বেশ নাক ডেকে ঘুমচ্ছিলাম। হঠাৎ মফিজুলদার তীক্ষ্ণ আর কর্কশ আওয়াজে উঠে বসলাম, “স্যার... লায়বাবু আপনাকে ডাকতিসে।”
এই মাঝরাত্তিরে আবার কি এমন এমারজেন্সি ঘটল যে সঞ্জীবদা আমাকে ডাকাডাকি শুরু করল?
কোয়ার্টার আর হাসপাতালের মধ্যে বিশাল দীঘি। দীঘির চারদিক ঘন ঝোপে ঢাকা আর সাপে ভর্তি। এ অঞ্চলের সাপখোপের বৈচিত্র্যও দেখার মত। আল-কেউটে, কালাচ, শাঁখামুটি, খরিস ইত্যাদি হেমাটোটক্সিক আর নিউরোটক্সিক সব ধরণের বিষাক্ত সাপই এখানে দেখা যায়। এছাড়াও হেলে, ঢোড়া, লাউডগা, ঘরচিতি, পুয়ে, মেটেলি, ঢ্যামনা এইসব নির্বিষ সাপেদের কথাতো বলেই শেষ করা যাবে না। রাত্রে কোয়ার্টার থেকে হাসপাতাল গেলে তাই পাঁচ ব্যাটারির টর্চ মাস্ট।
মহিলাদের ওয়ার্ডে ঢুকে দেখি ডাঃ সঞ্জীব রায় বসে বসেই দরদর করে ঘামছে। এই গরমেও তার গলায় একটা মাফলার জড়ানো।
শীত হোক, গরম হোক অথবা বর্ষা সঞ্জীবদা সবসময় গলায় মাফলার জড়িয়ে রাখে। তার মতে শুধু নেতা আর অভিনেতারা নয়, ডাক্তাররাও পাবলিক ফিগার। তাই প্রত্যেক ডাক্তারের স্বতন্ত্র স্টাইল থাকা উচিৎ। এবং এটাই ঐ ডাক্তারবাবুকে অন্যদের চেয়ে আলাদা আর বিখ্যাত করে তুলবে। সঞ্জীবদা মাফলার জড়িয়ে কতটা বিখ্যাত হয়েছিল জানিনা, কিন্তু গ্রামের অনেক মানুষই হাসপাতালে এসে মাফলার ডাক্তারবাবুর খোঁজ করত।
সঞ্জীবদা আমাকে দেখেই বলল, “ঐন্দ্রিল, আমার এই খড়গ্রাম হাসপাতালে তিনবছর হয়ে গেল। কোনদিন এরকম কেস দেখিনি।”
বললাম, “কি কেস দাদা?”
“নিজেই লেবার রুমে ঢুকে দেখ।”
লেবার রুমের দরজার সামনে বেশ কয়েকজন রোগিণী এবং রোগিণীর বাড়ির লোক উঁকিঝুঁকি মারছে। ধমক দিয়ে তাদের সরালাম। লেবার রুমের একটি টেবিলে একজন মা শুয়ে রয়েছে। তার রক্ত মাখা জামা কাপড় আর সদ্য আলাদা হওয়া প্লাসেণ্টা দেখে বুঝলাম একটু আগেই বাচ্চা হয়েছে।
এবার ওয়ার্মারটার দিকে তাকালাম এবং সাথে সাথে ধাক্কা খেলাম। এটা মানুষের বাচ্চা? মাথাটা অস্বাভাবিক রকমের বড়।অথচ দেহ দেখে বোঝা যাচ্ছে প্রি টার্ম বাচ্চা। সময়ের অনেক আগে হয়েছে। মেরুদণ্ডের শেষ প্রান্তে দেহের তুলনায় বেশ বড় সাইজের টিউমার। এই টিউমারকে মেনিঙ্গোসিল বলে। তার উপর কোমরের নীচ থেকে পা দুটির গঠন সম্পূর্ণ হয়নি। শুধু দুপাশে দুটো গুটলি মত, তাতে কয়েকটি আঙুলের অস্তিত্ব বোঝা যাচ্ছে।
সঞ্জীবদা পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। বলল, “ঐন্দ্রিল, তেত্রিশ সপ্তাহের প্রেগনেন্সি। বেশ প্রি ম্যাচিওর। এটাই প্রথম বাচ্চা। আগে আলট্রাসোনোগ্রাফি, রক্ত পরীক্ষা কিছুই করা নেই। একবারই মাত্র হেলথ সেন্টারে গেছিল জননী সুরক্ষা যোজনার কার্ড করতে। আর ও মুখো হয়নি। বাচ্চাটা প্রিটার্ম হলেও আর নানা রকম কনজেনিটাল অ্যানোমালি থাকলেও কিন্তু জন্মের পর সুন্দর কেঁদেছে। মেকোনিয়াম পাস করেছে। গায়ের রঙ দিব্যি গোলাপী।”
আমি বললাম, “এই বাচ্চা গ্রামীণ হাসপাতালে রেখে কী করবে। কান্দিতে রেফার করে দাও।”
“বাড়ির লোককে কান্দি নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছি। কিন্তু ওরা নিয়ে যাবে না।
বাচ্চাটির বাবার বক্তব্য এই সন্তান জোর করে বাঁচিয়ে কোনও লাভ নেই। ও কোনও দিনই সুস্থ জীবন পাবে না। তার থেকে এ বাচ্চা মরে যাওয়াই ভাল। ওরা তো বাচ্চা হাসপাতালে রেখেই মাকে নিয়ে চলে যাবে বলছিল। কোনও রকমে আটকেছি।”
আমি বললাম, “তাহলে আর কি। এখানেই থাকুক বাচ্চা। বাড়ির লোককে ভালো করে বুঝিয়ে সই করিয়ে রাখো। তারপর যা হওয়ার হবে।”
কিন্তু যা হ’ল তাকে খুব ভাল বলা যায় না । পরের দিন আমার ২৪ ঘণ্টা অনকল ডিউটি। সকাল সাড়ে সাতটার সময় হাসপাতালে ঢুকতে গিয়ে দেখি প্রায় সমস্ত গ্রামের লোক জড় হয়েছে হাসপাতালের সামনে। আশেপাশের গ্রাম থেকেও ভ্যানে করে, হেঁটে অনেক লোক এসেছে। সবাই বাচ্চাটাকে একবার চোখের দেখা দেখতে চায়। যারা ইতিমধ্যে দেখার সুযোগ পেয়েছে তারা অন্যদের কাছে গল্প করছে। এবং তাদের গল্পের গরু মাঝে মাঝেই গাছে উঠে যাচ্ছে। একজন বলছে, ‘দেখে এলুম রাক্ষস বাচ্চাটা জন্মানোর পর পরেই হামা দিতে শুরু করেছে।’
আরেকজন বলছে, ‘রাক্ষসটা ঘন্টায় ঘণ্টায় লম্বায় বাড়ছে। জন্মের পরে যা দৈর্ঘ্য ছিল ইতিমধ্যে তার দ্বিগুণ হয়ে গেছে।’
যারা এতক্ষণেও বাচ্চাটার দর্শন পায়নি তারা অধৈর্য হয়ে উঠেছে। সবাই দল বেঁধে হাসপাতালের ওয়ার্ডে ঢোকার চেষ্টা করছে।
আমি চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করলাম। ওয়ার্ড ফাঁকা করতে চাইলাম। লোকজনকে বোঝাতে চাইলাম এটা মোটেই রাক্ষস নয়। এটা প্রকৃতির একটি ছোট্ট ভুল। বাচ্চা জরায়ুর মধ্যে বৃদ্ধির সময় অনেকগুলি পর্যায়ের মধ্যে দিয়ে যায়। তবে সে স্বাভাবিক মানুষের আকৃতি পায়। এক্ষেত্রে কোনও ভাবে বাচ্চাটি শুধু আকারেই বেড়েছে। কিন্তু তার কিছু কিছু অঙ্গের গঠন আগের পর্যায়ে আটকে আছে।
কিন্তু গ্রামের লোককে সহজে কোনও কিছু বোঝানো যায়না। বিশেষ করে মুর্শিদাবাদ আর বীরভূমের ঠিক সীমানায় অবস্থিত এই গ্রামের এবং এর আশে পাশের গ্রামের অধিকাংশ মানুষ কোনও দিন স্কুল মুখো হয়নি। কুসংস্কার আর অন্ধবিশ্বাসের ঘাঁটি এই গ্রামগুলি। এসব অঞ্চলে বিনোদনের কোনও কিছু নেই। চাষের সময়টুকু পেরিয়ে গেলে লোকজনের করারও কিছু নেই। হাতে অফুরন্ত সময়। অদ্ভুত দর্শন বাচ্চাটি তাদের একঘেয়ে জীবনে কিছুটা বৈচিত্র্য এনেছে।
লোকজনের কথা বার্তা শুনে বাচ্চাটির মা’ও মনে হয় বিশ্বাস করতে শুরু করেছে মানুষের বাচ্চার রূপ ধরে কোনও জিন বা রাক্ষস তার গর্ভে এসেছে। সেও ভয়ার্ত দৃষ্টিতে মাঝে মাঝে বাচ্চাটিকে দেখছে। সেই দৃষ্টিতে অপত্য স্নেহের কোনও চিহ্ন নেই। কিছুতেই সে বাচ্চাটিকে কোলে নেবে না, বুকের দুধও খাওয়াবে না। যদিও খাবার দাবার ছাড়াই বাচ্চাটি দিব্যি রয়েছে। নিঃশ্বাস প্রশ্বাস স্বাভাবিক। রিফ্লেক্স বেশ সন্তোষ জনক।
একটা নবজাতককে তো চোখের সামনে কিছু না খেয়ে তিল তিল করে মরতে দেখা সম্ভব নয়। অতএব শিশুটির হাতে ছুঁচ পড়িয়ে গ্লুকোজ ড্রিপ শুরু করলাম।
সারাদিন চলে গেল হই হট্টগোলের মধ্যে। রাত্রে রাউন্ডের সময় অবাক হয়ে গেলাম। বাচ্চাটি তার মায়ের কোলে। কম বয়সে মা হওয়া মেয়েটি শিশুটিকে তার বুকের দুধ খাওয়ানোর চেষ্টা করছে। আমি মনে মনে হাসলাম। এটা হওয়া অবশ্যম্ভাবী ছিল। নাড়ির টান সবচেয়ে জোড়ালো টান। সেই টানের কাছে সন্তানের রূপ গুণ সব তুচ্ছ হয়ে যায়।
বাচ্চাটির গ্লুকোজ ড্রিপ বন্ধ করে দিলাম। শিশু সত্যিকারের অমৃতের স্বাদ পেয়েছে। তার আর নকল খাবারের দরকার নেই।
মাকে বললাম, “কাল সকালে ছুটি করে দেব। এ বাচ্চার চিকিৎসা এ হাসপাতালে সম্ভব না। এমনকি কান্দি বা বহরমপুরেও সম্ভব নয়। এ বাচ্চাকে বাঁচাতে গেলে কলকাতা যেতে হবে।”
বাচ্চাটির বাবাও ছিল। সে বলল, “কোথাও যাব না ডাক্তারবাবু। ও বাচ্চা মরবেই। এটা আমরা সকলে মেনে নিয়েছি। ওর বয়স কম। এরপর একটা সুস্থ্য স্বাভাবিক বাচ্চা হলেই ও সব দুঃখ ভুলে যাবে।”
তারপর প্রায় পাঁচমাস চলে গেছে। ভুলেই গেছিলাম সবকিছু। এক রাত্রে আবার হইচই। “ডাক্তারবাবু, শিগগিরি আমার ছেলেটাকে দেখুন…”
সেই বাচ্চাটা। আগের চেয়ে স্বাস্থ্য অনেক ভালো। যদিও মাথাটা আরও বড় হয়েছে। পিঠের টিউমারটাও আকারে বেড়েছে। বাচ্চাটা বাবার কোলে নিশ্চল, নিথর শুয়ে আছে। স্টেথো বসালাম। বুক নিঃশব্দ। হৃদপিণ্ডের কোনও শব্দ নেই। চোখে আলো ফেললাম। তারারন্ধ্র প্রসারিত হয়ে আছে। আলোতেও সংকুচিত হল না। বললাম, “বাচ্চাটির শরীরে প্রাণের কোনও লক্ষণ পাওয়া যাচ্ছে না।”
সাথে সাথে বাচ্চাটির বাবা হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। বলল, “আপনি ভালো করে দেখুন ডাক্তারবাবু। আপনার নিশ্চয়ই ভুল হচ্ছে। একবার অন্তত চেষ্টা করুন। এইতো খানিকক্ষণ আগেও কাঁদছিল।কাঁদতে কাদতেই ঘুমিয়ে পড়ল। সন্দেহ হওয়ায় নেড়েচেড়ে দেখি কিছুতেই জাগছে না।”
বাচ্চাটির মা আছাড়ি পিছাড়ি কাঁদছে। আমি ব্যর্থ হব জেনেও কিছুক্ষণ কার্ডিও পালমোনারি রিসাসিটেশনের চেষ্টা চালালাম। তারপর বাচ্চাটির বাবকে বললাম, “কোনও লাভ নেই। বাচ্চাটি মারা গেছে।”
কিছুক্ষণ বুকফাটা কান্না শুনলাম। কি সান্ত্বনা দেব। সন্তান হারা বাবা মাকে সান্ত্বনা জানানোর পদ্ধতি আমার জানা নেই। মনে হচ্ছে বাচ্চাটি ‘সাডেন ইনফ্যান্ট ডেথ সিনড্রোমে’ এ মারা গেছে। এক বছরের নীচে বাচ্চাদের ঘুমের মধ্যে এরকম মৃত্যু হয়। যার কোনও কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু সেসব তত্ত্বকথা শোনার মত মানসিক অবস্থা কারও নেই।
কাঁদতে কাঁদতে বাচ্চাটির বাবা বলল, “ছেলেটা বাঁচবেই যখন না, তখন জন্মের পর পর মরে গেল না কেন? আমাদের এত মায়ায় জড়িয়ে দিয়ে গেল কেন? ওকে নিয়ে দুবার এনআরএস হাসপাতালে গেছি। দুবারই বলেছে আর একটু বড় হোক। এখন কিছু করা যাবে না। সামনের সপ্তাহে আবার যাব ভেবেছিলাম। ওহ্, এতোগুলো দিনের এত স্মৃতি, কি করে ভুলব ডাক্তারবাবু।”
বাবা মায়ের হাহাকার শুনতে শুনতে আমি একটা সত্যি অনুভব করলাম। পাশাপাশি, কাছাকাছি কাটানো সময়ের নামই আসলে ভালোবাসা। ঐ সব প্রথম দর্শনেই প্রেম-ট্রেম আসলে ফালতু কথা। একসময় তারা এই বিকলাঙ্গ শিশুর মৃত্যু কামনা করেছিল। একসাথে থাকতে থাকতে সেই ঘৃণা যে কবে ভালোবাসায় পরিণত হয়েছে তা তারা নিজেরাই বোঝেনি।
সেকারণেই চারবছর পর যেদিন খড়গ্রাম হাসপাতাল ছেড়ে চিরকালের মত চলে আসছি, সেদিন হাসপাতালের এবং গ্রামের লোকদের জন্য তো বটেই, এমন কি আমার ভাঙাচোরা, সাপখোপে পরিপূর্ণ কোয়ার্টারটার জন্যও চোখে জল এসেছিল। যদিও চারবছর আগে চাকরি পাওয়ার পর আমি প্রতিটি দিনই চেয়েছি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এম ডি এনট্রান্সে সুযোগ পেয়ে এই গণ্ডগ্রাম থেকে পালাতে।