টাকা থাকলেই বড়লোক হওয়া যায় না। বড়লোক হওয়ার জন্য বড়ো হৃদয়ও দরকার। এমনকি টাকা পয়সার অভাব থাকা স্বত্বেও শুধু হৃদয়ের জোড়েও বড়লোক কম দেখলাম না, এই অতিমারির সময়ে।
যদিও আমার দেখার দুনিয়াটা খুব ছোট্ট। আমি একজন খুপরিজীবী চিকিৎসক। সাত সকাল থেকে রাত দুপুর অবধি স্কুটারে চড়ে খুপরিতে খুপরিতে ঘুরে ঘুরে রোগী দেখে বেড়াই।
প্রাকৃতিক শোভা, গাছ পালা, পশু পাখি এসব আর দেখা হয়ে ওঠেনা। সারাদিন ধরে মানুষ দেখি। সুস্থ মানুষও নয়। অসুস্থ মানুষ। রোগের কারণে যাদের বেশিরভাগেরই মন মেজাজ খারাপ। তবু তার মধ্যেই কতো গল্প জন্ম নেয়। সময়ের অভাবে সেসব লেখা হয়ে ওঠেনা। কতো গল্প হারিয়ে যায় চিরকালের মতো।
আজ যেমন, বাড়ির চেম্বারে শেষ রোগী দেখে মাস্কের আড়ালে বড়ো একটা শ্বাস ফেললাম। বাড়িতে সংগ্রাম শেষ। বারান্দায় বেরিয়ে দেখি, এক স্বামী- স্ত্রী তাদের ছোট্ট বাচ্চাকে নিয়ে বসে আছে।
বললাম, এতো দেরী করে এসেছেন কেন? কটা বাজে? এর পরেও আমার একটা চেম্বার আছে। সেখানে পৌঁছাতে দেরী হয়ে যাবে। তাছাড়া এটুকু বাচ্চাকে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন কেন? এখানে রোজ গাদা গাদা জ্বরের রোগী আসছে।
স্বামীটি বলল, ডাক্তাররবাবু, আমরা দেখাতে আসিনি। আপনাকে ভিজিট দিতে এসেছি?
আমি অবাক হয়ে বললাম, মানে? না দেখিয়েই শুধুশুধু ভিজিট দেবেন কেন?
স্বামীটি বলল, লকডাউনের মধ্যে বউয়ের ভীষণ পেটে ব্যথা হয়েছিল। আমি জোগাড়ের কাজ করি। সেসময় কাজ ছিলনা। আপনাকে দেখিয়েছিলাম। কিন্তু টাকা দিতে পারিনি। আজ সাতদিনের টাকা একসাথে পেয়েছি। প্রথমেই আপনার কাছে এসেছি। এরপর বাজারে গিয়ে মাছ কিনব, তেল কিনব। আর ছেলেকে বেলুন কিনে দেব।
আমি নিতে চাইনা, ওরা জোরাজুরি করে। আমি অবাক হয়ে ওদের চোখে খুশি দেখি। কে বলেছে ওরা গরীব? এই দীর্ঘ লকডাউন, এই অতিমারি ওদের মারতে পারেনি, এমনকি ওদের জীবনের ছোটোছোটো খুশি গুলোও কাড়তে পারেনি। পারবেও না।
একটি পনেরো বছরের ছেলেকে দেখছিলাম। জ্বর, সর্দি, কাশি। ওষুধপত্র লিখে রোগীর বাবাকে বললাম, কালকেই করোনার জন্য পরীক্ষা করিয়ে নিন। সরকারি হাসপাতালে এখনতো বিনা পয়সায় পরীক্ষা হচ্ছে।
ছেলেটির বাবা বলল, কাল ওর জন্মদিন। কি যে সময় এলো। জন্মদিনের সকাল হাসপাতালে লাইন দিয়ে কাটবে। তারপর একটা পাঁচশ টাকার নোট বার করে আমাকে দিল।
আমি ভিজিট রেখে বাকি টাকা ফেরত দিচ্ছিলাম, ছেলেটির বাবা বলল, ডাক্তারবাবু, দয়া করে টাকাটা রেখে দিন। সবার তো দেওয়ার ক্ষমতা নেই। আমার ছোট্ট একটা মুদির দোকান আছে। লকডাউনে লোকজনের অবস্থা নিজের চোখে দেখেছি। তেমন কয়েকজনকে যদি পয়সা না নিয়ে দেখে দেন। ক্ষমতা থাকলে আরও দিতাম।
আমি কিছুতেই নেব না। আর ছেলেটির বাবা দুহাত জোর করে দাঁড়িয়ে আছে। বলছে, আমি গরীব ডাক্তারবাবু, কিন্তু আমারও তো কিছু করতে ইচ্ছে করে।
গরীব? কে গরীব? যে তার সীমিত সাধ্য নিয়েও এই অকালে অন্যের পাশে দাঁড়াতে চাইছে? নাকি গরীব তারা, যারা এই মহামারীর সময়েও সুযোগের সদ্ব্যবহার করে কোটি কোটি টাকা ব্যাংক ব্যালেন্স বাড়াচ্ছে?
আমরা যখন কয়েকজন বন্ধু মিলে টাকা তুলে লকডাউনের সময় ক্লাবের পক্ষ থেকে একটা রিলিফ ফান্ড শুরু করেছিলাম, তখন ভাবতেও পারিনি এতো মানুষ পাশে এসে দাঁড়াবে। শুধু অর্থ নয়; চাল, ডাল, তেল ইত্যাদি দিয়েও আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে চেনা অচেনা বহু মানুষ। মেডিক্যাল ক্যাম্পগুলির জন্য না চাইতেই অর্থ সাহায্য পেয়েছি। কেউ আমাদের কাছে হিসেব দেখতে চায়নি। আমাদের বিশ্বাস করে দিয়েছে।
আর এই বিশ্বাসটুকুই মহামারীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রধান অস্ত্র হয়ে উঠবে। ভাইরাসের বিরুদ্ধে এই লড়াইয়ে আমরা জিতবই শুধু নয়, আমরা ইতিমধ্যেই অনেকটা লড়াই জিতে গেছি।
চোখ এ জল এলো