ইনি আর উনি থাকে খেয়ালঝুরি জঙ্গলের ধারে, মধুমালতি মাসির বাঁশবাগানের পেছনের ওই গেরস্ত বাড়িটায়। ভাঁড়ারঘরের এক কোণের একটা ছোট্ট গর্তে ওদের বাসা। সংসারে রাজ্যের হাঁড়িকুড়ি ঢেয়োঢাকনার আড়ালের ওই গর্তটুকুনি কেউ বিশেষ নজর করেনি কখনও। ওইটিকেই সাজিয়েগুজিয়ে বাড়িয়েচাড়িয়ে বসবাসের যুগ্যি তয়ের করেছে দু’টিতে। একটা পুরনো ফেলে দেওয়া কাঠের বাক্সে কমলি গাইয়ের গোয়ালঘর থেকে কুড়িয়ে আনা খড়ের টুকরো বিছিয়ে হয়েছে তাদের পালঙ্ক। গেরস্তবাড়ির খুকিটার পুরনো নীল জামার টুকরো দিয়ে হয়েছে ইনির বালাপোশ আর খোকনের লাল জামা হয়েছে উনির লেপ। ইনির আবার একটা সাজগোজ করার আয়নার ভারি শখ। তাই একটা ভাঙা কাচের টুকরো আর কতকগুলো দেশলাইয়ের খোল দিয়ে ড্রয়ারওয়ালা বাহারি আয়না বানিয়ে দিয়েছে উনি। যতই হোক গিন্নির আবদার, সেটা কি আর কত্তা ফেলতে পারে? এদিকে আমাদের ইনিও কিন্তু ভারি গুছুনে স্বভাবের। সারাক্ষণ তার এই ছোট্ট গর্ত ঘরটিকে সাজাতেই ব্যস্ত। গেরস্তবাড়ির গিন্নিমায়ের সিল্কের শাড়ি গিয়ে গর্তের হেথাহোথা ফাটাফুটোয় পর্দা বানিয়ে ঝুলিয়ে দিয়েছে ইনি। দুই ইঁদুর কত্তাগিন্নি মিলে দিব্বি আছে গেরস্তবাড়ির ভাঁড়ার ঘরের।
দিব্বি আছে এটা বলা অবিশ্যি ভুলই হবে। কারণ জীবনে তো আর ঝামেলার অভাব নেই। সে তুমি ইয়াব্বড় হাতি হলে যেমন নানা সমস্যা আছে তেমনি একটা পুচকে ইঁদুর হলেও বিপদের শেষ নেই। ইনি আর উনির শান্তির জীবনে তেমনি একটা বালাইয়ের নাম হল বগাই। তার নজর এড়িয়ে কিচ্ছুটি করার জো আছে? সারাদিন ওই ভাঁড়ার ঘরের পুব কোণের গর্তটার সামনে ওঁৎ পেতে বসে থাকবে হতচ্ছাড়াটা। ইনি আর উনি যদি একবার গর্ত থেকে মাথা বার করে উঁকিঝুঁকি মেরেছে ওমনি খপাৎ, কপাৎ আর গপাৎ। কপাৎ করে ধরতে অবিশ্যি পারে না, গপাৎ করে গিলতেও পারে না তাই। কিন্তু খপাৎ করে বড় বড় নখওয়ালা থাবা মেরে বগাই শয়তানটা সেদিন উনির ল্যাজের ডগাটা ‘নেই’ করে দিচ্ছিল আরেকটু হলেই।
বুঝলে না তো? রোসো তবে খুলেই বলি। বগাই হল একটা গাব্দাগোব্দা ছাইরঙা বেড়াল। ঝামরি ঝুমরি লেজ। একটা চোখ তার নীল আর একটা চোখ সবুজ। গেরস্তবাড়ির গিন্নিমার ভারি পেয়ারের বেড়াল সে। বিশেষ করে ওই নীল আর সবুজ চোখের জন্য বগাইয়ের ভারি গরব। হাজার বদমাইশি করলেও গিন্নিমা তাকে মোটেই বকাঝকা করেন না, শাস্তিও দেন না। সেই সুযোগ নিয়ে বগাই সব দোষ চাপায় ইনি আর উনির ঘাড়ে। বগাই এ বাড়িতে আসার পর থেকে ইনি আর উনির সুখের জীবনে কাঁটার মত গেঁথেই আছে। মাছের চুপড়ি থেকে ল্যাজাটা মুড়োটা তুলে নিয়ে থাবা চাটতে চাটতে ইনি আর উনির গর্তের দিকে চেয়ে মুখ তুলে ছলোছলো চোখ করে করুণ সুরে ডাকবে ‘মিয়াঁও’! ওমনি গিন্নিমা এসে দুষতে থাকবেন ‘উফ কী উৎপাতই না হয়েছে ইঁদুরের! আজ মাছ চুরি করেছে, সেদিন লেপতোষক ছিঁড়ে কুটিকুটি করেছিল! দাঁড়া আজই ইঁদুর ধরার কল কিনে আনব বাজার থেকে। দেখাচ্ছি মজা বজ্জাতগুলোকে! চল রে বগাই সোনা। তোকে দুধুভাতু দিই।’
কী সাঙ্ঘাতিক অন্যায় তোমরাই ভাবো একবার। বগাই দোষ করেও পেল দুধভাত আর ইনি উনির কপালে জুটল ইঁদুর ধরার কল!
তোষকটা নষ্ট করাটাও তো বগাইয়েরই কীর্তি! সেদিন গিন্নিমা ছাদে রোদ্দুরে দিয়েছিল রাজ্যের জিনিস। লেপ, বালিশ, তোষক, বেনারসি শাড়ি, ধান, আচারের বয়াম, আমসত্ত্ব, আরও কত্ত কী। বগাই একটা তোষকের ওপর দিব্বি আরামে কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমচ্ছিল। সেই সুযোগে যেই না ইনি ছাদে গেছে শুকোতে দেওয়া ধান থেকে দু’চারটি খুঁটে আনবে বলে, ওমনি বগাই বজ্জাতটা ফ্যাঁসসস করে দাঁত নখ বার করে তেড়ে এল। আর সেই করতে গিয়েই তোষকে ওর ধারালো নখ বিঁধে ঘটল বিপত্তি। কাপড়টা ছিঁড়ে গিয়ে রাশি রাশি তুলো চারিদিকে উড়ল। কিন্তু সে কুকম্মের দায় চাপল গিয়ে ইনি আর উনির ঘাড়ে! বোঝো তবে অনাচারটা!