আমি আপাদমস্তক সুবিধাবাদী আস্তিক। সবকিছু ঠিক ঠাক চললে, তখন ভগবানকে কেয়ারও করি না। আর বিপদে পড়লে ঠাকুর দেবতাকে ঘন ঘন স্মরণ করি।
ফাইনাল এমবিবিএস পরীক্ষার আগে যখন মেডিসিন, সার্জারি, গাইনির মহাসমুদ্রে হাবুডুবু খাচ্ছি, তখন দিনে তিনবার করে ফিরিঙ্গী কালীবাড়িতে গিয়ে হত্যে দিতাম। ‘মা, মা’ করে মা কালীর কান ঝালাপালা করে দিতাম। ওখানকার পুরোহিত মশাই আমাকে রীতিমতো স্নেহ করতে শুরু করেছিলেন। বলতেন, ‘বাবা, আমি অনেক ভক্ত দেখেছি, তোর মতো পাগল ভক্ত আর দেখিনি। মাকে না দেখে এক বেলাও থাকতে পারিস নে।’
সম্ভবত আমার অতি ভক্তির হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যই মা কালী সে যাত্রায় উপর মহলে অনেক বলে কয়ে আমাকে পাশ করিয়ে দিয়েছিলেন। না হলে, সার্জারি পরীক্ষায় প্র্যাক্টিকালের দিন যা ছড়িয়েছিলাম, তাতে কোনোভাবেই আমার পাশ করা উচিৎ নয়।
যাইহোক, রেজাল্ট বেরনোর পর রাতারাতি আমি নাস্তিক হয়ে গেলাম। রোজ বিকালে বৌবাজারে চা খেতে গেলেও কালীবাড়ির ধারেকাছে ঘেঁষিনা। ইনটার্নশিপে প্রায় চার হাজার টাকা মাইনে পেতাম। প্রতি শুক্রবার গ্লোব সিনামাহলের মাচায় উঠে ইংরেজি সিনেমা দেখতাম। তখন আর ঠাকুর দেবতার কথা মনেও পড়ত না।
ভক্তি আবার ফিরে এল খড়গ্রামে চাকরির শেষ দিকে। স্ত্রী, নবজাতক কন্যা আড়াইশো কিলোমিটার দূরের বাড়িতে। যে করেই হোক বাড়ির কাছাকাছি ফিরতে হবে। পোষ্ট গ্রাজুয়েশানে চান্স পাওয়া ছাড়া বাড়িতে ফেরার উপায় নেই। আমি আবার মা কালীর ফটো জোগাড় করে ‘মা মা’ শুরু করলাম।
আমার মতো সুবিধাবাদী সন্তানও মার স্নেহ থেকে বঞ্চিত হোল না। মেডিকেল কলেজে ফিরে এলাম। ফিরিঙ্গী কালীবাড়িতে আবার যাওয়া শুরু করলাম। তবে কলকাতায় ফিরে সাথে সাথে নয়। আবার বছর তিনেক পরে। এমডি ফাইনাল পরীক্ষার আগে আগে।
আমার অন্যতম অ্যাসিস্টেন্ট গৌড় রায়চৌধুরি কিন্তু আমার মতো সুবিধেবাদী আস্তিক নয়। ওর দিনের অনেকটা সময়ই ঈশ্বর বন্দনায় কাটে। ইসিজি করা ওর সেকেন্ডারি পেশা। ওর মূল পেশা পুজো আচ্চা করা।
গৌড় সপ্তাহের অধিকাংশ দিনই নিরামিষ খায়। সপ্তাহের বিশেষ কয়েকটি দিনে বাইরে কিছুই খায়না। এমনকি চা পর্যন্ত না। একাদশীতে দুচার টুকরো ফল খেয়ে দিব্যি সারাদিন কাটিয়ে দেয়।
পূজারী বামুন বললে আমাদের চোখে যে মানুষের চিত্র ভাসে গৌড় মোটেও সে রকম নয়। পুজো করাটা ওর কাছে প্রায় প্যাশন। আদ্যোপান্ত সৎ বামুন। দক্ষিণা নিয়ে কারো সাথে ঝামেলা করে না। বলে ডাক্তারবাবু, ‘যার যেরকম সামর্থ্য তাই তো দেবে। তা বলে তাঁর বাড়িতে কি ঈশ্বরের পুজো হবে না?’
করোনার সময়ে বেচারা পরে গেছে মুশকিলে। সব পুজোই বন্ধ। পয়লা বৈশাখ, অক্ষয় তৃতীয়া এক এক করে পার হয়ে যাচ্ছে, গৌড়ের ভুরু কুঁচকে উঠছে। যে কয়েকটা বাড়িতে নিয়মিত যজমানি করত সেগুলোও বন্ধ।
ও এখন প্রায় সব সময়ই আমার সাথে সাথে থাকছে। যদি দুএকটা ইসিজি বেশি পাওয়া যায়। মাঝে মাঝে মুখ ফসকে বলে ফেলছে, ডাক্তারবাবু, বড্ড বিপদে পড়ে গেলুম। বাচ্চাটা একেবারে ছোটো। বাবা, মায়েরও অনেক বয়স হয়েছে।’ কিন্তু তার ঈশ্বরে ভক্তি কমার কোনও লক্ষ্মণ দেখতে পাচ্ছি না।
সেই গৌড় কালকে চেম্বার শেষের পর বলে ফেলল, ‘ডাক্তারবাবু, চারিদিকের ঘটনা দেখতে দেখতে কদিন ধরে ভগবানের উপর আমার ভরসা হচ্ছে না। বাচ্চা কোলে নিয়ে শ্রমিকেরা রৌদ্রের মধ্যে হাঁটছে, সেটাকি ভগবানের চোখে পড়েনা? ভগবান থাকলে এতগুলো গরীব মানুষের ঘর আম্ফানে ভেঙে যায়? অথচ দেখেন, যে নেতাগুলো এই অকালেও গরীবের পেটে লাথি মারছে তাদের কিছুই হয় না। দিব্যি আছে।’
তারপর বলল, ‘আমার এই বিপদের সময়ে ভগবান মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। ডাক্তাররা আছেন বলে তাও কটা ইসিজি করে পরিবারের সকলের পেট ভরতে পারছি। ইদানীং আমার ভগবানের চেয়ে ডাক্তারের উপর ভরসা বেশি হচ্ছে।’
বললাম, ‘তা ডাক্তারদের উপর এতই ভরসা যখন আজ যাওয়ার সময় একটু চা, মিষ্টি খেয়ে যাও।’
গৌড় কিছুতেই খেল না। জানি ও মুখে যাই বলুক, ভগবানের উপর বিশ্বাস ওর এতটুকুও কমেনি।
~~~~
করোনার দিনগুলি #৩৭
করোনা রোগী
একদিন চেম্বার বন্ধ থাকলে পরদিন দ্বিগুণ রোগী দেখতে হয়।
রবিবার গেছিলাম মিনাখাঁর আমফান বিধ্বস্ত গ্রামে মেডিকেল ক্যাম্প করতে। সোমবার তাই বিপদে পড়লাম। সকাল সকাল ঘোলার দাস মেডিকেলের খুপরিতে ঢুকতেই দাস কাকু বললেন, 'ডাক্তার বাবু, হাত চালিয়ে। নইলে বারোটার মধ্যে বের হতে পারবেন না। অনেক পেশেন্ট।'
বললাম, 'যারা ক্রনিক পেশেন্ট পারলে ভাগিয়ে দিন। পরে আসবে।'
'ডাক্তারবাবু, গতকাল একবার ভাগিয়েছি। আজ আবার ভাগালে এবার দোকানে ভাঙচুর করবে।'
কথা বাড়িয়ে কাজ নেই। ঘাড় গুঁজে রোগী দেখতে শুরু করলাম। এই খুপরিটা সবচেয়ে ছোট। এসি একটা আছে বটে, কিন্তু চলে না। গত চার বছর ধরে ওটাকে অচল অবস্থায় দেখছি। সম্ভবত ভেতরে মেশিনপত্র নেই। এসির খোলস টানিয়ে চেম্বারটা কে জাতে তোলার চেষ্টা হয়েছে। থাকার মধ্যে আছে একটা টেবিল ফ্যান। সেটা আবার ঘুরে ঘুরে হাওয়া দেয়। মাস্ক পরে ঘামতে ঘামতে রোগী দেখছিলাম।
ঘড়ির কাঁটা ক্রমশ বারোটার ঘরের দিকে যাচ্ছে। আমার উত্তেজনাও বাড়ছে। সাড়ে বারোটার মধ্যে বাড়ির চেম্বারে না পৌঁছাতে পারলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। বাইরে বেশ কোলাহল। তার মানে এখনো অনেক রোগী নিজেদের মধ্যে লাইনের সিরিয়াল নিয়ে গণ্ডগোল করছে। আজ কপালে দুঃখ আছে।
একজন বয়স্ক ভদ্রলোক দুপদাপ করে চেম্বারে ঢুকলেন। বললাম, 'নাম বলুন।'
ভদ্রলোক নামটা বলেই বললেন, 'চিনতে পারলেন?'
বললাম, 'না তো। কেন বলুন তো?'
'আসলে আমি তো একজন বিখ্যাত মানুষ। কুখ্যাতও বলতে পারেন।'
বললাম, 'বলুন, সমস্যাটা কী?'
উনি বললেন, 'আমার করোনা হয়েছে....'
ডাক্তাররা কিছুতেই চমকায় না। সারাদিন আজব আজব ঘটনার সম্মুখীন হতে হতে তাদের চমকিত হওয়ার ক্ষমতা চলে যায়। বললাম, 'ইয়ার্কি মারছেন নাকি?'
'ছি ছি। ইয়ার্কি মারব কেন? তাছাড়া ডাক্তার আর ভগবানের সাথে কেউ ইয়ার্কি মারে? আপনি সত্যি আমার নাম শোনেন নি?'
'কেন, আপনি কি বাংলা সিরিয়াল করেন? ওই সব সিরিয়াল আর খবরের চ্যানেল আমি দেখিনা কখনো। একটা সিরিয়াল একটু খানি দেখেছিলাম। শাশুড়ি আর তার মেয়ে মিলে পরিকল্পনা করছে- কি করে বৌমাকে ওষুধ দিয়ে পাগল বানাবে। বাপরে...'
ভদ্রলোক করুণ মুখে বললেন, 'আমার নাম শোনেন নি আপনি? সত্যিই কি শোনেন নি আমার নাম?'
নেতিবাচক ঘাড় নাড়ালাম। বললাম, 'একটু তাড়াতাড়ি করলে ভালো হয়। সময়ের বড় অভাব।'
ভদ্রলোক তাতে কান দিলেন বলে মনে হলো না। বলে চললেন, 'অথচ আমি ভাবতাম করোনা হওয়ার পর আমাকে সবাই চিনে গেছে। ফেসবুক- হোয়াটসঅ্যাপে আমার ছবি, ঠিকুজি-কুলুজি দিয়ে পোস্ট ভাইরাল হয়েছিল।'
আমি বললাম, 'আপনার করোনা হোক, জলাতঙ্ক হোক- যাই হোক আমার কাছে কেন এসেছেন বলুন।'
ভদ্রলোক এবারও আমার কথা শুনলেন না। বললেন, 'সারা জীবনে কেউ পাত্তা দিত না। নিজের বউও না। আর একাত্তর বছর বয়সে করোনার কল্যাণে হঠাৎ বিখ্যাত হয়ে গেলাম। খারাপ লাগছে না, বুঝলেন ডাক্তারবাবু। কেউ কোনোদিন বাসের সিটও ছেড়ে দেয়নি। আজ করোনা হয়েছে বলে পরিচয় দেওয়ার সাথে সাথে সবাই লাইন ছেড়ে দিলো।'
অবাক হয়ে বললাম, 'আপনি নিজেই সবাইকে বলে বেড়াচ্ছেন আপনার করোনা হয়েছে?'
উনি বারাসতের জি এন আর সি হাসপাতালের একটা ডিসচার্জ সার্টিফিকেট বের করলেন। বললেন, 'না হলে তো আমাকে চৌদ্দ জনের পেছনে লাইন দিতে হতো।'
ডিসচার্জ সার্টিফিকেটে চোখ বোলালাম। কোভিড ১৯ এ আক্রান্ত হয়ে এপ্রিলের ১০ থেকে ২৫ তারিখ অবধি ভর্তি ছিলেন। বললাম, ‘আমার কাছে কেন?'
উনি সুগারের রিপোর্ট বার করলেন। সুগার খালি পেটে ২৭৮। প্রেসার মাপলাম। উপরের টা ১৭০ ছাড়িয়েছে। বললাম, 'করেছেন কি? এই নিয়ে আপনি করোনা থেকে বেঁচে ফিরলেন কি করে?'
'কাউকেই তো মরতে দেখলাম না। ভর্তির পর দিন তিনেক জ্বর ছিল। তারপরে শুধু বসে বসে গল্প করতাম। মেডিকেল কলেজের দুজন বাচ্চা ডাক্তারও আমার সাথে ভর্তি হয়েছিল। ভারী ভালো ছেলে। ওদের সাথেই বেশি গল্প করতাম।'
ওষুধ পত্র লিখে বললাম, 'দু সপ্তাহ পরে আসুন। প্রেসার স্বাভাবিক হল কিনা দেখতে হবে।'
ভদ্রলোক বেরোতেই দাস কাকু মাথা বাড়ালেন। 'আর রোগী নেই ডাক্তারবাবু। চট করে স্কুটার নিয়ে পালিয়ে যান।'
বিস্ময় মিশ্রিত পুলক অনুভব করলাম। 'কিন্তু বাইরে যে চিৎকার চেঁচামেচি শুনছিলাম?'
'এ ভদ্রলোক এমন ভাবে ঢাক ঢোল পিটিয়ে নিজের করোনা হওয়ার কথা জানালেন- শোনার পর সক্কলে পালিয়েছে। একজন পেটে ব্যথার পেশেন্ট ছিলো। ব্যথায় কুঁকড়ে যাচ্ছিল। সে পর্যন্ত দিব্যি সোজা হয়ে পালিয়ে গেল।'
আমি বললাম, 'আহা, ভদ্রলোককে একটা ধন্যবাদ দেওয়া উচিৎ ছিল।'
~~~~
করোনার দিনগুলি #৩৮
রাস্তায় কি ভিড়। কদিন আগেই ফাঁকা রাস্তায় স্কুটারে সোদপুর যাওয়ার সময় নিজেকে ভিআইপি মনে হতো। আমার সেই ভিআইপি স্ট্যাটাস মুছে গেছে। একশো মিটার যেতে দশবার ব্রেক চাপতে হচ্ছে।
লক ডাউনের শুরুতে দেশে করোনা রোগী ছিল ৩৪১ জন ও মৃত ৬ জন। অথচ প্রায় প্রত্যেকেই করোনা আতংকে ভুগছিলেন। সন্ধ্যের পর রাস্তাঘাট শ্মশান হয়ে যেতো।
আর আজ যখন ২.৫ লাখ রোগী আর ৭.৫ হাজার মৃত, তখন সকলের ভয় উবে গেছে। না উবে উপায়ও নেই। অপরিকল্পিত লক ডাউনে অধিকাংশ মানুষেরই পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেছে।
কোমরে ব্যথা, পায়ে ব্যথা নিয়ে অনেক রোগী আসছেন। লোকজন সাইকেল নিয়ে বসিরহাট থেকে বড়বাজার চলে যাচ্ছেন। অল্প কটা বাস চলছে। কিন্তু তাতে ওঠার জন্য প্রায় যুদ্ধ করতে হচ্ছে। নিজের চোখে না দেখলে সেই যুদ্ধ বিশ্বাস করা কঠিন।
সরকার পুরোপুরি হাত তুলে নিয়েছে। না, পুরোপুরি নয়। ট্রেন এখনো বন্ধ আছে। লোকাল ট্রেন বন্ধ থাকায় জনস্রোত পুরোটাই নেমে পড়েছে রাস্তায়।
তবে অল্প হলেও মহামারীর কয়েকটি ভালো দিকও আছে। আজ একজন রোগী এসেছিলেন। তার স্টেশনে লটারির দোকান ছিলো। মার্চ মাস থেকে বন্ধ। আগেও তাঁর কথা লিখেছি।
তাঁর সুগার নর্মাল। নিয়মিত ওষুধ খাচ্ছেন। এখন তিনি ঘুরে ঘুরে ফল বিক্রি করেন। হাসি মুখে বললেন, ‘ডাক্তারবাবু, লটারির থেকে ফলের ব্যবসা ভালো। অন্তত লোককে ঠকাচ্ছি মনে হয় না। আর লটারির ব্যবসা করবো না।'
একদল দামাল ছেলে মেয়ে, যারা এতোদিন নিজের কেরিয়ারের বাইরে খুব বেশি কিছু চিনত না, তারা ছড়িয়ে পড়েছে সারা বাংলা জুড়ে। পৌঁছে যাচ্ছে আমফান বিধ্বস্ত সুন্দরবনে অথবা অনাহার ক্লিষ্ট পুরুলিয়ার গ্রামে। ক্ষমতার রাজনীতিকে পরাজিত করে এরাই এখন বাংলার মুখ।
~~~~
করোনার দিনগুলি #৩৯
লক ডাউনের সময়ে খারাপ রোগীদের নিয়ে মহা সমস্যা। যতই হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন থাক, কিছুতেই ভর্তি হতে চায়না।
বুকে ব্যথা নিয়ে ছটফট করতে করতে এক ভদ্রলোক এলেন। ঘণ্টা তিনেক ব্যথা হচ্ছে। ইনো, জেলুসিল, প্যান ডি- যতরকম গ্যাসের ওষুধ আছে সব কিছু দিয়ে চিকিৎসা চলেছে। ইসিজি করতে বললাম। একটি চ্যাংড়া ছেলে বলল, ‘ইসিজি করে কি হবে ডাক্তারবাবু। আপনি একটা গ্যাসের ইনজেকশন দিন না। আমার জেঠতুতো দাদারও এমন হয়েছিল। ইনজেকশন দিতেই কমে গেছিল।’
বিনীত ভাবে বললাম, ‘ইনজেকশন নিশ্চয়ই দেব। কিন্তু আপনি আগে ইসিজি করান।’
ছেলেটি বলল, ‘ইনজেকশন দিতে দেরী করলে গ্যাস যদি মাথায় উঠে যায়? বুক অবধি উঠে এসেছে। মাথায় উঠতে কতক্ষণ। আপনি তাড়াতাড়ি ইনজেকশন দিন। তারপর ইসিজি করাবেন।’
বললাম, ‘আপনি ইতিমধ্যেই গ্যাস কমানোর যাবতীয় ব্রক্ষ্মাস্ত্র প্রয়োগ করেছেন। তাতে গ্যাস উপরে ওঠা তো দুরের কথা, হাঁটুতে নেমে যাওয়া উচিৎ ছিল। তা স্বত্বেও ওনার যখন বুকে ব্যথা হচ্ছে তখন ইসিজি না করলে আমি চিকিৎসা করতে পারব না।’
ছেলেটি এমন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল, সত্য যুগ হলে শিওর ভস্ম হয়ে যেতাম। তারপর ভদ্রলোককে প্রায় চ্যাংদোলা করে পাশের ঘরে ইসিজি করতে নিয়ে যাওয়া হলো।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ইসিজি হাজির। গ্রাফের অধিকাংশ রেখাই মধ্য লাইনের অনেক উপরে। বললাম, ‘রোগীর হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। শিগগিরি কোথাও ভর্তি করতে হবে।’
ছেলেটি বললেন, ‘অসম্ভব। এখন কোথায় ভর্তি করব? যেখানেই ভর্তি করব, করোনা হবে।’
‘করোনা হলে বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। কিন্তু একে এখুনি ভর্তি না করলে এনার বাঁচার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। এই ওষুধগুলো তাড়াতাড়ি কিনে আনুন। আর একটা গাড়ি জোগাড় করুন। আর জি করে নিয়ে যেতে হবে।’
‘আর জি কর, সেতো অনেক দূর! কি ভাবে যাব?’
একজন অটোওলা ঘুরঘুর করছিলেন। বললেন, ‘যাবেন? রিজার্ভে চলে যাব। ভাড়া চার চাকার থেকে কম নেব?’
ছেলেটি ওষুধ নিয়ে ফিরে এলো। বলল, ‘ডাক্তারবাবু, সবইতো ট্যাবলেট। ইনজেকশন দেবেন না?’
বললাম, ‘সব ট্যাবলেট চারটে- চারটে করে চিবিয়ে খাবেন এখুনি। চেবাতে চেবাতে আর জি কর চলে যাবেন?’
ছেলেটি বলল, ‘হার্ট অ্যাটাক হয়েছে বললেন, তবু একটা ইনজেকশন দেবেন না আপনি? রাস্তায় যদি কিছু হয়?’
আমি বললাম, ‘কথা কম বলে তাড়াতাড়ি অটোতে ওঠাও। দেরী করলে বিপদ আরও বাড়বে।’
ঘণ্টা খানেকের মধ্যে সেই ইনজেকশন প্রিয় ছেলেটির ফোন পেলাম, ‘ডাক্তারবাবু, এখানেও তো ভর্তি নিতে চাইছে। ভর্তি হলে করোনা হবে নাতো? দুটো ইনজেকশন দিয়ে নিয়ে চলে আসব? বাড়িতে স্যালাইন, অক্সিজেনের ব্যবস্থা করতুম।’
বহু কষ্টে গালাগালটা চেপে গেলাম। বললাম, ‘বাড়ি আনলে ফেরার পথে আমার কাছ থেকে একেবারে ডেথ সার্টিফিকেটটা লিখে নিয়ে যেও। রাত্রিরে আর বিরক্ত কোরো না।’
ছেলেটি মিনমিন করে বলল, ‘তাহলে ভর্তিই করে দি। করে দি ভর্তি?’
এই অসময়ে চেম্বার করার সময় আমার অন্যতম সহায় ছিল, সাগর দত্ত মেডিকেল কলেজ। সেটাকে তিনদিন আগেই কোভিড হাসপাতাল ঘোষণা করা হয়েছে। তারপর আমি পড়ে গেছি সমস্যায়।
লক ডাউনে সাধারণ রোগীর সংখ্যা কিছুটা কমলেও এমারজেন্সি রোগীর সংখ্যা অনেক বেড়েছে। অনেকেই অন্তিম অবস্থায় খাবি খাওয়া রোগী ভ্যানে করে চেম্বারে নিয়ে আসছেন। তাঁদের কাছাকাছি সাগর দত্তে ধরে বেঁধে পাঠিয়ে দিচ্ছিলাম। গত সপ্তাহেই একটি কমবয়সী বুকে জল জমা ছেলেকে সাগর দত্তে পাঠিয়েছিলাম। ওখানে তাকে ভর্তি করে বুকের জল বের করে টিবি ডায়াগনোসিস করে তবে ছেড়েছে।
প্রায় একইরকম একটি মেয়েকে সাগর দত্তে পাঠিয়েছিলাম। কাল সে আবার আমার কাছে এসেছে। তাকেও সাগর দত্তে ভর্তি নিয়েছিল। এর আবার বুকে আর পেটে দু জায়গাতেই জল জমেছে। সেই জল বার করে পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু রাতারাতি কোভিড হাসপাতাল ঘোষণা করায় ওখানকার সব রোগীদের ছুটি হয়ে গেছে। বেচারা এক পেট জল নিয়ে কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। জল বের করে দিলেই হলোনা। সেটা নিয়ে আবার পরীক্ষা করতে হবে। লক ডাউনের কল্যাণে এনাদের স্বাস্থ্যের পেছনে খরচ করার ক্ষমতা প্রায় শূন্যে নেমে এসেছে।
সাগর দত্ত হাসপাতালের কোভিড হাসপাতালে রূপান্তরের সিদ্ধান্ত নিয়ে বেশ গণ্ডগোলও শুরু হয়েছে। ওখানকার ইন্টার্নরা বিক্ষোভ দেখাচ্ছে। ইন্টার্নশিপের সময় একজন হবু ডাক্তার মেডিসিন, সার্জারি, গাইনি, পেডিয়াট্রিক্স বিভিন্ন বিভাগে ঘুরে ঘুরে ডিউটি করে। কিন্তু কোভিড হাসপাতাল হলে কোভিড রোগী ছাড়া পুরো ইন্টার্নশিপে তাদের অন্য কোনো রকম রোগীর চিকিৎসা দেখার সুযোগ মিলবে না। একজন ডাক্তার হয়ে যাবে, একটিও প্রসব না করিয়ে। তারপর সে যখন প্রত্যন্ত গ্রামীণ হাসপাতালের লেবার রুমে আসন্ন প্রসবা মায়ের মুখোমুখি হবে, তখন কি করে সামাল দেবে একমাত্র ভগবানই জানেন।
দেখলাম, ইন্টার্নদের এই বিক্ষোভের খবরের নীচে মাথা মুণ্ডু কিছু না বুঝেই অনেকেই ডাক্তারদের উপর গায়ের ঝাল ঝেড়েছেন। অনেকেই বলেছেন, বিক্ষোভ রত ডাক্তারদের রেজিস্ট্রেশন বাতিল করা উচিৎ। অনেকের মন্তব্যেই দুই, চার, ছয় অক্ষরের ছড়াছড়ি।
এই সব সর্বঘটের কাঁঠালি কলাদের ন্যূনতম ধারণাও নেই, কি ভাবে একজন ডাক্তার তৈরি হয়। একজন ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র যদি কোভিড ছাড়া অন্য কোনো রোগী দেখার সুযোগ না পায়, তাহলে কি করে সে স্টেথো বসিয়ে হার্টের ফুটো আছে কিনা বুঝবে? কি করে সে সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসা শিখবে।
গ্রামীণ হাসপাতালে যখন বিষ খাওয়া রোগী আসবে সে কি করবে? একটি তড়কা জ্বরের বাচ্চা এলে কি করে সামলাবে? কিভাবে সে ভ্যাকসিন রাখার আই এল আর ঠিক আছে কিনা বুঝবে?
যাই হোক, সরকারি নির্দেশ, বিশেষত এই মহামারির সময়ে মেনে নিতেই হবে। খারাপ লাগুক, ভালো লাগুক, এই সরকারি নির্দেশ মানতে চিকিৎসক এবং সাধারণ মানুষ হিসাবে আমরা বাধ্য। কিন্তু অনেকেই আছেন, যারা এই সরকারি নির্দেশের ঊর্ধ্বে। নীচের ছবিটা দেখুন। ভাইরাল হওয়া ছবি। টাকার অঙ্ক দেখে আমারই আতঙ্ক হচ্ছে।
ছবিটা দিল্লীর একটি কর্পোরেট হাসপাতালের। করোনা রোগীদের জন্য প্রতিদিনের আইসিইউ এর ভাড়া ৫৩ হাজার টাকা। ভেন্টিলেটর লাগলে ৭২ হাজার টাকা। পরীক্ষা নিরীক্ষা, ওষুধ পত্র ও অন্যান্য খরচ আলাদা। সব মিলিয়ে দৈনিক খরচ প্রায় লাখ দেড়েক। কলকাতার কর্পোরেট হাসপাতাল গুলিতেও খরচ প্রায় এমনই বা এর চেয়েও বেশি। কয়জনের এই অর্থ ব্যয় করে চিকিৎসা কেনার ক্ষমতা আছে? ব্যবসায়ীদের হাতে স্বাস্থ্যকে ছেড়ে দিলে যা হওয়ার ঠিক তাই হচ্ছে। সরকার এই দিকে একটু নজর দেবে না? দেবে না একটু এই দিকে নজর?
~~~~
করোনার দিনগুলি #৪০
মেডিকেল ক্যাম্প
লকডাউনে স্বাস্থ্য পরিষেবা কিভাবে ভেঙে পড়েছে মেডিকেল ক্যাম্পগুলি করতে করতে বুঝতে পারছি। গত তিন মাসে একেবারে মরো মরো অবস্থা না হলে কেউই হাসপাতাল মুখো হননি। যারা সরকারি হাসপাতাল থেকে সুগার প্রেসারের ওষুধ খাচ্ছিলেন, সব বন্ধ।
দলে দলে মানুষ ক্যাম্পে আসছেন। সারা দেশে টেলি মেডিসিন আইন সিদ্ধ হয়েছে। চিকিৎসক অনলাইনে পরামর্শ দিচ্ছেন। কিন্তু এক্রামন বিবি, শিউলি সর্দারদের জীবনে টেলি মেডিসিনের কোনো ভূমিকা নেই।
লকলকে লাউ ডগা ঢাকা খড়ের চালের নীচে রোগী দেখতে দেখতে প্রশ্ন করি, 'ওষুধ খাওনা কেন?'
'কি ভাবে হাসপাতালে যাব? গাড়ি নাই। টেরেন নাই। ঘরের লোকের কাজ নাই। আপনিই ওষুধ দেন, যা হয় কিছু দেন।'
আমি ওষুধের বাক্স হাঁটকাই। আমার সম্বল বারো রকমের ওষুধ। প্রেশার যাই থাক, এমলোডিপিন দিই। সুগারের মাত্রা না জেনেই মেটফরমিন। বারবার তাদের বোঝাই, 'হাসপাতালে যাও৷ নিয়মিত ওষুধ খাও। সুগার পরীক্ষা করো। এই মহামারীর সময়ে সুগার, প্রেশার ঠিক রাখা অত্যন্ত জরুরী।'
রোগিণী ভরসা দেন, ‘ঠিক যাব ডাক্তারবাবু। গফুরের বাপের কারখানাটা খুলুক।'
শ্বাসকষ্টের রোগীর লুঙ্গির ভাঁজ থেকে বিড়ি বার করি। জাঁদরেল ধমক দিই। কিন্তু ইনহেলার দিতে পারিনা। প্রেশক্রিপশনের শুরুতে বড়ো বড়ো করে লিখি 'ধূমপান বন্ধ করুন।' শেষ করি একটি ইনহেলারের নাম লিখে।
লোকটি এক হাতে এস্থালিন আর সেপ্ট্রান ট্যাবলেট নেন। অন্য হাতে প্রেসক্রিপশন। প্রেসক্রিপশন হাতের মধ্যে দলা পাকিয়ে যায়। বাইরে বেড়িয়েই হয়তো ফেলে দেবেন।
অপুষ্টিতে ভোগা মেয়েটিকে আয়রন ট্যাবলেট দিই। চৌদ্দ বছরে পঁচিশ কেজি পেরোয়নি। এখনো মাসিক শুরু হয়নি। ক্যাম্পের ফার্মাসিস্ট হয়ে ওঠা ডিউক আয়রন ট্যাবলেট কাগজে মোড়াতে মোড়াতে বলে, 'পায়খানা কালো হবে কিন্তু।'
মেয়েটি শূন্য চোখে শোনে। অন্য হাত বাড়িয়ে কৃমির ট্যাবলেট নেয়।
'বাড়িতে ক’জন বাচ্চা ছেলে মেয়ে আছে?'
মেয়েটি আঙুলের কর গোণে। ডিউক আরও এলবেন্ডাজল ট্যাবলেট খোঁজে। খুঁজে পায়না। হয়তো শেষ হয়ে গেছে। ছোটোবেলার বন্ধুরা একসাথে খোঁজে। বাবাই, প্রণবদা, সঞ্জীবদা, সুমনদা....। সকলেই মাঠে আছে। এই খেলায় জয় পরাজয় নেই। আরও চারটি এলবেন্ডাজল ট্যাবলেট পাওয়া যায়।
হয়তো আমরা কিছুই করতে পারিনা। হয়তো ক্যাম্পের মাঝপথেই ওষুধের অল্প ভাণ্ডার শেষ হয়ে যায়। তবু আমরা পরের ক্যাম্পের প্রস্তুতি নিই।
অন্তত হাতগুলো তো ছুঁতে পারব। আমার লেখা প্রেসক্রিপশন সুদৃশ্য ফাইলে ভেলোরের প্রেসক্রিপশনের সাথে স্থান পাবে না। বরঞ্চ প্রেসক্রিপশন উড়ে বেড়াবে ধূ ধূ ধানক্ষেতে। পুকুরের জলে ভেসে যাবে।
দু একটি এপিসোড আগে পড়েছি। সবগুলোতেই অসাধারণ সেন্স অব হিউমার আর পেথোস হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে আছে।
খুব ভাল লাগল।
বাংলার মুখগুলি কি বিষন্ন, মায়াময়, পবিত্র। ঐন্দ্রিল ভৌমিকের সম্মুখ যুদ্ধের পর্যবেক্ষণ আসলে মহামারীর দলিল। সবগুলো পর্ব একত্রে বই হওয়াটা জরুরি।
মনে মনে এই ধারাবাহিকটির জন্য অপেক্ষা করি। আরও লিখুন শশী ডাক্তার। শুভ