করোনার দিনগুলি #৫৯
স্মৃতি
আমি অনেকদিন খবরের কাগজ পড়ি না। টিভিও দেখি না। সারাদিন মানুষ দেখি।
এই মুহূর্তে করোনা মহামারীর বিশ্বে ঠিক কি অবস্থা, বলতে পারব না। করোনা ভ্যাকসিন কবে বাজারে আসবে তা নিয়েও মতামত দিতে পারব না। কিন্তু এটা নিশ্চিত করে বলতে পারি এই মহামারীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমরা জিততে চলেছি।
তাহলে কি করোনার প্রকোপ কমেছে?
তা একদমই নয়। বরঞ্চ কেস অনেক বেড়েছে। রোজই আমার রোগীদের মধ্যে দশ- বারোজনের করোনা ধরা পড়ছে। দু-তিন দিন আগে একদিনে বাইশ জন রোগীর করোনা ধরা পড়ল। তার মধ্যে এক বাড়িতেই আট জনের।
তবু করোনা যত ছড়াচ্ছে, মানুষের সাহস কমার বদলে বাড়ছে। মিডিয়ার দৌলতে এতদিন লোকে করোনাকে বাঘ-সিংহ ভাবছিল। সামনা সামনি হলে নিশ্চিত মৃত্যু। সামনাসামনি হওয়ার পর দেখা গেল করোনার দাঁত নখে তেমন ধার নেই। প্রায় সকলেই বাড়িতে সুস্থ হয়ে উঠছেন। বিশেষ কোনো চিকিৎসাও লাগছেনা।
ফলে শ্রমজীবী মানুষেরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চাইছেন। না ফিরে উপায়ও নেই। অধিকাংশ মানুষেরই দীর্ঘদিন ঘরে বসে থাকার মতো সঞ্চিত অর্থ নেই।
অনেকদিন বাদে চন্দ্রা আবার এসেছিল। ওর বর টোটো করে নিয়ে এসেছে। বর বলল, 'করোনার ভয়ে ওকে আর মাঝের সময়ে বের করি নি। কিন্তু শ্বাস কষ্টটা বেশ বেড়েছে। তাই আনতেই হল।'
চন্দ্রা আমার অনেক পুরনো রোগী। পাঁচ বছর আগে গর্ভাবস্থায় ওর শ্বাস কষ্টের খুব বাড়াবাড়ি হয়েছিল। তখন থেকেই আমাকে দেখায়।
চন্দ্রার দু'পা কোমরের নীচ থেকে অসাড়। বছর তিনেক আগে অটো উল্টে গিয়ে হয়েছে। চন্দ্রার স্বামী ওকে নিয়ে অনেক ছোটাছুটি করেছে। সাধ্যের বাইরে গিয়ে চিকিৎসা করতে চেয়েছে। একটি কেবল কোম্পানিতে সামান্য ইলেকট্রিশিয়ানের কাজ করা ছেলেটি পঙ্গু স্ত্রীকে নিয়ে ভেলোর পর্যন্ত দৌড়েছে। ধারদেনা করে অপরেশন করিয়েছে। লাভ কিছু হয়নি।
ওদের একটি ছোট্ট মেয়ে আছে। আগে যতবারই এসেছে সঙ্গে নিয়ে এসেছে। এবার করোনার ভয়ে সম্ভবত আনতে সাহস পায়নি। জিজ্ঞাসা করলাম, 'মেয়ে কেমন আছে?’
চন্দ্রা হাসিমুখে জানালো, 'ভালো আছে ডাক্তারবাবু। কিন্তু বড় দুরন্ত হয়েছে। সারাক্ষণ ছুটে বেড়ায়।' তারপর সামান্য চুপ থেকে বলল, 'আমি তো ওর পেছনে ছুটতে পারি না। ওর বাবা'ই যেটুকু সময় পায় ছোটে।'
চন্দ্রার বুকের মধ্যে সাঁই সাঁই শব্দ হচ্ছে। বললাম, 'তুমি কিন্তু বড্ড মোটা হয়ে যাচ্ছ।'
ও হাসতে হাসতে হাসতে বলল, 'সারাক্ষণ বসে বসে খাই। হুইলচেয়ারে ঘরের মধ্যে কত আর ঘুরবো? দিন না ডাক্তারবাবু রোগা হওয়ার একটা ওষুধ।'
বললাম, 'রোগা হওয়ার আবার ওষুধ হয় নাকি?'
'এত কঠিন কঠিন অসুখের ওষুধ হয়, আর রোগা হওয়ার ওষুধ নেই! নতুন ব্লাউজগুলো পর্যন্ত পরতে পারছি না। ছোট হয়ে যাচ্ছে। পুজোর সময় কি করব তাহলে? সাজবো কি করে?’
ওর বর গভীর ভাবে ওর দিকে তাকিয়ে বলল, 'চিন্তা নেই। আমি আবার নতুন বানিয়ে দেব।'
আমার চমৎকার লাগছিলো। মহামারির শেষ কবে হবে বলা মুশকিল। মহামারী শেষে কে থাকবে কে থাকবে না তাও বলা মুশকিল।
তবু মহামারীর মধ্যে আমরা বেঁচে রয়েছি। যাবতীয় মানবিক আবেগ নিয়েই বেঁচে রয়েছি। এই বেঁচে থাকার মুহূর্তগুলোই আমার মহামারীর স্মৃতি হয়ে রয়ে যাবে।
~~~~
করোনার দিনগুলি #৬০
ক্রমশ অবসাদ গ্রাস করছে। অবসাদ থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য অনেকদিনই টিভি দেখা, সংবাদ পত্র পড়া ছেড়ে দিয়েছি। তবু কিছু কিছু খবর এড়িয়ে যেতে পারিনা।
ডা. সুরেন্দ্র নাথ বেরার খবরটি যেমন। মাত্র ৩২ বছর বয়সেই স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞ এই ডাক্তারবাবু হেরে গেল করোনার কাছে। সে কাজ করতো মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজে।
খবরটা শোনার পর থেকে আর ছেলেটির ছবি দেখার পর থেকে কোনও কিছু ভালো লাগছে না। মেঘালয়ের তৃতীয় পর্ব লিখতে শুরু করেছিলাম, এক লাইনও লিখতে পারছি না। সারাদিন ধরে রোগী দেখার ফাঁকে ফাঁকে ভেসে উঠছে ছেলেটির মুখ।
সবচেয়ে খারাপ লাগছে, এতো চিকিৎসক আর স্বাস্থ্য কর্মী মারা যাচ্ছেন, তাঁদের জীবনদান পুরোপুরি ব্যর্থ হচ্ছে। তাঁদের মৃত্যুকে আমরা যথাযোগ্য সম্মান জানাতে পারতাম, যদি আমরা সকলে একযোগে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতির জন্য সোচ্চার হতে পারতাম। দরিদ্র আর প্রান্তিক মানুষদের জন্য আধুনিক চিকিৎসার দাবিতে সরব হতে পারতাম।
কিন্তু দুঃখজনক ভাবে আমাদের যাবতীয় আন্দোলনের অভিমুখ ঘুরে গেছে কর্পোরেট হাসপাতালে কেন এতো খরচ হবে সেই দিকে। বুদ্ধিজীবী অভিনেতা রাজনৈতিক স্বার্থে মানুষকে উস্কাচ্ছেন কর্পোরেট হাসপাতাল গুলি ভাঙচুর করার জন্য। অথচ কেউ প্রশ্ন করছে না কেন মহামারীর সময়ে সাধারণ মানুষকে ঘটি বাটি বেচে বেসরকারি চিকিৎসা পরিষেবার উপর নির্ভর করতে হবে।
করোনা কালের নিয়মে একসময় বিদায় নেবে। বেশ কিছু সাধারণ মানুষ ও চিকিৎসকের প্রাণের বিনিময়ে মহামারী থেমে যাবে। কিন্তু আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা পালটাবে না। বরঞ্চ স্বাস্থ্য ব্যবস্থা আরও বেশি ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। বিমা কোম্পানিগুলো ফুলে ফেঁপে উঠবে। প্রাথমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার হাল আরও খারাপের দিকে যাবে।
আর আমরা অসহায় চিকিৎসকেরা ডা. সুরেন্দ্র নাথ বেরার স্মৃতি বুকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকব। কর্ম জীবনের শুরুতেই নিজের পরিবারকে ভাসিয়ে চলে গেল ছেলেটা। ওর দুই শিশু সন্তানের আর কোনও দিন বাবা বলে কাউকে ডাকার সৌভাগ্য হবে না। যাদের একজনের বয়স পাঁচ। আর একজনের বয়স কয়েক মাস মাত্র। বাবাকে নিয়ে তাদের কোনও স্মৃতিই তৈরি হয়নি।
হয়তো সরকারি কমিটি খতিয়ে দেখবে ডা. বেরাকে কোভিড যোদ্ধার সম্মান দেয়া যায় কিনা? কোভিড যোদ্ধার সম্মান পাওয়া তার পক্ষে সম্ভব নাও হতে পারে। কারণ স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সরাসরি কোভিড রোগীদের চিকিৎসার সাথে যুক্ত থাকার কথাও নয়।
আর কিসেরই বা যোদ্ধা? আমরা যুদ্ধ শুরুর অনেক আগেই হেরে গেছি। রোগী দেখে কী হবে, তার কাছে যদি ওষুধ কেনার মতো অর্থই না থাকে? ওষুধ খাইয়েই বা কী হবে যদি তার দু'বেলার খাবার না জোটে? একদিকে দুধের শিশু অনলাইনে ক্লাস করছে, অন্যদিকে লকডাউনের সময় হাজার হাজার ছাত্র স্কুল ছুট হয়ে যাচ্ছে।
প্রতিদিন রোগী দেখা ক্রমশ একঘেয়ে হয়ে উঠছে। একদমই ভালো লাগছে না। কারণ জানি আমাদের সব কাজই অর্থহীন। জনস্বাস্থ্যের এই বিপর্যয়ের সময়েও মিডিয়াগুলি মেতে থাকবে কোন অভিনেতা, কোন অভিনেত্রী কী নেশা করেন তাই নিয়ে। এবং জনসাধারণও সেই আলোচনাতেই মশগুল থাকবে।
ডাঃ সুরেন্দ্র নাথ বেরার মৃত্যু কোথাও কোনও রেখাপাত করবে না। যেমন করেনি পরিযায়ী শ্রমিকদের মৃত্যুর খবর। কাজ হারানো মানুষের আত্মহত্যার খবর।
~~~~
করোনার দিনগুলি #৬১
মাস্ক
লোকজন করোনাকে যথেষ্ট ভয়ের চোখে দেখছেন। জ্বর, সর্দি-কাশির রোগীকে করোনা পরীক্ষা করতে বললেই জবাব দিচ্ছেন, 'আমার ওসব হয়নি ডাক্তারবাবু। পরশু বৃষ্টিতে ভিজেছিলাম, তারপরেই জ্বর এসেছে। বৃষ্টিতে ভিজলে যে সাধারণ জ্বর-জারি হয়, তাই হয়েছে।'
মুশকিল হলো- বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর, ফ্রিজের জল খেয়ে জ্বর, রৌদ্রে ঘেমে নেয়ে জ্বর, প্রায় সব ক্ষেত্রেই পরীক্ষা করলে করোনা ধরা পড়ছে।
আজ একজন রোগী এলেন রীতিমত হাঁপাচ্ছেন। বললাম, 'আপনার হাঁপানি রোগ ছিল নাকি?'
'হাঁপানি নয় ডাক্তারবাবু, আমার এজমা আছে।'
কথা বাড়ালাম না। বাঙালি রোগীদের মাথা ঘোরা রোগ থাকে না, ভার্টিগো রোগ থাকে। মাথা ব্যাথা বলে কোনও রোগ হয় না, সাইনাস বলে একটি রোগ হয়। এই সাইনাস জিনিসটি বেশ গণ্ডগোলের। রোগী দাবি করেন, ছোটবেলা থেকেই তাঁর একটি সাইনাস আছে।
প্রথমদিকে বোঝানোর চেষ্টা করতাম, সাইনাস আমাদের সকলেরই আছ। একটি নয়, একাধিক সাইনাস আছে। এখন আর বোঝানোর চেষ্টা করি না। যত বয়স বাড়ছে, তত হাল ছেড়ে দিচ্ছি।
ইদানিং লোকের ছুঁচিবাই নিয়েও বিশেষ প্রতিবাদ করি ন। স্যানিটাইজার নিয়ে লোকজনের বাড়াবাড়ি দেখার মতো। হাতে করে ছোট্ট একটা স্যানিটাইজার এর বোতল নিয়ে ঘুরছেন। যেখানে পারছেন দুফোঁটা স্যানিটাইজার ছড়িয়ে দিচ্ছেন। চেয়ারে বসার আগে কয়েক ফোঁটা স্যানিটাইজার ছড়িয়ে দিলেন। স্যানিটাইজার না তো- যেন গঙ্গার জল। দু- চার ফোঁটা ছড়িয়ে দিলে পুরো চেয়ারটাই পবিত্র হয়ে যাবে।
একমাত্র প্রতিবাদ করি কেউ যদি মাস্ক না পরেন, অথবা মাস্ক চিবুকে ঝুলিয়ে রাখেন। কারণ এটা নিশ্চিত ভাবে বুঝতে পারছি, করোনা ঠেকাতে মাস্কের বড়সড় ভূমিকা আছে। প্রতিদিন গড়ে কুড়ি- পঁচিশ জন করোনা রোগীর সংস্পর্শে আসছি। ডবল মাস্ক পরা ছাড়া আর বিশেষ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিই না। রোগী দেখার একটাই শর্ত, রোগী এবং বাড়ির লোককে মাস্ক পরতেই হবে। কাপড়ের মাস্ক হলেও আপত্তি নেই। কিন্তু রুমাল, শাড়ির আঁচল, ওড়না- এসব চলবে না।
তাই নিয়েও মাঝে মধ্যেই ঝামেলা লাগছে। কয়েকজন চির প্রতিবাদী মানুষ বলেছেন, 'স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, কিছু একটা দিয়ে মুখ ঢাকলেই হবে।'
আমি হাসিমুখে বলছি, 'যে যাই বলুক, মাস্ক ছাড়া আমি রোগী দেখব না।'
এই মাস্কের জোরেই আমাদের পরিবার এখনো টিকে আছ। বাড়িতে তিনজন চিকিৎসক, দুইজন নার্সিং স্টাফ। কিন্তু এখনো আমাদের বাড়িতে করোনা ঢুকতে পারেনি। হয়তো কিছুদিনের মধ্যেই ঢুকবে। কিন্তু এতদিন যে ঠেকিয়ে রাখা গেছে, সেটাও কম কি?
তবে অনেক মানুষেরই এই সচেতনতাটুকুও নেই। রাস্তাঘাটে অনেকের মুখেই মাস্ক নেই। থাকলেও গলা থেকে ঝুলছে। অনেককেই দেখছি মাস্ক সরিয়ে বারবার মুখে হাত দিচ্ছেন, নাক খুঁটছেন। এমনি সময় মাস্ক পরছেন, কিন্তু হাঁচি-কাশি দেওয়ার সময় মাস্ক নামিয়ে নিচ্ছেন।
চারদিকে কি বিপুল অপচয়। রাস্তাঘাট, বাড়ি- ঘর স্যানিটাইজেশনের নামে জল, অর্থ ও লোকবলের অপচয় হচ্ছে। মাঝে মধ্যে আকস্মিক লকডাউন করে করোনাকে কতদূর ঠেকানো যাবে, তা নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ আছে। বরঞ্চ স্বাভাবিক জীবনে যত দ্রুত সম্ভব ফেরার চেষ্টা করা উচিত। মানুষদের কিভাবে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে, সেটা প্রতিদিনই দেখতে পাচ্ছি। এই পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার একমাত্র হাতিয়ার হতে পারে মাস্ক।
একটা থ্রি লেয়ার মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করা গেলে মহামারী ছড়ানোর গতিকে আমরা অনেক শ্লথ করে দিতে পারব। কিন্তু সেটুকু করার বদলে বাদবাকি যাবতীয় কিছু করার চেষ্টা করা হচ্ছে। লোকজন করোনার ভয়ে স্বাস্থ্যকর্মীকে আবাসন ছাড়া করছেন। আর নিজে মাস্ক গলায় ঝুলিয়ে ভিড়ের মধ্যে চা- সিগারেট খাচ্ছেন।
“একটা থ্রি লেয়ার মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করা গেলে মহামারী ছড়ানোর গতিকে আমরা অনেক শ্লথ করে দিতে পারব।“
ওপারে যেমন এটি হয়নি, তেমন এপারেও এটি সর্বত্র হয়নি। অর্ধেক মানুষই মাস্ক ছাড়া দিব্যি ঘুরছে, কাজ-কর্ম করছে, গুলতানি মারছে। আর যারা মাস্ক পরছেন, তাদের অনেকেই আবার মাস্ক ঝুলিয়ে রেখেছেন চিবুকে। কাড়ি কাড়ি অর্থের গুচ্ছের অপচয়। মিডিয়ার হেনতেন প্রচারই সার।
কড়াকড়ি করে শুরু মাস্ক পরাটা বাধ্যতামূলক করা গেল না?
আর মাস্ক না পরার অজুহাতও কম নেই। কেউ বলেন, গরম লাগে। আবার কেউ বলেন, শ্বাস কষ্ট হয়। তবে জনপ্রিয় অজুহাত, আল্লা আছে না!
মাস্ক প্রসংগে এটি থাক। প্রথম থেকে সর্বত্র যদি এইটি বলত ~