সকাল থেকে চেয়ারে বসে বসে কোমরটা ধরে গেছে, পেটটাও যেন কেমন মোচড় মারছে। ওই খান দুই শুকনো পেয়ারা ছাড়া আর কিছুই জোটেনি, পিকাবুলিটার দ্বারা যদি একটা কাজ ঠিকঠাক হয়! নিজে বেরিয়ে গিয়ে যে কিছু ভালোমন্দ ঢুঁড়ে আনবে তারও জো নেই। অফিস ছেড়ে তো আর এরকম কাজের সময় খাবার খুঁজতে যাওয়া যায় না। অবশ্য অফিস ফাঁকা রাখার দরকার নেই, পিকাবুলি আর টিনিয়া তো আছেই। তবে ওরা কাজের চেয়ে অকাজটাই বেশি করে কী না!
এই তো সেদিন জিমি ব্যান্ডো বিকেলবেলায় একবারটি গেছিল উঁচু টিলাটার ওপারে মানুষদের আস্তানাতে। তার মধ্যেই দুই মক্কেল মিলে অফিসঘরটাকে একেবারে ফলের বীজ, শুকনো পাতা, ফুলের পাপড়ি ফেলে ডাস্টবিন বানিয়ে ফেলেছিল। তার ওপর এমন গান ধরেছিল ‘ট্যাঁট্যাঁ টুইট টুইট’ করে! পড়শি ময়নামতী এসে কী কমপ্লেনটাই না করল পরে জিমির কাছে।
জিমি ব্যান্ডোর অফিসঘরটি এই বুড়ো বটগাছের গোড়ার ওই ফোঁপরা বড় কোটরটায় আর বটগাছের একদম টঙে হ’ল গিয়ে ময়নামতীর বাসা। কত্তাগিন্নি থাকে চারটে ছানা নিয়ে। পিকাবুলি আর টিনিয়ার গলা সাধার চোটে ময়নামতীর ছানারা সারা দুপুর ধরে নাকি ঘুমোতে পারেনি, আর দুপুরের ঘুম ঠিক না হলে রাতে ছানাদের উল্টোপাল্টা সময়ে ঘুম হয়। ব্যাস! আর সকালে উঠতে পারে না, ইরাবতী ইগলের স্কুলে মর্ণিং ফ্লাইং লেসন মিস হয় ওদের।
না, এমনিতে জিমি ব্যান্ডো সচরাচর মানুষদের বসতির দিকের ওই পথ মাড়ায় না তবে, কিছু কিছু মারপ্যাঁচ মানুষদের থেকেও শিখতে হয়। এই যে সেবার জুজুৎসু প্যাঁচে বজ্জাত শিকো দ্য শেয়ালকে জব্দ করল জিমি, সেটা তো ওই ছোট্ট মিষ্টি মেয়েটা, কী যেন নাম, হ্যাঁ হ্যাঁ ঝিম্পাই, ওর থেকেই শেখা। টিলার ওইপারে পার্কটায় বাবা মায়ের হাত ধরে খেলা করতে আসে ঝিম্পাই, ক্যারাটের মকশোও করে। ওই দেখেই তো শিখেছে জিমি ব্যান্ডো।
আর... আর ওই যে সেবার ধোঁয়া বোম ছুঁড়ে বদমাশ কাক কিমোচাকে তাড়াল সেটাও তো নিমো বলে ওই বাচ্চা ছেলেটার কাছেই জেনেছে। নিমো এতই দুরন্ত ছটপটে যে দেখে বোঝারই উপায় নেই ও কতবড় বিজ্ঞানী। কতরকম আবিষ্কার ও করেছে, সব ফর্মুলা ওই সুপারম্যান আর আয়রন ম্যানের স্টিকার লাগানো হলদে নোটবইটায় লেখা আছে। একদিন নিমো খাতাটা পার্কের বেঞ্চে খুলে রেখেই মা বাবার হাত ধরে আইসক্রিম খেতে চলে গেছিল পার্কের ওই আইসক্রিমদাদুটার কাছে। তখনই বেঞ্চের পেছনের দেবদারু গাছটা থেকে নেমে এসে জিমি পড়ে নিয়েছিল ধোঁয়া বোমের ফর্মুলাটা। আরও দু-চারটে কারসাজি শিখে নেওয়ার ইচ্ছে ছিল কিন্তু নিমো ততক্ষণে আইসক্রিম কোণ-টা চাটতে চাটতে এসে গেছিল আর জিমিকে দেখে,
-“ও মা! কী সুন্দর কাঠবেড়ালিটা! গলায় আবার কেমন লাল স্কার্ফ বাঁধা, কোমরে বেল্ট, চোখে সানগ্লাস! ও বাবা, ও মা! দেখবে এসো! এটা নির্ঘাৎ স্পাই কাঠবেড়ালি!”
এই বলে চিৎকার করতেই ওপাশ থেকে ঝিম্পাইও ছুটে এলো। সেও জিমিকে দেখে অবাক! কিন্তু বড়রা কেউ আসার আগেই জিমি ব্যান্ডো হাওয়া হয়ে গেছিল। জোর বাঁচা বেঁচেছিল সেবার! বড়রা মনে হয় না নিমো-ঝিম্পাইদের কথা বিশ্বাস করবে।
নাহ্ এই সাজপোশাক পরে টিলার ওপারে মানুষদের এলাকায় পার্কে যাওয়াটাই ভুল হয়েছিল। আসলে ওই সুপারহিরোদের মত একটা ‘কেপ’ গলায় বাঁধার বড্ড শখ জিমির। যখনই কোনও নতুন কেস নিয়ে বিপদে পড়া পশুপাখি, জঙ্গলের সেরা গোয়েন্দা জিমির কাছে আসে, জিমি তখন কেপটা ফুলো ফুলো লেজের ঝাপটা দিয়ে একটু উড়িয়ে বলে,
-“হাই! আই অ্যাম ব্যান্ডো... জিমি ব্যান্ডো।”
লোকজনের সমীহ এমনিতেই বেড়ে যায়।
আর কোমরের বেল্টটায় অনেক দরকারি জিনিস থাকে, নেলকাটারের ভাঙ্গা ছুরি, বাবলগাম, রিবনের দড়ি, বিছুটিপাতার গুঁড়ো, একশিশি মধু, এইসব আরও কত কী!
আর চোখের ওই প্লাস্টিকের খেলনা সানগ্লাসটা অবশ্য ওই পার্কেই কুড়িয়ে পেয়েছিল। কোনও ছোটো বাচ্ছার হবে হয়ত। লাল টুকটুকে কেপটার সাথে লাল ডাঁটি সানগ্লাসটা ভারি মানিয়েছে কীনা।
যাক গে! কী কথা বলতে গিয়ে কীসব বলছি দেখো। ছোট্ট শহরটার একপ্রান্তে এই জঙ্গলটা। খুব বড় নয় আবার খুব ছোটোও নয়। জঙ্গল আর শহরের মাঝে দাঁড়িয়ে একটা ছোট্ট টিলা আর টিলার কোলে বাচ্ছাদের খেলার সুন্দর একটা পার্ক। এই জঙ্গলটাতেই বাস জিমি ব্যান্ডো দ্য গোয়েন্দা কাঠবেড়ালি আর তার দুই স্যাঙাৎ, পিকাবুলি নামের বুলবুলি আর টিনিয়া নামের সবুজ টিয়ার। জঙ্গলের সমস্ত পশুপাখির যা সমস্য হয় সবকিছুর সমাধান কে করে? কে আবার ... জিমি ব্যান্ডো অ্যান্ড টিম।
টিলার এইপারে একটা বুড়ো বটগাছে ইয়াব্বড় কোটরে জিমির অফিস। সে অফিসে একটা ভাঙা টেবিল গোটা দুই চেয়ার আর রাজ্যের কাগজপত্র রয়েছে। জিমির সমাধান করা সব কেসগুলোর নথিপত্র। বেশ অনেক রকমের আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রও আছে। উলের কাঁটা, অর্জুন গাছের আঠা, খেজুরের বীজ ভরা ফাঁপা চোঙ, আরও কত্ত কী!
অবিশ্যি টেবিলটা হল গিয়ে ওই বড় একটা পাথরের টুকরো যেটা চারটে কাঠের ডালের ওপর রাখা আর চেয়ার হ’ল তোমার ওই বড় বড় পাথরের টুকরো। সেই একটা চেয়ারে বসে বসেই জিমি তিন নম্বর পেয়ারাটা চিবোচ্ছিল আর মনে মনে তৈরি হচ্ছিল পিকাবুলি আর টিনিয়াকে বড়রকমের একটা বকুনি দেবে বলে। সেই যে সকালে চাট্টি পেয়ারা এনে দিয়ে দু’জন বেপাত্তা হয়ে গেল, সূয্যি বটগাছের মাথায় উঠে গেল এখনও তাদের ফেরার নামচর্চা নেই। ব্যাজারমুখে জিমি ব্যান্ডো গলা থেকে লাল স্কার্ফের কেপটা খুলে একটু কুংফুর প্যাঁচগুলো ঝালিয়ে নিতে মনস্থির করল। ঠিক এমন সময়ই ঝটরপটর করে প্রবল আওয়াজ সহযোগে একটা সবুজ রঙের আর একটা নস্যিরঙের রঙের গোলা এসে কোটরে... থুক্কুড়ি অফিসঘরে ঢুকে পড়ল, পিকাবুলি আর টিনিয়া!
ঢুকেই দু’জন হাঁউ মাঁউ করে একসাথে একগাদা কথা বলতে শুরু করল।
-“জিমিদাদা, শিকো শিকো.. সব ঐ বদমাশ শেয়ালটার চাল!”
-“না না শিকো একা নয়, বজ্জাত কিমোচা কাকও রয়েছে সাথে!”
-“আহা গো অতটুকু ছানাগুলো!”
-“ময়নামতী আর ওর বর কী কান্নাই না কাঁদছে!”
-“ইরাবতী ঈগলও ভারি চিন্তায় পড়েছে!”
জিমি এক ধমক দিয়ে থামায় দু’জনকে।
-“পিকাবুলি! টিনিয়া! তোরা চুপ করবি? এভাবে বললে তো বুঝতেই পারছিনা কিছু, ছাই। এক এক করে বল আমায় ঠিক কী হয়েছে।”
একটু জলটল খেয়ে, ধাতস্থ হয়ে, পিকাবুলি আর টিনিয়া মিলে যা বলল তা মোটামুটি এইরকম-
যে বুড়ো বটগাছের গোড়ার কোটরে জিমি ব্যান্ডোর অফিস তার মগডালে এক ময়না দম্পতির বাস, ময়নামতী আর মধুকুমার। তাদের চার চারটে ছানা মাসখানেক আগেই ডিম ফুটে বেরিয়েছে। মোমো, মিমি, মুমু আর মিউমিউ। ময়নামতী তার ছানাদেরকে ইরাবতী ঈগলের ফ্লাইং ট্রেনিংয়ের স্কুলে ভর্তি করেছে। আজকালকার দিনে তো আর বাপ মায়ের শেখানো বিদ্যের ভরসায় ছানাকে ফেলে রাখা যায় না। প্রফেশনাল ট্রেনিং চাই। আর জঙ্গলের বাচ্চা পশুপাখিরাও জানে যে ওড়ার মামলায় শেষ কথা ইরাবতী। শাঁ করে যখন বাতাস কেটে আকাশের ওই উঁচুতে চলে যায় কার সাধ্য আছে ওকে ধরে। তারপর ডানা ছড়িয়ে বাতাসে ঘুড়ির মত কেমন ভেসে থাকে, গ্লাইডিং না কী যেন বলে, অমনটা কি মধুকুমার পারবে? কক্ষণও না। তাই তো ময়নামতী কারোর বারণ না শুনে মোমো, মিমি, মুমু আর মিউমিউকে চোখ ফোটার ক’দিন পরেই, ‘ইরাবতী ফ্লাইং ইনস্টিটিউট’-এ ভর্তি করে দিয়েছিল।
বাছারা রোজ সক্কাল সক্কাল বাবা মধুকুমারের আনা পোকা মাকড় কেঁচো দিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে মা-কে টা-টা করে যায় পাশের অশ্বত্থগাছের ঝাঁকড়া ডালের ওপরের স্কুলে। তারপর সূয্যি যখন প্রায় গাছের মাথায় ওঠে তখন মা ময়নামতী যায় বাছাদের আনতে। কিন্তু বিপদ হ’ল আজ। ময়নামতী পাশের কোটরের ফিঙেগিন্নীর সাথে একটু বোলতার ডিমের চচ্চড়ির রেসিপি নিয়ে আলোচনা সেরে তারপর গেছিল ইরাবতীর ওখানে। গিয়ে দেখে, চারদিক সব লণ্ডভণ্ড, ‘ইরাবতী ফ্লাইং ইনস্টিটিউট’ লেখা বড় গাছের বাকলটা মাটিতে পড়ে লুটোচ্ছে। অশ্বত্থ গাছটার একাধিক ডাল ভাঙ্গা, রাজ্যের কাঁচা সবুজ পাতা সব ঝরে ভর্তি হয়ে আছে তলাটা।
ইরাবতী একটা ভাঙ্গা গাছের ডালে বসে বসে কপাল চাপড়াচ্ছে,
-“হে ভগবান্! এ কী সর্বনাশ হ’ল! আমার দুধের মত বাছারা! কত ভরসা করে আমার কাছে রেখে গেল ময়না বোন, মধু ভাই!”
এই দেখেই তো ময়না বুঝেছে কিছু একটা বিপদ ঘটেছে।
তারপর বহু কষ্টে সব তথ্য বেরিয়েছে যে, শয়তান কিমোচা কাক এসে ইরাবতীর সাথে মিথ্যে মিথ্যে গল্প ফেঁদেছিল। কিমোচার ভাইঝিকে নাকি ইরাবতীর স্কুলে ভর্তি করতে চায়। কটা করে পুঁটিমাছ আর ফড়িং দক্ষিণা দিতে হবে, সেইসব জিগ্গেস করছিল। ইরাবতী উত্তর দিতে দিতে একটু অন্যমনস্ক হয়েছে সেই ফাঁকে ওমনি কোত্থেকে শিকো শেয়াল এসে সুড়সুড় করে গাছ বেয়ে উঠে, ময়নার ছানা চারটেকে নিয়ে পগার পার। ইরাবতী বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল কিন্তু কিমোচো এমন ঝটাপটি করছে ইরাবতীর সাথে যে সে বেচারা কিচ্ছু করে উঠতে পারেনি। ইরাবতী ঈগল হ’লে কী হবে, অনেক বয়স হয়েছে। কিমোচার মত বদমাইশ বিশাল আকৃতির জোয়ান দাঁড়কাকের সাথে পারবে কেন।
সেই তখন থেকে ময়নামতী কেঁদে চলেছে, আর মধুকুমার সারা জঙ্গলময় বাছাদের খুঁজে চলেছে।
পিকাবুলি আর টিনিয়ার কাছে সবটা শুনে বড্ড মন খারাপ লাগল জিমির। যতই হোক ময়নামতীর পরিবার হ’ল গিয়ে ওদের প্রতিবেশী। তাদের চার চারটে ছানাকে এভাবে কিমোচা আর শিকো তুলে নিয়ে চলে যাবে, এটা তো জিমি থাকতে হতে পারেনা কিছুতেই। বিশেষ করে ওই ঘাঘু শয়তানদুটো আবার জিমির ‘জানি দুশমন’। নাহ্! এই কেসটা নিজের গরজেই সমাধান করতে হবে জিমিকে।
-“চল তো পিকাবুলি, নোটবুকটা নে। টিনিয়া আমার অস্ত্রগুলো গুছিয়ে নে। আগে ময়নামতীর কাছে যাই, তারপর ইরাবতীর কাছে যাব।”
এই বলে তিনমূর্তিতে চলল গাছের মগডালের দিকে। গিয়ে দেখে অঝোর ধারায় কেঁদে চলেছে ময়নামতী।
“বাছারা আমার গেলি কোথায়?
সেই সকালে উড়তে হোথায়,
দুষ্টু শিকো, পাজী কিমোচা
কেউ কি ওদের দেবে না সাজা?”
জিমি গিয়ে বললো,
-“ময়না বোন তুমি চিন্তা কোরো না! তোমার ছানাদের ফিরিয়ে আনা এখন আমার দায়িত্ব। নো টেনশন! আমাকে তোমাদের বাসায় যদি বাছাদের পালক-টালক পড়ে থাকে, তাই দাও তো দেখি খানকয়েক।”
ময়নামতী চোখটোখ মুছে, শিগগির জিমি ব্যান্ডো যেমন যেমন বলল ঠিক তেমন তেমন করল। জিমি পিকাবুলিকে বলল,
-“সোওওজা উড়ে যা দেখি টমটম কুকুরের আস্তানায়। ও চোখ বুজে বাতাসে গন্ধ শুঁকে বলে দেয় কোন কোটরে কোন পাখির বাসা। ওকে খুব দরকার এই কেসটায়। আর টিনিয়া তুই গিয়ে মধুকুমারকে খুঁজে নিয়ে আয়, বল আমি ঠিক সন্ধান বার করব ময়না খোকাখুকুদের।”
শাগরেদরা চলল যে যার কাজে, জিমিও চলল অকুস্থলে মানে ইরাবতী ঈগলের ফ্লাইং ইনস্টিটিউটে, পাশের অশ্বত্থ গাছে, ইনভেস্টিগেট করতে। পৌঁছে দেখে ইরাবতী ভাঙ্গা ডালপালা, স্কুলের নামলেখা বাকল সব টেনে টেনে ঠিক করার চেষ্টা করছে।
-“আমি কি ইরাবতী ম্যাডামের সাথে একটু কথা বলতে পারি?”
জিমি গলাখাঁকারি দিয়ে ফের বলে,
-“ওহ্ আমার পরিচয়টাই তো দেওয়া হয়নি, আমি ব্যান্ডো... জিমি ব্যান্ডো। এই ওয়ান্ডারল্যান্ড ফরেস্টের একমেবোদ্বিতীয়ম গোয়েন্দা।”
ইরাবতী তড়িঘড়ি বলে ওঠে,
-“হ্যাঁ বিখ্যাত গোয়েন্দা জিমি ব্যান্ডোকে তো জঙ্গলের পোকামাকড়গুলোও চেনে, আমি চিনব না? তবে কিনা আমার যা বলার ছিল সবই তো ময়নামতী আর মধুকুমারকে বলে দিয়েছি। কী দুর্গতিটাই না হ’ল। আমার ইস্কুলখানার দুর্দশাটা একবার দেখুন শুধু। এই বুড়ি পাখিটাকেও রেহাই দেয়নি কিমোচা শয়তানটা। কী রকম মেরেছে আমায়! পালক ছিঁড়েখুঁড়ে একাকার করেছে।”
এই বলে গাছের তলায় পড়ে থাকা চার পাঁচটা পালক দেখায়।
-“হুমম তাই তো দেখছি! আচ্ছা আপনি ঈগল পাখি আর কিমোচা দাঁড়কাক। আপনি পড়ে পড়ে মার খেলেন? দুটো ঠোক্কর মারতে পারলেন না?”
-“ইয়ে মানে চেষ্টা কি আর করিনি?”
ঝেঁঝে ওঠে ইরাবতী।
-“আসলে শুধু ঈগলেরই পালক দেখছি, একটাও দাঁড়কাকের কালো পালক তো পড়ে থাকতে দেখলুম না। যাকগে সে কথা, এবার বলুন আপনার ছাত্র ছাত্রীরা উড়তে কেমন শিখেছিল? মাস গেলে তো শুনি অনেক অনেক ফড়িং বোলতা কেঁচো পুঁটিমাছ নেংটি ইঁদুর সব দক্ষিণা নেন আপনি”
ইরাবতী স্পষ্টতই একটু ঘাবড়ে গেছে।
-“দিব্যি উড়তে শিখেছিল। আমি ট্রেনিংয়ে কোনও গলদ রাখিনে, তাই মাইনেও একটু বেশি লাগে বৈকি। না পোষালে বাবা মা দেয় কেন আমার স্কুলে?”
গলার কেপটা আরেকটা টান টান করে নিয়ে, কোমরের বেল্ট থেকে বিছুটিপাতার গুঁড়োভর্তি শিশিটা বার করে হাতে নেয় জিমি।
-“এই শিশিতে কী আছে জানেন? সত্যি কথার গুঁড়ো। আশা করি আপনার জন্য এটা ব্যবহার করতে হবে না!
এবার আমায় একটু বুঝিয়ে বলুন তো, চার চারটে ময়নাছানা, উড়তে পারে তাও ডানাবিহীন শিকো শেয়াল তাদের গাছে উঠে দিনদুপুরে ধরে ফেলল এটা কীকরে সম্ভব হ’ল? তারা ঝটাপটিও করল না, উড়লও না, চিৎকারও করল না, একটু বেশিই অদ্ভুত লাগছে না কি?”
ইরাবতী তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে তাকায় জিমির দিকে, ঘাড়ের কাছের পালকগুলো ফুলে উঠতে থাকে, পায়ের নরম চামড়ার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা বাঁকা নোখগুলোর ওপর রোদ্দুর ঝিকোয়, শক্ত ঠোঁটটা অল্প ফাঁক হয়। জিমিও বুঝতে পারে ইরাবতীর উদ্দেশ্য, বিছুটি গুঁড়োর শিশির ঢাকনাটা খুলে রেডি হয়। ইরাবতী যেই না উড়ে এসে ঝাঁপ দেয়, জিমি অমনি এক ডিগবাজি খেয়ে ইরাবতীর পেটের তলায় গলে যায়। একমুঠোয় পালকগুলো খামচে ধরে অন্য হাতের শিশি থেকে বিছুটির গুঁড়ো খানিকটা পালকের আড়ালের নরম চামড়ায় ঢেলে দেয়। ইরাবতী তো বিছুটির জ্বালায় ছটপটাতে থাকে, সেই ফাঁকে জিমি পার্কে কুড়িয়ে পাওয়া রিবনটা কোমরের বেল্ট থেকে বার করে ইরাবতীর পা দুটো আর ডানা দুটো বেঁধে দেয়। ইরাবতী ঈগলের আর নড়াচড়া করারও ক্ষমতা থাকে না।
ইতিমধ্যে পিকাবুলি, টমটম কুকুরকে নিয়ে আর টিনিয়া মধুকুমার আর ময়নামতীকে নিয়ে এসে হাজির। ওরা তো ইরাবতীর অবস্থা দেখে হতভম্ব!
-“এসবের মানে কী জিমিদাদা? এঁকে এরকম করে কে বাঁধল?”
জিমি কোমরের বেল্টটা টাইট করে তাইতে বিছুটিগুঁড়োর শিশিটা রেখে, কেপটা একটু হাওয়ায় উড়িয়ে উত্তর দেয়,
-“দাঁড়কাকের কাছে ঈগল এরকম গো-হারান হারে কখনও শুনেছো? একটা পালকও ওপড়াতে পারেনি কিমোচার? আর এতবড় “অসহায়” পাখিকে নাগালে পেয়ে তাকে না তুলে নিয়ে গিয়ে শেয়াল চারটে পুচকি পুচকি ময়নাছানা নিয়ে গেল? আর ময়নাছানারা তো উড়তে পারে, চারজনকেই শিকো একসাথে ধরে ফেললো, একজনও উড়ে পালাতে পারলোনা! এটা একমাত্র তখনও সম্ভব যখন শিকো ছাড়া বাকি দু’জনও হাত লাগাবে ওদের ধরতে। বাছারা তাদের উড়নমাস্টারকে বিশ্বাস করেই বিপদে পড়েছে।
সন্দেহ আমার প্রথমেই হয়েছিল। এখানে আসার পর ইরাবতীর কোটরের ওই টেবিলে দেখলাম কচুরির খালি শালপাতার ঠোঙা পড়ে। ও জিনিস তো একমাত্র টিলার ওপারের পার্কের দোকানে পাওয়া যায়। আর আমরা কে না জানি যে একমাত্র শিকো শেয়ালই মানুষদের দোকান থেকে খাবারদাবার চুরি করে আনে? আমি ছাড়া কেবল ও-ই যায় টিলার ওপারের মানুষদের এলাকায়।”
-“এএসব কী! তার মানে ইরাবতী...”
আর্তনাদ করে ওঠে ময়নামতী।
-“হুমম আমার ধারনা তাই-ই। তিন মূর্তিতে মিলে প্ল্যান করে এই কাজটা করেছে। ইরাবতীর বয়স হয়েছে, শিকার করতে পারে না আগের মত। ওই মাইনেতে পাওয়া পুঁটিমাছ ফড়িং এসব খেয়েই পেট ভরাতে হয়, কিন্তু মন ভরে না। তাই কিমোচা দাঁড়কাক আর শিকো শেয়ালের দেওয়া টোপটা গিলেছে নির্ঘাৎ। সব পরিষ্কার হবে এক্ষুণি। টমটম তুমি ময়নাছানাদের পালকের গন্ধ শুঁকে চলো দেখি তাদের খুঁজে বার করবে।”
টমটম ওমনি সোঁ সোঁ করে নাক ভরে পালকের গন্ধ নিল তারপর বোঁচা নাকটা তুলে বাতাসে এধার ওধার বার কয়েক ঘোরালো, তারপর দৌড় লাগালো টিলাটার দিকে। টমটমের পেছন পেছন ছুটল জিমি ব্যান্ডো, আর আকাশপথে উড়ল পিকাবুলি আর টিনিয়া। ময়নামতী আর মধুকুমারও সঙ্গ নিল, যাওয়ার আগে ইরাবতীর বাঁধনটা আরেকবার টাইট করে দিল পিকাবুলি। কিছুক্ষণ গন্ধ অনুসরণ করে দৌড়ানোর পর টমটম গিয়ে থামল টিলার গায়ের একটা গর্তের সামনে। এখানেই তার মানে শিকো ময়নাছানাদের রেখেছে। জিমি আরেকটি রিবনের টুকরোকে ল্যাসোর মত ফাঁস পাকিয়ে মাথার ওপর ঘোরাতে ঘোরাতে ঢুকল গর্তটায়। আলোজ্বলা খাপওয়ালা একটা পেনকে অন্য হাতে বাগিয়ে ধরল। পার্ক থেকে কুড়িয়ে পাওয়া এই পেনটা আঁধারে বেশ ভালো টর্চের কাজ করে।
যেই না জিমি গর্তে ঢুকল পাশের বাজপড়া তালগাছটার মাথা থেকে “ক্বা কা কাআআ!” ডাক ভেসে এল। বাকিরা চমকে ওপরপানে চেয়ে দেখ কিমোচা দাঁড়কাক বসে, ব্যাটা লুকিয়ে লুকিয়ে নজর রাখছিল। হাঁক ছেড়ে সাবধান করে দিল শিকোকে। পিকাবুলি টিনিয়া সাঁআআ করে উড়ে গিয়ে ঝাঁপাল কিমোচার ওপর। ওরা দু’জন আকারে ছোটো হ’লে কী হ’বে, বিখ্যাত গোয়েন্দা জিমি ব্যান্ডোর ওরা ডান আর বাম হাত। ওদের আবার সাহসের কী অভাব! পিকাবুলি আর টিনিয়ার দেখাদেখি ময়না বাবা মাও তাড়া করল কিমোচাকে। ক্ষুদ্র হ’লেও ‘একতাই বল’। চার চারটে পাখির আক্রমণে কিমোচা আর পালাতে পারল না। সবাই মিলে ওকে ধরে ওই তালগাছটারই গুঁড়ির সাথে বেঁধে ফেলল।
ওদিকে ল্যাসো ঘোরাতে ঘোরাতে তো জিমি এগিয়ে চলেছে। গর্তের একটু ভেতরে যেতে বেশ লম্বা চওড়া উঁচুপানা একটা খুপরিতে পৌঁছল। সামনে দেখল শিকো পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে “খ্যাঁক খ্যাঁক খ্যাঁক্কোস” করে হাসছে আর নিজের হাতের ধারালো নখগুলো পাশের পাথরে ঘষে আরও ছুঁচলো করছে। তার সামনে চারটে ময়নাছানা মোমো মিমি মুমু আর মিউমিউ কাঁপছে ভয়ে থরথর করে। জিমি আর দেরি না করে ল্যাসোটা বনবন করে ঘুরিয়ে হুউউশ করে ছুঁড়ল শিকোর গলা লক্ষ্য করে। ল্যাসোটা গলায়
মালার মত গলে যেতেই দিল হ্যাঁচকা টান। ব্যাস! একদম ফাঁসির দড়ির মত আটকে গিয়ে জিভ বেরিয়ে গেল শিকোর। জিমি জোরে চিৎকার করল,
-“অ্যাটাআআআক”
ময়নাছানারাও শিকো বেকায়দায় পড়েছে দেখে সাহস ফিরে পেল। ঠুকরে আঁচড়ে শিকোর গায়ের লোম, ঝাড়ুর মত লেজ সব ছিঁড়েখুঁড়ে একশা করল। কম কষ্ট দিয়েছে নাকি শয়তান শেয়ালটা ওদের। বেশটি করে পিটিয়ে তারপর ঠ্যাং ধরে টানতে টানতে শিকোকে বাইরে নিয়ে এল সকলে মিলে।
ময়নামতী আর মধুকুমার তো ছানাদের দেখে ছুট্টে উড়ে এসে বুকে
জড়িয়ে ধরল। ছানার সব জানাল মা বাবা আর গোয়েন্দা জিমি
ব্যান্ডোকে। ইরাবতী ওদের বন্ধ চোখে ওড়ার কায়দা শেখানোর নাম করে চোখ বেঁধে দিয়েছিল। ওরা তো কিছু সন্দেহ করেনি। হঠাৎই তারপর শিকো আর কিমোচা এসে ওদের ধরে বেঁধে, এই গর্তে এনে রেখেছিল। ভাগ্যিস জিমির প্রখর বুদ্ধিকে ফাঁকি দিতে পারেনি ইরাবতী, তাই তো সব ধরা পড়ল।
পিকাবুলি টিনিয়া সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠল,
-“গোয়েন্দা ব্যান্ডো... জিমি ব্যান্ডো ... জিন্দাবাদ!”
জিমি বলল,
-“হয়েছে হয়েছে, সূয্যি ডোবার আগে এই তিনটে ক্রিমিনালকে নিয়ে গিয়ে জঙ্গলের বাইরে দূর করে দিয়ে আসতে হবে। চলো টমটম একটু কাঁধ লাগাবে চলো দিকি।”
মধুকুমার বলে উঠল,
-“কাল দুক্কুরে কিন্তু আমাদের বাড়িতে সব্বার নেমন্তন্ন।”
ময়নামতী যোগ করল,
-“আমি ফিঙেদিদির দেওয়া স্পেশাল রেসিপিতে বোলতার ডিমের চচ্চড়ি বানাবো।”
মোমো মিমি মুমু আর মিউমিউ সমস্বরে বলে উঠল,
-“ইয়াম ইয়াম! হিপ্ হিপ্ হুররে!”
দারুণ দারুণ দারুণ! অসম্ভব ভাল লাগল। e জমানার বাচ্চাদের ভারি ভাল লাগবে। একদম perfect balance.
লেখকের সমস্ত লেখাই পড়েছি। চমৎকার উপস্থাপনা- ছোটোদের গল্প বলার মত একদম-
সব গল্প একত্র করে, সুকান্ত মন্ডলের আঁকা এ'রকম ছবি দিয়ে সুন্দর বই হয়- বাচ্চারা খুব খুশি হবে।
বাঃ! ছোটোদের জন্য চমৎকার উপহার। গল্পের সাথে ছবিও চমৎকার।
আররেকি ভাল এই গল্পটা। দারুণ।
অসাধারণ লাগলো। মনে পড়ে যায় নিজের ছোটবেলা যখন বড় কেউ পড়ে শোনাতেন 'চেঙা বেঙা', 'নাকাল নেংটি' বা রাশিয়ার উপকথা। ছবিতে -লেখায় এ এক অনন্য উপহার।
সক্কলকে অনেক অনেক ধন্যবাদ জানালুম :)
- সুস্মিতা