন আমরা নিজের ভাই, বোনকেও নিজেদের প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করি। খুড়তুতো, জ্যেঠতুত, পাড়াতুত সম্পর্কের মূল্য অচল পয়সার চেয়েও কম। নিজের অতি ক্ষুদ্র পরিবারেও যে নিজেদের মধ্যে মধুর সম্পর্ক বিরাজ করছে, একথা জোর দিয়ে বলা যায় না। মধুর সম্পর্ক বিরাজ করলে এত বিবাহ - বিচ্ছেদ, বৃদ্ধাশ্রমের বাড়বাড়ন্ত দেখা যেত না সমাজে। অথচ পরিসংখ্যান বলছে, এই যুগে প্রেমঘটিত বিবাহের সংখ্যার আধিক্য। একে অপরকে ভালোবেসে, বাকী জীবন একসাথে থাকবার অঙ্গীকার করে যদি সম্পর্ক তলানিতে এসে দাঁড়ায় তাহলে সেই সংসার অবশ্যই মরুভূমি সদৃশ্য। যে বাবা - মা সন্তানকে বড় করে তুলছে, মানুষ করে তুলছে, বুকে করে আগলে রেখেছে পৃথিবীর সমস্ত প্রতিকূলতা থেকে, স্নেহ - মমতা - ভালোবাসা দিয়ে নিজেদের রক্ত জল করে গড়ে তুলছে, সেই বাবা - মায়ের বৃদ্ধ বয়সে যদি বৃদ্ধাশ্রমে ঠাঁই হয়, সন্তানের কাছে যদি তারা বোঝা হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে সেই সম্পর্ক আর মরুভূমির রুক্ষতার মধ্যে পার্থক্য কোথায়? আসলে পৃথিবী বড়ই রুক্ষ, সম্পর্ক, স্নেহ, মায়া, মমতা, ভালোবাসা, সবই সাময়িক, আপেক্ষিক, ঘটনার পরিপ্রেক্ষিত। জীবনের বিভিন্ন স্তরে কিছু কিছু অস্থায়ী সম্পর্কের সৃষ্টি হয়, যার মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়ার কোনো স্থান নেই। সবটাই কিছু তাৎক্ষণিক বা ক্ষণস্থায়ী সময়ের জন্য। সেইসব সম্পর্কের আগেও আমি একা আবার পরেও আমি একা।
এই একাকীত্বের কারণেই, আমার মধ্যে আমিত্বের জন্ম। চারিদিকের এত প্রতিযোগিতা, হানাহানি, সম্পর্কের অবনমন। চোখ বুঁজলে সাধকেরা আরাধ্যের অবয়ব দেখতে পান আর আমরা অন্ধকার দেখি। নিজেকে যদি আমরা পরমারাধ্যের কাছে সমর্পণ করতে পারি, নিজের অস্তিত্বের চেয়ে পরমারাধ্যের অস্তিত্বকে বৃহৎ বলে ভাবতে পারি, তবেই আমিত্বের বিসর্জন। তবেই একাকীত্ব দূর হবে। এটা পুরোপুরি তত্ত্বকথা, বৈদিক যুগে বা নিদেন পক্ষে আজ থেকে দুশো বছর আগে এইসব কথার মূল্য থাকলেও আজ পরমারাধ্যের অস্তিত্বকেই স্বীকার করে না কেউ। ফলে বাস্তবের হেরফের হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
চারিদিকের প্রবঞ্চনা, প্রতারণা, হানাহানিকে আলাদা ভাবে দেখার কোনো যুক্তি নেই, বর্তমানে তা সমাজের, সংসারের অঙ্গ হিসেবেই প্রতিপন্ন। একাকীত্ব ধীরে ধীরে সমাজকে গ্রাস করছে। আমিও সেই গড্ডালিকা প্রবাহে বয়ে চলেছি। একাকীত্ব আমাকেও গ্রাস করেছে। সেই কারণেই মহা সিন্ধুর ওপারের সঙ্গীত মনোমুগ্ধকর লাগে, মন্ত্রমুগ্ধের মত টানে। কারণ একাকীত্ব সহ্য করার মতো যে মানসিক স্তরের শক্তির প্রয়োজন হয় তা মানুষের নেই। একটা পর্যায়ে একাকীত্ব থেকে মুক্তি চাইতে বাধ্য মানুষ। আবার অন্যভাবে দেখলে, মানুষের মানসিক স্তরের এই পরিবর্তনের কারণে সামাজিক স্তরে বা এই পৃথিবীতে যে ক্ষতি মানুষ করে চলেছে বা ইতিমধ্যেই করে ফেলেছে তার মূল্য মানুষকেই চোকাতে হবে।
সেই মূল্য চোকাতে বাধ্য করছে এই বসুন্ধরা, সেই কারণেই তার রুক্ষ মূর্তি প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে। শুধুমাত্র আবহাওয়া পরিবর্তন হচ্ছে না, মানুষের মননেও গভীর পরিবর্তন হচ্ছে। মানুষ ধৈর্য্যহীন, স্নেহ - মমতাহীন, লালসাময় রাক্ষুসে জীব হয়ে উঠেছে। সুদূর আন্টার্টিকাও তার হাত থেকে ছাড় পাচ্ছে না। সেখানকার বরফেও তেজস্ক্রিয়তার নবুদ মিলছে। নিজের মূল্যেই মানুষ একাকী হয়ে পড়েছে, একাকীত্ব ক্রমশঃ বেড়ে চলেছে এবং এই একাকীত্বই তার ধ্বংসের কারণ হবে।
একাকীত্ব সকলের মতো আমাকেও ধীরে ধীরে গ্রাস করছে, কারণ আমি সমাজের বা এই গ্রহের বাইরের কোনো জীব নই। কিন্তু নিজের একাকীত্বের সাথে বর্তমানে মনুষ্য নামক জীবের একাকীত্ব মেলাতে পারছি না। হয়তো কিছুটা ধৈর্য্যের অভাব রয়েছে আমার, আবার লালসা কিছুটা হলেও আছে হয়তো আমার মধ্যে, কিন্তু স্নেহ - মায়া - মমতা যথেষ্ট পরিমাণেই বিদ্যমান এখনও। রাক্ষুসে প্রবৃত্তির ফাঁদে ধরা দিইনি এখনও। তবু একাকীত্ব আছে, মৃত্যুর আহ্বান শুনতে ভালো লাগে, মহা সিন্ধুর ওপার থেকে ভেসে আসা সঙ্গীতের ধ্বনি কানে সুমধুর লাগে। কবিগুরুর মতো আমারও বলতে ভালো লাগে, "মরণ রে, তুঁহু মম শ্যাম সমান"। এ একাকীত্ব আমার একান্তই নিজস্ব, সমাজের রক্তপিপাসু রূপে ভয় পাই প্রচন্ড, পৃথিবীর রুক্ষতায় কেঁপে উঠি বারেবার।
মানুষের একাকীত্বের কারণেই, আমিত্বের বাড়বাড়ন্তের কারণেই সমাজ আজ রক্তচক্ষু মেলেছে। সুন্দর ভুবনের কুৎসিত রূপ প্রতিদিন তার লেলিহান পাখনা মেলছে। পিপাসার নিবৃত্তির কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না, বরং বেড়েই চলেছে। আবার সমাজের রুক্ষতার কারণেও মানুষ একাকীত্বে ভুগছে এবং ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাচ্ছে তার একাকীত্ব - এটাও সঠিক। এর থেকে নিস্তারের পথ জানা নেই, চক্রব্যূহ বললে বোধহয় সঠিক বলা হয়। ঔষধ বোধহয় একটাই, "মরণ রে, তুঁহু মম শ্যাম সমান"।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।