করোনার দিনগুলি ১৭
মহামারী ও খিদে
এই ক্ষুদ্র তুচ্ছ চিকিৎসক জীবনে আমি যে একটা প্যানডেমিক দেখে যেতে পারব, এবং সেই প্যানডেমিকের সময়েও কাজ করতে পারব, স্বপ্নেও ভাবিনি। যদি মহামারী শেষে বেঁচে থাকি, তাহলে এই সময়টা সারাজীবনের এক অমূল্য অভিজ্ঞতা হয়ে থেকে যাবে।
আজ আমার প্রথম পোস্টিং খড়গ্রাম হাসপাতালের গল্প শোনাতে ইচ্ছে করছে। ২০০৮ সালে খড়গ্রাম হাসপাতালে যখন যোগ দি, তখন বার্ড ফ্লুর সিজিন চলছে। এবং সেবারের মুরগীদের বার্ড ফ্লু পশ্চিমবঙ্গে প্রথম ধরা পড়েছিল এই খড়গ্রামেই। সকালে যখন কালিং টিমের সদস্যরা পিপিই পরে মুরগী মারতে যেত, তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে ওষুধ খাওয়াতাম। ফেরার পরে আবার স্বাস্থ্য পরীক্ষা।
সে সময় বয়স কম ছিল। কোনও দিনও সিরিয়াস ভাবে ভেবে দেখিনি এই বার্ড ফ্লু মানুষের ছড়িয়ে পরলে কি হতে পারে। উল্টে তখনও আমার রান্নার দিদির পোষা হাঁস গুলোকে আদর করেছি, খাওয়া শেষ করে তাদের নিজের থালাতেই খেতে দিয়েছি। আসলে মহামারী সম্পর্কে কোনও ধারণাই তখনও ছিল না।
মহামারী যে কি বুঝলাম কয়েকদিন পরে। খড়গ্রাম ব্লকে শনিগ্রাম বলে একটি গ্রাম আছে। তার পাশেই আর একটি গ্রাম। কয়েকঘর আদিবাসী মানুষ বসবাস করেন। খবর এলো সেখানে এনকেফালাইটিসের মতো একটি রোগে পরপর ছয়জন মারা গেছেন।
এসিএমওএইচ এর নির্দেশে সেখানে হেলথ ক্যাম্প করতে যেতে হবে। জ্বরের রোগী থাকলে তাদের তথ্য আনতে হবে। আউটডোর শেষ করে কিছু ওষুধপত্র নিয়ে সরকারি জীপে রওনা দিলাম। প্রফুল্লদা জীপ চালাচ্ছে।
জীপটা অন্তত পঞ্চাশ বছরের পুরনো। চললে যা ঝাঁকুনি হয়, বয়স্ক লোকের ভার্টিব্রাল ডিসলোকেশান হয়ে যাবে। কিন্তু গ্রামের রাস্তায় চলার ক্ষেত্রে খুব কার্যকরী। নদী বাঁধের উপর দিয়ে গর্তে ভরা রাস্তায় এই গাড়ি ছাড়া গতি নেই।
অবশেষে দ্বারকা নদীর বাঁধের উপর এক নির্জন স্থানে প্রফুল্লদা জীপ থামাল। বলল, ‘এবার নদী ধরে হেঁটে যেতে হবে।’
ওষুধের বাক্স প্রফুল্লদার মাথায়। আমার কাঁধের ব্যাগে টুকটাক ডাক্তারি পরীক্ষার জিনিস পত্র। বেশ কিছুক্ষণ শুকনো নদীখাত ধরে হাঁটার পরে অন্যপারে এলাম। আরও কিছুক্ষণ হেঁটে গ্রামে পৌঁছলাম।
পরপর কয়েকটা মাটির বাড়ি। একটাই বাড়িরই শুধু ইটের দেওয়াল, এসবেস্টসের চাল। কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল কিছু একটা গণ্ডগোল হয়েছে।
প্রফুল্লদা ওষুধের বাক্স একটা বটগাছের গোড়ায় নামিয়ে রাখল। তারপর বাড়িগুলোতে একটু উঁকি ঝুঁকি মারল। ফিরে এসে বলল, ডাক্তারবাবু, সবাই রোগের ভয়ে পালিয়েছে।
সেই খাঁ খাঁ ভৌতিক গ্রামের মধ্যে দাঁড়িয়ে বুঝেছিলাম, মহামারী ঠিক কি জিনিস। আণুবীক্ষণিক জীবের সামনে মানুষ কতটা অসহায়। জীবন বাঁচানোর জন্য ঘরদোর ছেড়ে, জমির শস্যের মায়া ত্যাগ করে মানুষ স্বেচ্ছায় দেশান্তরি হয়।
সেই প্রথম মহামারীকে ভয় পেতে শিখলাম।
খড়গ্রামে চাকরিতে জয়েনিং এর প্রথম দিনেই আরও একটা জিনিসকে চিনেছিলাম। সেটা হল খিদে। চিনিয়েছিল একজন সিনিয়র দাদা। যার বদলি হয়ে আমি ওখানে গেছিলাম।
খড়গ্রাম মুর্শিদাবাদের কান্দি মহকুমার একটি গ্রাম। এখানে প্রতি বছর বন্যা হত। বলা ভাল বন্যা করা হত। ম্যাসাঞ্জোর থেকে জল ছাড়লেই শঙ্করপুর, সাদল এই সব অঞ্চলে দ্বারকা নদীর বাঁধ কেটে দেওয়া হত। কারা কাটত? যাদের বন্যা হলে লাভ হয়। যাদের হাত দিয়ে বন্যা ত্রাণের টাকাটা খরচ হয়। বন্যা বন্ধের জন্য ‘কান্দি অ্যাকশন প্লান’ কার্যকরী হওয়ার পর এখন আর বন্যা বিশেষ হয় না।
এই ঘটনাটা আমি আগেও শুনিয়েছি। সেই সিনিয়র দাদার জবানবন্দীতেই আরেকবার শোনাই।
“সাত সকালে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বিএমওএইচ জানাল সাদলে মেডিক্যাল ক্যাম্প করতে হবে। ওদিকে হেব্বি বন্যা হয়েছে। গ্রাম জলের তলায়। বাঁধের উপর সব লোকজন আশ্রয় নিয়েছে।
কিছুটা পথ প্রফুল্লদার জিপে গিয়ে আমি নৌকায় উঠলাম। প্রফুল্লদা দেখি নৌকাতে সারি সারি বোতল ভর্তি সাদা ফিনাইল তুলছে।
‘কি ব্যাপার প্রফুল্লদা, এত ফিনাইল নিয়ে কি হবে?’
‘আজ্ঞে স্যার, বিএমওএইচ ম্যাডাম বললেন প্রচুর ফিনাইল পরে রয়েছে, নিয়ে যেতে।’
আসলেই আমাদের হাসপাতালে অফুরন্ত ফিনাইল। জেলাতে ওষুধ চাইলে ওষুধ পাওয়া যাচ্ছে না, রেবিস ভ্যাকসিন যা দরকার মিলছে তার দশ ভাগের একভাগ। কিন্তু না চাইতেই ফিনাইল পাওয়া যাছে। কানাঘুষোয় শোনা যাচ্ছে ‘মানকচু’ নাকি বত্রিশ কোটি টাকার(!) ফিনাইল কিনেছে।
যাই হোক প্রচুর পরিমাণে ফিনাইল আর অল্প পরিমাণে সেপট্রান আর প্যারাসিটামল ট্যাবলেট নিয়ে ঘণ্টা দুয়েক বাদে বাঁধের কাছাকাছি পৌঁছলাম। সেখানে তখন অগুনতি মানুষের ভিড়।
নৌকা কাছাকাছি আসতেই চিৎকার শুনলাম, ‘ওরে হাসপাতাল থেকে বাচ্চাদের দুধ পাঠিয়েছে রে...’
কিছু লোক জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং মুহূর্তের মধ্যে ফিনাইলের বোতল গুলি লুঠ হয়ে গেল।
আমি তখন পাগলের মত নৌকায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করছি, ‘ওগুলো দুধ না। ওগুলো ফিনাইল। কেউ খেও না।’
সাথে সাথে খিস্তির বন্যা বয়ে গেল...’ তিনদিন ধরে বাচ্চাগুলোর পেটে এক ফোঁটা দুধ পড়েনি। আর তুই শালা বো+++ ফিনাইল নিয়ে ++ মারতে এসেছিস।’
এরপর দাদাটি আমাকে বলল, ‘সত্যি বলছি ঐন্দ্রিল, আমার নিজেকে তখন ওই গালাগালির যোগ্য বলেই মনে হচ্ছিল। পেট ফোলা, কাঠি কাঠি হাত পায়ের বাচ্চা গুলোর সামনে সেপট্রান আর প্যারাসিটামল হাতে নিজেকে সার্কাসের ক্লাউন মনে হচ্ছিল। যদি তুই কখনও বন্যাতে যাস নিজের পয়সায় এক দু বস্তা মুড়ি কিনে নিয়ে যাস। প্যারাসিটামল ট্যাবলেট না দিয়ে বরঞ্চ বাচ্চাগুলোকে একমুঠো করে মুড়ি দিস।'
করোনার দিনগুলি ১৮
হতভাগ্য মাতাল
আমার এক স্কুলের বন্ধুর আজ হেব্বি আনন্দ হয়েছিল। তবে বর্তমানে কি অবস্থায় আছে জানিনা।
বেচারা লক ডাউনের পর থেকেই মুচড়ে পড়েছিল আর মাঝে মাঝেই মুখ্যমন্ত্রীকে গালাগালি করছিল। সেদিনও গলা ব্যথা নিয়ে দেখাতে এসে মুখ্যমন্ত্রীর নামে একগাদা অভিযোগ জানিয়ে গেল। আমি বললাম, ‘এই ব্যাটা, তোকে তো তৃণমূলের লোক বলে জানতাম। মুখ্যমন্ত্রীর উপর রেগে গেলি কেন?’
ও বলল, ‘পিসির সরকার ক্রমশ পি সি সরকার হয়ে উঠছে। মরা মানুষকে বাঁচিয়ে তুলছে। এটা সরকার চলছে, না ম্যাজিক শো।’
বললাম, ‘বাবারে..., তুই তো দেখছি জমির দালালি ছেড়ে দেশ ও দশের জন্য হেব্বি চিন্তা ভাবনা করতে শুরু করেছিস। কি দিনকাল পড়ল!!’
বন্ধু বলল, ‘আচ্ছা ঐন্দ্রিল, তোর কাছে স্টকে কিছু আছে নাকি?’
আমি বললাম, ‘কি?’
তার স্ত্রী সঙ্গে এসেছিল। সে বন্ধুকে জোর ধমক লাগাল। ‘লজ্জা করেনা তোমার, ছি ছি, ডাক্তার দেখাতে এসে মালের খোঁজ করছ। দাদা, আপনি কিছু মনে করবেন না।’
আমি বললাম, ‘মনে করার প্রশ্নই নেই। কারণ আমি এখনও বিষয়টা বুঝতে পারিনি।’
বন্ধু বলল, ‘ন্যাকা। সব বুঝেও না বোঝার ভান করছিস। তোর কাছে মদের বোতল আছে? বিয়ার, হুইস্কি, রাম, জিন যা হোক? লক ডাউনের ঠেলায় গত সাতদিন ধরে এক ফোঁটাও মদ জোগাড় করতে পারিনি। এই দ্যাখ, হাত পা কাঁপছে। চোখে চার রাত্রি ঘুম নেই। তোদেরকে তো শুনি অনেক দিয়ে যায়।’
আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘কে দিয়ে যায়?’
‘আরে ওই যে, ব্যাগ নিয়ে চুপি চুপি তোদের সাথে দ্যাখা করেনা... ওই যে রে ওষুধ কোম্পানির লোকগুলো...’
‘মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ?’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, ওরাই। ওরা তো শুনেছি তোদের চাল, ডাল, আলু, গাড়ি, ফ্রিজ, মদের বোতল সব কিছু দিয়ে যায়।’
আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘কোথা থেকে শুনলি?’
‘কেন প্রধানমন্ত্রীই তো বলেছেন। ওই যে লন্ডনে গিয়ে ভরা সভায় বক্তব্য রাখলেন, ওষুধের কোম্পানিগুলো ডাক্তারদের বিদেশে বেড়াতে নিয়ে যায়। এমনকি মেয়ে ছেলে পর্যন্ত দেয়।’
বন্ধুর বউ ধমকে উঠল, ‘তুমি থামবে। মদ না খেয়েই মাতলামি করছ। নিজে তো অষ্টপ্রহর ঘরে শুয়ে বসে কাটাচ্ছ। চা দাও, চা দাও করে অস্থির করে দিচ্ছ। আর যাঁরা এই মহামারীর সময়ে নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমাদের আগলে রেখেছেন, তাদের নিন্দা করছ! নরকেও তোমার স্থান হবে না।’
বন্ধুটি বলল, ‘আহা আমি নিজের কথা বলেছি নাকি। এতো প্রধানমন্ত্রী বলেছেন। নরকে গেলে প্রধানমন্ত্রী যাবেন, আমি কেন যাব। ঐন্দ্রিল যদি আমাকে একটা নীপ খাওয়ায় তাহলে খোলা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমি ডাক্তারদের প্রশংসা করব আর প্রধানমন্ত্রীকে গালি দেব।’
আমি বললাম, ‘তোকে কিছু করতে হবে না ভাই। কারণ আমি তোকে মদ খাওয়াতে পারব না।’
বন্ধুর বউ বলল, ‘আপনি কিছু মনে করবেন না। বিয়ের পর থেকেই কি জ্বালায় যে জ্বলছি। এই প্রথম আশার আলো দেখছি। ও সাতদিন মদ না খেয়ে আছে। স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি, লক ডাউনটা যদি আর কটা দিন বাড়ায় তাহলে হয়তো মদের অভাবে ও মদ ছেড়ে দেবে।’
বন্ধু বলল, ‘হ্যাঁ ছেড়ে দেব, এবার শিওর ছেড়ে দেব। ঐন্দ্রিল, তোর স্যানিটাইজারের বোতল থেকে দু ফোঁটা আমার হাতে দে।’
আমি ওর হাতে ঢেলে দিলাম। ও ভালো করে শুঁকে বলল, ‘আহা, গন্ধেই অর্ধেক ভোজন। চলি।’
আজ রাত্রে রোগী দেখে বাড়ি ফিরে স্নান টান সেরে ফেসবুক খুললাম। এবং ফেসবুক খুলে চমকে গেলাম। সেই বন্ধু যে কিনা স্কুলে রচনা কোনোদিন একশ শব্দের বেশি লেখেনি, সে প্রায় পাঁচশো শব্দের এক সাংঘাতিক স্ট্যাটাস নামিয়েছে। তার পোষ্টে সে পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়েছে মদের সরবরাহ আবার শুরু করার জন্য। তাতে চার ঘণ্টায় চারশোরও বেশি লাইক। দেড়শ মন্তব্য। আমি দেখে শুনে ঘেঁটে গিয়ে একটা মন্তব্য করেছিলাম, ‘ ইয়ে... এটা কি ঠিক হল। মদ কে কি অতি আবশ্যকীয় পণ্য বলা যায়?’
বন্ধু মন্তব্যের উত্তর দিয়েছে, ‘তুমিও তো বাবা মিষ্টির দোকান খোলার পর অনেক হেজিয়ে দেড়পাতা জোড়া পোষ্ট নামিয়েছিলে। যার যাতে নেশা হয়। নিজের বেলায় আঁটি শুঁটি, পরের বেলায় চিমটি কাটি।’
আহা, আহা, এটা লেখার পর জানতে পারলাম, খবরটা ফেক। সম্ভবত এরকম একটা অর্ডার হয়েছিল। আবার প্রত্যাহার হয়েছে। এখন যদি একবার বন্ধুর মুখটা দেখতে পারতাম।
করোনার দিনগুলি ১৯
ভবিষ্যতের গল্প
বরুণ বাবু গোছানো মানুষ। তিনি চাকরি জীবনের শুরু থেকেই অবসর পরবর্তী জীবনের কথা ভেবেছেন। তিনি জানতেন, যা পেনশন পাবেন, তাতে খাওয়া দাওয়ার বিশেষ অসুবিধা হবে না। সমস্যা হতে পারে বড়সড় অসুখে পড়লে।
বরুণ বাবু জানতেন, সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা হয় না। অতএব বেসরকারি হাসপাতালই ভরসা। কিন্তু বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার খরচ পেনশনের টাকায় চালানো মুশকিল। তাই তিনি বহু বছর ধরে একটা মোটা অঙ্কের মেডিক্লেম করে রেখেছেন।
বরুণ বাবু কোনো দিনও সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থার অবনতি নিয়ে চিন্তা করেননি। নিজের দুই ছেলেকেই বেসরকারি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়িয়েছেন। তার দুই ছেলেই নামকরা প্রাইভেট কলেজ থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে ইংল্যান্ডে ভালো চাকরি করে। তিনি ছেলেদের পিছনে যা অর্থ লগ্নি করেছিলেন, এখন একজনই একবছরে তার চেয়ে বেশি আয় করে।
বরুণ বাবু কোনও দিন সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়েও মাথা ঘামান নি। কমতে কমতে সরকারি স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ জি ডি পির এক শতাংশে নেমে এসেছে। তিনি তাই নিয়ে গলা ফাটান নি। তিনি জানতেন সরকারি হাসপাতালে যায় গরীবেরা, যাদের অন্য কোথাও যাওয়ার মতো অর্থ নেই। তার কাছে অর্থ আছে, বিশাল অঙ্কের মেডিক্লেম আছে। অতএব তিনি বা তাঁর স্ত্রী অসুস্থ হলে বাইপাসের ধারে পাঁচতারা কর্পোরেট হাসপাতালে ভর্তি হবেন।
বরুণ বাবু একটু স্বার্থপরের মতো বাঁচছিলেন। তাঁর জগতটা ছিল দশ শতাংশ মানুষের ভারতবর্ষ। বাকি নব্বই শতাংশ ভারতবাসীকে নিয়ে তাঁর মাথা ব্যথা ছিল না।
কিন্তু একটা অসুখ বরুণ বাবুর জীবনকে দেখার দৃষ্টি ভঙ্গি সম্পূর্ণ পাল্টে দিল।
তাহলে সব কিছু খুলেই বলা যাক। ইংল্যান্ডে যখন করোনা ধরা পড়ল, তাঁর দুই ছেলেই রাতারাতি দেশে ফিরে এলো। বড় ছেলে তার বিদেশী বৌ কেও নিয়ে এসেছে। এর আগেও বরুণ বাবু ও তাঁর স্ত্রী রেখা দেবী বহুবার তাদের ছেলেদের দেশে ফিরতে বলেছেন। কিন্তু দুজনের কেউই পাত্তা দেয়নি। আজ ঠেলায় পরে তারা দেশে ফেরায় বরুণ বাবুর মনের মধ্যে একটু খচ খচ করছিল। কিন্তু তাঁর স্ত্রী আন্তরিক ভাবে খুশি হলেন। তিনি দুবেলা ভাল মন্দ রান্না করে দুই পুত্র ও পুত্রবধূকে খাওয়াতে লাগলেন।
বড় পুত্রের সামান্য জ্বর আসছিল। তাঁর কাছে গল্প শুনলেন কিভাবে প্লেনে জ্বর আসার পরে তড়ি ঘড়ি প্যারসিটামল খেয়ে জ্বর কমিয়ে সে এয়ারপোর্টের থার্মাল চেকিং ব্যবস্থাকে ফাঁকি দিয়েছে। রেখা দেবী সেই গল্প শুনে ছেলের বুদ্ধির প্রশংসা করলেন। বরুণ বাবুও প্রশংসা করলেন। কিন্তু তাঁর মনের মধ্যে খচখচানি কমছিল না।
তারপর লক ডাউন হয়ে গেল। তাতে বরুণ বাবুদের খুব বেশি অসুবিধা হচ্ছিল না। তাঁরা ভালই ছিলেন। কোথায় শ্রমিকরা বাড়ি ফেরার জন্য বাচ্চাদের কাঁধে বসিয়ে আড়াইশো কিলোমিটার হাঁটছে, কোথায় মুটে-মজুরদের একবেলাও ভাত জুটছে না, সেই নিয়ে তাঁদের কোন মাথা ব্যথা ছিল না। বস্তিবাসীদের খাবার বিতরণের জন্য এলাকার কয়েকটি ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো যুবক সাহায্য চাইতে এসেছিল। বরুণ বাবু তাদের খালি হাতেই বিদায় জানালেন।
কিন্তু তাদের সুখ দীর্ঘস্থায়ী হল না। সাতদিনের মাথায় বরুণ বাবু ও তাঁর স্ত্রী জ্বরে পড়লেন। গলা ব্যথা, সারারাত কাশি আর তীব্র জ্বর। পরের দিন বরুণ বাবু ডাক্তার দেখানোর জন্য বিভিন্ন বড় নার্সিং হোমে ফোন করলেন। সব জায়গাতেই একই উত্তর, ‘এই মুহূর্তে আউট ডোর বন্ধ আছে। আপনি অন্য কোথাও দেখিয়ে নিন।’
পাড়াতেই একজন ডাক্তার সাত ফুট বাই সাত ফুট খুপরিতে দুবেলা চেম্বার করেন। একশ টাকা ভিজিট। বরুণ বাবু যাতায়াতের পথে দেখেছেন। পাড়ার বিভিন্ন বাড়ির কাজের লোক, রান্নার মাসি, রিক্সাওয়ালা, ভ্যনওয়ালা, দিন আনা দিন খাওয়া মানুষেরা ঐ ডাক্তারবাবুকে দেখাতে যায়। উপায়ন্তর না দেখে বরুণ বাবু আর রেখা দেবী তাঁর কাছেই গেলেন।
ডাক্তার বাবু গম্ভীর মুখে সব শুনলেন, এমনকি প্যারাসিটামল খেয়ে বড় ছেলের থার্মাল স্ক্যানারকে ফাঁকি দেওয়ার গল্প পর্যন্ত। তিনি বললেন, ‘আপনার ছেলে অত্যন্ত গর্হিত কাজ করেছে। আপনি আজই বেলেঘাটা আই ডি হাসপাতালে যোগাযোগ করুন।’
বরুণ বাবু বললেন, ‘কিন্তু ডাক্তারবাবু, সরকারি হাসপাতালে যাব? ওখানে চিকিৎসা হবে?’
ডাক্তারবাবু বললেন, ‘ওখানেই চিকিৎসা হবে। ঐ পাঁচতারা বেসরকারি হাসপাতাল গুলো যারা খুলেছেন, তাঁরা কেউ সাধারণ মানুষ চিকিৎসা পাবে বলে খোলেননি, ব্যবসার জন্য খুলেছেন। তাঁরা যে দৃষ্টি ভঙ্গি নিয়ে মদের ব্যবসা করেন, সেই একই দৃষ্টি ভঙ্গি নিয়ে হাসপাতাল চালান। মদের দোকানের ম্যানেজার আর নার্সিং হোমের ডাক্তার দুটোই ওনাদের কাছে এক। আজ এই মহামারীর সময়ে যখন মানুষের সবচেয়ে বেশি হাসপাতাল দরকার তখন বেশীরভাগ কর্পোরেট হাসপাতালই রোগী ভর্তি বন্ধ করে দিয়েছে। কারণ তারা বুঝতে পারছে এসময়ে ব্যবসা করাটা দুঃসাধ্য।’
আই ডি হাসপাতালে ঘণ্টা খানেক বেশ দুর্ভোগের পর বরুণ বাবু আর রেখা দেবী দুজনেই ভর্তি হয়ে গেলেন। রেখা দেবীর ততক্ষণে শ্বাস কষ্ট শুরু হয়েছে। দুজনেরই থ্রোট সোয়াব আর রক্ত পরীক্ষা হল। দুজনেই জানতে পারলেন তাদের করোনা রোগ ধরা পরেছে। ভাইরাসের উৎস তাঁদেরই ছেলে, যে রোগ লুকিয়ে নিজের বাবা মা সহ অনেককেই মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে।
বরুণ বাবু আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠলেন। কিন্তু রেখা দেবীর নানা রকম সমস্যা দেখা যাচ্ছিল। ওনার শ্বাস কষ্ট আস্তে আস্তে বাড়ছিল। তবে চিকিৎসকরা বারবার অভয় দিয়েছেন, ভয়ের কিছু নেই। তাঁর স্ত্রী সুস্থ হয়ে যাবেন।
বরুণ বাবু এই প্রথম কোনও সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এখানে সব কিছুই তিনি নতুন চোখে দেখছিলেন। এখানে চিকিৎসক- সিস্টাররা রেনকোট পরে ডিউটি করেন। রেনকোট পরে এই গরমের মধ্যে দর দর করে ঘামেন। তিনি শুনলেন এক মহিলা চিকিৎসক তাঁর সাত মাসের বাচ্চাকে ছেড়ে বারো দিন ধরে হাসপাতালে পরে আছেন। ডিউটি শেষ করার পরও তিনি বাড়ি ফিরতে পারবেন না। চৌদ্দ দিন কোয়ারান্টাইনে থাকতে হবে।
বরুণ বাবু অন্য রোগীদের গল্প শুনলেন। কমবয়সীরা নিজেরাই বিদেশ থেকে রোগ নিয়ে ফিরেছে। বয়স্কদের বেশিরভাগেরই একই গল্প। সুপুত্র বিদেশ থেকে রোগ লুকিয়ে এনেছে, এবং বাবা-মাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে।
অবশেষে দুজনেই রোগ মুক্ত হয়ে হাসপাতাল থেকে ছুটি পেলেন। একদিন লক ডাউন উঠে গেল। আস্তে আস্তে পৃথিবীও স্বাভাবিক হল। কিন্তু সেই পৃথিবী আগের মতো হল না।
বরুণ বাবুর দুই ছেলেই আবার বিদেশে ফিরে গেছে। কিন্তু তাতে বরুণ বাবু বা রেখা দেবীর খুব দুঃখ নেই। তাদের চারপাশকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ বদলে গেছে।
মহামারী উত্তর পৃথিবীতে মানুষ সকলের জন্য স্বাস্থ্যের দাবীতে সরব হয়েছে। সরকারি স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ বাড়ানোর জন্য দিকে দিকে আন্দোলন হচ্ছে। সেই সব মিছিলে শ্রমজীবী মানুষের সাথে পা মিলিয়ে বরুণ বাবু আর রেখা দেবীকে প্রায়ই হাঁটতে দেখা যায়।
করোনার দিনগুলি ২০
আজ সবচেয়ে বেশি সংখ্যক প্যানিক এটাকের রোগী দেখলাম। গতকাল ১০ নম্বর ওয়ার্ড কে পুরোপুরি আইসোলেটেড করার পর মধ্যমগ্রামের মানুষের মধ্যে ভীতি আরও বেড়েছে।
অদ্ভুত ভাবে প্যানিক এটাকের বেশির ভাগ রোগীই কম বয়সী ছেলে মেয়ে। কারো বুকে চাপ ব্যথা, বুক ধড়ফড়ানি। কারো গলা বুজে আসছে, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।
অনেক রোগীই রোগীদের জন্য নির্ধারিত চেয়ারে বসতে চাইছেন না। তাদের বসার জন্য জোর করছি না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই দেখে দিচ্ছি। দুয়েক জন রোগী বলেই ফেললেন, ‘ডাক্তার বাবু, দূর থেকেই দেখুন। ছোঁয়ার দরকার নেই।'
কয়েকজন রোগীর দাবি তাদের সবসময়ই জ্বর আসছে। কিন্তু বাড়ির থার্মোমিটার খারাপ থাকায় তাপমাত্রা ৯৮ ডিগ্রী ফারেনহাইটের বেশি দেখাচ্ছে না।
এর মধ্যেই এক অবাঙালি পরিবার এলেন। এরা মাঝে মাঝেই আসেন। স্বামী গেঞ্জি কারখানায় কাজ করেন। স্ত্রীর গ্রেড থ্রি ম্যালনিউট্রিশানে ভোগা চেহারা। আঠাশ বছর বয়েসে ওজনও আঠাশ কেজি। দীর্ঘদিন ধরে অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসে ভোগায় অমন চেহারা হয়েছে।
ওনারা সঙ্গে চার বছরের মেয়েকেও নিয়ে এসেছেন। আমি বললাম, 'একে নিয়ে এসেছেন কেন?'
পুরুষটি বললেন, 'কার কাছে রেখে আসব ডাক্তারবাবু?'
তারপর তিনি তাঁদের দুঃখের সাত কাহন শোনালেন। গেঞ্জি কারখানার মালিক গত মাসের অর্ধেক বেতন দিয়েছেন। তাতে অবশ্য পুরুষটি বিশেষ দোষ দেখেন না। মালিকেরও আর্থিক অবস্থা খুব ভালো নয়। তার উপর চৈত্র সেলের সময় ব্যবসা ভালো হবে ভেবে ধার দেনা করে অনেক কাঁচামাল তুলেছিলেন।
মহিলা ভালো বাংলা জানেন না। তিনি এক জগাখিচুড়ি ভাষায় জানালেন গত দুই সপ্তাহ ইনসুলিন বন্ধ। এখন শরীর অত্যন্ত দুর্বল। হাঁটতে গেলে মাথা ঘুরে পরে যাচ্ছেন।
গ্লুকোমিটারের গোটা দুই স্ট্রিপ অবশিষ্ট ছিল। তাই দিয়ে সুগার মাপলাম। পাঁচশো বত্রিশ। বললাম, 'ইনসুলিন না নিলে তুমি শিওর মারা পড়বে।'
ছোট্ট মেয়েটা মায়ের বাহু ধরে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। আমার ছোটো মেয়ের বয়সী। এর আগে যতবারই এরা এসেছে বাচ্চাটাকে আদর করেছি। এমনই পরিস্থিতি ছোটো মেয়েটাকে আদর করাও সম্ভব নয়।
দীর্ঘদিন মানুষের অসহায়তা দেখতে দেখতে আমার অনুভূতি গুলো ভোঁতা হয়ে গেছে। সেই আমিও বাচ্চা মেয়েটার মুখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না।
পুরুষটি বললেন, 'ডাক্তারসাব, পনেরো তারিখে লকডাউন উঠলেই বাড়ি ফিরব। হাতে টাকা পয়সা নেই। খাওয়া জুটছে না। বাড়িওয়ালা বাড়ি থেকে বের করে দেবে বলেছে। তার আগে যমুনাকে খাড়া করে দিন।'
একজন সহৃদয় মানুষের সাহায্যে এক ভায়াল ইনসুলিনের ব্যবস্থা হলো। কিন্তু মহিলা যে ডোজে ইনসুলিন নেন, তাতে খুব বেশি দিন চলবে না।
তাতেই তাঁরা খুব খুশি। বারবার ধন্যবাদ জানিয়ে বললেন, যদি আচ্ছে দিন সত্যিই আসে, তাহলে আবার দেখা হবে। তখনও আমরা কেউই জানিনা লকডাউন ৩০ শে এপ্রিল পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।
যেতে যেতে মহিলাটি আবার ফিরে এলেন। আমায় অবাক করে ছেঁড়া চটের ব্যাগ থেকে একটা নতুন হেলথ ড্রিংকস এর কৌটো বার করলেন। যেটার বিজ্ঞাপনে দাবি করা হয় এটা খেলে বাচ্চার তিনগুণ বেশি বুদ্ধি ও শক্তি হবে।
মহিলা তাঁর বিচিত্র ভাষায় জিজ্ঞাসা করলেন, 'যদি এটা রোজ দু-চামচ করে মেয়েকে খাওয়াই, তাহলে মেয়ের এই মহামারীতে কিছু হবে নাতো।'
আমি গালাগালি দিতে গিয়ে থমকে গেলাম। কাকে গালি দেব? সর্বস্ব দিয়ে সন্তানকে আগলে রাখতে চাওয়া ওই অশিক্ষিত মা-কে?
এ কদিনে বহু উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তিও বহুবার জানতে চেয়েছে এই মহামারীর সময়ে কোন হেলথ ড্রিংকস, প্রোটিন পাউডার বা মাল্টি ভিটামিন খেলে ইমিউনিটি বাড়তে পারে।
তাঁদের বহু বোঝানোর চেষ্টা করেছি, 'ওই সব ছাই পাঁশ খেয়ে ইমিউনিটি বাড়ে না। বরঞ্চ ধূমপান ছাড়ুন, দু’বেলা একটু শরীর চর্চা করুন। তাতে অনেক উপকার হবে।'
তাঁদের মুখ দেখে বুঝেছি কেউই আমার কথায় সন্তুষ্ট হননি। ডাক্তারের কথা কেউ বিশ্বাস করেন না।
করোনার দিনগুলি ২১
মধ্যমগ্রামের পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে বুঝতে পারছি না। সম্ভবত খুব ভালো দিকে যাচ্ছে না।
দিকে দিকে রাস্তা বন্ধ । নববারাকপুরে যাওয়ার দুটো ব্রিজই বাঁশ দিয়ে ব্লক করা।
কি হচ্ছে, কেন হচ্ছে কিছুই জানতে পারছি না। চারিদিকে শুধু গুজব। চিকিৎসক হয়েও আমার এলাকা সম্পর্কে একেবারে অন্ধকারে। সারাদিন জ্বরের রোগী দেখছি। কাকে সন্দেহ করব, কাকে করব না – বুঝতেও পারছি না।
আরেক সমস্যায় পড়েছি। দলে দলে রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস আর 'এস এল ই'র রোগীরা প্রেসক্রিপশন নিয়ে আসছেন। তাদের অতি প্রয়োজনীয় ওষুধ হাইড্রক্সি ক্লোরোকুইন বাজার থেকে উধাও।
বিভিন্ন মিডিয়া কোভিড-১৯ এর প্রতিরোধে হাইড্রক্সি ক্লোরোকুইনের ভূমিকা নিয়ে সবিস্তারে আলোচনা করেছে। তারপর থেকে ওষুধটি মুড়ি মুড়কির মতো বিক্রি হয়েছে। আমি এমন রোগীও পেয়েছি যিনি করোনা থেকে বাঁচার জন্য হাইড্রক্সি ক্লোরোকুইনের ৪০০ মিলিগ্রামের ট্যাবলেট দশদিন ধরে রোজ দুটো করে খাচ্ছেন। করোনা তার দেহে কোনো রকমে ঢুকলেও, বেচারা ভাইরাস বড্ড লজ্জায় পড়বে।
তবে তার পরেও ওষুধটি পাওয়া যাচ্ছিল। কফিনে শেষ পেরেক পুঁতেছেন ট্রাম্প সাহেব। ভারতের কাছ থেকে হুমকি সহ ওষুধটি চাওয়ার পর, অবশিষ্ট ওষুধও রাতারাতি বাজার থেকে হাওয়া হয়ে গেছে।
সাধারণ মানুষ ভেবেছেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট যে ওষুধের জন্য তর্জন গর্জন করছেন, তাতে নিশ্চয়ই সঞ্জীবনী শক্তি আছে। ফলে অনেকেই প্রাথমিক দ্বন্দ্ব কাটিয়ে উৎসাহের সাথে হাইড্রক্সি ক্লোরোকুইন খেতে শুরু করেছেন।
ওদিকে কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত রোগীদের হাইড্রক্সি ক্লোরোকুইনের প্রয়োগের ফলাফল বিশেষ সন্তোষজনক নয় বলে কয়েক জায়গা থেকে রিপোর্ট আসছে। তবে এদেশের মানুষ ডাক্তারের বক্তব্যের চাইতে মিডিয়ার বক্তব্যকে বেশি বিশ্বাস করেন। এবং তার চেয়েও বেশি বিশ্বাস করেন আমেরিকার প্রেসিডেন্টের বক্তব্যকে। ফলে 'এস এল ই' রোগীদের আপাতত ম্যালেরিয়ার ওষুধই খাওয়াতে হচ্ছে।
এদিকে অন্যান্য ওষুধ পত্রের যোগানও বিশেষ ভালো নয়। সকাল থেকে অন্তত একশো ফোন পেলাম, ‘ডাক্তার বাবু, এই ওষুধটা পাচ্ছি না। একটা বিকল্প বলুন।' লকডাউন আরো দীর্ঘায়িত হলে এবার ওষুধের জন্য হাহাকার শুরু হবে।
তবে অন্যান্য হাহাকার ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। অধিকাংশ মানুষের রোজগার বন্ধ। কর্ম চ্যুত হওয়ার ভয়, খাদ্যের জন্য হাহাকার। অত্যধিক উদ্বেগ এবং হতাশায় অনেকেই মানসিক ভারসাম্য হারাচ্ছেন।
লকডাউন বাড়তে থাকলে এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। লকডাউনের সময় কমানোর জন্য দরকার ছিল প্রথম অবস্থায় রোগ নির্ণয় করা এবং তাদের আইসোলেটেড করা। কিন্তু এখনো রোগীদের অবস্থা খুব খারাপ না হলে অথবা তাদের করোনা রোগীর সংস্পর্শে আসার হিস্ট্রি না থাকলে পরীক্ষা হচ্ছে না।
নিঃসন্দেহ আমি যুদ্ধ ক্ষেত্রে আছি। খেলনা বন্দুক নিয়ে প্রবল প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের চেষ্টা করছি। একটা সত্যি বন্দুক পেলে দেখিয়ে দিতাম যোদ্ধা হিসাবে আমি খুব একটা খারাপ ছিলাম না।
"যদি তুই কখনও বন্যাতে যাস নিজের পয়সায় এক দু বস্তা মুড়ি কিনে নিয়ে যাস। প্যারাসিটামল ট্যাবলেট না দিয়ে বরঞ্চ বাচ্চাগুলোকে একমুঠো করে মুড়ি দিস।'
এই হচ্ছে বাস্তব চিত্র। দুর্যোগ বা করোনার আগেই মানুষগুলো না অনাহারে মারে যায়।
প্রত্যেকটা লেখাই অত্যন্ত সজীব সত্য আর জরুরী ও বটে।এ সময়ের একটা দলিল রয়ে যাচ্ছে।প্রাণভরা শুভেচ্ছা জানাই।।