মন খারাপ
হঠাৎ হঠাৎ কোলাহল। আবার থেমেও যায়। অকস্মাৎ নিস্তব্ধ হয়ে যায় আশপাশ। সামনের চেয়ারে নতমস্তকে বসে থাকে চৌদ্দ বছরের অনাথ ছেলে। অনাথ ছিল না তিনদিন আগেও। ওর বাবা, মা একটি সরকারি কোভিড হাসপাতালে মারা গেছেন একই দিনে। একজন সকালে, একজন রাত্রে।
শোকের সময় নেই। ছেলেটির জ্বর আসছে। ছেলেটির সাথে তার কাকা এসেছেন। তাঁরও জ্বর। বাড়িতে বয়স্ক ঠাকুমা। তাঁরও জ্বর।
জ্বর ছাড়া আর কোন রোগ নেই? আছে- আদিম আতংক। সকলে আতংকে ভুগছেন। বোধ, বুদ্ধি, বিবেচনা বোধ গুলিয়ে ফেলছেন। মৃত্যু ভয়- লকডাউনের ভয়- কাজ হারানোর ভয়।
এক শীর্ণকায়া ভদ্রমহিলা এসেছেন। তাঁর স্বামী করোনায় আক্রান্ত হয়ে সাগর দত্ত হাসপাতালে মারা গেছেন। ভদ্রমহিলা ঘন ঘন অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছেন। স্থানীয় কোয়াক ডাক্তারের নিয়মিত ডাক পড়ে। তিনি এসে দু – বোতল, তিন – বোতল স্যালাইন চালান। টালির ঘরে টিম টিমে হলুদ বালব। ঘরের এধার থেকে ওধার নাইলনের দড়ি। তার থেকে স্যালাইনের বোতল ঝোলে। মহিলা ক্রমশ বিছানার সাথে মিশে যান। কোয়াক ভরসার বাণী শোনান, 'শরীরের ভেতর শুকিয়ে গেছে। স্যালাইন দিলেই ঠিক হয়ে যাবে।'
রোগিণী ঠিক হন না। অথবা যেটুকু ঠিক হন, ওই ভরসাটুকুর জোরেই।
আমি পাশ করা ডাক্তার, বোঝানোর চেষ্টা করি। 'শরীর ওভাবে শুকিয়ে গিয়ে কোনো রোগ হয় না। খামোখা স্যালইন দিয়ে লাভ নেই।'
রোগিণীর আত্মীয়দের সিদ্ধান্তহীনতা বেড়ে যায়। ওষুধ লিখে দিই। রোগিণী পরের দিন আবার আসেন। তার পরের দিনও। অবস্থার উন্নতি হয় না। কোনো ওষুধই প্রিয়তম মানুষটিকে হারানোর কষ্ট কমাতে পারে না।
জ্বর নিয়ে বন্ধ কারখানার শ্রমিক আসেন। জ্বর নিয়ে ভ্রাম্যমাণ সব্জি বিক্রেতা আসেন। জ্বর নিয়ে কাজের মাসি আসেন। ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা তাঁদের আধমরা করে রাখে। ডাক্তার আর ভরসা দিতে পারে না। ডাক্তার চোখ বুজলেই দুঃস্বপ্ন দেখে।
একেকটা করে উদ্দেশ্যহীন দিন কাটে। সকাল থেকে দুপুর, দুপুর থেকে রাত। মাস্কের আড়ালে প্রতিটি মুখ এক।
করোনার আগের দিনগুলি অলীক মনে হয়। আদৌও কি সেই সব দিনগুলি ছিল? যখন সোনার কারিগর জোয়ান ছেলেটি নববধূকে নিয়ে আসত। যুবকের চোখে প্রগাঢ় ভালোবাসা। যুবতীর ঠোঁটের কোণে রহস্যময় হাসি।
যুবকটি বলে, 'একবার ভালো করে দেখে দেন ডাক্তারবাবু। বেলা গড়ালে ওর খুব দূর্বল লাগে।'
'এই মেয়ে তোর বাপের বাড়ি কোথায়? কলেজে গিয়েছিলি? তাহলে এত বড়ো বড়ো নখ রেখেছিস কেন?'
যুবকটি হাসতে হাসতে একটা পাঁচশো টাকার নোট বার করে। আমি ফেরত দেওয়ার জন্য চকচকে একশো- দুশো টাকার নোট খুঁজি।
করোনার দিনগুলি চলে গেলেও আগের দিনগুলি ফিরবে না। শ্রমজীবী মানুষদের বহু লড়াই তখনও বাকি থাকবে।
শেষ বাক্যে দীর্ঘশ্বাস! তবু আশানদী প্রবাহমান।
আরো লিখুন, শশী ডাক্তার