বৈশাখ মাস হলেও যেন গরম কাল নয়। আজ ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মধ্যে রাত নটা নাগাদ যখন বাড়ি ফিরলাম, স্কুটার চালাতে বেশ ঠাণ্ডাই লাগছিল।
অনেকদিন বৃষ্টিতে ভিজি না। ভিজতে সাহস পাই না। এমনিতেই ঠাণ্ডার ধাত। হাঁচি শুরু হলে আর থামতে চায়না। তার উপর মাস্ক পরে থাকায় সারাক্ষণ নাক সুড়সুড় করে। রোগীদের সামনে হেঁচে ফেললে দেখতে হবে না। পরের দিনই রটে যাবে, ডাক্তারবাবু করোনা আক্রান্ত। সেই ভয়ে প্রতিদিনই প্রায় অ্যালার্জির ওষুধ খাচ্ছি।
এই মধ্যমগ্রামও যেন আগের শহর নয়। আজ বৃষ্টি হওয়ায় রাস্তা পুরো শুনশান। চৌমাথা থেকে বাড়ি ফেরার সময়ে একটাও গাড়ি চোখে পড়ল না। ওভারব্রিজের মাঝামাঝি প্রতিদিনই দাঁড়াই। প্লাটফর্মের প্রত্যেকটা সিগন্যাল লাল হয়ে আছে। এই সময় যে হাজার হাজার লোক স্টেশনে ভিড় করে থাকত, আপ ট্রেন একগাদা ক্লান্ত লোককে কলকাতা থেকে বয়ে এনে প্লাটফর্মে উগড়ে দিত, তারা কোথায় গেল? তারা আর আদৌ কোনও দিন প্লাটফর্মে ভিড় করবে তো?
সবকিছু বদলে গেছে, ভেবেছিলাম হাসপাতালও বদলে গেছে। অনেকদিন হাসপাতাল ভাঙচুরের খবর নেই, ডাক্তারের মাথা ফাটছে না। বিষ্ঠা মাখতে হচ্ছে না। স্বাস্থ্য কর্মীদের কয়েক জায়গায় পাড়া ছাড়া করা হয়েছে, মাঝ রাতে সিস্টারকে ভাড়া বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু অসংখ্য মানুষ সেই সব ঘটনার সমালোচনা করে স্বাস্থ্য কর্মীদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন।
ভেবেছিলাম ডাক্তার নিয়ে মানুষের মনে যে মোটা দাগের বিভাজন আছে, হয় অগ্নীশ্বর নয় চামার, লক ডাউনের সময়ে সেই ধারণার পরিবর্তন ঘটবে। এর মাঝামাঝিও যে বিশাল সংখ্যক চিকিৎসক শ্রেণী আছেন, যারা আর পাঁচটা লোকের মতোই সাধারণ মানুষ, কিন্তু তেমন পরিস্থিতিতে সাধারণত্ব পেরিয়ে গিয়ে অনেক বড় কাজ করে ফেলতে পারেন, তাদের সাথে সকলের পরিচয় হবে।
কিন্তু বাড়ি ফিরে বুঝলাম কিছুই বদলাবে না। হোয়াটস অ্যাপে চিকিৎসক বন্ধুদের পাঠানো সাগর দত্ত হাসপাতালে ভাঙচুরের ছবি দেখলাম। কোভিড সাসপেক্ট এক রোগীর মৃত্যুর পর তাঁর স্বঘোষিত বাড়ির লোকেরা এমারজেন্সিতে মনের সুখে ভাঙচুর করেছেন। প্রাণভয়ে অন্য রোগীরা ওয়ার্ড ছেড়ে পালিয়েছেন। যে আইসোলেশন ওয়ার্ডে পিপিই ছাড়া ঢুকলে চৌদ্দ দিনের কোয়ারান্টাইনে থাকার কথা সেখানেও তাণ্ডব চালিয়ে আবার তাঁরা ভিড়ে মিশে গেছেন।
বেশ করেছেন। ভালোই করেছেন। চিকিৎসকদের নিশ্চয়ই গাফিলতি ছিল। ডাক্তাররা নিশ্চিত রোগীকে না দেখে হোয়াটস অ্যাপে ব্যস্ত ছিল। ওহ, ভুলে গেছি আইসোলেশন ওয়ার্ডে তো আবার মোবাইল নিয়ে ঢোকা যায় না। যাই হোক হোয়াটস অ্যাপ না হলেও নিশ্চয়ই রোগীকে না দেখে ল্যাবরেটরি থেকে পাওয়া কমিশনের টাকা হিসাব করছিল।
যে কারণেই ডাক্তার পেটান, আপনারা ভালই করেছেন। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন কারো মানসিকতা একটুও বদলায়নি। সতর্কতার খোলস ভেঙে অনেক চিকিৎসকই একটু একটু বেরোতে চাইছিলেন। তাঁরা আবার খোলসে ঢুকে যাবেন।
এদেশে রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে কোনো দরিদ্র শ্রমিকের মৃত্যু হয়না। এ রাজ্যে সরকারি উদ্যোগে মৃত্যুর কারণ বদলানো হয় না। এদেশে লক ডাউনের সময় দিনের পর দিন ছোট্ট শিশুরা খিদেতে কাঁদে না। এদেশে স্বাস্থ্য খাতের ব্যয় কমতে কমতে প্রায় অদৃশ্য হয়ে যায় না।
আর যদি এর কোনোটা হয়ও তাঁর জন্য একমাত্র দায়ী স্বাস্থ্য কর্মীরা। যত পারেন ওদের পেটান। ওরা নিজেদের বড্ড বেশি হিরো ভাবছিল। সাবাশ, ডাক্তার পেটানো আপনারাই এই লক ডাউনের সময় প্রকৃত হিরো। নিশ্চিন্তে থাকুন, অতীতের মতোই আপনাদের কারো বিশেষ কোনো শাস্তি হবে না। সে যতই প্যানডেমিক আইন চালু থাকুক না কেন। কিচ্ছু বদলায় নি। সব কিছু একই আছে। লকডাউনে আগের মতো নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য আরও একবার ধন্যবাদ।
এই কাণ্ড এপারে হলে একটুও অবাক হতাম না।
করোনা রাক্ষুসি অনেক সংহার করছে, আবার অনেক শিক্ষাও দিয়ে যাচ্ছে।
"'কিচ্ছু বদলায় নি। সব কিছু একই আছে।" - এইটা সবচেয়ে মর্মান্তিক।