অলংকরণ: রমিত
গলি থেকে বেরিয়েই তমাল একটা মিনিবাস পেয়ে গেল। ঢিক ঢিক করে বাসটা প্রায় নাগালের বাইরে চলে গেছিল। কোনোরকমে পেছনের সিটে বসা ছেলেটার দৃষ্টি আকর্ষণ করাতে সেই চিৎকার করে বাসটা থামাল। গত রাতে হঠাৎই খেয়াল হয়েছিলো যে রোববারে প্রথম মেট্রো নটায় ছাড়ে, সিনেমাও তো শুরু ঐ সময়ে। গদারের ছবি ভালো ভিড় হবে, অন্তত সাড়ে আটটায় গিয়ে লাইনে দাঁড়াতে হবে। তমাল ঠিক করলো এক ঘণ্টা আগে বেরোবে, অটোয় অটোয় হাজরা চলে যাবে, তারপর ওখান থেকে কিছু একটা পেয়ে যাবে। নাকি ক্যাব নেবে, অন্তত তিনশো টাকা, সেটা বড্ড বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। ফাঁকা বাসটা দেখে মুহূর্তে ডিসিশন পাল্টাল, একটা সাইডের সিট নিয়ে জমিয়ে বসে পড়ল। মোবাইলে সময় দেখল, হেসেখেলে সোয়া আটটার মধ্যে পৌঁছে যাবে। মোটামুটি শীত পড়ে গেছে, এতো সকালে অর্ধেক দোকানই খোলেনি। বাবুর দোকানের বাইরে ট্রেতে একগাদা দুধের প্যাকেট ডাঁই হয়ে পড়ে আছে। রবিনের দোকানে সবে কচুরি ভাজা শুরু হয়েছে। বাঁশদ্রোনি পৌঁছাতে পৌঁছাতে গাড়ি ভর্তি হয়ে গেল। বাজারও তখন আড়মোড়া ভেঙে সবে জেগে উঠছে। তমাল যার থেকে সবজি কেনে সে তখন ভ্যান থেকে মাল নামিয়ে পসরা সাজাচ্ছে। যে বয়স্ক মানুষটা তার সাথে থাকে তাকে খুব হম্বিতম্বি করছে। আজব মানুষ এই লোকটি। শীতের সময়েও হাতকাটা গেঞ্জি পরে থাকে আর মুখ ভর্তি গুটখা। নিজের মতো করে ইংরাজিতে কথা বলে। কেউ বেশি দরাদরি করলে ফুটিয়ে দেয়। এক দিন খদ্দের কম ছিল, তমালকে পাকড়ে কানের কাছে ফিসফিস করে বুঝিয়েছিল কীভাবে এই ব্যবসা করে তিন তিনটে মেয়ের সে বিয়ে দিয়েছে, শুধু ছোট মেয়ের সময়েই সাত লাখ। হুঁ, কি বুঝলেন!
প্রায় এক যুগ বাদে সে মিনিবাসে উঠল। এখন মেট্রো যেমন, একসময় মিনিবাস ছিল যাতায়াতের অন্যতম মাধ্যম। পাড়ার রাস্তায় লাইন দিয়ে গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকতো। ঘর থেকে বেরিয়েই ফাঁকা বাসে উঠে পড়, কত সুবিধা, কি আরাম! মিনিবাসের মালিক তখন এলাকার শের। ভরা জরুরি অবস্থা তখন। যুব কংগ্রেসের রমরমা। প্রাণ বাঁচাতে কিছু বামপন্থী কর্মীও তাদের সাথে ভিড়ে গেছে। দল ভারি করার জন্য ঢালাও লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে, নতুন সব রুট চালু হচ্ছে, প্রায় রোজই কারো না কারো নতুন গাড়ি বেরোচ্ছে। তমালের বন্ধুবান্ধবরা তখন সদ্য কিশোর, কেউ সবে স্কুলের গণ্ডি পেরিয়েছে, কেউ বড়জোর কলেজের ফার্স্ট ইয়ার, কেউ তস্য বেকার। বাস্তবে পড়াশুনা ডকে উঠেছে, সকাল থেকে রাত অবধি পাড়ার রকে, চায়ের দোকানে অন্তহীন আড্ডা। গড়ের মাঠে নিয়মিত খেলা দেখতে যাওয়া, অনাদি কেবিনের মোগলাই, ধর্মতলায় হলিউডি সিনেমা, ‘রোমান হলিডে’, ‘হোয়ার ইগলস ডেয়ার’, প্যাপিলন……। এরই মধ্যে কদাচিৎ অতি বাম পত্রপত্রিকায় চোখ বুলানো, নিজেদের অজান্তেই নিষিদ্ধ রাজনীতির দিকে একটা ঝোঁক তৈরি হওয়া। ভাল-মন্দ, ঠিক-বেঠিক, উচিত-অনুচিত সম্পর্কে কোনও পরিষ্কার ধারণা তখনো তৈরি হয়নি, রাজনীতি সম্পর্কেও ধারণা ধোঁয়াটে। এলাকার দাদারা বুঝত ছেলেগুলো বেশ নির্ভেজাল, পাড়ায় সবাই সুনজরে দেখে, এরা সাথে থাকলে নিজেদের ইমেজটাও বেশ চকচকে হয়, মানুষ সমীহ করে। তাই তারা তমালদের প্রশ্রয় দেয়। এই দাদারাই মিনিবাসের সিন্ডিকেট, ইউনিয়ান সব কন্ট্রোল করে। মালিক শ্রমিক উভয় পক্ষই এদের হাতে। এরা হ্যাঁ করলে কেউ ডিউটি পায়, নচেৎ পায় না। এরা তমালদের ফোকটে শহর ঘোরার সুযোগ করে দেয়। মাঝেমধ্যেই তমাল দুতিনজন বন্ধু নিয়ে সামনে ইঞ্জিনের পাশে লম্বে সিটটায় বসে পড়ে। বিনা পয়সায় ধর্মতলা, বাবুঘাট চক্কর মেরে আসে। মিনিবাসে ফ্রী ঘোরা তাদের অধিকারে দাঁড়িয়ে যায়, যখনই আড্ডায় বোর হয়ে যেতো তারা একটা গাড়িতে চেপে বসত। ড্রাইভার কন্ডাকটার কেউ তাদের ঘাঁটাতে সাহস করতো না।
হঠাৎ বাসটা ডান দিকে ঘুরে গেল! কি হল ব্যাপারটা? যাত্রীদের মধ্যে একটা গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ল। তমাল এতক্ষণ খেয়ালই করেনি যে গাড়ি পুরো ঠাসা, ঘাড়ের ওপর লোক ঝুঁকে পড়ছে। কিন্তু আনোয়ার শাহ রোডে বাসটা ঘুরে গেলো কেন? এরকমটা তো মহরমের দিন হয়। তমালের মাথায় চিন্তাটা আসতেই একজন বলে উঠলো,
নিশ্চয়ই মুসলমানদের কোনও পরব!
এদের তো পরব লেগেই আছে, আরেকজন ফুট কাটল।
ড্রাইভারের কেবিনের খাঁচায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এক যুবক কান থেকে হেডফোনটা খুলে গলা তুলে বলে উঠলো, কেন হিন্দুদের পরব কম কিছু আছে না কি?
বাহ রে, ছোকরার তো বেশ সাহস, তমাল মনে মনে তাকে তারিফ করল। কিন্তু আসল ব্যাপারটাই তো জানা হল না, রুট চেঞ্জ হল কেন?
আরে দাদা কিছু বলুন। এতো মহা ফ্যাসাদে পড়লাম, আমি যাব ভবানিপুর, আর আপনি তো যাদবপুরের দিকে চললেন।
আমি কি নেতা না মন্ত্রী যে জানবো, কন্ডাক্টার খেঁকিয়ে উঠল। পুলিশ না যেতে দিলে কি আমি জোর করে যাব? বাস দাঁড় করাচ্ছি, যান গিয়ে ট্রাফিককে জিজ্ঞাসা করে আসুন।
ইতিমধ্যে লর্ডসের মোড় এসে গেছে। এখান থেকেই তো বাপি অ্যারেস্ট হয়েছিল। কী অদ্ভুত না! এতদিন বাদেও এখান দিয়ে গেলে এই কথাটা ঠিক মনে পড়ে যায়। তমাল ভেবেছিলো বাঁ দিকের ফ্লাইওভার ধরে হয়তো বাস দেশপ্রিয় পার্ক হয়ে যাবে, কিন্তু তাও তো নয়, সাউথ সিটি মল ক্রস করে যাদবপুর থানার দিকে সেটার গতি। মাঝারি গতিতে চলেছে, এদের তো মজা, রোববার সকালে এতো প্যাসেঞ্জার তো ভাবাই যায় না। তমাল মোবাইল দেখল, সবে আটটা বাজতে পাঁচ, যথেষ্ট সময় আছে। এক্সাইড মোড় যাবে তো, সে চেঁচিয়ে উঠল। কন্ডাক্টার তার দিকে হাত তুলে আশ্বস্ত করল।
নতুন ছেলে। আগে হেল্পার থেকে ড্রাইভার সবাইকে তমাল চিনত। এখন কদাচিৎ দুএকজন পুরানো লোক চোখে পড়ে। চোখাচুখি হলেই বলে দেয় কোন বাসটা যাবে কিংবা আদৌ তখন কোনও বাস আছে কি না। আগে তো অফিস টাইমে লম্বা লাইন পড়ে যেত। তমালের কোনও দিন কোনও অসুবিধা হতো না। ড্রাইভারের গা ঘেঁষে ইঞ্জিনের ওপরে কিংবা পেছনে একটা কাঠের তক্তার ওপর ঠিক জায়গা হয়ে যেত। এখন তমাল বোঝে এই সামান্য কিছু সুবিধার জন্য কত উল্টোপাল্টা ঘটনায় অজান্তেই তারা শামিল হয়ে গেছে। এলাকার ক্ষমতার খেলায় তারা মাঝেমাঝেই বোড়ে হয়ে গেছে। চকচকে উদোম পেটানো শরীর, হাতে খোলা পিস্তল, দৃপ্ত ভঙ্গিতে হেঁটে চলেছে একটা মানুষ যার চোখ দুটো দিগন্তে নিবদ্ধ, ঠিক যেন দিওয়ারের বচ্চন! এখনো ঐ দৃশ্যটা তমালের চোখে ভাসে। উল্লসিত জনতা সেই লোকাল বচ্চনের পেছন পেছন, যাদের মধ্যে তমালরাও আছে। কি উত্তেজনা, রীতিমতো রোমাঞ্চকর! কি ব্যাপার, কোথায় যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে তারা কিছুই জানে না! এরকম আরও কত ঘটনা…….পাড়ার ক্লাবে একটা ছেলেকে মেরে প্রায় আধ মরা করে দেওয়া হল। কারণটা যে কি ছিল সেটা এখনো এতো বছর পরেও তমালের কাছে পরিষ্কার নয়।
কাকু এক্সাইড যাবে তো? দাঁড়িয়ে থাকা ছোকরা তার সামনের সিটে বসে পড়েছে। বাস তখন যোধপুর পার্ক পেরোচ্ছে।
যাবে যাবে
আপনিও তো নন্দন?
কি করে বুঝলেন?
জামার ফাঁক দিয়ে ডেলিগেট কার্ডের ফিতেটা উঁকি মারছে।
উরেব্বাস! এতো পুরো ফেলুদা! তমাল ভাবল।
যাই বলুন গদার এমনিতেই তো দুরূহ, তার ওপর যদি প্রথম থেকে না দেখা যায়……………
গদার শহরে বহুবার হয়েছে, যত ভিড় হবে ভাবছ ততো হবে না, তমাল দেখল যুবক তার ছেলের বয়সি তাই ‘তুমি’ করে বলল।
আপনার অনেক দেখা না?
ঐ দুচারটে, তমাল ফটফট করে কটা নাম বলে দিল।
ঢাকুরিয়া ব্রিজ ক্রস করে বাস আর এগোয় না। একদম স্ট্যান্ড স্টিল, বাম্পার টু বাম্পার ট্র্যাফিক!
যারা রাসবিহারি যাবেন তারা গড়িয়াহাটে নেমে পড়ুন, ওদিকে বাস যাবে না, কন্ডাক্টার হেঁকে দিল।
ব্যস কয়েকজন রাগে ফেটে পড়ল। এটা তো আগে বলনি ভাই, একি মগের মুল্লুক না কি? কারণটা কি সেটাই তো বোঝা যাচ্ছে না, পুরো রুট ঘুরিয়ে দিলেন, টালিগঞ্জ থেকে যাদবপুরের দিকে চলে এলেন?
আরে দৌড় হচ্ছে দৌড়, পেছন থেকে এক ভদ্রলোক বলে উঠলেন। তমাল পেছনে তাকিয়ে দেখে বেশ এক জাঁদরেল প্রৌঢ়, চোখে পুরু ফ্রেমের চশমা, মোবাইল খুট খুট করছেন। বাসের অধিকাংশ লোকের চোখ তখন তার দিকে।
দৌড়! কে একজন বিস্ময় প্রকাশ করলেন।
ম্যারাথন। এক কোম্পানি স্পনসর করেছে, তা ধুমসো ব্যাটা বেটিরা সব শর্টস বারমুডা পরে হৈ হৈ করে রাস্তায় নেমে পড়েছে। পুরো শহরের ট্র্যাফিক ঘেঁটে ঘ!
তা সেটা আগে থেকে এনাউন্স করবে তো।
তাহলে মেট্রো সকাল থেকেই চালু করা উচিত ছিল, আমরা তো মেট্রোতেই যাতায়াত করি।
দেখুন ঐ কোম্পানির কাছেও নেতারা টাকা খেয়ে বসে আছে…….
কাকু ঝুলে গেলাম……….ছেলেটার কণ্ঠস্বর কাতর।
এবার তমাল তাকে কোনও আশ্বাস দিতে পারলো না। তার নিজেরই নার্ভাস লাগছে। সময় মতো পৌঁছাবে তো? মোবাইলে দেখল আটটা দশ।
কলকাতার রাজপথে ম্যারাথন, বেশ অভিনব বটে। স্কুলে তো তাদের প্রতি বছরই হতো। বয়স অনুযায়ী গ্রুপ করা হতো, রুটও সেই অনুযায়ী ঠিক হতো। একবার কি করে যেন তমালের নাম বয়স্ক ছেলেদের গ্রুপে পড়ে গেল। কঠিন প্রতিযোগিতা, প্রতিদ্বন্দ্বীরা তার থেকে বড়সড়, রুটও লম্বা। স্কুল গেট পেরিয়ে, হাইওয়ের পাশ দিয়ে সামান্য কিছুটা গিয়ে গ্রামের ধানক্ষেতে নেমে যাওয়া। আল ধরে ছোটা, যারা আরও পটু তারা ক্ষেতে নেমে যায়, কাটা ধানের গোছ মাড়িয়ে উর্ধশ্বাসে সামনে এগিয়ে যায়। তারপর দীনদরিদ্র গ্রামের পথ, পেটফোলা অর্ধনগ্ন বাচ্চাকাচ্চাদের অবাক দৃষ্টি, মাঠের পর মাঠ, তারপর সেই অন্তহীন আম বাগান। সেখানে প্রবেশ করে তমালের হঠাৎ যেন দম বেড়ে গেল, তুমুল বেগে দৌড়ানো শুরু করলো এবং অবশেষে পঁয়ষট্টি নাম্বারে শেষ করলো। একশো প্লাসের মধ্যে পঁয়ষট্টি খুব খারাপ কি?
বহুক্ষণ ঢিকির ঢিকির করে, দাঁড়িয়ে গড়িয়ে অবশেষে বাস গড়িয়াহাট পেরোল। তখন সাড়ে আট বেজে গেছে।
ভবানিপুর যারা যাবেন তারা ফাঁড়িতে নেমে পড়ুন। মিন্টো পার্ক ধরার চেষ্টা করবো, চাইলে সেখানেও নামতে পারেন। কোনও ঠিক নেই কিন্তু। আগে থেকে বলে দিলাম, পরে আমাকে গাল দেবেন না, কন্ডাক্টার হাঁক মেরে সবাইকে জানিয়ে দিল।
পাবলিকের চিল্লামিল্লি, গুঞ্জন স্তিমিত হয়ে গেছে, সবাই বুঝে গেছে বাস যে ভাবে যাচ্ছে সেভাবেই যাবে, এর অন্যথা কিছু হবে না। এটাই নিয়ম, তমাল ভাবল। আল্টিমেটলি সবাই সব কিছু মেনে নেয়। প্রথমে একটু হম্বিতম্বি, তারপর যে কে সেই! কোনও সমস্যার প্রতিকারের কোনও চেষ্টা আছে কি? তমাল একটু অবাক হল, হঠাৎ মাথায় এধরণের চিন্তা, এই সময়ে, নন্দনে গদার দেখতে যাওয়ার পথে? ধুস!
কয়েক বছর আগে সেই লোকাল বচ্চনের সাথে হঠাৎ বাজারে দেখা। কোথায় সেই খালি গায়ে পিস্তল হাতে বীরপুঙ্গব, এতো লুঙ্গি ফতুয়া পরা আদ্যোপান্ত এক ছাপোষা মানুষ। সেই বিশাল ছাতিটা নেতিয়ে যাওয়া ফুলুরির মতো চুপসে গেছে, কাঁধ ভেতরে ঢুকে গেছে, ফতুয়াটা যেন একটা হ্যাঙ্গারে ঝুলছে। মাথায় টাক, কোথায় সেই ঢেউ খেলানো চুল। তার পেছনে সেই মারমুখী জনতাও নেই, সেই কুৎসিত উল্লাসও নেই। তার হাতে একটা প্লাস্টিকে ফুল, বগলে একটা ব্যাগ আর মুখে একটা আধপোড়া বিড়ি।
বৃহস্পতিবার তোমার বৌদির পুজো থাকে তাই বাজারে আসতেই হয়, বুঝলে।
পাড়ায় ফিরে এসেছ, জানতাম না তো?
অনেক দিন হল
কোথাও দেখি না?
বেরোই না, সংসারধর্মেই সময় কেটে যায়, বলে একটা ম্রিয়মাণ হাসি।
রাজনীতি…….
সে সব কবে পাট চুকে গেছে, আচ্ছা চলি বলে সে হনহন করে হাঁটা দিল, নিমেষের মধ্যে জনতায় মিশে গেল। বেচারা পালাল, জানে তমাল আরও অনেক কিছু জানতে চাইবে। এতদিনের অতীতটা তো পুরো রহস্যাবৃত।
কী হয়! সেই পঁচিশ বছরের তরতাজা যুবক এলাকায় যার দোর্দন্ডপ্রতাপ, আজ এক মিইয়ে যাওয়া ভাঙ্গাচোরা মানুষ, নিজের উদ্দাম যৌবনটাকে যেন একটা ইরেজার দিয়ে মুছে দিয়েছে!
ভবানিপুর নেমে যান, মিন্টো পার্ক যাবে কি না বলতে পারছি না, আমি কিন্তু বারবার আপনাদের জানাচ্ছি, ভবানিপুর! ভবানিপুর! করে কন্ডাক্টার হাঁক মারল, বাসের সাইডে দুচারটে চাপড় দিল।
ওয়েদার ম্যারম্যারে। শীতের মরা রোদ আর কি রকম একটা স্যাঁতস্যাঁতে ভাব। নন্দনের এসি খুব স্ট্রং, একটা চাদর নিয়ে এলে হতো, তমাল ভাবল। ছেলেটা এর মধ্যে কখন টুক করে এসে তমালের পাশে বসে পড়েছে। বাঁ হাতে দামি মোবাইল, ইয়ারফোনটা গলায় ঝুলছে। অন্য হাতে একটা পাতলা পেপারব্যাক, লেখকের নামটা দেখা যাচ্ছে না।
কাকু সোজা গিয়ে যদি পার্ক সার্কাসের ফ্লাইওভার ধরে নেয়?
এটা যে তমালের মাথায় আসেনি এমনটা নয়, চিন্তাটা সে মনের গহ্বরে ঠেলে দিয়েছিলো, ছেলেটা সেটা উস্কে দিল।
তাহলে তো একেবারে রেস কোর্সে গিয়ে নামাবে?
অত চিন্তা করছো কেন, দৌড়াবে, ইয়াং ছেলে…….
দেরি হয়ে যাবে ঢুকতে, কিছুই বুঝতে পারবো না।
তমাল কিছু বললো না। চিন্তাই হচ্ছে ফ্লাইওভারের শেষ মাথায় গিয়ে ফেললে অনেকটা হাঁটা। মর্নিং ওয়াক অনেক দিন হল বন্ধ হয়ে গেছে, হাঁটাচলার এখন খুব একটা অভ্যাস নেই।
কাকু যদি কিছু মনে না করেন একটা কথা জিজ্ঞাসা করব?
করো
না আমি প্রায় আপনার ছেলের বয়সি, এই বলছিলাম কি……ছেলেটা একটু নড়েচড়ে বসল।
বলে ফেল। ডোন্ট হেজিটেট
গদারে খুব সেক্স আছে না?
তমালের হাসি পেয়ে গেল। সে তো থাকবেই, পার্ট অফ লাইফ! ব্রেথলেস, ম্যাস্কুলিন ফেমিনিন, আলফাভিল, সে মনে করার চেষ্টা করলো। সেরকম রগরগে তো কিছু নেই। কথা আছে অনেক, বুঝলে, অ্যাকশন কম। আর আছে রাজনীতি, ভিয়েতনাম, নেপাম বম্ব, বব ডিলান......... সেই বিখ্যাত দৃশ্য, দুই যুবক গাড়ির পিছনে স্ক্রল করছে ‘পিস ইন ভিয়েতনাম’।
না আমাদের এখানে তো সবকিছুই খুব রাখাঢাকা…….
হঠাৎ বাসটা বেশ স্পিড তুলল, কোয়েস্ট মল পেরিয়ে আর একটু এগিয়ে বাঁ দিকে ঢুকে গেল।
এবার শান্তি হয়েছে, ফ্লাইওভার ধরছে না, মিন্টো পার্ক হয়ে এক্সাইড ধরবে, ব্যস আর কি! সবে পৌনে নটা, সিনেমা শুরুর আগেই ঢুকে যাবে।
ছেলেটার মুখে হাসি। তমালের চোখে চোখ রেখে পুরানো প্রসঙ্গে ফিরে এলো, এবার আমার প্রশ্নের উত্তরটা দিন।
খুব সিম্পল, আমাদের সমাজে সেক্স নিয়ে অনেক ইনহিবিশন্স রয়েছে, সেটা ওদের ওখানে নেই, সেটাই তাদের শিল্প সংস্কৃতিতে প্রকাশ পায়।
এই ছবিটায় সেক্স আছে?
মনে হয় না, এটা মূলত কমেডি
কোন ছবিতে আছে?
অল্পবিস্তর অনেক ছবিতেই, প্রেনাম কারমেন, পিয়েরে লে ফু। একটা দৃশ্য আছে মুখের সিগারেটটা বার করে নিয়ে মেয়েটা বেলমন্ডোকে চুমু খাচ্ছে, তমাল প্রগলভ হয়ে পড়ল।
এগুলো তো কোনটাই এই ফেস্টিভ্যালে নেই, ছেলেটা প্রায় আর্তনাদ করে উঠল।
কেন, কনটেম্পট আছে, এইতো দু দিন বাদেই। ব্রিজিৎ বার্দো! উফ, ফাটাফাটি!
আপনার দেখা? ছেলেটা উত্তেজনায় তমালের উরু চেপে ধরল।
হ্যাঁ, কিন্তু আবার দেখব।
কি নাম বললেন?
কনটেম্পট
না না সিনেমা নয়, ঐ যে…..
ব্রিজিৎ বার্দো, নাম শোনোনি, ষাট-সত্তর দশকের সেক্স বম্ব! তমাল নিজের অজান্তেই এই রসালো আলোচনায় মজে গেল। আরও কিছু বলতে গিয়েও চেপে গেল, হাজার হলেও ছেলেটা হাঁটুর বয়সী। ছোটো থেকেই সে এচোঁড়ে পাকা ছিল। যুবক বয়সেই কীভাবে যেন ‘এন্ড গড ক্রিয়েটেড উওম্যান’ দেখে ফেলেছিল, যে ছবি করে বার্দো সিনেমার জগতে আলোড়ন ফেলে দিয়েছিল। তার কয়েক বছর বাদে কার্জন পার্কের ফুটপাতে দুম করে সেই লাস্যময়ীর একটা জীবনী পেয়ে গিয়েছিল। বইটার একটা চাঞ্চল্যকর তথ্য তমালের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল। প্রথম বার যৌনমিলনের পর উল্লসিত সদ্যকিশোরি বার্দো বাড়ির বাইরের ব্যালকনিতে দু হাত তুলে ভুবনজয়ীর ভঙ্গীতে প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছিলো, অবশেষে আমি নারী!
গোর্কি সদন থেকে একটু এগিয়েই বাস থেমে গেল। সামনে লম্বা লাইন। ছেলেটা নেমেই তীর গতিতে ছুটল। কাকু আপনি আসুন, আপনার জায়গা রাখব।
তমাল হাঁপিয়ে, কঁকিয়ে, গালি খেতে খেতে যখন নন্দনে ঢুকল তখন অ্যাঞ্জেলা সন্তান ধারণ করার জন্য মরীয়া। তার প্রেমিক এমিলে অপারগ, রাস্তার এক প্রৌঢ়কে জিজ্ঞাসা করছে, আমার বান্ধবী অন্তসত্ত্বা হতে চায়, আপনি একটু সাহায্য করবেন।
সে বেচারা কাঁচুমাচু মুখ করে বলে, মাপ করবেন, আমার না আজকে একদম সময় নেই।