প্রায় এক হাজার বছর আগের বাংলা। ১০৭৫ খ্রিষ্টাব্দ, পাল রাজবংশের অন্ধকার যুগ চলছে। সিংহাসন নিয়ে ভাইয়ে ভাইয়ে লড়াই শুরু হয়েছে। সাম্রাজ্যের পরিধি ক্রমশই ক্ষুদ্র হচ্ছে। বাঙালীর গর্ব অতীশ দীপঙ্কর বিক্রমশিলা মহাবিহার ছেড়ে তিব্বতে চলে গেছেন প্রায় ত্রিশ বছর হলো। চারদিকে শুধুই অন্ধকার। তার মধ্যে একটি প্রদীপের দীপ্ত শিখার মতো জ্ঞানের আলো জ্বালিয়ে রেখেছেন চিকিৎসক চক্রপাণি দত্ত। প্রথম বিখ্যাত বাঙালি চিকিৎসক, যার রচিত পুস্তক এক হাজার বছর পরেও আজও সমস্ত ভারতবর্ষের আয়ূর্বেদিক কলেজগুলিতে পড়ানো হয়। সে দীপ শিখাও কি নিভে যাবে?
১.
কক্ষের এককোণে মৃগ চর্মের আসনে বসে রেড়ির তেলের প্রদীপের আলোয় সুশ্রুতের টিকা লিখছিলেন চক্রপাণি দত্ত। তন্নিষ্ঠ হয়ে গেছিলেন নিজের কাজে। দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে চমকে উঠলেন।
বর্ষাধারী একজন সৈন্য দাঁড়িয়ে আছে। সে বলল, ‘সেনাপতি শূল্য শীঘ্র আপনাকে তাঁর গৃহে যেতে বলেছেন।’
চক্রপাণি থমকালেন। ‘এতো রাতে?’
‘তা জানিনা। আমার উপর আদেশ রয়েছে যেতে না চাইলে বলপূর্বক নিয়ে যেতে। তবে আপনাকে আশ্বস্ত করতে পারি জ্ঞানদীপ কবিরাজ চক্রপাণি দত্তের উপর বল প্রয়োগ করার মতো স্পর্ধা আমার নেই।’
চক্রপাণি সামান্য হাসলেন, ‘তুমি কেমন সৈনিক হে, সেনাপতির নির্দেশ পালন করতে ইতস্তত করছ!’
সৈনিকটি মাথা নিচু করল। বলল, ‘আজ্ঞে, সব সেনাপতির উপরেও আরেকজন সেনাপতি আছেন। যিনি বিবেক হয়ে মাঝে মাঝে কথা কন। কি করে আমি ভুলে যাবো আমার তিন বছরের কন্যা যখন ভেদ বমিতে মরতে বসেছিল, মহাকালের সাথে পাঞ্জা লড়ে আপনিই তাকে বাঁচিয়েছিলেন।’
চক্রপাণি বললেন, ‘তোমার বিবেকের দংশনের আপাতত প্রয়োজন নেই। আমি যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে আসছি।’
পাথরের রাজপথে ঘড়- ঘড় শব্দে রথ ছুটছে। চক্রপাণি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। পাল রাষ্ট্র এক চরম সংকটের মধ্যে দিয়ে চলেছে।
দ্বিতীয় শূরপাল সম্রাটের আসনে বসেছেন- এখনও বছর ঘোরেনি। কিন্তু এর মধ্যেই তাঁর স্বেচ্ছাচারিতা চরমে উঠেছে। মদ্যপান এবং নিত্য নতুন নারীসঙ্গ নিয়েই তিনি মেতে আছেন।
অন্যদিকে পাল সাম্রাজ্য ক্ষয় পেতে পেতে শুধু মগধেই কোনও ভাবে টিকে আছে। যে বাংলার মাটিতে একদা এই বংশ রাজত্ব করতে শুরু করেছিল, সেই বাংলাতেই পাল বংশের প্রায় অস্তিত্ব নেই। ছোটো খাটো সামন্তরাও নিজেদের স্বাধীন রাজা বলে ঘোষণা করছেন।
সম্রাট শূরপালের মুখোমুখি হতে আজকাল চক্রপাণির বিরক্তি লাগে। এঁকে তিনি ছোটো বেলা থেকেই দেখেছেন। চক্রপাণির পিতা নারায়ণ দত্ত ছিলেন সম্রাট নয়পালের রন্ধনশালার কর্মচারী। নয়পাল শূরপালের পিতামহ। নয়পাল জ্ঞানী ব্যক্তির কদর করতেন। তিনি শিশু চক্রপাণির প্রতিভা বুঝতে পেরে তাঁকে সোমপুর বিহারে পাঠিয়েছিলেন শিক্ষা লাভের জন্য। চিকিৎসা বিদ্যায় প্রভূত পারদর্শিতা অর্জন করে চক্রপাণি যখন ফিরলেন, তখন নয়পাল পরলোক গমন করেছেন। তাঁর পুত্র দ্বিতীয় বিগ্রহপাল সিংহাসনে।
বিগ্রহপাল বাপকা বেটা ছিলেন। গুণী মানুষ চিনতে তাঁর ভুল হয়নি। চক্রপাণিকে তিনি রাজবৈদ্য নিয়োগ করেন। কিন্তু বারবার বহিরশত্রুর আক্রমণে তিতিবিরক্ত বিগ্রহপালকে সারাজীবন যুদ্ধ করেই কাটাতে হয়েছে।
বিগ্রহপালের অকস্মাৎ মৃত্যুর পর থেকেই পাল বংশের পতনের সব লক্ষ্মণ গুলি প্রকাশ পাচ্ছে। ভাইয়ে ভাইয়ে সিংহাসন নিয়ে লড়াই শুরু হয়েছে। বিগ্রহপালের পুত্র দ্বিতীয় মহীপাল তাঁর অপর দুই ভাই দ্বিতীয় শূরপাল এবং রামপালকে কারারুদ্ধ করে নিজেই সম্রাট হয়ে বসেন।
কিন্তু সম্রাজ্য তিনি বেশীদিন ভোগ করতে পারেন নি। বরেন্দ্র অঞ্চলের সামন্তরা মহীপালের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। সম্রাট দ্বিতীয় মহীপাল তা দমন করার জন্যে অভিযান চালান। শেষ পর্যন্ত তিনি বিদ্রোহীদের হাতে নিহত হন।
এই সুযোগে দ্বিতীয় শূরপাল রাজা হয়ে বসেন। কিন্তু পাল বংশের সম্রাট হিসাবে তিনি একেবারেই অযোগ্য। ইন্দ্রিয় সুখের বাইরে অন্য কিছু নিয়ে মাথা ঘামাতে তিনি নারাজ। সাম্রাজ্য ক্রমশ ছোটো হয়ে আসছে আর তিনি বিলাস ব্যাসন বজায় রাখার জন্য প্রজাদের উপর করের বোঝা চাপিয়েই চলেছেন। চক্রপাণি বেশ বুঝতে পারছেন এভাবে প্রজাদের শোষন করে পাল সাম্রাজ্য বেশিদিন টিকবে না। তিনি বহুবার শূরপালকে তা বলার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু শূরপাল ভালো কথা কানে তোলেন নি। তিনি সবসময় একগাদা নির্বোধ মোসাহেব পরিবেষ্টিত থাকেন। তাদের বাইরে আর কারও কথা কানে তোলেন না।
সেই সুযোগে মোসাহেবেরাও তাদের দাঁত নোখ বের করতে শুরু করেছে। নয়পাল বা বিগ্রহপালের আমলে সেনাপতির সাহস ছিলোনা রাজ কবিরাজকে বলপূর্বক ধরে নিয়ে যাওয়ার কথা বলার।
২.
শূল্য অস্থির ভাবে পায়চারী করছেন তাঁর প্রাসাদের সামনে। চক্রপাণিকে দেখে বললেন, ‘কবিরাজ, এতো দেরি হ’ল?’
চক্রপাণি উত্তর দিলেন না। শূল্যের ক্রোধ আরও বেড়ে গেল। তিনি বললেন, ‘মহারাজ বিগ্রহপাল আপনাকে আশকারা দিয়ে মাথায় তুলেছেন। তবে সেই যুগ কিন্তু আর নেই এটা মনে রাখবেন।’
চক্রপাণি বললেন, ‘কি জন্য আমাকে স্মরণ করেছেন সেটা জানালে বাধিত হব।’
‘আপনাকে আর কি জন্য ডাকব। একটি মেয়ে বিষ খেয়েছে। দেখুন যদি কিছু করা যায়।’
চক্রপাণিকে নিয়ে শূল্য প্রাসাদের একটি কক্ষে প্রবেশ করলেন। কক্ষটির মাঝখানে একটি পালঙ্ক। চারপাশের দেওয়ালের চারটি কুলঙ্গিতে দীপ জ্বলছে। সেই দীপের আলোয় চক্রপাণি একটি নারী শরীর দেখতে পেলেন।
চক্রপাণি এগিয়ে গিয়ে মেয়েটির কব্জিতে হাত রাখলেন। নাড়ি দেখতে দেখতে তাঁর মুখে বিস্ময় ফুটে উঠল। প্রদীপের আলোয় দেখা যাচ্ছে মেয়েটির মুখ থেকে গ্যাঁজলা বেরোচ্ছে।
পালঙ্কের মাথার কাছে এক দাসী দাঁড়িয়ে। চক্রপাণি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কতক্ষণ আগে খেয়েছে?’
দাসীটি ভীত মুখে বলল, ‘আমি তো বুঝতে পারিনি। সাঁঝ থেকেই কথা বন্ধ হয়ে গেছে। তাও এক প্রহর সময়।’
চক্রপাণি দাসীটিকে একটি দীপ নিয়ে আসতে বললেন। দীপের আলোয় তিনি মেয়েটির চোখের পাতা টেনে দেখলেন। উদরে হাত দিয়ে পরীক্ষা করলেন। তাঁর ভুরু ক্রমশ বেঁকে যাচ্ছিল।
তিনি বললেন, ‘সেনাপতি শূল্য, আপনি তো অকৃতদার বলে জানতাম। তাহলে ইনি কে?’
শূল্য হাসল। বলল, ‘অকৃতদার তো কি হয়েছে, ব্রক্ষ্মচর্য তো পালন করছি না।’
চক্রপাণি বললেন, ‘আপনি বারবনিতার ঘরে গেলে আমার বলার কিছু ছিল না। কিন্তু মেয়েটিকে দেখে বিবাহিত মনে হচ্ছে। তাছাড়া এর শরীরে জোর জবরদস্তির চিহ্ন বর্তমান। অন্যের বিবাহিতা স্ত্রীকে আপনি জোর করতে পারেন না। সেটা অন্যায়।’
শূল্য বলল, ‘যুদ্ধ বন্দী শত্রুপক্ষের নারীদের ভোগ করায় যুদ্ধজীবিদের কোনও নিষেধ নেই। ও একজন বিদ্রোহী শাক্যসেনের স্ত্রী। মগধের উত্তরে স্বস্তি গ্রামের কৃষকরা স্থানীয় এক কবিরাজ শাক্যসেনের নেতৃত্বে বিদ্রোহ করেছিল। আমাদের সেনা বিদ্রোহীদের ঠাণ্ডা করে দিয়েছে। শাক্যসেন ধরা পড়েছে। আজ বিচারক শাক্যসেনের প্রাণদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন। কালকে দুপুরে শূলে চড়িয়ে সেই আদেশ কার্যকর করা হবে। আমি সেই সংবাদ শুনিয়ে মেয়েটার দেমাক ভাঙ্গাতে গেছিলাম। কিন্তু ও যে বিষ খেয়ে বসবে বুঝতে পারিনি।’
চক্রপাণি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। স্বেচ্ছাচারিতা একদম চরমে উঠেছে। যে সেনাপতি পাল সম্রাজ্যে সকল নারীর সম্ভ্রম রক্ষা করার জন্য প্রতিশ্রুতি বদ্ধ, তিনি নিজেই নারীদের সর্বনাশ করছেন। বিগ্রহপালের আমল হলে সেনাপতি শূল্যকে এই অপরাধে শূলে চড়ানো হত। কিন্তু শূরপালকে বলে কিছু লাভ নেই। শূল্য তাঁর কাছের লোক। তাছাড়া সম্রাট স্বয়ং নারীশরীরের মোহে ডুবে রয়েছেন। চক্রপাণি বললেন, ‘আমাকে একটু ভালোভাবে পরীক্ষা করতে হবে। চিকিৎসক যখন রোগিণীকে পরীক্ষা করবেন, তখন ঘরের মধ্যে কারোর থাকার বিধান নেই।’
শূল্য বলল, ‘নিয়মের তোয়াক্কা আমি করি না। তবে এক্ষেত্রে আপনার অবাধ্য হব না। পারলে মেয়েটিকে বাঁচিয়ে দিন কবিরাজ। অন্তত কিছু দিনের জন্য হলেও। আমার মেয়েটিকে খুব পছন্দ হয়েছিল। শরীর যেন আগুণের মতো।’
৩.
শূল্য ও দাসী বেরিয়ে যাওয়ার পরে চক্রপাণি আস্তে আস্তে মেয়েটির গালে চাপড় মারতে লাগলেন আর বলতে শুরু করলেন, ‘আমি জানি তোমার কিছু হয়নি। তোমার নাড়ির গতি স্বাভাবিক। প্রশ্বাসের ছন্দও স্বাভাবিক। চোখ মেলে তাকাও মা। সময় খুব কম। কিছু বলার থাকলে আমাকে বল। পরে আর সুযোগ পাবে না।’
মেয়েটির গলার ভেতরের ঘড়ঘড়ে আওয়াজটা বন্ধ হয়ে গেল। সে আস্তে আস্তে চোখ খুলল। এদিক ওদিক তাকাল।
চক্রপাণি বললেন, ‘আমি রাজবৈদ্য চক্রপাণি দত্ত। তোমার কিছু বলার থাকলে তাড়াতাড়ি বলল। শূল্যের ধৈর্য্য বড্ড কম।’
মেয়েটির চোখে শ্রদ্ধার দৃষ্টি ফুটে উঠল। বলল, ‘আমি আপনার নাম অনেক শুনেছি। আমার স্বামী বলেন আপনি সাক্ষাৎ ধন্মন্তরি। আমার স্বামী শাক্যসেন একজন কবিরাজ। রোগীদের চিকিৎসার সময়ে আমি তাঁর সহযোগী হিসাবে কাজ করতাম। স্বামীর কাছ থেকে আমি চিকিৎসা সংক্রান্ত অনেক কিছুই জেনেছি। আর এটাও জেনেছি ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ চিকিৎসকের নাম চক্রপাণি দত্ত।’
চক্রপাণি বললেন, ‘চিকিৎসা বিদ্যার উপর তোমার যে বেশ দখল আছে সেটা তোমাকে পরীক্ষা করেই বুঝেছিলাম। কীটনাশক খাওয়া রোগিণীর হুবহু নকল করছিলে। নাড়িতে হাত দেওয়ার আগে আমারও কোনও সন্দেহ হয়নি। তোমার নামটা বল মা।’
‘আমার নাম পদ্ম। আমার স্বামীকে আপনি বাঁচান বাবা।’
‘তোমার স্বামী পাল সম্রাটের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিলেন কেন?’
পদ্ম বলল, ‘পর পর দুবছর শস্য তেমন হয়নি। তবু সম্রাট রাজস্ব বাড়িয়েই চলেছেন। ঐ পরিমাণ রাজকর দিতে হলে সকলকে না খেয়েই মরতে হবে। তবে বিদ্রোহ কেউ করনি। ওরা শুধু খাজনা আদায় করতে আসা রাজার সৈন্যদের জানিয়েছিল, এতো খাজনা দেওয়া অসম্ভব। সেখানে সবার হয়ে বলার দায়িত্ব নিয়েছিলেন আমার স্বামী। ওদের একজনের কাছেও অস্ত্র ছিল না।’
‘আশ্চর্য, এই অপরাধে মৃত্যুদণ্ড?’
‘বিচার ব্যবস্থাও সবসময় সবলের পক্ষেই থাকে। আপনার কাছে আমি স্বামীর জীবন ভিক্ষা চাইছি। ওকে যে করে হোক বাঁচান বাবা।’
‘আমি... আমি কি করে বাঁচাবো? সিংহাসনে বিগ্রহপাল থাকলে চেষ্টা করা যেতো। কিন্তু শূরপাল গুণীর কদর করতে জানেন না।’
‘সকলে বলে আপনি মৃতের প্রাণ ফিরিয়ে দিতে পারেন। আপনি চেষ্টা করলে সবই সম্ভব।’
চক্রপাণির চিন্তাক্লিষ্ট মুখে বললেন, ‘একটা উপায় হতে পারে। তবে তোমাকেও কঠিন পরীক্ষা দিতে হবে। সত্যিকারের বিষ খেতে পারবি রে মা?’
তিনি পদ্মর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিস ফিস করে বলতে লাগলেন। সময় বড্ড কম। তাছাড়া সেনাপতি শূল্যর চোখ শকুনের মতো, তাঁর মন নব বধূর মতো সন্দেহ প্রবণ।
চক্রপাণির কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে দরজা ঠেলে ঢুকলেন শূল্য। বললেন, ‘আপনার পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষ হয়েছে? মেয়েটির শারীরিক অবস্থা কীরকম?’
চরম হতাশায় মাথা নাড়লেন চক্রপাণি। বললেন, ‘অবস্থা ভালো নয়, কালকের দিন সম্ভবত কাটবে না। আমি ঔষধ দিচ্ছি।’
৪.
রাজধানীর পাথরের রাস্তার দুপাশে থিক থিক করছে ভিড়। বাচ্চারা বাবা মায়ের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। বয়স্করা গল্প করছেন, তিনি ঠিক কতবার এরকম সঙ দেখেছেন।
মগধের মানুষ শান্তিতে নেই। একের পর এক যুদ্ধ লেগেই রয়েছে। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রাজস্ব ও খাদ্যদ্রব্যের দাম। প্রজাদের পক্ষে দুবেলার খাবার জোগাড় করাই দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছে।
মানুষ শান্তিতে থাকলে চিত্রকলা, কাব্য, সংগীত ইত্যাদিতে বিনোদন খোঁজে। আর অশান্তিতে থাকলে নানা রকম বীভৎস ঘটনায় বিনোদন খুঁজে পায়। এমন একটা বিনোদনের কারণ আজ জুটে গেছে। দুইদিন আগে মগধের উত্তরপ্রদেশ থেকে একজন বিদ্রোহী নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিচারে তাঁর মৃত্যুদণ্ড সব্যস্ত হয়েছে।
সেই অপরাধীকে আজ গাধার পিঠে চাপিয়ে বধ্যভূমির দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। শূলে চড়িয়ে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হবে।
পাল সাম্রাজ্যে মৃত্যুদণ্ড সাধারণত চারভাবে কার্যকর করা হয়। অপরাধী যদি সম্ভ্রান্ত বংশের হয়, তাঁকে মশানে নিয়ে গিয়ে মা কালীর সামনে বলি দেওয়া হয়। আর অপরাধী বিকলাঙ্গ বা ব্যাধী আক্রান্ত হলে তাঁকে জ্যান্ত অবস্থায় পুঁতে ফেলা হয়। বাকিদের অপরাধের গুরুত্ব অনুযায়ী শূলে দেওয়া হয় অথবা অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করা হয়।
সামনে বর্শা হাতে আটজন সৈনিক, পেছনে বর্শা হাতে আরও আটজন সৈনিক। তাঁদের মাঝখানে গাধার পিঠে অপরাধী। অপরাধীকে দেখেই জনতা মনের সুখে গালাগালি দিতে লাগল। দু একজন অত্যুতসাহী ব্যক্তি পাথর ছুঁড়ে মারতে লাগল।
গাধাটি ভয় পেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। পেছন থেকে সৈন্যরা খোঁচা মারায় সে আবার চলতে শুরু করল। কিন্তু সে ভয় পেয়ে আছে। মাঝে মাঝেই বিশ্রী আওয়াজ করে ডাকছে।
গাধার পিঠের মানুষটির কিন্তু মুখমণ্ডলের কোনও পরিবর্তন নেই। সেখানে ভয়ের চিহ্ন নেই। চারিদিকে এতো মানুষের কটুক্তির পরও সেখানে রাগের কোনও চিহ্ন নেই। মুখের ভাব যদি পড়া যেতো তাহলে সকলে বুঝতে পারত সেখানে রয়েছে অপরিসীম ঘৃণার চিহ্ন।
আস্তে আস্তে জনতার শোভাযাত্রা বধ্যভূমিতে পৌছোলো। শূল প্রস্তুত, জহ্লাদও প্রস্তুত। শূলে চড়ানো নিঃসন্দেহে মৃত্যু দণ্ডের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ। এক্ষেত্রে একটি ছুঁচালো দণ্ডকে পায়ূপথে প্রবেশ করানো হয়। তারপর দণ্ডটিকে মাটিতে গেঁড়ে দেওয়া হয়। সুচালো দণ্ডটি একসময় অপরাধীর শরীর ভেদ করে বুক অথবা ঘাড় দিয়ে বার হয়। অপরাধী বেশ কয়েক ঘণ্টা ধরে অপরিসীম কষ্ট পেয়ে মারা যায়।
যদিও যুবকটি তার সম্ভাব্য পরিণতির কথা ভাবছে না। তার মনে হচ্ছে সব কিছু তাড়াতাড়ি মিটে গেলে ভালো হয়। সে একমণে একজন নারীর কথা ভাবতে চাইছিল। পদ্মর কথা। কে জানে সে এখন কোথায় আছে। শেয়াল কুকুরের খপ্পর থেকে সে কি নিজেকে বাঁচাতে পারবে?
পাথরের রাস্তায় ধুলো উড়িয়ে একটি ঘোড়া এসে দাড়ালো। ঘোড়া থেকে মধ্যবয়সের একজন ঋজু মানুষ নেমে এলেন। যুবকটি চমকে উঠল। এনাকে সে চেনে। পাল সম্রাটদের রাজসভার একজন অলঙ্কার কবিরাজ চক্রপাণি দত্ত।
চক্রপাণি উচ্চস্বরে বললেন, ‘অপরাধীকে আমি পরীক্ষা করব। যদি সে রোগমুক্ত হয় তাহলে তাঁকে আমার রোমথা বলে ঘোষণা করব।’
জনগণের মধ্যে চাঞ্চল্য দেখা দিল। নতুন যে নাটকটি অনুষ্ঠিত হতে চলেছে সেটিও মন্দ নয়।তবে শূলে চড়ানোর চাইতে নিঃসন্দেহে সেটা ম্যাড়ম্যাড়ে।
চক্রপাণি যুবকটির দেহ পরীক্ষা করলেন। তারপর হাসিমুখে দুপাশে মাথা নেড়ে বললেন, ‘একে রোমথা ঘোষণা করা হল।’
যুবকটি ভাবছিল ভাগ্যের কি পরিহাস। দুদিন আগেও সে নিজেই ছিল একজন চিকিৎসক। আর এখন রোমথা... একজন চিকিৎসকের ক্রীতদাস। তবে যার ক্রীতদাস সে হতে চলেছে, তাঁর ক্রীতদাস হওয়ার জন্যও তার মতো একজন সাধারণ কবিরাজকে সাত জন্ম তপস্যা করতে হয়।
লৌহশলাকা আগুনে পুড়িয়ে যখন শাক্যসেনের কপালে রোমথা শব্দটি লিখে দেওয়া হল, তখন তার চোখের পাতা যন্ত্রণায় একটুও কাঁপল না।
৫.
চক্রপাণি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘রোমথা কী, তাই নিয়ে তোমার কোনও ধারনা আছে?’
শাক্যসেন ইতিবাচক শির সঞ্চালন করল।
‘কী ধারণা?’
‘প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত অপরাধীদের সম্রাটের অনুমোদন পাওয়া একজন চিকিৎসক নিজের রোমথা ঘোষণা করতে পারবেন। রোমথারা হল চিকিৎসকদের ক্রীতদাস। চিকিৎসকরা ইচ্ছামতো রোমথাদের ব্যবহার করতে পারবেন। নতুন কোনো ঔষধ বা বিষ খাইয়ে তার গুণাগুন পর্যবেক্ষণ করতে পারবেন। তার উপর শল্যচিকিৎসার অনুশীলন করতে পারবেন। এমনকি রোমথাকে ফুটন্ত জলে ফেলে সেদ্ধ করে মহামাস তৈল তৈরী করতে পারবেন।’
চন্দ্রপাণি আহত স্বরে বললেন, ‘অস্বীকার করব না কিছু কিছু চিকিৎসক শুধু মাত্র আর্থ আর খ্যাতির লোভে এই সব পৈশাচিক কাণ্ড ঘটায়। এই মহামাস তৈলের যে কোনো ঔষধি গুণ নেই আমি বারবার বলেছি। কিন্তু বিত্তবান মানুষেরাও যৌবন ধরে রাখার জন্য মরিয়া। আসলে অপরাধ করেন মুষ্টিমেয় কয়েকজন আর বদনাম হয় সমগ্র চিকিৎসক গোষ্ঠীর।’
শাক্যসেন বললেন, ‘আমি নিজেও একজন গ্রাম্য চিকিৎসক ছিলাম। আপনার অনেক কীর্তির কথা আমি শুনেছি। আপনাকে যে আমি নিজের চোখে দেখতে পাব, আপনার সান্নিধ্যে সময় কাটাতে পারব, সেটা কোনদিনও ভাবতে পারিনি। আপনার রোমথা হওয়াও আমার পক্ষে গর্বের ব্যপার।’
চক্রপাণি বললেন, ‘আমি তোমার মতোই একজন রক্ত মাংসের সাধারণ মানুষ। অতএব তোমার অতটা গর্বিত না হলেও চলবে। তোমার জীবন বাঁচানোর আর কোনও উপায় না পাওয়ায় তোমাকে রোমথা করতে বাধ্য হয়েছি।’
‘আপনি হঠাৎ আমাকে বাঁচানোর জন্য উতলা হয়ে উঠলেন কেন? আমিতো আপনার সম্পূর্ণ অপরিচিত?’ শাক্যসেন বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে জিজ্ঞাসা করল।
‘কারণ একটি মেয়েকে আমি কথা দিয়েছিলাম। মেয়েটি আমাকে বাবা বলে ডেকেছিল।’
শাক্যসেনের মুখে হঠাৎ সমস্ত শরীর থেকে রক্ত ছুটে এলো। উত্তেজনায় সে সব ভুলে চক্রপাণির হাত চেপে ধরল। বলল, ‘আপনি কি আমার পদ্মকে দেখেছেন? সে কোথায় আছে? কেমন আছে?’
চক্রপাণি সামান্য হেসে বললেন, ‘তুমি বোধহয় বিস্মৃত হয়েছো রোমথাদের কোনও ব্যক্তিগত জীবন থাকে না। প্রভুই তার সবকিছু।’
শাক্যসেন মুখ নিচু করলেন। চক্রপাণি বললেন, ‘তবু শুনে নাও, পদ্মকে সেনাপতি শূল্য ধরে এনেছিল। কিন্তু শূল্য পদ্মকে স্পর্শও করতে পারেনি। তাঁর আগেই পদ্ম বিষ খেয়ে তার প্রাণ ত্যাগ করেছে।’
শাক্যসেনের মুখ নিচুই হয়ে রইল। তার চোখের জলে কক্ষের মেঝে লবণাক্ত হতে থাকল।
চক্রপাণি বললেন, ‘কান্নাকাটির সময় পরে অনেক পাবে শাক্যসেন। কিন্তু তুমি কি শেষ বারের মতো পদ্মকে দেখতে চাও?’
শাক্যসেনের গলা কান্নায় রুদ্ধ হয়ে আসছে। সে বলল, ‘চাই প্রভু। আর আপনি যদি অনুমতি দেন তাহলে আরেকটা জিনিস চাই। ঐ শূল্যকে নিজ হাতে হত্যা করে এর প্রতিশোধ নিতে চাই।’
চক্রপানি বললেন, ‘ভুলে যেওনা তুমি একজন রোমথা। একা বিচরণ করতে দেখলেই সেপাইরা তোমাকে তৎক্ষণাৎ হত্যা করবে। তবে আমি তোমাকে স্বাধীন করে দিতে পারি।’
‘কিভাবে? এই যে আমার কপালে রোমথা লিখে দেওয়া হয়েছে, এতো চিরস্থায়ী!’
‘তুমি সুশ্রুতের নাম শুনেছ? আজ থেকে প্রায় ১৬০০ বছর আগে মহাঋষি সুশ্রুত জন্মেছিলেন। সুশ্রুত সংহিতা পড়েছো? সুশ্রুত সংহিতায় ১৮৪ টি অধ্যায় আছে। তাতে আছে ১১২০ রকম রোগের বর্ণনা। ৭০০ ভেষজ উদ্ভিদ, ৬৪ টি রাসায়নিক ও ৫৭ টি প্রাণিজ মিশ্রণের কথা যা ঔষুধ হিসাবে ব্যবহার করা যায়। শুধু এখানেই শেষ নয়, তিনি তাঁর পুস্তকে অসংখ্য অস্ত্রোপাচারের বর্ণনা দিয়েছেন। সেই সব অস্ত্রোপাচারের জন্য তিনি ১২১ টি বিভিন্ন রকম যন্ত্রের বিস্তারিত বিবরণও দিয়েছেন। সেই যুগে শাস্তিস্বরূপ অনেকের নাক কেটে দেওয়া হতো। সুশ্রুত নিতম্ব থেকে মাংস ও চামড়া কেটে এনে সেই নাক মেরামতির বর্ণনা দিয়েছেন। আর আমি তাঁর ষোলোশো বছর পরে জন্মে তোমার ঐ কপালের দাগ চিরতরে মুছে দিতে পারব না?’
শাক্যসেন বলল, ‘কিন্তু ঐ দাগ মুছে কী হবে? পদ্মকে ছাড়া যে আমার আর কোনও অস্তিত্ব নেই।’
‘জীবন বড় অদ্ভুত শাক্যসেন। একজন চিকিৎসক হিসাবে সেটা আমি আরও ভালোভাবে বুঝতে পেরেছি। আর অনেক কিছুই ঔষধে সারানো যায় না। সময়ের সাথে সে সব নিজে নিজেই সেরে যায়। তবে আমরা মনে হয় প্রতীক্ষা করার খুব বেশী সময় পাব না। সম্রাট শূরপাল আমাকে জরুরী এত্তেলা পাঠিয়েছেন। সম্ভবত আমার কোনও বিশেষ শুভাকাঙ্ক্ষী তাঁর কাছে আমার নামে একটু বেশী প্রশংসা করেছেন। আমি রাজবাড়ি থেকে ঘুরে আসছি। আমার ঘর সংলগ্ন একটি গুপ্ত কক্ষ আছে। তুমি ততোক্ষণ ঐ গুপ্ত কক্ষে অপেক্ষা কর।’
৬.
শূরপাল বললেন, ‘কবিরাজ, আপনি নাকি আজ এক রাস্ট্রদ্রোহীকে রোমথা করে এনেছেন?’
চক্রপাণি এক দৃষ্টিতে শূরপালকে দেখছিলেন। অতিরিক্ত মদ্যপান আর অত্যাধিক বিলাস ব্যসনের ফলে শূরপালের চেহারা হয়ে উঠেছে ছোটখাটো হস্তী শাবকের মতো। সামান্য কথা বলতেই তিনি হাঁপাচ্ছেন।
শূরপাল এবার রীতিমতো ধমক দিলেন, ‘কি হলো, পাল সম্রাটের কথার জবাব দেওয়ার সৌজন্যও কি আপনি হারিয়ে ফেলেছেন? শূল্য মনে হচ্ছে ঠিকই বলেছে। ঐ বিদ্রোহীদের সাথে আপনার যোগাযোগ আছে।’
চক্রপাণি বললেন, ‘ক্ষমা করবেন মহারাজ। আমি এই জীবনে যেটুকু হতে পেরেছি সবই পাল সম্রাটদের কৃপায়। আমার পিতা ছিলেন সম্রাট নয়পালের রন্ধনশালার সামান্য কর্মচারী। তবু আমি তাঁর কৃপা থেকে বঞ্চিত হই নি। তিনি আমার অধ্যায়নের বন্দোবস্ত করেছিলেন। আপনার পিতা বিগ্রহপাল আমাকে রাজ বৈদ্য হওয়ার সম্মান দিয়েছেন। পাল বংশের সিংহাসনে যে থাকুক, তাঁর সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করা আমার পক্ষে অসম্ভব।’
শূরপাল বললেন, ‘তাহলে একটা কাজ করুন। কাল প্রত্যুষেই ঐ হতভাগা দেশদ্রোহীটাকে ফুটন্ত জলে ফেলে মহামাস তৈল প্রস্তুত করুন। কদিন ধরে শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। অন্দরমহলে এতোগুলো স্ত্রী, ওদিকে আমার কোনরকম ইচ্ছেই জাগ্রত হচ্ছে না। ঐ টগবগে জোয়ান লোকটার দেহ থেকে তৈরী মহামাস তেল মাখলে লাভ হতে পারে... কি বলেন কবিরাজ?’
চক্রপাণি কিছু বললেন না। তিনি দেখছিলেন এটুকু কথা বলতেই শূরপাল হাঁপিয়ে উঠেছেন। তাঁর মুখমণ্ডল রক্তবর্ণ ধারন করেছে। গলার শিরা গুলি দপ দপ করছে।
এই লক্ষ্মণগুলি ভালোভাবেই চেনেন চক্রপাণি। উচ্চরক্তচাপের লক্ষ্মণ। সর্পগন্ধার রস খাওয়ালে সাময়িক স্বস্তি মেলে। দীর্ঘ মেয়াদী চিকিৎসার জন্য অন্য ঔষধ। এখুনি এখুনি ঔষধ শুরু না করলে সন্ন্যাস রোগে পক্ষাঘাত এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
শূরপাল দমের কষ্ট একটু কমলেই আবার হুংকার দিয়ে উঠলেন, ‘তাহলে কাল সকালে আপনি মহামাস তেল তৈরী করছেন। মনে রাখবেন এটা পাল সম্রাটের আদেশ। আর পুরো প্রক্রিয়াটাই হবে সাধারণ মানুষের সামনে। যাতে তারা বুঝতে পারে রাজার বিরুদ্ধে যাওয়ার শাস্তি কি। যা খরচ লাগবে, রাজকোষ থেকে নিয়ে নেবেন। কাল অপরাহ্নের আগেই আমার মহামাস তৈল চাই। এর অন্যথা হলে পাল সম্রাজ্যে আপনার কোনও স্থান হবে না।’
চক্রপাণি দত্ত মাথা নীচু করে বললেন, ‘যথা আজ্ঞা মহারাজ।’ তিনি মন দিয়ে শূরপালের কথা সম্পূর্ণ শোনেন নি। তিনি একদৃষ্টিতে শূরপালের পায়ের কালো কালো দাগ গুলি দেখছিলেন। সম্রাট কি মধুমেহেও আক্রান্ত। মূত্রটা পরীক্ষা করতে পারলে হতো। এই অবস্থায় মদ্যপান কি উচিৎ হচ্ছে? সাথে অতিরিক্ত তৈলাক্ত হরিণের মাংস?
৭.
শুক্লপক্ষের পঞ্চমীর রাত। দুই অশ্বারোহী শুকনো মাঠের উপর দিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে চলেছেন।
বাঁধানো রাস্তা ধরেও তাদের গন্তব্যে পৌঁছানো যেতো। কিন্তু ওই রাস্তায় সেপাইরা টহল দেয়। দুজনের কেউই সৈন্যদের মুখোমুখি পড়তে ইচ্ছুক নয়।
দুজন অশ্বারোহীই আমাদের পূর্বপরিচিত। একজন চক্রপাণি দত্ত। আর একজন, যার মাথায় কাপড়ের ফেট্টি বাঁধা সে শাক্যসেন।
রাজবাড়ি থেকে ফিরে চক্রপাণি সময় নষ্ট করেন নি। আজকের রাতটুকুই হাতে সময় আছে। তিনি শাক্যসেনের কপাল থেকে আস্তে আস্তে রোমথা লেখাটি তুলে সে জায়গায় ডান ঊরু থেকে নতুন চামড়া প্রতিস্থাপন করে দিয়েছেন। আপাতত ক্ষতস্থান নানারকম ভেষজ ঔষধি দিয়ে তিনি বেঁধে দিয়েছেন। সাতদিন পরে বাঁধন খুলে ফেলতে হবে।
শাক্যসেন বারবার জিজ্ঞাসা করছিল, ‘এসব করে কী লাভ?’
‘আমি বিনা দোষে কাউকে ক্রীতদাস বানিয়ে রাখতে চাইনা। তোমাকে মুক্ত করে দেবো। এই রাজ্য ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাবে। কপালে রোমথা লেখা থাকলে সেটা সম্ভব হবে না। যে রাজ্যেই যাও সেই রাজ্যের সেনা তোমাকে গ্রেপ্তার করবে।’
‘কিন্তু মুক্তি পেয়েই বা লাভ কী? যেখানে পদ্মই থাকল না। বরঞ্চ আপনার কাছে রোমথা হয়ে থাকলে তবু জীবনটার একটা মানে থাকত।’
চক্রপাণি বললেন, ‘আমার নিজের ভবিষ্যৎ চরম অনিশ্চিত। গত এক দিনে যা করেছি আর আজ রাতে যা করতে চলেছি, তারপর এ রাজ্যে আমার আর থাকা চলে না। আজ দুপুরেই আমার স্ত্রী, কন্যাকে বরেন্দ্রভূমের ময়ুরেশ্বর গ্রামের উদ্দ্যশে রওনা করে দিয়েছি। তারা এই রাজ্যের সীমানা পেরিয়ে অপেক্ষা করবে। আমি আজ সারারাত অশ্ব চালনা করে ভোরের আগেই তাদের সাথে যোগ দেব।’
শাক্যসেন জানেনা সে কোথায় যাচ্ছে। রোমথাদের কোনও প্রশ্ন করতে নেই। তবে সে বুঝতে পারছিল নিশ্চয়ই গুরুতর কোনও ব্যপার আছে। যখন তাদের ঘোড়া শ্মশানে প্রবেশ করছিল, তখন তার বুক অজানা আশংকায় কাঁপতে শুরু করেছিল।
শ্মশানে একটা কাঠের চিতা সাজানো। তার উপর ওটা কার দেহ? শাক্যসেন কম্পিত পদে এগিয়ে গেল। তার পদ্ম ঘুমিয়ে আছে। ললাট সিঁদুরে মাখামাখি।
শাক্যসেন আরেকটু এগোতেই দুজন সৈন্য তাকে বাধা দিল। বলল, ‘মৃতদেহের কাছে যাওয়ার হুকুম নেই।’
শাক্যসেনের কানে সৈনিকদের নিষেধ আদৌ ঢুকল কিনা বোঝা গেলো না। পতঙ্গ যেমন মৃত্যুভয় উপেক্ষা করেই আগুণের দিকে ছুটে চলে, তেমনি সেও চিতার দিকে এগিয়ে চলল। একজন সৈনিক বর্ষা তুলল। ধারাল বর্ষায় শাক্যসেনের দেহ এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে যাবে।
চক্রপাণি তাকে থামালেন। সৈনিকদের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘বেচারার মাথা ঠিক নেই। নিজের স্ত্রীর মৃতদেহ দেখে কারই বা মাথার ঠিক থাকে!’
সৈনিকরা ঘটনা জানে। তাদের মনও বেদনায় আদ্র হয়ে উঠল। কিন্তু মুখে বলল, ‘মহামান্য কবিরাজ, আপনি ছাড়া কারও কাছে যাওয়ার হুকুম নাই। আপনি কাছে গিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করলেই মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেলা হবে।’
‘ঠিক আছে। তবে তোমরা কি অবন্তী রাজ্যের দ্রাক্ষা থেকে প্রস্তুত আসব পান করতে চাও?’
চক্রপাণি পোষাকের ভেতর থেকে একটি সৌখিন মৃত্তিকা নির্মিত চ্যাপটা পাত্র বের করলেন। সৈনিক দুজনের চোখেই লোভের ছায়া। কিন্তু তারা দোটানায় ভুগছে। কর্তব্যের সময়ে মদ্যপান কি উচিৎ হবে?
৮.
কিছুক্ষণের মধ্যেই সৈনিক দুজন মাটিতে গড়িয়ে পড়ল। চক্রপাণি বললেন, ‘আসবের মধ্যে গাঢ় মাত্রায় চেতনা নাশক ঔষধ মিশানো আছে। একদণ্ডের আগে ওদের জ্ঞান ফিরবে না।’
শাক্যসেন এক দৌড়ে পদ্মর পাশে গেল। তার এক হাত মুঠোয় ধরে পদ্মার বুকে মাথা রাখল। তার চোখের জল বাঁধ মানছে না। কিন্তু কয়েক মুহুর্তের মধ্যেই সে তড়িতাহতের মতো উঠে বসল এবং স্থান কাল ভুলে চিৎকার করে উঠল, ‘প্রভু, পদ্ম এখনও বেঁচে আছে।’
চক্রপাণি বললেন, ‘চুপ, চুপ... অমন আহাম্মকের মতো গগন বিদারী চিৎকার করো না। আমি খুব ভালোভাবেই সেটা জানি। আফিম ও হেনবেইন গাছের পুষ্পের রস পান করায় পদ্ম এরকম মৃত্যু সদৃশ অবস্থায় রয়েছে। সাপ সহ বিভিন্ন প্রানী যখন শীতঘুম দেয়, তখন তাদের শরীরেও প্রায় সমগোত্রীয় পরিবর্তন হয়। হৃদপিণ্ডের গতি, নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের গতি সবই অনেক কমে যায়। সাধারণ লোক দেখলে মৃত বলেই ভুল করবে।’
শাক্যসেন কিছু বলার চেষ্টা করল, কিন্তু তার কন্ঠ থেকে ঘড় ঘড় আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই বের হল না।
চক্রপাণি পোশাকের মধ্যে থেকে আরেকটি আরকের বোতল বের করলেন। আফিমের প্রতিষেধক। তিনি অস্ত্রপ্রচারের পর রোগির জ্ঞান ফেরাতে এটাই ব্যবহার করেন। সেটি শাক্যসেনের হাতে ধরিয়ে বললেন, ‘চোখের জল মোছো। সময় খুবই কম। নিভৃতে স্ত্রীর বুকে মাথা রেখে বিলাপের সময় পরে অনেক পাবে।’
শাক্যসেন উঠে দাঁড়ালেন। পূব আকাশ রাঙ্গা হয়ে ওঠার এখনও অনেক দেরী। উষাকালের সেই অপূর্ব আলো এই মাঝ রাতেই মাখামাখি তার মুখে।
চক্রপাণি দত্ত নিজের ঘোড়ায় উঠে বললেন, ‘আমি চললাম আমার জন্মস্থান ময়ূরেশ্বর গ্রামে। সবকিছু নতুন করে আবার শুরু করব। আমার অর্জিত জ্ঞান জনসাধারণের হিতার্থে ছড়িয়ে দেব। তোমাকে স্বাধীন করে দিয়ে গেলাম। তুমি আমার মেয়েটাকে নিয়ে পূব দিক মুখ করে অশ্ব চালিও। ইরানী অশ্ব। ভোরের অনেক আগেই রাজ্যের সীমানা পেরিয়ে যাবে। বঙ্গালা মুলুকে একটা জনপদ দেখে তোমার পেশা শুরু কোরো। মনে রেখো, “বিদ্বত্ত্বঞ্চ নৃপত্বঞ্চ নৈব তুল্যং কদাচন। স্বদেশে পূজ্যতে রাজা বিদ্বান সর্বত্র পূজ্যতে”।’