করোনার দিনগুলি #৫৩
ওভার কনফিডেন্স
এবার করোনা রোগীরা সুস্থ হয়ে চেম্বারে ফিরে আসছেন। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী এখন আর রিপিট করোনা পরীক্ষা করার দরকার নেই। চিকিৎসক সুস্থ বলে সার্টিফিকেট দিলেই তিনি স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেন। চৌদ্দ দিন হোম আইসোলেশনে কাটানোর পর অনেকেই সার্টিফিকেট নিতে আসছেন।
সাধারণত রোগ সেরে গেলে কেউ ডাক্তারের কাছে ফেরত আসেন না। যারা আসেন, হয় তাদের জ্বর কমেনি অথবা পেটে ব্যথা আরও বেড়েছে। প্রথম দিকে হতাশ হয়ে পড়তাম। ভাবতাম, কারোরই তো অসুখ কমাতে পারছি না। আস্তে আস্তে বুঝলাম, দশ জনের মধ্যে দু- তিনজন ফেরত আসছেন। বাকিরা সুস্থ আছেন বলেই আসছেন না।
দিনকে দিন অভিজ্ঞতা বাড়ছে। এখন আর সহজে আনন্দ, মন খারাপ, হতাশা এইসব হয় না।
কতো রকমের মানুষ যে হয়! সাধারণ মানুষ, ‘ডাক্তার বাবু, আমি ঠিক হয়ে যাবো তো?’
ধৈর্য্য হীন মানুষ, ‘আমার রোগীর অবস্থা খুব খারাপ। আগে দেখে দিন। না হলে খারাপ কিছু যদি হয়, আপনি দায়ী থাকবেন।'
হাল ছেড়ে দেওয়া মানুষ, ‘ডাক্তার বাবু, বাবার বয়স পঁচাশি পেরিয়েছে। তিনবার স্ট্রোক হয়ে গেছে। আর কোথাও ভর্তি করবো না। আপনি যা পারেন করুন। তারপর যা হওয়ার হবে।'
ঝগড়ুটে শাশুড়ী, 'যবে থেকে ওই হারামজাদি মেয়ে আমার বাড়িতে এসেছে, তবে থেকে প্রেশারই কমছেই না।'
সর্বহারা শ্রমিক, 'ডাক্তার বাবু, লকডাউনে কারখানা বন্ধ। আপনার কাছে ওষুধ গুলো হবে? কিনে খেতে পারব না।'
তৈল মর্দনকারী মানুষ, ‘ডাক্তার বাবু, আমি প্রচুর ডাক্তার দেখিয়েছি। কিন্তু আপনার মতো ডাক্তার আমি কখনো দেখিনি।'
রাজার অসুখে আক্রান্ত মানুষ, ‘ডাক্তার বাবু, বাঁ পায়ের কড়ে আঙুলের ঝিন ঝিন টা কমে গেছে। কিন্তু তার পর থেকেই নাভির ঠিক দুই আঙুল নীচে বিন বিন করছে।'
সন্দেহ বাতিকগ্রস্ত বুড়ো, ‘ডাক্তার বাবু, ছেলে কাজের লোককে দিয়ে চায়ে বিষ মেশাচ্ছে। আমি মরলে বাড়িটা প্রোমোটারকে বেচে দেবে।'
হাহাকার সর্বস্ব মা, ‘ডাক্তার বাবু, আমার দুটো মেয়েরই থ্যালাসেমিয়া। ওদের বাপ অন্য মেয়ের সাথে পালিয়েছে। কয়েক বাড়ি ঠিকে ঝির কাজ করতাম। লক ডাউনে কাজ চলে গেছে। তিনমাস মেয়েদের রক্ত দিতে পারিনি। আজ সকাল থেকে বড় মেয়েটার খুব শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। কিছু একটা করুন।'
যাঁরা বলেন, 'জীবন অঞ্জন চৌধুরীর সিনেমা নয়', তাঁরা একটা দিন আমার সাথে থাকুন। বুঝতে পারবেন অঞ্জনবাবুই মানুষের সত্যিকারের আবেগগুলোকে ধরেছিলেন। তা যতই মেলোড্রামাটিক মনে হোক।
ধান ভাঙতে শিবের গাজন হয়ে যাচ্ছে। আবার প্রসঙ্গে ফেরত আসি। করোনা আক্রান্ত রোগীরা সুস্থ হয়ে প্রায় সকলেই ফেরত আসছেন। সুস্থ রোগী দেখলে চিকিৎসকের কনফিডেন্স বাড়ে। আমারও বাড়ছে। করোনাকে আর মোটেই ভয়ঙ্কর রোগ বলে মনে হচ্ছে না। সম্ভবত একটু ওভার কনফিডেন্সেই ভুগছি।
আমার সব ক্যাশে কারবার। অনলাইন লেনদেনে সড়গড় নই। মহামারীর সময়ে দূরের কাউকে টাকা পাঠাতে হলে অন্যের দারস্থ হই। যে পাঠাচ্ছে তাকে পরে ক্যাশে টাকা দিয়ে দিই।
এক আত্মীয় আমার হয়ে হাজার তিনেক টাকা অন্যকে পাঠিয়েছিল। চেম্বার শেষ করে রাত সাড়ে নটায় ফোন করলাম, 'বাড়ি আছো? তাহলে টাকাটা দিয়ে আসি।'
'রাখত টাকা। পরে দিস। এত ব্যস্ত হচ্ছিস কেন?'
বললাম, 'চারিদিকে যা অবস্থা। করোনা রোগীতে ছেয়ে গেছে। এ সময় কারো কাছে ঋণ বাকি রাখতে চাইনা। কখন কি হয়ে যায়।'
'তুই এত ভাবিস না। তোর কিচ্ছু হবে না। তোর বয়স কম। কোন অসুখ-বিসুখ নেই। তোর আবার কি হবে?’
বললাম, 'ইয়ে.... আমি আমার কথা না, তোমার কথা ভাবছিলাম। তোমার তো আবার সুগার প্রেসার দুটোই আছে। এ সময় ঋণ বাকি না রাখাই ভালো।'
মুশকিল হলো এর পরেই মোবাইলের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং আমিও টাকা ফেরত দিতে যেতে ভরসা পাচ্ছি না।
করোনার দিনগুলি #৫৪
অভিনেতা রুদ্রনীলবাবু লিখেছেন,
“হয়ত একদিন কিছু মানুষ,ধৈর্যের বাঁধ ভেংগে.. দলমত জাতধর্ম ভুলে কিছু রক্তচোষা বেসরকারি হাসপাতাল ভাংগবে। মালিকরা নিজের হাসপাতালে ভর্তিরও সময় পাবেন না! কাঠের বদলে তার লুঠের টাকা দিয়েই তাকে দাহ করা হবে ধাপার মাঠে! ঘি এর বদলে তার শরীরে ছড়ানো হবে থুতুর আতর । গংগার বদলে তার নাভি ভাসানো হবে দুর্গন্ধের ড্রেনে।..., ঠিক সেই মূহুর্তে,
স্বজন হারানো লুন্ঠিত বিপর্যস্ত গরীব ও মধ্যবিত্তেরা হাওয়ায় ছুঁড়ে দেবেন উলুধ্বনির ভ্যাকসিন। তাদের চোখের আগুনে লজ্জা পাবে ভলক্যানোর লাভা!
মহাকাল লিখবেন বাকি ইতিহাস।”
আমি ওনার এই বক্তব্যকে ধিক্কার জানাই।
এখন প্রশ্ন হলো আমি কেন এই বক্তব্যের বিরোধী। নীতিগতভাবে ওনার বক্তব্যকে সমর্থন জানানো উচিত ছিল। কারণ মহামারী সময়ও যেভাবে কর্পোরেট হাসপাতালগুলি ছলে-বলে-কৌশলে মানুষকে শোষণ করে চলেছে তা সত্যিই অত্যন্ত নিন্দনীয়। তাছাড়া ওনার পোস্টটিতে কোথাও চিকিৎসকদের বিরুদ্ধেও কিছু বলা হয়নি।
আমি ওনার বক্তব্যের বিরোধী, কারণ আমার মনে হয়েছে পোস্টটি উস্কানিমূলক এবং উদ্দেশ্যমূলক। পোস্টটি করা হয়েছে মানুষের দৃষ্টি মূল সমস্যা থেকে অন্য দিকে ঘোরানোর উদ্দেশ্যে।
ওনার পোস্টের পরিপ্রেক্ষিতে আমার কিছু বক্তব্য আছে।
১.কর্পোরেট হাসপাতাল যদি ভাঙচুর হয় তাহলে মালিকের গায়ে কি আদৌ হাত উঠবে? বরঞ্চ রক্তাক্ত হবেন চিকিৎসক নার্স ও সামান্য মাইনেতে কাজ করা কিছু স্বাস্থ্য কর্মী।
২. ধাপার মাঠে মালিকের বদলে পুড়বে কোনও স্বাস্থ্য কর্মীর দেহ।
৩.থুতুও মালিকের গা অবধি পৌঁছাবে না। থুতু মাখবেন চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরাই।
৪. গরিব ও মধ্যবিত্ত মানুষদের চিকিৎসার দায়িত্ব কেন সরকার নেবে না? সরকারি হাসপাতাল থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে কেন তাদের দ্বারস্থ হতে হবে কর্পোরেট হাসপাতালের?
আসলে সমস্যাটা অনেক গভীর। এবং সেটা রুদ্রনীলবাবুর মত ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা বুদ্ধিজীবীর জন্য আদৌ সুখকর নয়।
আমাদের দেশ ও রাজ্যের স্বাস্থ্য বাজেট অনেকটা নিম্নবিত্ত বাড়ির দুঃখিনী মায়ের খাওয়ার মত। সকলকে দিয়ে যদি কিছু বেঁচে থাকে তবে খাওয়া জোটে।
তাছাড়া সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাটাও বেশ অদ্ভুত। সবচেয়ে অদ্ভুত হেলথ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন। যার চাপে মান সম্মান বজায় রাখতে বহু চিকিৎসক চাকরি ছাড়ছেন। একজন জলজ্যান্ত উদাহরণ আমি। অথচ এখনো আমি মনেপ্রাণে সরকারি চিকিৎসকই রয়ে গেছি।
যাহোক, ব্যক্তিগত কথা বাদ দিয়ে বলাই যায়, জোড়াতালি দিয়ে চালানো সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এই মহামারীর সময়ে সাধারণ মানুষকে ভরসা দিতে পারছে না। ফলে তাঁরা বাধ্য হয়ে বেসরকারি হাসপাতালের দ্বারস্থ হচ্ছেন।
বেসরকারি পরিকাঠমো দিয়ে কখনো মহামারী আটকানো যায় না। এবং সেটা করার চেষ্টা করলে পরিস্থিতি এমনই ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। সম্ভবত রুদ্রনীল বাবুও এটা জানেন। কিন্তু উনার হাত-পা বাঁধা। অতএব কর্তার ইচ্ছায় কর্ম।
উনি 'পুঁজিপতিদের কালো হাত ভেঙ্গে দাও- গুড়িয়ে দাও' মার্কা পোষ্ট করে নিজের রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মটা মজবুত করলেন। যদিও তিনি ভালভাবেই জানেন ওই পুঁজিপতিদের গায়ে আদৌ হাত উঠবে না। মার খাবেন মহামারীর বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে লড়াই স্বাস্থ্যকর্মীরাই। আর ওই পুজিঁপতিরা ভোটের সময় টাকার যোগান দেবে। তাই এই অসময়ে তাদের অনৈতিক ব্যবসা বন্ধ করার জন্য সরকারি তরফে উৎসাহ দেখা যায় না। বিপ্লব শুধু ফেসবুকের উস্কানিতেই সীমাবদ্ধ থাকে।
সবশেষে ডা. অরুণাচল দত্ত চৌধুরীর লেখা একটি কবিতা। রুদ্রনীল বাবু পড়ে দেখবেন কি?
'কান্নাকে কবিতা ভেবোনা'
এক পাশে মর্টালিটি রেট
অন্য পাশে দাউদাউ পেট
দড়ির ওপরে হেঁটে যায়
এ স্বদেশ, মাথাখানি হেঁট।
ভ্যাক্সিন... মরীচিকা মায়া
কর্পোরেট... ডাকাতের ছায়া
তবুও আশায় বাঁচো চাষা
রাষ্ট্রের নিদান বেহায়া।
তালা মারা কল কারখানা
কৃষকের ক্ষেতে যাওয়া মানা
কোভিড ওয়ারিয়র শুধু
আগলাবে জীবনের দানা।
স্বাস্থ্যের কর্মী তো চেনা...
মেটাচ্ছে সমাজের দেনা!
বাস... ব্যাঙ্ক... আকুল হকার
তারও কথা কেউ ভাববে না?
উড়ে এলে ভিনদেশি জেট
ভরে ওঠে বানিয়া পকেট
রাশি নোট ছাপা হয়ে গেলে
হাসিমুখে তাকাবে বাজেট।
ভাবলে, সবারই আয়ু গোণা
মিডিয়া করুক আলোচনা।
এরই মাঝে আবেদন শুধু...
কান্নাকে কবিতা ভেবো না।
বরাবরের মতোই চমৎকার। শিবের গীতটিও ধান ভাংগার জন্য জরুরি, বাংলারই আসল রূপ।
রুদ্রনীলের পোস্টটি নকশালী কায়দার, আত্মঘাতী মনে হয়েছে।
করোনার এই অমূল্য দলিল এই ধারাবাহিক। আরও লিখুন