বিচিত্র অভিজ্ঞতা
মনে হচ্ছে আমার ‘দ্বিতীয় ঢেউয়ের দিনগুলি’ লেখার সময় ফুরিয়ে এসেছে। দ্বিতীয় ঢেউয়ে যেমন হইহই রইরই করে কেস বেড়েছিল, তার চেয়েও দ্রুতগতিতে কেস কমছে। জ্বরের রোগীরা আস্তে আস্তে সংখ্যালঘু হয়ে পড়ছেন।
তাই এই দ্বিতীয় ঢেউয়ের দিনগুলিতে এক বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা লিখেই ফেলি। নাহলে পরের সপ্তাহে হয়তো আর লেখার সুযোগ পাব না।
আমি টেলিমেডিসিনের ঘোরতর বিপক্ষে। অন্য চিকিৎসকদের অনেকরকম মতামত থাকতে পারে, কিন্তু আমার ধারণা টেলিমেডিসিন জিনিসটি সোনার পাথর বাটি। রোগীকে একবারও স্বচক্ষে না দেখে, শারীরিক পরীক্ষা নিরীক্ষা না করে শুধু তার সমস্যার কথা শুনে ওষুধ দেওয়াটা বেশ বিপজ্জনক।
এতকাল কেউ ফোনে রোগের বিবরণ দিয়ে ওষুধপত্র জানতে চাইলে আমি সবিনয়ে প্রত্যাখান করে বলেছি, ‘হয় সশরীরে আমাকে দেখাতে আসুন অথবা কাছাকাছি কোনো ডাক্তারখানায় বা হাসপাতালে দেখিয়ে নিন। ফোনে ওষুধ আমি বলি না।’
অনেকেই অসন্তুষ্ট হতেন। অনেকেই বলতেন, ‘সামান্য একটু গলা খুসখুস করছে, একটা এন্টিবায়োটিক বলে দেন না। দেখাতে গেলেই তো এক ঘণ্টা লাইনে দাঁড়াতে হবে।’
বলতাম, ‘সামান্য গলা খুসখুসে কোনো এন্টিবায়োটিক খাওয়ার দরকার নেই। আপনি দুবেলা গরম জলের ভাপ নিন।’
বলাই বাহুল্য এই সৎ উপদেশে কেউ খুশি হতেন না। সম্ভবত ভাবতেন চেম্বারে গেলে ভিজিট পাওয়া যাবে বলে তাঁকে সশরীরে আসতে বলছি। সে তিনি যা খুশি ভাবুন, তাই নিয়ে মাথা ঘামাতাম না। তবে এতে একটা লাভ হয়েছিল। ফোন কম আসতো। সকলেই প্রায় বুঝে গেছিলেন ফোন করে ‘আমাকে একটা ভালো গ্যাসের ওষুধের নাম বলে দিন প্লিজ, পেটটা খুব ব্যথা ব্যথা করছে’ বারবার অনুরোধ করলেও আমি কিছুই বলব না।
কিন্তু করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময়ে বাধ্য হয়েই আমাকে ফোনের সাহায্যেও কিছুটা চিকিৎসা চালাতে হচ্ছে। অসংখ্য জ্বরের রোগী আসছেন। নিশ্চিত জানি পরীক্ষা করলে প্রায় সকলেরই করোনা বেরোবে। সেই ভিড়ের মধ্যে সুগার প্রেশারে আক্রান্ত বয়স্ক মানুষদের আসতে বলাটা রীতিমত অপরাধ।
ফলে ছোটখাটো সমস্যায় ফোনেই টুকটাক ওষুধ বলে দিচ্ছিলাম। তবে ফলাফল সবসময় ভালো হয়নি। এই ঘটনার কথা আগেও লিখেছি। এক বয়স্ক ভদ্রমহিলা ফোন করে বললেন, ‘বড্ড কোষ্ঠ কাঠিন্য। কিছু একটা ওষুধ বলে দিন ডাক্তারবাবু।’
রোগী দেখতে দেখতে ফোন ধরেছিলাম। বললাম, ‘আপনি সকালে দুচামচ আর রাত্রে দুচামচ সফটোভ্যাক খান।’ তারপর ফোন কেটে রোগী দেখায় মন দিলাম।
দুদিন পরে ওই ভদ্রমহিলা হাজির। পায়খানা একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে। কিছু খেলেই বমি করছেন। রীতিমতো মেজাজ দেখিয়ে বললেন, ‘আপনার কথা মতো চলেই আমার এই অবস্থা।’ বেশ ঘাবড়ে গেলাম, আমি আবার কী করেছি? রোগিণীর ছেলে তাগড়াই জোয়ান। আমার মতো নাদুস নুদুস নয়। দেখলেই বোঝা যায়, শরীরের জন্য দিনের অনেকটা সময় ব্যয় করে। মায়ের কথা শুনে বেশ কড়া দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
তবে আরও জিজ্ঞাসাবাদ করে যখন সত্যিটা জানলাম, তখন হাসি চেপে রাখা দুষ্কর হলো। ভদ্রমহিলা ‘সফটোভ্যাকের’ বদলে রোজ দুবেলা দুচামচ করে শুকনো কড়কড়ে ‘শক্তভাত’ খেয়েছেন। কোষ্ঠ সাফ করার জন্য এনেমা লিখলাম। ভালো করে বুঝিয়ে বললাম, ‘এটা কিন্তু মুখ দিয়ে খাবেন না, নীচ দিয়ে ঢোকাবেন।’ যিনি সফটোভ্যাকের বদলে শক্তভাত খেতে পারেন, তাঁর পক্ষে সবই সম্ভব।
এরপর থেকে ফোনে কেউ কোষ্ঠ কাঠিন্যের কথা বললে ইসবগুল খেতে বলি। সফটোভ্যাকের নাম উচ্চারণ করি না কখনো। কিন্তু তাতেও মুশকিল। সকলেই অবধারিত ভাবে জানতে চায়, ‘ডাক্তারবাবু, আমার ঠান্ডার ধাত। করোনার সময়ে ইসবগুল খেলে ঠান্ডা লেগে যাবে নাতো?’
এরকম আরো হাজারো প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য বহু মানুষ ফোন করেন। যেমন, কলা খেলে ঠান্ডা লেগে যাবে কিনা? হাঁটু ব্যাথায় টমেটো, ভেন্ডি খাওয়া যায় কিনা? প্রেশারের রোগীদের ডিম খাওয়া যাবে কিনা? লবণ ভেজে খাওয়া উচিৎ কিনা? এবং আমার উত্তরে তারা বিশেষ সন্তুষ্ট হন না।
তবে কোভিড রোগীদের ক্ষেত্রে ফোনের মাধ্যমে চিকিৎসা বেশ কাজে দিয়েছে। হোম আইসোলেশনে থাকা রোগীরা সরাসরি ফোন করে ডাক্তারবাবুর সাথে যোগাযোগ করে নিজেদের কথা বলতে পারেন। এতে আর যাই হোক, তাঁদের আইসোলেশনে থাকার সময় অন্তত মানসিক উদ্বেগ অনেক কমেছে।
তবে আমার মতো চিকিৎসক যারা প্রায় সারাদিনই রোগী দেখে, তারা বেশ সমস্যায় পড়েছে। রোগী দেখতে দেখতে প্রতি ঘণ্টায় যদি কুড়িটা করে ফোন আসে তাহলে রোগী দেখা অসম্ভব হয়ে যায়। তার মধ্যে অধিকাংশই অত্যন্ত অপ্রয়োজনীয় ফোন। যেমন, ‘ডাক্তারবাবু, আমার বাবার করোনা ধরা পড়েছে। ওনাকে হরলিক্স আর কমপ্লানের মধ্যে কোনটা খাওয়ালে ভালো হবে?’ ফলে বাধ্য হয়ে চেম্বারের সময় ফোন সুইচ অফ রাখতে হচ্ছে। অথবা ফোন গৌড় বা ন’জেঠুর কাছে রাখতে হচ্ছে। আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট সঞ্জয়দা আপাতত করোনার খপ্পরে পড়ে মাঠের বাইরে।
সেদিন দেখি জেঠু কাউকে ফোনে হেব্বি ধমকাচ্ছে। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কী হলো?’
জেঠু বলল, ‘দেখনা, কে একজন ফোন করে বলছে খুব দরকার, শিগগিরি ডাক্তারবাবুকে দিন। বললাম, ডাক্তারবাবু ব্যস্ত আছেন। খারাপ রোগী দেখছেন। পাঁচটা নাগাদ ফোন করুন। তবু বলছে খুব এমারজেন্সি। কী এমারজেন্সি জিজ্ঞাস করায় বলছে সুগারের রোগী, দুপুরে দুটো রসগোল্লা খেয়ে নিয়েছে। দুপুরের ইনসুলিন কী একটু বাড়িয়ে দিতে পারে... চিন্তা কর!’
আমি হাসলাম। এ ধরণের বিরক্তিকর ফোন প্রায়শই পাই। রাত তিনটেয় কেউ ফোন করে ঘুম ভাঙিয়ে বলেছেন, ‘ডাক্তারবাবু, কিছুতেই ঘুম আসছে না, কী ওষুধ খাব?’ তাও ভাগ্য ভালো বলেননি, ‘ডাক্তারবাবু, ঘুম আসছে না, আপনার সঙ্গে একটু গল্প করা যাবে?’
সারাদিনের মধ্যে শুধু রাত্রেই ঘণ্টা পাঁচেক ঘুমানোর সময় পাই। বাধ্য হয়ে মোবাইল বন্ধ রাখতে হয়। ওই পাঁচ ঘণ্টার মধ্যে গোটা চারেক ফোন এলে পরের দিন ঝিমোতে ঝিমোতে রোগী দেখতে হবে।
ইদানিং করোনা রোগী অনেক কমেছে। কিন্তু ফোন আসা কমেনি। এখন অধিকাংশ ফোনই ভ্যাক্সিন সংক্রান্ত।
‘ডাক্তারবাবু, আমার ডিম আর চিংড়ি মাছে এলার্জি আছে। ভ্যাকসিন নিতে পারবো?’
‘হ্যাঁ, পারবেন। ভ্যাকসিনে ডিম বা চিংড়ি মাছের কোনো উপাদানই নেই।’
‘আমার কিন্তু বেগুনেও এলার্জি।’
‘পারবেন।’
‘ভেন্ডিতে, কলায় এলার্জি থাকলে?
‘তাও পারবেন।’
‘আর ডাস্ট এলার্জি থাকলে?’
বাধ্য হয়ে ‘পারবেন’ বলার সঙ্গে সঙ্গে ফোন কাটলাম।
এছাড়াও সুগার, প্রেশার, হার্টের অসুখে ভ্যাকসিন নেওয়া যাবে কিনা, করোনা হওয়ার কতোদিন পর ভ্যাকসিন নেওয়া যাবে, ভ্যাক্সিন দিলে টিটেনাস টক্সয়েড, কুকুরে কামড়ানোর ইংজেকশন ইত্যাদি নেওয়া যাবে কিনা, মদ খাওয়া যাবে কিনা এসব ফোন হামেশাই পাচ্ছি।
তবে এসব ফোন যারা করেছেন, তাঁরা প্রায় সকলেই আমাকে চেনেন। কিন্তু ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টরস ফোরামের টেলি কনসালশটেশনের লিস্টে ১৬০ জন চিকিৎসকের মধ্যে আমারও নাম থাকায় অপরিচিত বহু রোগীদের কাছ থেকেও ফোন পাচ্ছি। লিস্টে আমার নামের পাশে শনিবার আর রবিবার রাতের সময় লেখা আছে। কিন্তু রোগীরা কেউই সেই টাইম টেবিল মানেন না। এক রাতে দশটা নাগাদ বাড়ি ফিরে বড় মেয়ের সাথে ক্যারাম খেলতে খেলতে ফোনে কথা বলছি। একটা ফোনে কথা বলতে বলতেই গোটা তিনেক মিসকল হয়ে যাচ্ছে। মালদা থেকে একজন ফোন করেছেন। তাঁর সতেরোদিন আগে করোনা ধরা পড়েছে। তিনি প্রায় প্রতিদিনেরই ধারা বিবরণী দিচ্ছিলেন আর কবে কী ওষুধ খেয়েছেন আর কী পরীক্ষা করেছেন, সে সব শোনাচ্ছিলেন। আমি দুয়েক বার বলতে চেষ্টা করেছি, ‘আপনার এখন কী সমস্যা হচ্ছে বলুন।’ কিন্তু তিনি বিস্তারিত না শুনিয়ে ছাড়বেন না। আমি হাঁ হু করছি আর মাঝে মাঝে বলছি, ‘বেশ করেছেন’ আর মেয়ের সাথে মনোযোগ দিয়ে ক্যারাম খেলছি।
হঠাৎ ওপাশের ভদ্রলোক বললেন, ‘কিছু মনে করবেন না, আপনার রেজিস্ট্রেশন নাম্বারটা একবার বলবেন?’
আমি থতমত খেয়ে বললাম, ‘কেন?’
‘আপনি কী সত্যিই ডাক্তার? চারদিকে যা ফ্রড কেস হচ্ছে শুনছি?’
রীতিমতো আহত হয়ে বললাম, ‘পয়সা নিয়ে টেলি কন্সালটেশন করলে তবু ঠকবার ভয় থাকত, কিন্তু আপনিতো বিনামূল্যেই...’
‘আপনার কী রেজিস্ট্রেশন নাম্বারটা বলতে কোনো অসুবিধা আছে?’
বলতাম কিনা সেটা পরের ব্যাপার, কিন্তু আশ্চর্য হয়ে দেখলাম ফোনের ঠেলায় নিজের রেজিস্ট্রেশন নাম্বারটা মনে করতে পারছি না।
অনেকেই টেলি কন্সালটেশনের পর ভিজিট দিতে চাইছেন। তাঁদের সবিনয়ে বলছি, আমি নিজেই ফোনে এভাবে চিকিৎসা করার ঘোরতর বিরোধী। করোনার কাল কেটে গেলেই আবার ফোনে কোনো রকম ওষুধপত্র বলা বন্ধ করে দেব। অতএব এর জন্য আমাকে ভিজিট দেওয়ার প্রশ্নই নেই। এই লকডাউনের সময় বহু সেচ্ছাসেবী সংগঠন প্রায় প্রতি এলাকাতেই মানুষের জন্য কাজ করছে। টেলিকন্সালটেশন বাবদ যে টাকা টুকু আমাকে দিতে চাইছেন, ঐ টাকা সেসব সংগঠনের হাতে তুলে দিন।
পড়ে খুব ভালো লাগছে। ডাক্তারি পেশাটা যে এখনও পুরোপুরি ব্যবসায় পরিণত হয় নি জেনে স্বস্তিবোধ করছি।
ডা ভৌমিকের দীর্ঘ জীবন ও অটুট কর্মশক্তি কামনা করি।
মাধব চট্টোপাধ্যায়,হায়দ্রাবাদ