করোনার দিনগুলি #১০
ছবিতে মুখগুলো দেখে থমকে গেলাম। এনারা শ্রমিক বা দিন মজুর। কাজের সূত্রে বাড়ি থেকে অনেক দূরের ভিন রাজ্যের শহরে থাকেন। কেউ একা, কেউ পরিবার সহ।
লক ডাউনে কাজ বন্ধ। রোজগারও বন্ধ। হাতের টাকা ক্রমশ ফুরিয়ে আসছে। কেউ অর্ধাহারে, কেউ অনাহারে। মরিয়া হয়ে তাঁরা মহামারীর মধ্যেই বাড়ি ফেরার চেষ্টা করছেন।
কেউ শিশু পুত্র-কন্যা সহ দেড় শো- দুশো কিলোমিটার পথ হেঁটে ফেরার চেষ্টা করছেন। কোথাও জনস্রোত অপেক্ষা করছে একটা সরকারি বাসের জন্য।
মেডিসিনে মাস্টার্স ডিগ্রী করার সময় স্যার বারবার বলতেন, 'ঐন্দ্রিল, মানুষের মুখ ভালো করে লক্ষ কর। মানুষের মুখেই অনেক অসুখের ছবি ফুটে ওঠে। শারীরিক যন্ত্রণা, অসহায়তা , মৃত্যু ভয় এইসবের ছবি পড়তে পারলে তবেই চিকিৎসক হয়ে উঠতে পারবি।'
কিন্তু আজ অনেক চেষ্টা করেও ছবির মানুষগুলির মুখের ভাষা পড়তে পারছি না। মনে হচ্ছে, আতংক না, মৃত্যুভয়ও না, যেনো একরাশ ঘৃণা ফুটে উঠেছে শ্রমিকদের মুখে। আমাদের মতো স্বচ্ছল গা-বাঁচানো লোকদের প্রতি তীব্র ঘৃণা। ঘৃণা সেই রাস্ট্রের প্রতি, যে রাস্ট্র রাতারাতি স্পেশাল প্লেনের ব্যবস্থা করে বিদেশ থেকে প্রভাবশালী নাগরিকদের বাড়ি ফেরাতে পারে, কিন্তু লকডাউন ঘোষণা করার আগে দেশের মধ্যে থাকা নাগরিকদের বাড়ি ফেরার কোনো ব্যবস্থা করে না।
আর এর জন্য দায়ী আমরাই। যে যার নিজের কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকতাম। কোনো দিনও খোঁজ নিইনি আমাদের দেশের প্রান্তিক মানুষগুলো কেমন আছে। আজ যখন পিঁপড়ের মতো পিলপিল করে লক্ষ লক্ষ মানুষ রাজপথে ঘরে ফেরার জন্য লং-মার্চ শুরু করেছেন আমরা বিস্ময়ে অসাড় হয়ে গেছি।
কি আর করতে পারি! শুধু নিরাপদ দূরত্ব থেকে প্রার্থনা করতে পারি বাবা ঘরে ফিরে তার শিশু কন্যার কপালে রোগের ছোঁয়াচ মুক্ত চুমু খাক। যে মা তার দুই শিশু কন্যাকে নিয়ে পথ হাঁটছেন, ক্লান্তি যেন তাঁদের থামিয়ে না দেয়। শ্রমিকদের এই লংমার্চ যেন করোনা মহামারীর থেকেও বেশি প্রাণঘাতী না হয়ে ওঠে।
এত হাজার হাজার বাস রাস্তার ধারে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে, সেগুলো কি শ্রমিকদের বাড়ি ফেরার জন্য ব্যবহার করা যেতো না? ওদের জন্য কয়েকটি স্পেশাল ট্রেনের ব্যবস্থা করা যেতো না?
রেনকোট পরিয়ে চিকিৎসকদের হিরো সাজিয়ে জনসাধারণের সাহস বাড়ানোর চেষ্টা হচ্ছে। কিন্তু সত্যিটা হলো চিকিৎসকরাও এখন নিজেরাই বিপন্ন। অধিকাংশ সামাজিক অসুখের চিকিৎসাই তাদের জানা নেই।
পৃথিবীর গভীর... গভীরতর অসুখ এখন।
করোনার দিনগুলি #১১
লকডাউনের আজ সপ্তম দিন। একটু পিছনে ফিরে দেখে নি, এই এক সপ্তাহে আমি কি জানলাম, কি শিখলাম।
১. হাইপোক্লোরাইট সলিউশান দিয়ে শ্রমিকদের শোধন করাঃ জানতাম হাইপোক্লোরাইট সলিউশান মানব দেহের চামড়া, বিশেষ করে নরম চামড়ার জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। সরাসরি চোখে গেলে দৃষ্টি শক্তি নষ্ট হতে পারে। দেহের ভেতরে করোনা ভাইরাস থাকলে তাঁকে হাইপোক্লোরাইটে স্নান করিয়ে ক্ষতি ছাড়া কোনো লাভ হবে না।
উত্তরপ্রদেশের পুলিশ সেটাই করল। দরিদ্র শ্রমিকদের রাস্তায় ফেলে হাইপোক্লোরাইটে স্নান করল। ভাত দেবার মুরোদ নাই, কিল মারার গোঁসাই।
২. আরও আশ্চর্য বিষয় হল এসব নিয়ে কিছু বলতে গেলে এক দল লোক গাঁক গাঁক চিৎকার করছেন, কেরলেও নাকি ২৩ তারিখে শ্রমিকদের এই ভাবে হাইপোক্লোরাইটে স্নান করানো হয়েছিল। তখন আমি কেন নিশ্চুপ ছিলাম, আমি নির্ঘাত বামপন্থী ইত্যাদি ইত্যাদি।
গরীব মানুষের কথা বললে তাঁকে বামপন্থী হতেই হবে এটাও জানলাম। যদিও তাঁদের উল্লেখিত বামপন্থী জিনিসটা কি, খায় না মাথায় দেয়, নাকি এটা একধরণের গালাগালি সেটা আমি এখনও জানিনা।
৩. আমি ডাক্তার হওয়ার পর পনের বছরে যত প্যানিক ডিজঅর্ডারের রোগী দেখেছি, এই এক সপ্তাহে তার চেয়ে বেশি প্যানিক ডিজঅর্ডারের রোগী দেখেছি। প্রায় সকলেই আতংকে ভুগছেন। দুবার হাঁচি দিলেই অনেকে করোনা ভাইরাসের জন্য থ্রোট সোয়াব বা রক্ত পরীক্ষা করাতে চাইছেন।
৪. বেশীরভাগ মানুষই যে অকৃতজ্ঞ সেটা মহামারীর চোখে আঙুল দিয়ে শেখালো। যারা স্বাস্থ্য কর্মীদের জন্য থালা বাজালেন, তারাই পরের দিন ভাড়ায় থাকা চিকিৎসক, নার্সদের ঘর থেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বার করে দিয়েছেন। ভুবনেশ্বরে মহিলা চিকিৎসককে এমনকি বাড়ি না ছাড়লে ধর্ষণের হুমকি দেওয়া হচ্ছে।
৫. এটা বন্ধু চেনারও সময়। অনেকেই না চাইতেই দরিদ্র রোগীদের জন্য সাহায্য করতে চাইছেন। ওষুধ দিয়ে যাচ্ছেন। অনেকে রোগীই আমাকে স্যানিটাইজার উপহার দিয়েছেন। উচ্চপদে কাজ করা বন্ধু ফোন করে বলছে, বাড়ি বসে অসহ্য লাগছে ভাই। আমাকে লড়ার একটা সুযোগ করে দে। যে কোনও সরকারি হাসপাতালে ট্রলি ঠেলতেও রাজি। না হলে তোর সাথে থাকি। তোর কম্পাউন্ডারি করি।
৬. কমদামী রেনকোট যে PPE হিসাবে ব্যবহার করা যায় সেটাও শিখলাম। ছেঁড়া ফাটা রেনকোট পরা ভাইবোনদের বিপদ থেকে রক্ষা করার জন্য এখনও ভগবানে বিশ্বাসী হতে রাজি আছি।
৭. মিষ্টি একটি অত্যাবশ্যকীয় পণ্য হিসাবে স্বীকৃতি পেল। আমি এটা আগে থেকেই মনে প্রাণে বিশ্বাস করতাম। যারা রসরাজের নলিনীর স্বাদ থেকে বঞ্চিত, তাঁরা জীবনের প্রকৃত স্বাদ কোনোদিনই পাননি। কেউ সমর্থন না করলেও, মুখ্যমন্ত্রীর এই সাহসী সিদ্ধান্ত নেওয়ার পেছনে আমার পূর্ণ সমর্থন আছে। করোনায় মরতে হলে মরবো। কিন্তু জলভরা খেয়েই মরবো।
বিদ্রঃ সকালে রোগী দেখে ফেরার পথে রসরাজে গেছিলাম। তখন সাড়ে বারোটা। কিন্তু রসরাজ খোলেনি। অন্য একটি দোকানে শুধু ক্ষীর-কদম ছিল। তাই গোটা দশেক কিনে এনেছিলাম। কিন্তু সেগুলো এতোটা শক্ত, দাঁত দিয়ে ভাঙা যাচ্ছে না। আমার বড় মেয়ের দাঁত নড়ছিল। মিষ্টি খেতে গিয়ে ওর দুটো দাঁত পড়ে গেছে। আমি বাড়িতে রোগী দেখা শেষ করে লিখছি আর চুষে চুষে খাচ্ছি।
করোনার দিনগুলি #১২
মিষ্টি গল্প
আমি খুবই ভীতু মানুষ। তাই আর বিতর্কিত বিষয়ে যাব না। ইতিমধ্যেই স্বাস্থ্যকর্মীদের PPE নিয়ে গলা ফাটানোর জন্য এক ডাক্তারবাবুকে পুলিশের হাতে নাকাল হতে হয়েছে। অতএব আমি PPE নিয়ে কিছু লিখবনা। আমি চিকিৎসক। চিকিৎসা করতে গিয়ে টিবি, হেপাটাইটিস, করোনা সবকিছুতেই আক্রান্ত হতে পারি। সেটা অকুপেশানাল হ্যাজার্ড। তাতে আমার তেমন আপত্তি নেই। কিন্তু পুলিশ-টুলিশ আমার তেমন সহ্য হয় না।
এমনিতেও করোনায় না মরলেও পাবলিকের হাতে মরতেই হবে। দিল্লীতে এক হাসপাতালে করোনা রোগী সাতদিন ভেণ্টিলেশনে থেকে মারা যাওয়ার পরে রোগীর তথাকথিত আত্মীয়রা এক তরুণ ডাক্তারকে উদোম পিটিয়েছে। সম্ভবত ইন্দোরে জ্বরের রোগীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে সার্ভে করার সময় দুজন চিকিৎসক গণপিটুনি খেয়েছেন। তার মধ্যে একজন মহিলা চিকিৎসক। আমি এখনও সেই গণপিটুনি খাওয়ার ভিডিও দেখার সাহস অর্জন করতে পারিনি।
সেসব নিয়েও কিছু লিখবনা আমি। ঐ যে বললাম, প্রশাসনকে বড়ই ভয় পাই। পুলিশের সামনে নির্ভয়ে ডাক্তারকে চড় মারা যায়। কিন্তু সেই চড় খাওয়া নিয়ে উচ্চবাচ্য করলেই প্রশাসন ডাক্তারকেই ধমক লাগায়।
জানিনা আমাদের এই অশান্ত সময়ে কি করা উচিৎ। কিন্তু ঐ যে ফাইনাল ইয়ারে সকলেই প্রতিজ্ঞা করে ফেলেছিলাম, একটা বস্তাপচা হাজার বছরের পুরোনো সেন্টিমেণ্টাল প্রতিজ্ঞা, ‘সবসময় রোগীর ভালোর জন্য যা করার তাই করব। কোনো ভয়, ঘৃণা, এমনকি নিজের জীবনের ঝুঁকির জন্যও রোগীর অনিষ্ট কখনও কামনা করবো না।’ সেটা যে আমার কয়েকজন ভাইবোন একেবারে আত্তীকরণ করে ফেলেছে, স্পষ্ট বুঝতে পারছি। শুধু আমাদের দেশ নয়, চীন, ইতালি, কিউবা এমনকি আমেরিকার মতো ধনতান্ত্রিক দেশেও। সেসব নিয়েও কিছু লিখব না আমি।
বরঞ্চ আজ মিষ্টি নিয়ে লিখি। মিষ্টি নিয়ে মিষ্টি লেখায় কোনও রিস্ক নেই।
ঘোলা থেকে রোগী দেখে ফিরছিলাম। সবই জ্বরের রোগী এবং সকলেই প্রায় নিঃসন্দেহ তাঁর করোনা হয়েছে। কারো জ্বরের সাথে গলা ব্যথা। কারো বুকে সাঁই সাঁই। কারো নাক দিয়ে লবণ জল গাড়াচ্ছে। কারো আবার জ্বর জ্বর ভাব। থার্মোমিটারে স্বাভাবিক তাপমাত্রা দেখাচ্ছে। কিন্তু রোগীর দাবী তাঁর জ্বর আসছে। থার্মোমিটারের পারদে ভেজাল আছে।
এধরণের জ্বরের চিকিৎসা করাই সবচেয়ে ঝামেলার। এই জ্বরের চিকিৎসা করার জন্য আমার নিজস্ব একটি পদ্ধতি আছে। কিন্তু যেহেতু এই লেখাটা আমার অনেক রোগীই পড়বেন, এবং সেই পদ্ধতির সাথে তাঁদের চিকিৎসা পদ্ধতির মিল পেলে মনঃক্ষুণ্ণ হতে পারেন, তাই আর বিশদে লিখলাম না।
বরঞ্চ মিষ্টির গল্পে ফেরত আসি। ঘোলা থেকে ফেরার সময় সাজিরহাট ব্রিজের কাছে একটা মিষ্টির দোকান খোলা দেখে দাঁড়ালাম। জানি আট দিনের বাসী মিষ্টি। কিন্তু মিষ্টি তো।
গুটি গুটি পায়ে দোকানে গিয়ে দাঁড়ালাম। দোকানদার আমায় ভালোমতো চেনেন। আমারই রোগী। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ভালো মিষ্টি কোনটা হবে?’
উনি আমায় দেখে কেমন থতোমতো খেলেন। বললেন, ‘ডাক্তারবাবু, আজই আটদিন বাদে প্রথম খুললাম। আজই মিষ্টি নেবেন?’
বললাম, ‘কেন? অনেকরকম মিষ্টিই তো আছে দেখছি।’
উনি বললেন, ‘ডাক্তারবাবু, দোকানের ভেতরে আসুন। আপনার সাথে কথা আছে।’
গেলাম ভেতরে। দু মিটার দূরে দাঁড়িয়ে বললাম, ‘বলুন কি কথা?’
উনি ইতস্তত করে বললেন, ‘আজ্ঞে ডাক্তারবাবু, সব মিষ্টিই আগের সোমবার বানানো। শুধু কাঁচাগোল্লাটাই গরম। তবে সব ফ্রিজে ভরে রেখেছিলাম। কিন্তু প্রাণে ধরে আপনাকে বাসী মিষ্টি দিতে পারব না। আপনি আমার রোজকার খদ্দের। তার উপর আমার ডাক্তার। আজ যদি ছানা জোগাড় করতে পারি, তাহলে কাল রসগোল্লা বানাব। কাল গরম রসগোল্লা নেবেন।’
আমি ততক্ষণে মোহনভোগ, ছানার জিলাপির প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি। আহা, কতদিনের অদর্শনের পর দেখা। বললাম, ‘বাসী হোক, ও দুটো আমায় খান দশেক করে দিন।’
দোকানদার বললেন, ‘যদি অভয় দেন একটা কথা বলি। নেওয়ার আগে আপনি টেস্ট করে নেন। ভালো থাকলে তবে নেবেন।’
মোহনভোগ খেলাম, ছানার জিলাপিও খেলাম। দিব্যি আছে। দোকনদার বললেন, ‘জলভরাটাও একটা টেস্ট করেন। এটা কড়াপাকের। নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা নেই।’
জলভরা খেলাম। তারপর ক্ষীরকদম্ব। তারপর কালাকাঁদ। তারপর ক্ষীরের প্যাঁড়া, আমসত্ত্বের স্যান্ডুইচ মিষ্টি, চকলেট মিষ্টি, মিহিদানার লাড্ডু। বললাম, ‘সব ঠিক আছে।’
দোকানদারকে টাকা দিলাম। কিছুতেই নিলেন না। বললেন, ‘এবার নির্ভয়ে বিক্রি করতে পারব। কেউ কিছু বললেই বলব, স্বয়ং ডাক্তারবাবু এসে আমার মিষ্টি টেস্ট করে সার্টিফিকেট দিয়ে গেছেন।’
করোনার দিনগুলি #১৩
এতো দিন ফোনে রোগীর কথাবার্তা বিশেষ শুনতাম না। দু’চার কথা শোনার পরই বলতাম, খারাপ রোগী দেখছি। আপনি প্রেসক্রিপশান নিয়ে যোগাযোগ করুন। ফোনে ওষুধ বলা যাবে না।
এখন সেটা করতে পারছি না। রোগীদের দুচার কথা ফোনে শুনতেই হচ্ছে। তাঁদের দুচারটে ওষুধ ফোনেই বলে দিতে হচ্ছে। দেশে লকডাউন চলছে, আমি কি করে তাঁদের আসতে বলি।
মুশকিল হল, তাঁরা ঘরে রয়েছেন। হাতে অফুরন্ত সময়। সারাদিন ধরে যা যা সমস্যা হচ্ছে, ভেবে রাখছেন। তারপর চা খেতে খেতে ফোন করছেন। অন্যদিকে আমি সে সময় চারদিনের জ্বরে নেতিয়ে পরা রোগী দেখছি।
জ্বরের রোগিণীর মা বারবার মুখে আঁচল চাপা দিচ্ছেন। ধমক লাগালাম। উনি বললেন, করোনা রোগের ভয়ে মুখ ঢাকছেন।
বললাম, করোনা ভাইরাস আপনার ভাশুর নয়, যে ঐ মুখ ঢাকায় সন্তুষ্ট হয়ে চলে যাবেন। বরঞ্চ বারবার মুখে হাত দিয়ে আপনি নিজের বিপদ ডেকে আনছেন।
বলতে বলতেই আমার মোবাইল বেজে উঠল। বাধ্য হয়ে রোগী দেখতে দেখতেই ফোন ধরলাম। জিনিসটা এই করোনার মরসুমে যথেষ্ট আনহাইজিনিক। কিন্তু না ধরেও উপায় নেই। রোগীকে ছোঁয়া হাতেই মোবাইল ধরে কানে ঠেকাচ্ছি। আমারও সব স্টেরিলিটির গুষ্টি উদ্ধার হয়ে গেল।
কিছু কিছু ফোন রোগীরা প্রয়োজনেই করেন। কিন্তু বেশিরভাগ ফোনেরই মাথা মুণ্ডু থাকেনা। ফোন করেই ওপাশের ব্যক্তি প্রথমেই বলেন, ডাক্তারবাবু, আমি শ্রীকান্ত সাহা, জানুয়ারীর দুই তারিখে আপনার কাছে দেখাতে গেছিলাম মনে পড়ছ?
আমি উত্তর দিই, আজ এপ্রিলের তিন তারিখ, এই তিনমাসে আমি অন্তত দশ হাজার রোগী দেখেছি। প্রত্যকের কথা মনে রাখা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কি দরকার বলুন।
ভদ্রলোক অত্যন্ত আহত স্বরে বললেন, মনে পড়ছে না? সত্যি আপনার মনে পড়ছে না? ঐ যে পেটে ব্যথা নিয়ে গিয়েছিলাম।
আমি একটু রুক্ষ ভাবেই বললাম, যা বলার তাড়াতাড়ি বলুন। খারাপ রোগী দেখছি।
আচ্ছা, ডাক্তারবাবু আমি কলা খেতে পারব?
কেন? কলা খাবেন না কেন? আপনার কি সুগার আছে?
না না। কিন্তু কলা খেলে তো ঠাণ্ডা লেগে যেতে পারে। আর ঠাণ্ডা লাগলেই তো করোনা ভাইরাস চেপে ধরবে।
আপনি নির্ভয়ে কলা খান। কিচ্ছু হবে না।
আচ্ছা ডাক্তারবাবু তেঁতুল খেলে করোনা হতে পারে? চিনাদের শুনেছি খাবার থেকেই প্রথম করোনা হয়েছিল।
কি আর করি। বললাম, আপনি বাদুড়, সাপ আর আরশোলা ছাড়া আর সব কিছু খান। অত্যন্ত অভদ্র ভাবে ফোন কেটে দিলাম।
জ্বরের রোগীটিকে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ওষুধ লিখতে যাচ্ছি। আবার ফোন। একজন মহিলা ফোন করেছেন।
হ্যালো, ডাক্তারবাবু। আমরা কি এসি চালাতে পারি।
আমি অবাক ভাবে জিজ্ঞাসা করলাম, কেন? আপনাদের এলাকায় লো ভোল্টেজ নাকি?
উনি বললেন, না না, গরমে তো করোনা ভাইরাস মরে যায়। এসি চালালে করোনা হবে নাতো?
বাধ্য হয়ে অ্যাসিস্ট্যান্ট সঞ্জয়দাকে ডাকলাম। বললাম, একটু ফোনে প্রক্সি দাও। জরুরী মনে হলে আমায় দিও।
রোগী দেখতে দেখতে শুনছি মাঝে মঝেই ফোন বাজছে আর সঞ্জয়দা ফোন ধরছে। দিব্যি সামলে দিচ্ছে। একবারই শুধু আমাকে দিল। ওষুধের দোকান থেকে ফোন করেছে। কি একটা ওষুধ আউট অফ স্টক হয়ে গেছে। পরিবর্তে কি ওষুধ দেবে জানতে চাইছে।
সাড়ে পাঁচটায় বাড়িতে রোগী দেখা শেষ হল। সঞ্জয়দা মোবাইল ফেরত দিল। বলল, দাদা, অনেক ফোন এসেছিল। লোকজন প্যানিকড হয়ে গেছে। সকলেই প্রায় করোনা ঠেকানোর জন্য কি করা উচিৎ জিজ্ঞাসা করছিল। আমি পদ্ধতি বলে দিয়েছি।
পদ্ধতি? কি পদ্ধতি? আমি চমৎকৃত হলাম।
ঐ যে আধ ঘণ্টা অন্তর অন্তর গরম জলে পাতি লেবুর রস দিয়ে দু ঢোঁক করে খেতে হবে।
সর্বনাশ করেছে। এ পদ্ধতি কোথায় পেলে?
ফেসবুকে দেখলাম তো। অনেকেই শেয়ার করেছে।
আমি বললাম, যা করেছ, ভালই করেছ। মোমবাতি জ্বালিয়ে যদি ম্যাক্সওয়েলের মতবাদ অনুযায়ী ম্যাগনেটিভ ফিল্ড তৈরি করে করোনা ভাইরাস ধ্বংস করা যায়, তাহলে গরম জল খেয়েও যায়।
তারপর আরেক জায়গায় রোগী দেখা সেরে রাত্রি ন’টায় বাড়ি ফিরলাম। রাত নটা থেকে কাকুর দোকানে রোগী দেখতাম। আপাতত কাকু করোনাতঙ্কে ভুগছে। বৃহস্পতিবার রাতে বাড়বাড়ি হয়েছে। বুকে চাপা ব্যাথা, দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কাকুর ধারণা হার্ট এটাক হয়েছে, এক্ষুণি মরে যাবে।
আধঘণ্টা পরেও বেঁচে থাকায় কাকু নিজের ডায়াগনোসিস চেঞ্জ করেছে। এখন তার মনে হচ্ছে এফেব্রাইল করোনা হয়েছে। তিনদিনের মাথায় মরে যাবে।
তাই আপাতত তিনদিন দোকান বন্ধ। সোমবার অবধি সকলে বেঁচে থাকলে আবার খোলা হবে। বাড়ি ফিরে হাত-পা ধুয়ে আমি ছটা রসগোল্লা খেলাম। যদি মরতেই হয়, তাহলে যেন আপসোস না করতে হয়। তবে সম্ভবত এরাজ্যে আর বেশি কেউ করোনায় মরবে না।
করোনার দিনগুলি #১৪
করোনা ছোঁয়াচে, করোনাতঙ্ক তার চেয়েও বেশি ছোঁয়াচে। এক পরিবারের চারজন এসেছেন। বাবা, মা এবং তাঁদের দুই ছেলে মেয়ে।
বাবা, মায়ের বয়স চল্লিশের মধ্যে। ছেলের ষোলো বছর। মেয়েটি একেবারেই ছোটো। বয়স আটের নীচে।
মায়ের প্রথম সমস্যা শুরু হয়েছে। আজ সকাল থেকেই একটু একটু গলা ব্যথা করছিল। ভদ্রমহিলা ফেসবুক থেকে জেনেছেন মধ্যমগ্রামের কারবেলায় নাকি করোনা রোগী পাওয়া গেছে। ভদ্রমহিলার বাড়িও কারবেলায়। খবরটা শোনার পর থেকেই ওনার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে আর বুকে ব্যথা। তাঁর কিছুক্ষণের মধ্যে তাঁর স্বামী ও পুত্রেরও গলা ব্যথা ও শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে গেছে। একমাত্র ছোটো মেয়েটিই স্বাভাবিক আছে।
চিকেন পক্সের রোগী দেখছিলাম। তাঁরও একই জিজ্ঞাস্য, করোনা হয়নি তো। তাঁকে একটা জোরদার ধমক লাগাতে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ বাইরে হইচই।
বারান্দায় বেরিয়ে দেখলাম, মা আর ছেলে চোখ উল্টে অজ্ঞান হয়ে গেছেন। বাবা হাউমাউ করে কাঁদছেন। আর ঝাঁকড়া চুলের ছোটো মেয়েটি বড় বড় চোখ করে সকলের কাণ্ড কারখানা দেখছে।
স্টেরিলিটির ১০৮ করে তিনজনকে ভেতরে এনে শোয়ানো হল। মানসিক রোগের চিকিৎসক নই। কিন্তু এ কদিনে অ্যাংজাইটি, ডিপ্রেশন আর প্যানিক অ্যাটাকের এতো কেস দেখছি যে মোটামুটি মানসিক রোগের বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠেছি।
বাকি রোগীরাও চেম্বারের দরজা দিয়ে উঁকিঝুঁকি মারছিলেন। মহামারীর ভয়ের চাইতেও কৌতূহলের জোর বেশি। ধমক দিয়ে তাঁদের বাইরে পাঠানো হল। মহিলার মাস্ক খুললাম। দাঁতে দাঁত আটকে আছে। তাঁর ফাঁক দিয়ে একটা ‘মুখের ভেতর গলে যাওয়া’ ট্যাবলেট চালান করলাম।
ভদ্রলোক হাহাকার করে বললেন, আমাদের সব শেষ হয়ে গেল। ছেলে, মেয়ে দুটোর কি হবে?
আমি বললাম, দয়া করে শান্ত হোন। আপনি অবুঝ হলে ওরা আরও ঘাবড়ে যাবে।
প্যানিক অ্যাটাকের একটা বৈশিষ্ট্য হল ডাক্তারবাবু সামনে থাকলে, সে যতই আমার মতো নিধিরাম সর্দার ডাক্তারই হোক না কেন, কিছুক্ষণের মধ্যেই রোগী সুস্থ হয়ে যায়। এক্ষেত্রেও তাই হল। ওষুধ-পত্র লিখে সাগর দত্ত হাসপাতালের সাইক্রিয়াট্রি আউটডোরে রেফার করে ওনাদের বাড়িতে পাঠালাম। ভদ্রলোক বৌবাজারে সোনার কাজ করতেন। এমনিতেই সোনার কাজের বাজার খারাপ। তাঁর উপর লক-ডাউনের ফলে কাজ পুরোপুরি বন্ধ।
কাজ হারানোর ভয়ে অনেকের মধ্যে সাইকোসিসও দেখা যাচ্ছে। আমাদের বাড়িতে একজন রঙের কাজটাজ করতেন। কালকে তাঁর ছেলে নিয়ে এসেছিলেন। আক্ষরিক অর্থেই পাগলামি করছেন। সারাক্ষণ বিড় বিড় করছেন। এই হাসছেন, এই কাঁদছেন।
আবার আরেকজন রোগীর বাড়ির লোকের অবস্থা করুন। লক ডাউনের শুরু থেকেই ভদ্রমহিলা বাড়াবাড়ি রকমের সন্দেহ-বাতিকগ্রস্ত হয়ে উঠেছেন। তার ঠেলায় বাড়ির লোকের জীবন ওষ্ঠাগত। বয়স্ক মহিলার ধারণা বাড়ির লোকেরা তাঁর ক্ষতি করতে চায়। এমনকি কোনও ওষুধও খেতে চাইছেন না। বউমা ওষুধ খাওয়াতে এলে আমাকে ফোন করে জিজ্ঞাসা করছেন ওষুধ খাবেন কিনা।
হাত ধোয়ার বাতিক অনেকের মধ্যেই ওবসেসিভ কম্পালসিভ ডিজঅর্ডারের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। বারবার সাবান দিয়ে হাত ধুতে ধুতে অনেকেরই হাতে ঘা হয়ে গেছে। তবু তাঁরা হাত ধুয়েই চলেছেন।
কবে যে এই ভয়ংকর দিনগুলোর শেষ হবে কেউ জানেনা। অনেক ঘরেই জমানো টাকা পয়সা শেষের দিকে। লক ডাউন আরও বাড়তে পারে এই আতঙ্ক তাঁদের অস্থির করে দিচ্ছে। আতঙ্ক থেকে মুক্তি পেতে অনেকেই আত্মহত্যার করার কথাও চিন্তা ভাবনা করছেন।
একদিন নিশ্চিত ভাবেই এই মহামারীর প্রকোপ কেটে যাবে। হয়তো মহামারী পরবর্তী পৃথিবীটা আগের চাইতে আরেকটু ভালো হবে। সেদিনের জন্য আমাদের বেঁচে থাকতেই হবে। শুধু সুস্থ শরীরে নয়, সুস্থ মনেও। করোনার দিনগুলো আমাদের যে করেই হোক কাটিয়ে দিতে হবে। কাটিয়ে দিতে হবে প্রিয়জনদের মুখ চেয়ে। কাটিয়ে দিতে হবে পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে।
করোনার দিনগুলি #১৫
আজকের দিনটা বেশ ঘটনাবহুল। একটুর জন্য কোয়ারাণ্টাইনে যেতে যেতে বেঁচে গেলাম। গতকাল সকালে একজন পরিচিত ফোন করেছিলেন, মধ্যমগ্রামেরই এক অতি পরিচিত অসুস্থ মানুষকে দেখার জন্য।
আমি তখন সোদপুরের এক চেম্বারে। বললাম, বেলা দুটোর পর বাড়িতে নিয়ে আসুন। দেখে দেব।
বিকেলে আবার ওই পরিচিত জনের ফোন পেলাম। ডাক্তারবাবু, আমরা আর আসছি না। ওনার শারীরিক অবস্থা আরও খারাপ হওয়ার জন্য হসপিটালাইজড করতে হয়েছে।
আজ বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে দেখলাম, তাঁর করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পরেছে। তাঁর সংস্পর্শে আসার জন্য অনেককেই কোয়ারান্টাইনে যেতে হয়েছে। উনি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠুন।
যুদ্ধের শুরুতেই যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরে যেতে মোটেই ভালো লাগত না। একজন সৈনিক আমাদের থেকে ভাগ্যবান। তিনি আহত হলেও যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারেন। কিন্তু আরেকটু হলেই আমাকে সুস্থ দেহেই লড়াইয়ের ময়দান ছাড়তে হত।
আমরা যারা প্রাইভেট প্রাক্টিশনার লকডাউনের দিনগুলিতে জ্বর ও অন্যান্য এমারজেন্সি রোগী দেখে চলেছি, তাঁদের অবস্থা সবচেয়ে করুন। করোনায় মৃত্যু হলে সম্ভবত আমাদের পরিবার চিকিৎসকদের জন্য নির্ধারিত ৫০ লাখ টাকার বিমা পাবে না। অভিজ্ঞ ডাক্তারবাবুরা এই বিষয়ে একটু আলোকপাত করলে ভালো হয়।
সবচেয়ে বিচ্ছিরি অবস্থা হচ্ছে হাত পেতে রোগীদের কাছ থেকে ভিজিট নেওয়ার সময়। রোগী দেখার সময় কায়দা করে তার পেশা জানার চেষ্টা করছি। একটা আশ্চর্য বিষয় অনেক দরিদ্র মানুষ এই সময়েও জোর করে ভিজিটের কিছুটা অন্তত দিতে চাইছেন। বলছেন, ভিজিট না দিলে জ্বর সারবে না।
আরও সমস্যা হচ্ছে কয়েকটি এমারজেন্সি রোগীর ক্ষেত্রে। একটি কমবয়সী ছেলের মাস দেড়েক ধরে জ্বর আর কাশি। গত একসপ্তাহ ধরে শ্বাস কষ্ট হচ্ছে। সপ্তাহখানেক আগে আমার কাছে এনেছিল। স্টেথো বসিয়ে ডানদিকের বুকে কোন আওয়াজই পেলাম না। এক্সরে করে আসতে বললাম। এক্সরেতে ডানদিকে ম্যাসিভ প্লুরাল ইফিউশান। সম্ভবত টিবি। কোথাও ভর্তি করে বুকের জল বের করে পরীক্ষা করা দরকার।
ছেলেটি সোনার কারিগর। আমাদের পাড়ার আশপাশের অনেক মানূষই সোনার কাজ করেন। কিন্ত সোনার মতো মূল্যবান ধাতুর কাজ করলেও তাঁদের আর্থিক অবস্থা খুব ভালো নয়। অগত্যা ভর্তি হতে হলে সরকারি হাসপাতালই ভরসা।
টোটো ভাড়া করে ছেলেটি দু’দিন পনেরো কিলোমিটার দূরের একটি সরকারি মেডিকেল কলেজ থেকে ঘুরে এসেছে। ভর্তি হতে পারেনি। এমনকি বক্ষ বিভাগে দেখাতেও পারেনি। এই সব রোগী নিয়ে কি করব জানিনা। প্রাইভেট ল্যাবরেটরি গুলোতে রুটিন কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা ছাড়া বাদবাকি সব পরীক্ষা নিরীক্ষা বন্ধ। বুকের জল বের করে দিলেও কোথাও পরীক্ষা করতে পারবে কিনা জানিনা। কালকে আবার ছেলেটি ঐ মেডিকেল কলেজেই যাবে। দেখা যাক।
অন্যান্য মেডিকেল এমারজেন্সিও থেমে নেই। আজই একজন হার্ট এটাকের রোগী পেলাম। তখনও গোল্ডেন আওয়ারের মধ্যে আছে। বাড়ির লোককে বললাম এখুনি হাসপিটালাইজড করা দরকার। এ্যাম্বুলেন্স জোগাড় করা গেল না। একটা গাড়ি জোগাড় করতেই অনেকটা মূল্যবান সময় নষ্ট হল। ঐ সময়টুকু প্রথমিক ওষুধপত্র দিয়ে দূরু দুরু বুকে অপেক্ষা করলাম।
আরও একটা সমস্যায় পড়েছি। দয়া করে সমস্যাটি নিয়ে হাসাহাসি করবেন না। গত কয়েক বছর ধরে আমার একটা বিচ্ছিরি নেশা হয়ে গেছে। প্রায় সর্বক্ষণ আমি চা খেতে খেতে রোগী দেখি। চা না পেলে ঘন্টাখানেকের বেশি রোগী দেখা আমার কাছে অসম্ভব হয়ে ওঠে। করোনার মরসুমে মাস্ক পরে রোগী দেখছি। যার ফলে প্রতি ঘন্টায় চা কি করে খাব বুঝে উঠতে পারছি না। একঘন্টা অন্তর অন্তর সব ছেড়ে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে চা পান করা সম্ভব নয়। কেউ যদি এই সমস্যার একটা সমাধান করে দিতে পারেন চির কৃতজ্ঞ থাকব।
আজ আমার স্ত্রীর জন্মদিন ছিল। তিন কন্যা বিকাল বেলায় বাড়ির ছাদে ছাই বৃষ্টি দেখে উত্তেজিত হয়েছিল। তাদের দাবীতে কেক কাটা হল। বড় কেক পাওয়া যায়নি। মুদির দোকানে দশটাকার বেশি দামের কেক নেই। তাই আনা হল গোটা কয়েক। এই দমবন্ধ করা পরিস্থিতির মধ্যেও কিছু সময়ের জন্য বাঁচতে ভালো লাগল।
রাত্রে আমি, স্ত্রী আর মেয়েরা মিলে মোমবাতি জ্বালালাম। অন্যরাও জ্বালিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রী, করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমরা আপনাদের সাথে আছি। আপনারা যা বলবেন আমরা তাতেই রাজি। আপনারা শুধু আমাদের অস্ত্র দিন। কমপয়সায় পরীক্ষার ব্যবস্থা করে দিন। যাতে জ্বর আসলেই প্রত্যেকটি রোগী সাথে সাথে পরীক্ষা করতে পারে। প্রতিটি কোভিড-১৯ কেস যাতে প্রথম অবস্থাতেই রোগ ছড়ানোর আগে ধরা পরে। আর পারলে প্রত্যেকটি স্বাস্থ্য কর্মীর জন্য উপযুক্ত পিপিই এর ব্যবস্থা করুন। সরবরাহের ব্যবস্থা থাকলে আমরা অনেকেই পয়সা খরচ করে কিনতে রাজি আছি।
আজই এনআরএস হাসপাতালে এক করোনা রোগীর মৃত্যুর পরে কয়েকজন, চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীকে কোয়ারন্টাইনে পাঠানো হয়েছে। এমনিতেই আমাদের চিকিৎসক, নার্সের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। উপযুক্ত পিপিই থাকলে তাঁরা আজ লড়াইয়ের ময়দানে থাকতে পারতেন।
ডাঃ ঐন্দ্রিল ভৌমিকের কিছু লেখা পড়লাম, খুবই সরল ভাষায় লেখা এবং প্রাণবন্ত। ডাঃ ভৌমিক একেবারে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করেছেন যে যত না করোনার আতংক তার চেয়ে করোনাতঙ্ক অনেক বেশী এবং সেটা ঘরে বসেই বেশ ভাল করে বুঝতে পারছি।ষাঠোর্দ্ধ বয়স আর পঁচিশ বছরের ডায়াবেটিক রুগীর গৃহবন্দী অবস্থায় বাড়ীর গৃহিণীর করোণাতঙ্কের কারণে পরাধীনতার জ্বালা অনুভব করা ছাড়া আর কোন গতি নেই।
খুবই খারাপ লাগে ভাবতে যে খেটে খাওয়া মানুষজন কি ভাবে কালাতিপাত করছেন, কিভাবে তাঁদের খাওয়া-দাওয়া জুটছে? যদিও সরকারের তরফ থেকে তাঁদের সব দিক দিয়ে আশ্বস্ত করা হয়েছে,তবুও বর্তমান সামাজিক পরিস্থিতিতে আর দায়িত্বপ্রাপ্ত লোকেদের মানসিকতায় সবাই এই সুযোগ পাচ্ছেন কিনা সেই নিয়ে একটা প্রশ্ন থেকেই যায়। যদিও এই প্রশ্ন করা আমার সাজে না কারণ বর্তমান পরিস্থিতিতে গৃহবন্দী থাকা ছাড়া আমার কোনও অবদানই নেই তবুও মনে মনে এই মানুষগুলোর পাশে আছি, যদি কিছু করতে পারি, এদের পাশে দাঁড়াতে পারি।
সর্ব্বোপরি যে সব ডাক্তারবাবু,নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী এবং আন্যান্য কর্মীরা, যারা এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে নিরলসভাবে দেশের স্বার্থে প্রাণপন লড়াই করছেন তাঁদের আমার প্রণাম। আমার বিশ্বাস যে আমরা খুব তাড়াতাড়ি এই ভয়ানক আসহনীয় পরিস্থিতি থেকে বেড়িয়ে আসব এবং পৃথিবী আবার হাসবে। সবাই ভাল থাকবেন।
রঞ্জন ভট্টাচার্য্য।