মানুষের মতো কাজ
এখন বাড়ি ভিত্তিক জ্বর হচ্ছে। অর্থাৎ জ্বর যে বাড়িতে ঢুকছে এক ধাড়সে সে বাড়ির সকলের জ্বর হয়ে যাচ্ছে। একই বাড়ি থেকে সাতজন জ্বরের রোগী আবার এসেছেন। পাঁচদিন আগেও এনারা এসেছিলেন। এই পাঁচদিনে পরিবর্তন বলতে তিনজনের আর জ্বর আসছে না। বাকি চারজনের এখনও জ্বর আসছে। বাড়ির সবচেয়ে বয়স্ক ব্যক্তির অবস্থা ভালো নয়। তাঁর প্রচুর শুকনো কাশি হচ্ছে।
কাশতে কাশতে তিনি বললেন, ‘ডাক্তারবাবু, পাঁচদিন তো আপনার ওষুধ খেলাম। কিন্তু কষ্ট তো কমার বদলে বেড়ে গেল।’
ওনার হাতের আঙুলে পালস অক্সিমিটার লাগাতে লাগাতে বললাম, ‘করোনা পরীক্ষাটা করেননি কেন?’
‘করানোর চেষ্টা করেছিলাম। গ্রামীণ হাসপাতালে অনেক লাইন টাইন দেওয়ার পর আগামীকাল যেতে বলেছে। প্রাইভেটে অনেক টাকা চায়। তাও দুদিন বাদে পরীক্ষা করবে। রিপোর্ট দেবে তিনদিন পর।’
বললাম, ‘দেখুন, জ্বর যদি আর দিন দুয়েকের মধ্যে না কমে, যদি শ্বাস কষ্ট হয়, যদি অক্সিজেন স্যাচুরেশন ৯৫% এর নীচে থাকে তাহলে কিন্তু ভর্তি হতে হবে। টেস্ট রিপোর্ট না থাকলে ভর্তি হতে সমস্যা হবে।’
যেটা বলতে পারলাম না, যে কোভিড রিপোর্ট পজিটিভ থাকলেও ভর্তি হতে এমন কিছু সুবিধা হবে না। রোগীর চাপে সরকারি ও বেসরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অবস্থা ভালো নয়। কোভিড কেয়ার নম্বরে ফোন করে ধৈর্য ধরে বেড পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হবে আর ভগবানের কাছে প্রার্থনা করতে হবে এই সময়ের মধ্যে রোগীর ভালো- মন্দ কিছু না হয়ে যায়।
পরের রোগীও জ্বরের। এনার স্ত্রীকে কদিন আগে দেখেছিলাম। কোভিড রিপোর্ট পজিটিভ এসেছে। কী করবেন জানতে এসেছেন।
সব বুঝিয়ে বললাম। কী কী ওষুধ চলবে লিখে দিলাম। ভদ্রলোক সব শুনে টুনে বললেন, ‘আচ্ছা, স্ত্রীকে কী মাঝে মাঝে একটু অক্সিজেন দিতে পারি?’
‘হঠাৎ অক্সিজেন দেবেন কেন?’
‘শুনেছি অক্সিজেন দিলে করোনার রোগীরা ভালো থাকে। তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়। আমি সেইজন্য আগে থেকেই অক্সিজেনের একটা সিলিন্ডার জোগাড় করে রেখেছি।’
‘কী আশ্চর্য, অক্সিজেন স্যাচুরেশন না কমলে শুধু শুধু অক্সিজেন দেবেন কেন? আর চারিদিকে যখন অক্সিজেনের জন্য হাহাকার চলছে তখন আপনি অকারণে অক্সিজেনের সিলিন্ডার বাড়িতে মজুদ করে রেখেছেন কেন?’
ভদ্রলোক বললেন, ‘টিভিতেই তো দেখাচ্ছে হাসপাতালে বেড নেই। কোথাও রোগী ভর্তি করা যাচ্ছে না। অক্সিজেনও পাওয়া যাচ্ছে না। আগে থেকে জোগাড় করে না রাখলে দরকারের সময় কোথায় পাব?’
আমি বললাম, ‘দেখুন, কোভিডে অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমতে শুরু করলে বাড়িতে অক্সিজেন দিয়ে খুব লাভ হয়না। রোগীকে হাসপাতালে যতো শীঘ্র সম্ভব ভর্তি করা উচিৎ। যেহেতু হাসপাতালে বেড জোগাড় করতে সময় লাগছে, সেই সময়টুকু কাটানোর জন্য অক্সিজেন দেওয়া যেতে পারে।’
ভদ্রলোক বিশেষ সন্তুষ্ট হলেন না। বিড়বিড় করে বললেন, ‘তাহলে দেব না অক্সিজেন, একটুও দেব না? এতো খরচা করে জোগাড় করেছিলাম।’
একটু রাগ প্রকাশ করতে বাধ্য হলাম। বললাম, ‘স্যাচুরেশন ৯৫% এর উপরে থাকলে, শ্বাস কষ্ট না থাকলে অক্সিজেন দেওয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই।’
পরের রোগীও জ্বরের। করোনার কল্যাণে ইদানীং আমার কাজ বেশ সহজ হয়ে গেছে। রোগ নির্ণয় করতে বেশি চিন্তা ভাবনা করতে হচ্ছে না।সকলকেই প্রায় একই ওষুধ লিখতে লিখতে মনে হচ্ছে যেন পরীক্ষার হলে টুকলি করছি।
এই রোগীকেই দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল। ছেলেটাকে আমি চিনি। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো ছেলে। প্রায় প্রতিদিনই একগাদা করোনা রোগীদের প্রেসক্রিপশন নিয়ে আমার কাছে আসে। ওর এলাকার কারও করোনা ধরা পড়লে বাড়ি গিয়ে খোঁজ খবর নেয়। তাঁদের জন্য যথা সাধ্য করে। একটা পালস অক্সিমিটার জোগাড় করেছে। তাই দিয়ে সকলের অক্সিজেন স্যাচুরেশন দেখে। কারও সমস্যা হলে হাসপাতালে ভর্তির পদ্ধতি জানায় এবং ভর্তি হতে সাহায্য করে। অনেকের বাজার ঘাট পর্যন্ত করে দেয়।
যারা এতদিন বিভিন্ন জনসভায় মানুষের জন্য কাজ করতে চেয়ে কান্নাকাটি করছিলেন, ভোট মিটতেই এবং করোনা বাড়তেই যে যার ঘরে গিয়ে খিল এঁটেছেন। যখন মানুষের জন্য কাজ করার, মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সবচেয়ে বেশি দরকার তখন এই রকম কয়েকটি তরুণ যুবক ছাড়া কারোরই পাত্তা পাওয়া যাচ্ছে না। প্রত্যেকটি পাড়ায় পাড়ায় এখন এরকম ছেলেদের বেশি দরকার। তারা যদি পাড়ার প্রতি বাড়ির অসুস্থ রোগীদের খবর রাখে, তাঁদের অক্সিজেন স্যাচুরেশন সহ অন্যান্য সহজ শারীরিক পরীক্ষা গুলি করতে পারে এবং রোগীর অবস্থা খারাপ হলে হাসপাতালে ভর্তির ব্যাপারে সাহায্য করতে পারে তাহলে বিপর্যয় অনেকটাই এড়ানো যেতে পারে।
বললাম, ‘যাহ্, তোমার জ্বর হলে চলবে কী করে? অতোগুলো অসুস্থ লোকের তাহলে কী হবে?’
ছেলেটি হেসে বলল, ‘আমার জন্য কিচ্ছু আটকে থাকবে না। আমার জ্বরের খবর পেয়েই এই দুই বন্ধু এগিয়ে এসেছে। যদি করোনাও ধরা পড়ে, মাত্র তো পনেরোটা দিন। এই কটা দিন ওরাই সামলে নেবে। ওরা দুজন এবার থেকে আপনার কাছে আসবে।’
এতক্ষণে ছেলেটির সাথে আসা দুই যুবকের দিকে তাকালাম। এবং স্পষ্ট বুঝলাম মানুষের জন্য কাজ করতে দলবলের দরকার হয় না। দল বদলেরও দরকার হয় না। একা একা যে কোনো মুহূর্ত থেকেই কাজ শুরু করা যায়। এবং কাজ করতে করতে সঙ্গীও ঠিক জুটে যায়।
যে ভাবে রাত কাটছে
গীতায় আছে ‘ফলের আশা না করে কর্ম করে যাও’। আমরা তুচ্ছ খুপরিজীবি ডাক্তার। এইসব মহান বাণীকে আত্তিকরণ করতে পারিনি। কর্মের ফলাফল মনোমত না হলে মেজাজ খিঁচরে যায়।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউ সুনামি হয়ে যাওয়ার পর সারা দিনে রোগী দেখছি প্রচুর। তাতে সমস্যা নেই। একদা সরকারি চাকরি করার সুবাদে আমি প্রচুর রোগী দেখেই অভ্যস্ত। অধিকাংশই জ্বরের রোগী। তাতেও সমস্যা নেই। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে রোগীরা অনেকসময়ই আমার প্রত্যাশা মতো ভালো হয়ে উঠছেন না। প্রতিদিনই দু-চারজন হঠাৎ করে খারাপ হয়ে যাচ্ছেন। আরো মুশকিল হচ্ছে তাঁরা যখন জিজ্ঞাস করছেন, ‘কী করব? কোন হাসপাতালে ভর্তি হব?’ তার কোনো সদুত্তর দিতে পারছি না।
করোনার রিপোর্ট করাতে দেরী হচ্ছে। রিপোর্ট আসতেও দেরী হচ্ছে। রোগী খারাপ হলে ভর্তি হতে দেরী হচ্ছে। এক চক্রব্যূহের মধ্যে পরে ছটফট করছি। বাড়ি ফিরেও শান্তি নেই। সাড়ে নটা- দশটা থেকে শুরু হয় ফোন পর্ব। সেও শেষ হতে হতে রাত সাড়ে এগারোটা।
একমাত্র ঘুমের সময়টুকুই শান্তি। সকাল সাতটা থেকে রাত দশটা অবধি রোগীর চাপে যা যা করে উঠতে পারিনি, সে সবই স্বপ্নে করার চেষ্টা করি। কিন্তু বেশীরভাগ রাত্রেই সেটুকুও হয়ে ওঠে না।
গতরাতে যখন শুলাম তখন রাত বারোটা। পরেরদিন সাতটা থেকে দোহাড়িয়ায় চেম্বার আছে। ভোর ভোর উঠতে হবে। স্ত্রীর বিএসসি নার্সিংয়ের ফাইনাল পরীক্ষা কাছাকাছি চলে এসেছে। তাই সে আলাদা ঘরে রাত জেগে পড়ে। মানে ঘুমে ঢোলে আর পড়ার চেষ্টা করে। আমি দুই মেয়েকে নিয়ে শুই।
ছোটো মেয়েকে ভয়ংকর ভুতুড়ে গল্প শুনিয়ে ঘুম পাড়ালাম। তারপর আমিও ঘুমের জগতে একটু একটু করে প্রবেশ করছি, তক্ষুনি ‘টিং টং’- কলিংবেল বেজে উঠল।
নিশির প্রথম ডাকেই যেমন সাড়া দিতে নেই, তেমনি ডাক্তারদের মাঝরাতের কলিংবেলের প্রথম আওয়াজে সাড়া দিতে নেই। মটকা মেরে পড়ে রইলাম।
কিন্তু ওপারের মানুষটির ভীষণ তাড়া। তিনি এবার সুইচ চেপেই আছেন, ছাড়ছেন না। এখনই দুই মেয়ে উঠে পড়বে। এমনকি যা আওয়াজ হচ্ছে গোটা পাড়ার মানুষও উঠে যেতে পারে।
দরজা খুলে দোতালার বারান্দা থেকে উঁকি মারলাম। গম্ভীর স্বরে বললাম, ‘কী হয়েছে?’
'ডাক্তারবাবু, শিগগিরী দেখুন না, খিঁচুনি হচ্ছে।'
বোঝো কাণ্ড। এই মাঝ রাতে খিঁচুনি রোগী নিয়ে আমি কী করব? ওপর থেকেই বলে দেওয়া যায় তাড়াতাড়ি হাসপাতালের এমারজেন্সিতে নিয়ে যান। সেটা খারাপ দেখায়। একবার নিজের চোখে রোগীকে দেখে বলি। নইলে এনারাই একটু বাদে বলবেন, ‘হারামজাদা ডাক্তার রোগীকে না দেখেই হাসপাতালে পাঠিয়ে দিল।’
নীচে নামলাম। দরজা খুললাম। এক ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়ে আছেন। খিঁচুনি হওয়ার মতো কাউকে চোখে পড়ছে না। বললাম, ‘রোগী কই?’
ভদ্রমহিলা কোল থেকে একটি বছর দেড়েকের বাচ্চাকে টেবিলের উপর শুইয়ে দিলেন। বললেন, ‘কাল থেকে জ্বর হচ্ছিল। একটু আগে চোখ টোখ কেমন দাঁড়িয়ে গেছিল। খিঁচুনি হচ্ছিল।’
ফেব্রাইল কনভালশানের কেস। কিন্তু বাচ্চা রোগী দেখলেই আমার পেটের মধ্যে গুড়গুড় করে। অনেক কষ্টে বুঝিয়ে শুনিয়ে হাসপাতালে পাঠালাম।
হাতটাত ধুয়ে জামাকাপড় পাল্টে আবার শুয়েছি, চোখ বন্ধ করে প্রাণপণে ঘুমানোর চেষ্টা করছি। রাত দেড়টা বাজে। আর সাড়ে চারঘন্টা মতো ঘুমানোর সুযোগ আছে। এই ঘুমটুকু না হলে কাল পনেরো ঘণ্টা রোগী দেখতে দেখতে বারে বারে হাই উঠবে।
ভাগ্য খারাপ। আবার আমাকে চমকে দিয়ে কলিং বেল বেজে উঠল। বারান্দা থেকে উঁকি মারলাম। ‘কী হয়েছে?’
‘মরে যাচ্ছি ডাক্তারবাবু?’
‘কী হয়েছে পরিষ্কার করে বলুন।’
‘খুব হাঁটু ব্যথা হচ্ছে।’
‘আপনি হাঁটু ব্যথার জন্য এই মাঝ রাত্রে আমার ঘুম নষ্ট করছেন?’ আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।
‘আপনি বুঝতে পারছেন না। ভয়ংকর হাঁটু ব্যথা হচ্ছে। ব্যথার চোটে ঘুমাতে পারছি না। মনে হচ্ছে মরে যাব।’
আমার মাথা গরম হচ্ছে। বললাম, ‘হাঁটু ব্যথায় কেউ মরে না। এখন দেখাতে হলে হাসপাতালের এমারজেন্সিতে যান।’
‘হাসপাতালে যেতে চাচ্ছি না। ওখানে তো শুনছি করোনা রোগীতে ভর্তি।’
‘মাঝরাতে হাঁটুব্যথার রোগী আমি দেখব না। দয়া করে আর কলিং বেল বাজাবেন না।’
জল টল খেয়ে আবার শুয়ে পড়লাম। ভদ্রলোক এখন নির্ঘাৎ আমার চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করছেন। সেসব ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লাম। কিন্তু মনোমতো স্বপ্ন দেখতে পারছিলাম না। সারাদিন রোগী দেখে দেখে স্বপ্নেও সেই রোগীরাই আসছেন।
স্বপ্নেই এক রোগী দেখছিলাম, স্যাচুরেশন ৮০%। বললাম, ‘ভর্তি না করে বাড়িতে রেখেছেন কেন?’
বাড়ির লোক বললেন, ‘সরকারি হেল্প লাইনে ফোন করেছিলাম। বলেছে আমার রোগী ওয়েটিং লিস্টে ৫০১ নম্বরে আছে।’
স্বপ্ন বলেই চমকালাম না। কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ একটা আওয়াজে ঘুমটা ভেঙে গেল। কলিংবেল আরেকবার বেজে উঠতেই বুঝতে পারলাম ওটার আওয়াজেই ঘুম ভেঙেছে। একবার তাও সহ্য করা যায়। তা বলে এক রাত্রে তিন তিনবার!
বারান্দা থেকে উঁকি মেরে দেখলাম বাড়ির সামনে একটা এ্যাম্বুলেন্স দাঁড়িয়ে। একজন কমবয়সী ছেলে বলল, ‘ডাক্তারবাবু, একবার নীচে আসবেন?’
নীচে গিয়ে বুঝলাম পরিস্থিতি গুরুতর। এক বয়স্ক মানুষকে তিনদিন আগে আমার কাছে আনা হয়েছিল। ভদ্রলোকের স্ট্রোক হয়েছিল। প্রেশারও অনেক বেশি ছিল। আমি প্রেশারের ওষুধ দিয়ে বলেছিলাম সাথে সাথে হাসপাতালে ভর্তি করতে। ওনার বাড়ির লোক করোনার ভয়ে ওনাকে বাড়িতেই রেখে দিয়েছিলেন। আজ রাতে পরিস্থিতি খারাপ হওয়ায় হাসপাতালে নিয়ে গেছেন। কিন্তু হাসপাতালে যখন পৌঁছেছেন, তার আগেই উনি মারা গেছেন। ওখান থেকে সরাসরি আমার কাছে নিয়ে এসেছেন। এখন আমি যদি ডেথ সার্টিফিকেটটা লিখে দিই।
ভদ্রলোককে আমি চিনি। পাশের পাড়ায় থাকেন। মনটা খারাপ হয়ে গেল। ওনার বাড়ির লোককে বললাম, ‘এখন চারটে বাজে। আপনি সাড়ে সাতটা নাগাদ ওনার আধার কার্ড আর আমার প্রেসক্রিপশন নিয়ে দোহাড়িয়ার এই চেম্বারে চলে আসুন।’ ঠিকানাটা ভালো করে বুঝিয়ে বললাম।
আবার ঘুমানোর চেষ্টা করছি, হঠাৎ পাঁজরের কাছে একটা তীক্ষ্ণ ব্যথায় ঘুম ঘুম ভাব কেটে গেল। ছোটো মেয়ে রাণী ডাকছে, ‘বাবা, ও বাবা...’
‘কী হল?’
‘বাবা, হিসু করব।’
‘করে আয়।’
‘লাইট জ্বেলে দাও। আমি তো ছোটো, হাত পাই না। তুমি বাইরে দাঁড়াবে। বাথরুমে আরশোলা আছে, ভূত আছে। আমার ভয় করে। ও বাবা কী হল? আমার কিন্তু বিছানায় হয়ে যাবে।’
অগত্যা উঠে পড়লাম। বাইরে আলো ফুটে গেছে। পাখি ডাকাডাকি করছে। আর শোয়ার চেষ্টা করে লাভ নেই। একটা বড়সড় হাই তুলে দিনের শুভসূচনা করলাম।
১
"এতক্ষণে ছেলেটির সাথে আসা দুই যুবকের দিকে তাকালাম। এবং স্পষ্ট বুঝলাম মানুষের জন্য কাজ করতে দলবলের দরকার হয় না। দল বদলেরও দরকার হয় না। একা একা যে কোনো মুহূর্ত থেকেই কাজ শুরু করা যায়। এবং কাজ করতে করতে সঙ্গীও ঠিক জুটে যায়।"
এরা আছে বলেই করোনাক্রান্তির ভেতরেও অনেক মরণাপন্ন মানুষ এখনও শ্বাস নিতে পারছে।
২
গুরুচণ্ডালীর এই ধারাবাহিকটির জন্য মনে মনে অপেক্ষা করি। এই লেখা নিছক ডাক্তার ঐন্দ্রিলের দিনপঞ্জি নয়, বরং মহামারীর প্রথম সারির সৈনিকের লেখা জীবন্ত দলীল।
তবে স্বীকার করি, এপারে করোনাজনিত ব্যস্ততায় গুরুতে এতোদিন আসা হয়নি, নিজের লেখা তো দূরে থাক, এই ধারাবাহিকসহ আরও অনেক লেখা পড়া হয়নি। এমনকি নোটিফিকেশন এড়াতে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপেও ইস্তফা দিতে হয়েছে।
কোভিডে টিভি স্টেশনের একজন সহকর্মী মারা গেলেন, পাশের চেয়ারের আরেক সহকর্মীর পর পর দুজন পরিবারের সদস্য চলে গেলেন, একসংগে আক্রান্ত হলেন আটজন সংবাদ সহকর্মী, আর লোকবল সংকটে সাপ্তাহিক ছুটি ছাড়াই টানা একমাস ১০-১২ ঘন্টা ডিউটি করতে হলো চণ্ডালকে। পরিস্থিতি এখন এমনই কঠিন!
৩
তবে এখন ধারাবাহিকতা না মেনেই যতোটা পারা যায়, সব লেখা একে একে পড়ে ফেলার চেষ্টা থাকবে নিশ্চয়ই। এই জীবানুর মহারাজত্বেরকালে সুস্থভাবে বেঁচে থাকাই যেন বিস্ময়।
চলতি ধারাবাহিকটি পূর্ণাঙ্গ বই আকারে প্রকাশের দাবি রাখে। লেখকের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এইখানে নিবেদন দুপয়সা :
এপারে করোনাশহীদ চিকিৎসক নিছক কম নয়। তাদের মনবল অটুট রাখতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তিন চিকিৎসকের সিলেটি জনপ্রিয় লোকগীতির সাথে নৃত্য, বলাই বাহুল্য ভাইরাল ভিডিও
''ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো'' যে যুবকের কথা লিখেছেন, আশা করি তিনি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবেন। ডাক্তারবাবুর কাছে একটা প্রশ্ন ছিল: যে কাজ এই যুবক ও তাঁর বন্ধুরা করছেন, তার জন্য তো কোনো সাধুবাদই যথেষ্ঠ নয়; কিন্তু নিজেরা সুস্থ থেকে এই কাজ চালিয়ে যেতে এঁদের কাছে ভালো N-95 মাস্ক থাকা খুব দরকার, তা কি আছে? যদি না থাকে, তাহলে আমি কিছু মাস্ক ওঁদের কাছে পৌঁছে দিতে চাই; ডাক্তারবাবু বা অন্য কেউ একটু সাহায্য করতে পারবেন এ ব্যাপারে?
পাই?
জানাচ্ছি
অরিনবাবু, অসাধারণ লাগলো লেখাটা। বিশেষ করে এই কথাটার সাথে ১০০% একমত।
"এবং স্পষ্ট বুঝলাম মানুষের জন্য কাজ করতে দলবলের দরকার হয় না। দল বদলেরও দরকার হয় না। একা একা যে কোনো মুহূর্ত থেকেই কাজ শুরু করা যায়। এবং কাজ করতে করতে সঙ্গীও ঠিক জুটে যায়।"
অভ্যুদা, এটা আমিও করার চেষ্টা করছিলাম আমাদের পাড়ায় (দমদম/বরানগর অঞ্চলে), যদি এই ব্যাপারে কিছু সাহায্য করা যায় জানিও, বা কী ভাবে পৌঁছনো সবথেকে এফিসিয়েন্ট হবে।