
অতিমারিতে অতি মারাত্মক কিছু ঘটছে না। তবে কম মারাত্মক ঘটনা রোজই ঘটছে।
খুপরিতে রোগী দেখতে দেখতে চিৎকার করছিলাম। এক রোগিনীকে এক মাস বাদে আসতে বলেছিলাম। তিনি তিন মাস বাদে এসেছেন। সিস্টোলিক প্রেশার ২০০ ছুঁয়েছে।
আগেরবারও এমন প্রেশার পেয়েছিলাম। ওষুধপত্র দিয়েছিলাম। তাতে তো কমার কথা!!
বললাম, 'প্রেশারের ওষুধ বন্ধ করেছেন কেন?'
রোগিনী বললেন, 'না ডাক্তারবাবু, ঠিকমতো খেয়েছি।'
'ঠিকমতো খেলে প্রেশার তো একটু হলেও কমবে। আপনার তো কমার বদলে বেড়ে গেল। একি, একি, মাস্ক নামাচ্ছেন কেন?'
'দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।'
'আপনার আগের রোগীই চারদিন জ্বরে ভুগছেন। নাকে গন্ধ পাচ্ছেন না। টেস্ট করলে করোনা ধরা পরার সম্ভাবনা যথেষ্ট। এই যে মাস্ক খুললেন, গোটা কতক ভাইরাস ড্রপলেটে চেপে নাচতে নাচতে নাকে ঢুকে গেল। আপনার যা প্রেশার, একবার করোনা হলে দেখতে হবে না।'
রোগিনী ভয়ে ভয়ে বললেন, 'আমি তো সামান্য সময়ের জন্য খুলেছি।'
বললাম, 'ভাইরাস ওঁত পেতে বসে আছে সুযোগের অপেক্ষায়। ওদের কাছে লোহার বাসর ঘরে একটা ছ্যাঁদাই যথেষ্ট। মূল কথায় আসুন। আপনি কি ওষুধ খাচ্ছেন, নাকি খাচ্ছেন না?'
'ডাক্তারবাবু, আপনি যত দিন খেতে বলেছিলেন, খেয়েছিলাম। তারপর বন্ধ করে দিয়েছি। প্রেশার তো নরমালই ছিল।'
আমি প্রেসক্রিপশনে আঙ্গুল দিয়ে দেখালাম, প্রেশারের ওষুধের পাশে বাংলায় লেখা আছে, 'চলবে'। সবে বড়সড় ঝাড় দেবো বলে প্রস্তুতি নিচ্ছি, এমন সময় ভয়ে ভয়ে আমাদের রান্নার দিদি বিথীকাদি মুখ বাড়ালেন, 'দাদা, একটা কথা ছিল।'
'বলো।'
'দাদা, রানাদার কি করোনা হয়েছে? অনেকে ওদের বাড়িতে রান্না করতে যেতে বারণ করছে। ওর মা নেই। বাবা আর ছেলে মিলে থাকে। আমি না গেলে কাকুকেই রান্না করতে হবে।'
ডিউক এর কাছ থেকে একটু আগেই ঘটনাটা শুনেছি। রানাদার এক বন্ধুর বাবা মারা গেছিলেন। করোনার মার্কেটে শ্মশানবন্ধু পাওয়াও দুষ্কর। রানাদা বন্ধুর সাথে শ্মশানে গেছিল।
বন্ধুটির অফিস থেকে আগেই করোনা টেস্ট করানো ছিল। সিম্পটম সে রকম কিছু ছিল না। বাবাকে সৎকার করে ফিরে সে রাত্রেই রিপোর্ট পেয়েছে কোভিড পজিটিভ।
সেই খবর আস্তে আস্তে ডালপালা মেলেছে। আজকে রানাদার বাবা বাজার করতে বেরিয়েছিলেন। অনেকে অবজেকশন জানিয়েছেন, 'আপনার ছেলের করোনা হয়েছে, আপনি বাইরে বেরিয়েছেন কেন?' তাঁদের অনেকে বিথীকাদিকে ওদের বাড়ি রান্না করতে যেতে বারণ করেছেন।
এই পরিস্থিতির সাথে আমি আগেও পরিচিত। আমাদের আর একজন গৃহ সহায়িকা অঞ্জুদিকে পাশের পাড়ার এক বাড়িতে বলেছিল, 'তুমি ডাক্তারবাবুর বাড়িতে কাজ করো। ডাক্তারবাবু রোজ জ্বরের রোগী দেখছেন। ওই বাড়িতে কাজ না ছাড়লে আমাদের বাড়ি আর কাজ করতে পারবে না।' অঞ্জুদি আমাকে হেসে বলেছিলেন, 'বললুম, আপনাদের কাজটাই তাহলে ছেড়ে দিই। তবে আপনারা জ্বর হলে কোথায় যাবেন? ডাক্তার কি দেখাবেন না?’
বিথীকাদিকে বুঝিয়ে বললাম, 'দেখো রানাদা তো একজন মাত্র করোনা রোগীর কাছাকাছি এসেছে। আর আমি তো রোজ জনা কুড়ি করোনা রোগীর কাছাকাছি আসছি। তাহলে তো আমারও বাড়ি বসে থাকা উচিত। শুধু আমার না, সব ডাক্তারেরই বাড়ি বসে থাকা উচিত। তুমি যেভাবে আমাদের বাড়ি মাস্ক পরে কাজ করছো, সেভাবেই রানাদাদের বাড়ি মাস্ক পরে কাজ করো।'
উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত রোগিনী এতক্ষণ চুপচাপ বসে ছিলেন। এবার ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, 'প্রেশারের ওষুধ কি তাহলে খেতেই হবে? আমার মামাতো দাদা বলছিল প্রেশারের ওষুধ ধরলে না কি ছাড়া যায় না?'
আমি বললাম, 'প্রেশারের ওষুধ ছাড়তে পারেন। সে ক্ষেত্রে পৃথিবীও ছাড়ার প্রস্তুতি নিয়ে রাখুন। শুনলেন তো, এ সময় মরলে সৎকার করতে গিয়েও হেব্বি ঝামেলা।'
"করোনার মার্কেটে শ্মশানবন্ধু পাওয়াও দুষ্কর।"
কি কঠিন বাস্তবতা!
অঞ্জুদির মতো মানুষেরা আছেন বলেই এখনো পৃথিবী সুন্দর!
কাজরী রায়চৌধুরী | 42.***.*** | ২০ সেপ্টেম্বর ২০২০ ১৪:৫৬97402ডঃ ঐন্দ্রিল ভৌমিকের কয়েকটি কিস্তি পড়লাম। অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় লেখা এবং পাশাপাশি সচেতন করার কাজও করছেন।
Abhyu | 47.39.***.*** | ২২ সেপ্টেম্বর ২০২০ ১৩:০৫97464এখানেই থাক
https://epaper.anandabazar.com/epaperimages/22092020/22092020-md-hr-6/42927485.jpg
Pinaki | 136.228.***.*** | ২২ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২০:৪২97531ডুবে গিয়েছিল, তুললাম।