রাত্রি দেড়টার সময় ফিমেল এক নম্বর ওয়ার্ড থেকে আয়া মাসি ডাকতে এল, “ডাক্তারবাবু চলেন, হেব্বি ঝামেলা লেগেছে।”
এত রাতে আর ঝামেলা টামেলা ভাল লাগেনা। আমি সারাদিন ঝামেলার মধ্যে পরে থাকা এই স্টেট জেনারেল হাসপালের একমাত্র ফিজিশিয়ান। নাইট ডিউটি করে অন্যদের মত বাড়ি ফিরে ঘুমাতে পারব না। চারখানা ওয়ার্ডে ভর্তি শতাধিক রোগীর রাউন্ড দিয়ে ফিরতে হবে। সবে ভাবছিলাম মাথাটা এমারজেন্সির টেবিলে ঠেকিয়ে একটু ঝিমিয়ে নেব।
আগে গোটা রাত্রি না ঘুমিয়েও দিব্যি পরেরদিন রাত্রি বারোটা অব্দি রোগী দেখতে পারতাম। আজকাল কেমন বিরক্তি লাগে। বয়স বাড়ছে মনে হয়।
মাসিকে জিজ্ঞাসা করলাম, “কিসের ঝামেলা?”
“এখুনি যে রোগীটা ভর্তি করলেন, ওর বর ঝামেলা করছে। পুরো গলা অব্দি গিলে আছে।”
পাশ থেকে ডাঃ অঞ্জন খান বড় একটা হাই তুলে বললেন, “যা ঐন্দ্রিল দেখে আয়। ভর্তির সময় ভালো করে কাউন্সিলিং করিসনি কেন?”
কাকে কাউন্সিলিং করব? মদের ঘোরে যে বার বার রোগীকে স্ট্রেচার থেকে নামিয়ে নিজেই স্ট্রেচারে শুতে চাইছে তাকে কি কোনরকম কাউন্সিলিং করা সম্ভব?
মাতাল লোকটির সঙ্গের রোগিণীটিও অদ্ভুত। কুড়ি থেকে ত্রিশ যে কোনও বয়সের অধিকারিণী শীর্ণ মহিলা। গ্রেড থ্রি ম্যালনিউট্রিশানে ভোগা চেহারা। ওজন ত্রিশ কেজিরও কম হবে। তিনি দাঁতে দাঁত লাগিয়ে মূর্ছা গেছেন।
এরকম মাতাল স্বামীর দূর্বল বউ হলে মূর্ছা যাওয়াই স্বাভাবিক।
আমি ডাঃ খানকে বললাম, “যান না স্যার, আপনি একটু কাউন্সিলিং করে আসেন। আপনি এত সিনিয়ার, এত অভিজ্ঞ। আপনার মুখ নিঃসৃত একটি বাণী শুনলেই মাতাল দাঁতাল যে হোক চুপ করে যাবে।”
ডাঃ খান বললেন, “বাজে বকিস নে ঐন্দ্রিল। বাষট্টি পেরিয়ে তেষট্টি হল। আমার এখন এক এবং একমাত্র লক্ষ পঁয়ষট্টি ক্রস করে এই হেলথ সার্ভিস থেকে পালানো। মাঝরাতে এসব ঝামেলার রোগী দেখলে কাউন্সিলিং তো দূরের কথা, গালি দিতে ইচ্ছে করে।”
অগত্যা আমিই গেলাম মেয়েদের ওয়ার্ডে। ভেতরে একজন তুলকালাম চিৎকার করছে। “এই সব চক্রান্ত, বিরোধী চক্রান্ত। অ্যাঁ, আমি কিছু বুঝিনা... তাইনা। সব পলিটিক্যাল খেলা, নোংরা পলিটিকস।”
সিস্টারদিদি আমায় দেখে বললেন, “দেখুন ডাক্তারবাবু, কি জিনিস ওয়ার্ডে পাঠিয়েছেন। গলা অব্দি গিলে ওভারলোড হয়ে আছে। সিকিউরিটির ছেলেটাকে ডাকলাম, সে বলছে একা ওকে বার করতে পারবে না। গতকাল কোন মাতাল ওকে কামড়ে দিয়েছে।”
আমি বললাম, “শুধু শুধু হাসপাতালের ওয়ার্ডে ঝামেলা করছেন কেন? কত খারাপ খারাপ রোগী ভর্তি আছে। তাদের যদি কিছু হয়, কে দায়ী থাকবে?”
“আপনিই দায়ী থাকবেন। শালা, ডাক্তার হয়েছ... অ্যাঁ... আমার রোগিকে একটা বিছানা দিতে পারে না, আবার দায় দায়িত্ব শেখাচ্ছিস। এই দ্যাখ, অ্যাঁ... এই দ্যাখ।”
বলে সে পকেট হাঁটকাতে আরম্ভ করল। খানিকক্ষণ বাদে একটা কাগজের টুকরো পকেট থেকে তুলে আমার হাতে দিল। বলল, “ভালো করে দ্যাখ, আমি কে। হ্যাঁ... ভালো করে দ্যাখ... তাহলেই ডাক্তারি পেছন দিয়ে ঢুকে যাবে।”
আমি ভালো করে কাগজটা দেখলাম। তারপর ওর হাতে ফেরত দিলাম। সে বলল, “কি বুঝলি... ”
“আজ্ঞে কিছুই বুঝলাম না। ওটা মদের স্লিপ।” মনে মনে ভাবলাম, উন্নতি কতদূর পৌঁছেছে, মদ কেনার সময়ও ক্যাশ মেমো দিচ্ছে! মুখে বললাম, “দ্যাখেন, এই ওয়ার্ডে আর জায়গা নেই। রোগীকে ডবল থাকতেই হবে। পঁচিশটা বেড। আর ভর্তি আছে আটত্রিশ জন। সহজ পাটীগণিতের হিসেব।”
“মিসটেক, মিসটেক... তাহলে এটা দ্যাখ।”
“আজ্ঞে, এটা সোদপুর থেকে শিয়ালদহের ট্রেনের টিকিট।”
“তাহলে আসল জিনিসটা কোথায় গেল। এবার সে পকেট টকেট হাতড়ে একটা কার্ড বের করে আমাকে দিল। “এটা দ্যাখ।”
দেখলুম। সরকারি স্বাস্থ্য সাথী কার্ড।
“হ্যাঁ... এই কার্ড আমাদের কে দিয়েছে জানিস। তারপরও তুই বলছিস আমার রোগী একটা গোটা বেড পাবে না। গরীব মানুষের জীবন নিয়ে খেলা করছিস। দাঁড়া, আমিও দেখে নেব তুই কি *লের ডাক্তার হয়েছিস।”
এবার মাথাটা বেশ গরম হয়ে যাচ্ছিল। সবে ভালো মত গুছিয়ে উত্তর দিতে যাচ্ছি, তার আগে একজন রোগিণীই বলতে আরম্ভ করল, “এই যে দাদা, অনেকক্ষণ করে বক বক করেছেন। আমাকে চিনতে পারছেন?”
মাতাল মহাশয়ের সাথে আমিও সেই রোগিণীর দিকে তাকালাম। চোখের তলায় গাঢ় কাজল, ঠোঁটে লিপিস্টিক। পোষাক আসাক দেখে মনে হচ্ছে কল্যাণী এক্সপ্রেস হাইওয়ের ধারে যে বার গুলো আছে, সেখানে কাজ করে। নতুন গজিয়ে ওঠা বার গুলির কল্যাণে এরকম রোগিণী আমরা মাঝে মাঝেই পাই।
মহিলাটি মাতাল মহাশয়কে বলল, “চিনতে পেরেছেন তো। রোজ আপনি আমাদের ওখানে বসেই মদ খান, তারপর যে মেয়েটির হাত ধরে টানাটানি করেন, আমিই সেই মেয়ে। আরও কি কি করেন, তাই নিয়ে আমার আর মুখ খোলাবেন না।”
অবাক হয়ে দেখলাম, মূর্ছা যাওয়া শীর্ণ মহিলা দিব্যি জ্ঞান ফিরে উঠে বসেছে। সেও চিৎকার শুরু করেছে, “অ্যাঁ, তুমি মদ খেয়ে মেয়েছেলেদের ধরে টানাটানি আরম্ভ কর? আরও কি সব কর? এসব শোনার আগে আমার মরণ হলনা কেন?”
আর মাতাল লোকটি কেন্নোর মতো গুটিয়ে ওয়ার্ড ছেড়ে বেড়িয়ে যাচ্ছে।
আমিও এমারজেন্সিতে ফেরত এলাম। দেখলাম, একটা মোটর সাইকেল এক্সিডেন্ট এসেছে। দুই জন সওয়ারিই গুরুতর আহত। একজনের পায়ের ফিবিউলা ভেঙে বেড়িয়ে এসেছে। অন্যজনের মাথার অর্ধেকের চুল সমেত চামড়া উল্টে খুলি বেড়িয়ে গেছে। কিন্তু অমৃত রসের প্রভাবে তারা সব রকম ব্যথা বেদনার উর্ধে। ডাঃ খানকে তারা বারবার বলছে, “ডাক্তারবাবু, ভয় পাবেন না, ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আপনি একা বয়স্ক মানুষ। খাটনিটা একটু বেশী পড়ে গেল। তাড়াতাডি সেলাই মেরে দিন। একটু এদিক ওদিক হলেও অসুবিধা নেই। জুড়লেই হবে। আহ... আপনার তো পুরো মাখনের মত হাত, বুঝতেই পারলাম না।”
আমিও হাত লাগালাম। সেলাই যখন প্রায় শেষের পথে, ফিমেল এক নম্বর ওয়ার্ড থেকে আবার কলবুক। একজন স্ট্রোকের রোগীর অবস্থা খারাপ, খিঁচুনি আরম্ভ হয়েছে।
রোগীর প্রায় শেষ অবস্থা। খিঁচুনি বন্ধ করার জন্য ওষুধ পত্র দিলাম। সিস্টার দিদিকে বললাম, “বাড়ির লোককে ফোন করুন।”
দিদি বললেন, “করেছিলাম, কিন্তু দুটো মোবাইল-ই সুইচ অফ। মোবাইল বন্ধ করে বাড়ির লোকজন সুখে ঘুমাচ্ছে।”
আমি বললাম, “কিন্তু সকাল পর্যন্ত এই রোগী কি আর থাকবে?”
দিদি বললেন, “কিছু করার নেই। এত রাতে কি করে খবর দেব। সকালে ডায়েটের ছেলেটা এলে ওকে পাঠাতে পারি।”
আমি বললাম, “তাহলে তাই করুন। আগের পেশেন্ট কোথায়... ঐ যাকে নিয়ে ঝামেলা হল।”
সিস্টার দিদি একটা বেড দেখালেন। বললেন, “ঐ বেডেই ডবল করে দিয়ে দিয়েছি। ভালো আছে। আর ঝামেলা করেনি।”
অবাক হয়ে দেখলুম, একটা বেডে মাতাল ভদ্রলোকের স্ত্রী আর বারে কাজ করা মেয়েটি, দুই জনে প্রায় গলা জড়াজড়ি করে ঘুমাচ্ছে।