মধুমালতী মাকড়শার বয়স অনেক হল! কিন্তু তা বলে যে একটু রেহাই পাবে, জিরেন পাবে এমনটি কি হওয়ার জো আছে! নিজের হাতে বোনা অমন সুন্দর একটা দোলনা বাঁশবাগানের এ ডাল থেকে ও ডালে টেনে বাঁধা আছে কিন্তু তাইতে একটু পিঠ ঠেকানোর সুযোগ আর মধুমালতীর হচ্ছেটা কই! সারা খেয়ালঝুরি জঙ্গলের বাসিন্দাদের নিত্য প্রয়োজনের জিনিস বুনতেই তো দিন কাবার হচ্ছে। দিনের আলো নিভলেও দম নেওয়ার ফুরসত নেই। জোনাইয়ের টিমটিম আলোতেই সেলাই বোনাই চালিয়ে যেতে হয়।
এই তো গেল হপ্তায় এল ইনি আর উনি। বাঁশঝাড়ের পেছনের মাটির নিকোনো ঘরটায় রান্নাঘরের গর্তে থাকে ইনি আর উনি, দুই নেংটি ইঁদুর। তাদের আবার অন্য সমস্যা। তাদের গর্তের মুখে দুষ্টু বিড়াল বগাই সবসময় হাঁ করে বসে থাকে। ইনি আর উনি বেরোলেই তাড়া করে করে নাকাল করে ওদের। তাই ওরা এসেছে মধু মাসির কাছে।
-“মধু মাসি ও মধু মাসি! দাও না আমাদের একটা জাল বুনে। বগাই বেড়ালকে বন্দী করে একটু পিঠেটা নাড়ুটা খেতে পাই তবে। নইলে এত কষ্ট করে গেরস্ত বাড়িতে গর্ত খুঁড়ে বাসা বেঁধে লাভটা কী হল বলো দিকিনি!”
চিকিমিকি পুঁতির মত চোখ তুলে ইনি আর উনি যখন কিছু আবদার করে মধুমালতীর মনটা গলে যায় এক্কেবারে। আহারে ওই অতটুকু ছোট্ট দুটো জীবের ওপর কী অন্যায় অত্যাচারটাই না করে বদমাইশ বগাইটা। চোখের কোলে জল আসে মধুমালতীর। চোখটোখ মুছে জাল সেলাই করতে বসল ইনি আর উনির জন্য।
বাঁশবাগানের পাশেই আছে একটা তেঁতুলগাছ। তাইতে সদ্য ডিম ফুটে ছানা বেরিয়েছে দুটো টিয়েপাখির। তাদের গায়ে এখনও লোমও গজায়নি, চোখও ফোটেনি। তেঁতুলতলায় বড্ড মশার উৎপাত। দিনে রাতে দুইবেলায়। বাবা টিয়ে মা টিয়ে খাবার খুঁজতে গেলেই রাজ্যের মশা এসে হুল বেঁধায় বাছাদের গায়ে। মধুমালতী ওদের প্রতিবেশী বলে কথা একটা দায় দায়িত্ব তো বর্তায় নাকি? তাই একটা সুন্দর দেখে মশারি বুনে দিয়েছিল। ভারি জব্দ হয়েছে মশারা। কিছুতেই আর টিয়েছানাদের ধারেপাশে ঘেঁসতে পারে না।
কিন্তু টিয়েছানারা বিপদের হাত থেকে বাঁচলে কী হবে! বিপদে পড়েছে মধুমালতী নিজে। আশাপাশে যত পাখপাখালি আছে, যাদের ডিম ফুটে ছানা বেরনোর সময় হয়ে এলো বলে, তারা সব মশারির অর্ডার দিয়ে গেছে। বুলবুলি, ময়না, ফিঙে আরও কতজনা। মধুমালতীর আপত্তি নেই মশারি বুনতে, কিন্তু মুশকিল হল হাত তো মোটে আটটা। তাই দিয়ে কতই বা বুনবে সারা দিনমান। শুধু তাই নয় জাল বোনার সুতোতেও এবার টান পড়ছে। সুতো তৈরি করাও তো মুখের কথা নয়।
কাল আবার বাঁশবাগানের গায়ের চাঁদনিদিঘির রুপোলী রুই মাছ এসে বললে,
-“অ মধু দিদি! দাও দেখি একটা জাল বুনে শক্ত দেখে। আমার বাছারা খালি এদিক সেদিক চলে যায়। ওদিকে ওপাড়ার রাক্ষুসে শোল বোল সব ওঁৎ পেতে বসেই রয়েছে, কখন বাছাদের গিলে নেবে। তুমি এমন একটা ঘিচিঘিচি জাল বুনে দাও যাতে বাছারা একটু বড় হওয়ার আগে যেন গলে না যেতে পারে, আবার জালটা বেশ নরমসরমও যেন হয়। বাছাদের গা ঘষে আঁশ উঠে যাবে যাবে নইলে।”
অমনধারা ফ্যাচাং-এর জাল, তার ওপর সে জলে ভিজবে না, এমনটি কী করে বোনে বলো হেখি মধুমালতী। মধুমালতীর সুতো তো জলে পড়লেই নষ্ট হয়ে যাবে।
বাধ্য হয়েই একরকম এবার না করতে হবে, ফেরাতে হবে সকলকে। মন খারাপ করে মুখটা ভার করে একমনে জাল বুনছিল মধুমালতী। এমন সময় টুইটুই টুনটুনি এসে হাজির। টুইটুই সারাদিন টইটই করে হেথা হোথা উড়ে বেড়ায়। বিশেষ কাজকম্মো কিছু করে না। মধুমালতী মাসির কাছে মাঝেমধ্যে আসে সুতো নিতে। টুনটুনি সুতো দিয়ে গাছের পাতা সেলাই করে বাসা বানিয়ে ডিম পাড়ে, তা জানো তো? টুইটুইকে দেখে মধুমালতী বলে,
-“তুই এলি বাছা! কিন্তু আজ যে সুতো একদম শেষ রে। কাল আসিস বরং। যদি পারি তো অল্প সুতো দেব। এই দেখ না, ক’দিন ধরে পাখির ছানাদের মশারি, ইনি আর উনি নেংটি ইঁদুরের বগাই বেড়ালকে ফাঁদে ফেলার জাল, এত কিছু বুনতে বুনতে সুতোও শেষ আর আমার দমও শেষ। তাও তো এখনও রুই মায়ের ছানা আটকানোর জাল বুনে উঠতে পারি নি। আমার সুতো তো জলে পড়লেই ভিজে নষ্ট হয়ে যায়। কী দিয়ে যে রুই মায়ের জন্য জাল বুনি!”
এই শুনে টুইটুই টুনটুনি বলে,
-“ও এই কথা! তুমি আমায় আগে বলবে তো মধুমাসি। এই আমি যে পাতা জুড়ে ঘর বানাই সে তো তোমার থেকে সুতো নিয়ে আর গাছের আঁশ তুলে তাই দিয়ে। গাছের আঁশ চট করে ভিজে নষ্ট হয় না। তুমি তাই দিয়ে বরং রুইছানাদের জন্য বেড়াজাল বুনে দাও।”
মধুমালতী বলে,
-“এটা তো ভালো বুদ্ধি দিয়েছিস রে টুইটুই! তবে মুশকিল হল আমি কীকরে এত বুনব বল দিকিনি? বয়স হচ্ছে। চোখের জ্যোতি হারিয়েছে! হাতের গতি হারিয়েছে!”
টুইটুই বলে,
-“তোমার তো আট আটটা চোখ! তাও সমস্যা!”
মধুমালতী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
-“ওরে সব চোখ কী আর সমান কাজে লাগে! সামনের এই চোখজোড়া দিয়ে আমি দেখতে পাই যে তুই কী রঙের, কতটা দূরে দাঁড়িয়ে আছিস! আর পাশের বাকি চোখগুলো দিয়ে বুঝতে পারি আশেপাশে কেউ নড়াচড়া করছে কিনা! যাই হোক। দিনে দিনে এই জাল বোনা বন্ধই করে ফেলতে হবে হবে রে টুইটুই!”
টুইটুই একটুখানি চিন্তা করে তারপর বললে,
-“আচ্ছা মধুমাসি, আমি তো টুকিটাকি বুনতে পারি। বাবুইদিদিও পারে। তোমার মত এত সুন্দর নকশা অবশ্য করতে পারি না সুতো দিয়ে। এমনটা হয় না তুমি আমাদের শিখিয়ে পড়িয়ে দিলে কী করে অমন বুনতে হয়। তারপর আমরা সবাই মিলে সুতো, গাছের আঁশ, লম্বা ঘাস, খড় সব দিয়ে নানারকম জিনিস বুনলুম। যেমনটি সকলের প্রয়োজন। কী বলো? তাহলে তোমার এমন সুন্দর এই হাতের কাজের জাদুর ছোঁওয়া থেকে কেউ বঞ্চিত হবে না!”
টুইটুইয়ের বুদ্ধি শুনে মধুমালতী আটটা চোখই বড় বড় করে চাইল। তাই তো! এটা তো দারুণ ভাবনা। মধুমালতীর এই বোনার বিদ্যেটা যদি আর পাঁচজনকে শিখিয়ে দেয় তাহলে সকলেরই উপকার হয়। এতদিন যে কেন এটা মাথায় আসেনি! এক গাল হেসে টুইটুইকে বলে,
-“তবে আর অপেক্ষা কীসের? যা ডেকে নিয়ে আয় তো বাবুইকে। আজ থেকেই শুরু করি। রুই মায়ের ছানাদের জন্য জাল বুনি চল। আসার পথে গাছের আঁশ আনতে ভুলিসনে যেন।”
টুইটুই আর এক মুহূর্তও দেরি না করে ফুড়ুৎ করে উড়ল বাবুইদিদির সন্ধানে।
এদিকে মধুমালতী সুতো নিয়ে বুনতে বসল। অপূর্ব নকশায় কারুকার্যে এক এক করে লেখা ফুটে উঠল,
“মধুমালতী বয়ন শিক্ষা কেন্দ্র”
টুইটুই আর বাবুই এলে এটাকে ঠোঁটে করে টাঙিয়ে দিতে বলবে বাঁশবাগানের ওপরটায়। আরও নিশ্চয়ই ছাত্রছাত্রী হবে নতুন সেলাই শেখার ইস্কুলের! ইস্কুলের নামটা বুনতে পারাটাই হবে তাদের সেলাইশিক্ষার প্রথম পরীক্ষা।
কি মিষ্টি একটা গল্প। আগের জিমি ব্যান্ডোও দারুণ লেগেছিল। এটাও খুব ভাল লাগল।
অসাধারণ লাগল।
বেশ মজাদার। দারুণ লাগল
“মধুমালতী বয়ন শিক্ষা কেন্দ্র” এ একটু বড়দের ভর্তি নেবে? মশারী বোনা শিখতাম!
লেখাটি মায়াময় ♥
আহা! কি মিষ্টি গল্প।