
#করোনার_দিনগুলি ৬৫সাত সকালে স্কুটার নিয়ে মিলন পল্লীতে গৌড়ের চেম্বারে রোগী দেখতে যাচ্ছিলাম। চৌমাথার সিগন্যালে আটকে গেলাম।
লকডাউনের কল্যাণে এসব সিগন্যালের কথা ভুলেই গেছিলাম। লকডাউন উঠে যাওয়ার পর পরই সব সিগন্যাল আবার স্বমহিমায় ফেরত এসেছে।
তখন বাড়ি থেকে সাত মিনিটে ঘোলা যেতাম, পাঁচ মিনিটে মিলন পল্লী। আর আজ দশ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকার পর যদি বা সিগন্যাল সবুজ হলো, কিন্তু চৌমাথা পেরোনোর আগেই আবার লাল।
বিরক্তি নিয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলাম। আমার পাশের সাইকেল চালক, যার মাস্ক গলা থেকে ঝুলছে, পিচিক করে গুটখা রঞ্জিত লালারস আমার পা ঘেঁষে ফেললেন।
আমি সভয়ে পা সরিয়ে তাঁর দিকে কটমট করে তাকাতেই তিনি একগাল হেসে বললেন, 'ভুল হয়ে গেছে দাদা। মাফ করেন।'
দিনের শুরুতেই তর্ক করতে ভালো লাগে না। কিন্তু সাতটা বাজার আগেই চৌমাথাতে এতো ভিড় কেন? এক্সিডেন্ট ট্যাক্সিডেন্ট হয়েছে নাকি? গাড়ি ঘোড়ার ফাঁক দিয়ে দেখছি লোকে লোকারণ্য।
সাইকেল চালক লোকটি কালো দাঁত বের করে হাসলেন। বললেন, 'লোকাল ট্রেন শিগগিরী চালু না হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।'
আমি বললাম, 'মধ্যমগ্রাম হাট চৌমাথাতেই বসছে নাকি?'
'হাট নয়, এ হলো কাজে যাওয়ার সংগ্রাম। আমিও দু’চারদিন লড়েছিলাম। এখন সাইকেলে যাই। কষ্ট হয় বটে, কিন্তু মারামারি করে বাসে যাওয়ার চেয়ে কম। তাছাড়া করোনা হওয়ার সম্ভাবনাও কম, যাতায়াতের খরচ কম। অনেক সুবিধা।'
বললাম, 'সাইকেলে কদ্দুর যান?’
'বৈঠকখানা বাজার। ওখানে একটা ছাপাখানায় কাজ করি। যাতায়াতে রোজ পঞ্চাশ কিলোমিটার সাইকেল চালাই।'
সিগন্যাল আবার সবুজ হলো। আমি চৌমাথা ছাড়িয়ে দাড়ালাম। একটা বাস আসল। সকলে হই হই করে দৌড়ে গেল।
এক বয়স্ক ব্যক্তি দৌড়াতে গিয়ে পরে গেছেন। দু-তিনজন তাকে মাড়িয়েই ছুটল।
কন্ডাকটর গেটে দাঁড়িয়েই চিৎকার করছেন, 'আর উঠবেন না। আর জায়গা নেই।'
একজন অতি উৎসাহী ব্যক্তি তাকেই টেনে বাস থেকে নামিয়ে নিজে উঠে গেলেন।
কোথায় শারীরিক দূরত্ব! কোথায় মাস্ক!! অনেকেরই মাস্ক আছে বটে, কিন্তু ন্যাতার মতো বহু ব্যবহৃত জীর্ণ মাস্কগুলি গলা থেকে ঝুলছে।
লাদেন নামে পরিচিত বিপজ্জনক মোটর ভ্যানে ঠেসে লোক উঠছে। দুজনের মধ্যে ছয় ফুট দূরত্ব তো দূরের কথা, ছয় মাইক্রোমিটার দূরত্বও নেই। বিড়ি টানতে টানতে শ্রমজীবী মানুষেরা কাজে যাচ্ছেন।
ছোটো হাতি, চারশো সাত- যিনি যাতে পেরেছেন, চড়ে বসেছেন। বাড়ি বসে থাকলে সরকার অর্থ সাহায্য করবে না। জীবিকার জন্য তাঁরা মহামারীর ভয়কে তুচ্ছ করছেন।
দেখতে দেখতে উপলব্ধি করলাম আমরাই পৃথিবীর সবচেয়ে স্বার্থপর জীব। আমাদের সরকার, আমি- সবাই।
সরকার দিনের পর দিন লোকাল ট্রেন বন্ধ করে রেখেছে। কিন্তু মানুষ কিভাবে কাজে যাবে তা নিয়ে মাথা ঘামাতে নারাজ। তাদের দায়িত্ব নিতেও নারাজ।
করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রধান অস্ত্র মাস্ক। সরকার থেকে দিব্যি শ্রমজীবী মানুষদের মধ্যে বিনামূল্যে ভালো মানের মাস্ক বিতরণ করা যেতো। তাদের মধ্যে মাস্ক পরার সুফল নিয়ে আলোচনা করা যেতো। কিন্তু সরকার অন্য কাজে ব্যস্ত।
আমিও আরও বড় স্বার্থপর। এই মহামারীর মিলন ক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছে ভাগ্যিস আমার একটা নিজস্ব স্কুটার আছে। ভাগ্যিস যাতায়াতের জন্য এদের মতো মারামারি করতে হয় না। এদের মতো জীবনের ঝুঁকি নিতে হয় না।
একটি এন- ৯৫ ও একটি সার্জিক্যাল মাস্কের আড়ালে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। চশমার কাচ ঝাপসা হলো। স্কুটার স্টার্ট দিয়ে টুকটুক করে চললাম মিলন পল্লীর খুপরিতে। ওখানে অন্তত জনা ত্রিশেক জ্বরের রোগী অপেক্ষা করছেন।
এরপর আবার দুর্গাপুজো আসছে। জোরকদমে প্যান্ডেলের বাঁশ বাধা হচ্ছে। পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।
আমার তুচ্ছ লেখালেখির সময় বার করা ক্রমশ দুষ্কর হয়ে উঠেছে। যত দিন যাচ্ছে, জ্বরের রোগীর সংখ্যা অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে।
লোকজনও মরিয়া হয়ে উঠেছে। আজ এক ভদ্রলোককে তিনজন যুবক পাজাকোলা করে আনল। সঙ্গে একজন সদ্য যুবতী। ভদ্রলোকের মেয়ে। সে শুধু বলছে, 'ডক্টর, আগে আমার বাবাকে দেখুন। খুব সিরিয়াস অবস্থা।'
জিজ্ঞাসা করলাম, 'হয়েছেটা কি?'
কিছুতেই বলতে চায়না। শুধু বলছে, 'জ্বর এসেছিলো। তারপর সিরিয়াস হয়ে গেছে।'
অবশেষে কাগজপত্র ঘেঁটে বার করলাম তিনদিন আগের করোনার রিপোর্ট- পজিটিভ।
বললাম, 'একি, একে এভাবে চেম্বারে নিয়ে এসেছেন কেন? আর আপনারা জড়াজড়ি করে যেভাবে আনলেন, তাতে তো আপনাদেরও করোনা হবে।'
যুবক তিনজন হতবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল। 'করোনা?? কিন্তু ওযে বলল..'
বললাম, 'এনাকে বাঁচাতে হলে হাসপাতালে ভর্তি করতেই হবে। এই দেখুন অক্সিজেন স্যাচুরেশন ৮২% এ নেমে গেছে। শিগগিরী একে এম্বুলেন্সে তুলুন।'
কিন্তু এম্বুলেন্সে তোলার জন্য কেউই এগিয়ে এলো না। বস্তুত ওই তিন যুবককে আর খুঁজেই পাওয়া গেল না।
অনেকেই নিয়ম কানুনের তোয়াক্কা করছেন না। বাড়িতে একজন করোনা রোগী। অন্যজনের জ্বর, হালকা সর্দি কাশি। তাই নিয়েই তিনি বাজার ঘাট সেরে ডাক্তার দেখাতে এসেছেন। মুখের মাস্ক থুতনিতে। একজনের থেকে কতজনের যে সংক্রমণ হচ্ছে, কে জানে?
দুর্গাপুজো যত কাছে আসছে, আতংক তত চেপে ধরছে। পুজোর পর কি হবে কে জানে? এখনই তো সকাল থেকে রাত পর্যন্ত শতাধিক রোগী দেখছি। এর চেয়ে রোগী বাড়লে খুপরিতে তালা ঝুলিয়ে পালাতে হবে।
শুধু আমি একা নই, সরাসরি রোগী পরিষেবার সাথে যুক্ত সব স্বাস্থ্যকর্মীই ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। এই ক্লান্ত সৈনিকদের আর বড়োসড়ো যুদ্ধে লড়ার ক্ষমতা নেই।
এই মহামারীর মধ্যেও ব্যবসায়ীরা যথারীতি স্বাস্থ্য নিয়েও ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। করোনা রোগীদের কয়েক লাখ টাকা বিল হচ্ছে। তাদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সরকারের সদর্থক ভূমিকা নেই। চিকিৎসা করতে গিয়ে অনেকেই সর্বস্বান্ত হচ্ছেন।
মধ্যে স্বাস্থ্যকর্মীদের উপর শারীরিক আক্রমণ একটু কমেছিল। ইদানীং রোজই প্রতিটি জেলা থেকে হাসপাতাল ভাঙচুর ও চিকিৎসক নিগ্রহের খবর আসছে। দুর্গাপুজোর পর করোনা রোগীর সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়বে। তার সাথে সাথে বাড়বে ক্লান্ত শ্রান্ত স্বাস্থ্যকর্মীদের নিগ্রহের ঘটনাও।
বিভিন্ন চিকিৎসক সংগঠন মুখ্যমন্ত্রীর কাছে সরাসরি আবেদন করেছে দুর্গাপুজোয় জনসমাগম বন্ধ করার জন্য। কিন্তু এখনো পর্যন্ত খুব ইতিবাচক কোনো পদক্ষেপ সরকারি তরফে নেওয়া হয়নি।
বেশিরভাগ মিডিয়ার ভূমিকাও এক্ষেত্রে সন্তোষ জনক নয়।
মেডিকেল কলেজগুলির জুনিয়র ডাক্তাররা প্রায় সাত মাস ধরে হোস্টেলে বন্দী হয়ে আছে। প্রায় অর্ধেক জুনিয়র ডাক্তার ইতিমধ্যেই কখনো না কখনো করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। অন্যকে সংক্রমিত করার ভয়ে তারা বাড়ি যাওয়া তো দূরের কথা, হোস্টেলের বাইরেই বিশেষ বেরোচ্ছে না।
সে কারণেই মেডিকেল কলেজের মেন হোস্টেলের জুনিয়র ডাক্তাররা হোস্টেলেই নিজেরা ছোটো করে দুর্গাপুজোর উদ্যোগ নিয়েছিল। ব্যাস... মিডিয়াতে হইচই শুরু হয়ে গেল, “চিকিৎসকরা দুর্গাপুজোর বিরোধিতা করে নিজেরাই পুজো করছেন।” সোস্যাল মিডিয়ায় রীতিমতো কাদা ছোড়াছুড়ি শুরু হল।
আমার হোস্টেলের ছোটো ভাইরা দুঃখ বুকে চেপে রেখে পুজো বাতিল করেছে। তারা চায়নি সাধারণ মানুষের কাছে ভুল বার্তা যাক। দীর্ঘ সাত মাস জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লড়াইয়ের পরও এই পুজোয় কোনো স্বাস্থ্যকর্মী একদিনও ছুটি পাবেন না। তাদের মুখ চেয়ে আপনি অন্তত এই পুজোয় ঘরে থাকুন। ঘরেই পরিবারের মানুষেদের সাথে উৎসবে মাতুন।
শেষে একটি খবরের স্ক্রিনশট দিলাম। এধরণের ঘটনা গুলির নিন্দা করুন। তা নাহলে স্বাস্থ্যকর্মীরা আস্তে আস্তে তাঁদের কাজে উৎসাহ হারিয়ে ফেলবেন।
:|: | 174.254.***.*** | ১৭ অক্টোবর ২০২০ ১৫:৫৫98577কোনও স্ক্রিনশট দেখা যাচ্ছে নাতো!
:|: | 174.254.***.*** | ১৮ অক্টোবর ২০২০ ০২:৫৭98591হ্যাঁ এইবার এসেছে। ধন্যবাদ
Pagla Dashu | 2a0b:f4c0:16c:15::***:*** | ২৫ অক্টোবর ২০২০ ১৯:৫১98991পুজোর শুভেচ্ছা ডাক্তার বাবু|
নমস্কার