ছবিঃ pixabay
১
গাছেরও মানুষ-নাম হয়, এ বাড়িতে আসার আগে জানত না ইন্দুলেখা । উঠোনের মোটা গুঁড়ির আম ফলের গাছটা, নাক ফজলির আর গুঁড়ি পুকুরের পাড়ে ওটা হিমসাগর । দুটো গাছের নাম মুখে আনতে পারে না সে, তবে মনে মনে বলায় কোন বাধা নেই, উঠোনের গাছটার নাম, স্বর্গীয় গোলোকনাথ সাহা, তার শ্বশুর । পাড়ের গাছটা স্বর্গীয় ভুজঙ্গ সাহা, শ্বশুরের বাবার, ব্রজকিশোরের দাদু । ব্রজকিশোর, তার স্বামী, তার নামেও গাছ আছে, রাধাগোবিন্দ জীউ’র দোচালা মন্দিরের সামনে । সেটা আম নয়, জোড়া গাছ, তেঁতুলকে জড়িয়ে একটা বট । পাড় জুড়ে গাছ । সুপুরি, নারকেল, কাঁঠাল আর লম্বু গাছ । লম্বুগাছগুলিকে দেখলেই হাসি পায় । যেন রোগা সিঁড়িঙ্গে লোকের মাথায় বাবরি চুল! সরু লম্বা গাছগুলির মাথায় গুচ্ছ সতেজ পাতা । এদের সবার নাম আছে । ব্রজকিশোরের পূর্বপুরুষদের । ওইদিকে স্বর্গীয় পঞ্চানন সাহা, ওখানে স্বর্গীয় হেমচন্দ্র সাহা...
-এত গাসের নাম তুমি দিসঅ? অত নাম মনে আসিল তোমার!
-নাহ বাবা দিসে,তার আগে বাবার বাবা দিসে ।
পুকুরপাড়ের গাছ ছাড়িয়ে বিস্তৃত পাটের জমি । গ্রাম বিচ্ছিন্ন শ্বশুরের এই ভিটেকে চারপাশ ঘিরে রেখেছে ক্ষেত । উচ্ছের লতা জড়ানো ভারা আল ধরে সোজা চলে গেছে দূরে । আলের পথে ইতস্তত ছড়িয়ে গেছে লাল হলুদ পাকা করলা । এক অংশে তিলের ক্ষেত । হাওয়া লেগে পুজোর ঘণ্টির মত নড়তে থাকে সাদা তিল ফুল । লক লক করে কচুর পাতা । লতি বিক্রি হয় হাটে । আর পাটের সবুজ যতদূর চোখ যায় । মানুষ সমান এখন পাট গাছগুলি । বর্ষায় চূর্ণির জল খাল ভাসিয়ে এসে জমিতে ঢোকে । সেই জলে পচতে থাকে পাট । ইন্দু ভাবে, কেমন বীজ ছড়ানোর পর পরই চারা গজিয়ে তর তর বেড়ে উঠতে পারে এরা । বিকেলে উঁচু আলে দাঁড়িয়ে দেখে, দখিনা হাওয়ায় উড়তে থাকে তার খোলা চুল । হু হু করে ওঠে বুক । ভেতরের শ্বাস নাকের বাইরে এসে মৃদু ফোঁস করে, বাঁশির ফুটো দিয়ে বাতাস যেমন ।
-মাইয়া লোকের নামে তো একটাও গাসের নাম রাখে নাই কেউ!
স্নানেরও শব্দ আছে । ভোরবেলার একটাই সময়ে ব্রজকিশোর মরচে ধরা টিউবওয়েল পাম্প করে ঘটি ঘটি জল ঢালে মাথায় । স্নানান্তে বিষ্ণুর দ্বাদশ নাম স্মরণ করে । গলায় তুলসি কাঠের মালার সঙ্গে আরেকটি ফুটো কড়ি আটকানো মালা । কীর্তন দলে গান গায় ব্রজকিশোর, পালা গানে সখী সাজে । দুষ্টের ছলের অভাব নেই, কে কখন বিদ্যা করে তাঁর গানের গলা নষ্ট করে দেয়, তাই ঐ মন্ত্রপুত মালা । দ্বাদশ অঙ্গে তিলক কাটার নিয়ম তবু একমাত্র কণ্ঠে খড়িমাটির তিলক কাটে ব্রজকিশোর । কণ্ঠে গোবিন্দের অধিষ্ঠান । রেকাবি হাতে যায় ফুল চয়নে । ঠাকুরকে ফুল মিষ্টি জল দিতে হয় । নয়নতারা আর সাদা টগরে ভরে থাকে রেকাবি ।
স্নানের শব্দে চোখ মেলে তাকায় ইন্দু । ঘুটঘুটে অন্ধকার মাটির ঘরে চারকোণা একটা ফোঁকর, কাঁটা বাঁশের কঞ্চি ঢাকা । সেটা দিয়ে সাদা আলো আসে । বিছানায় উঠে বসলে সবুজ পাট ক্ষেত দেখা যায় । চৌহদ্দিতে দুটো আলাদা খড়ের ছাউনি দেওয়া মাটির ঘর । প্রত্যেকটার সঙ্গে চিলতে মাটির বারান্দা । বাঁশের ঠেকনায় ধরা খড়ের চাল । পুকুরের পাড় বরাবর ঘরটা আগে ছিল রাধাগোবিন্দের । সারাদিন ক্ষেতের কাজের পর বারান্দায় বসে শ্বশুর খোল বাজিয়ে নাম গান করত । রোজ সন্ধেবেলা গুটিকয় ভক্তবৃন্দ ঘিরে বসত তাকে । কোন এক ভোর রাতে গৃহত্যাগী হয় গোলোকনাথ সাহা । দোচালার জোড়া মন্দির হবার পর ঠাকুর উঠে গেছেন সেখানে । সঙ্গে নতুন এক কালী মূর্তিরও স্থাপন হয়েছে । কাপড়ে ঢাকা মৃদঙ্গটা এখন দেবতার শূন্যস্থানে দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে । ঘরটা এখন ব্রজকিশোরের । এখানেই তার বাস, একা । ঘুম থেকে উঠে ঘর, বারান্দা, উঠোন ঝাঁট দেয় ইন্দু । গোয়াল পরিষ্কার করে । গাই বাছুর বের করে খুঁটোতে বেঁধে দুই হাঁটুর ফাঁকে বালতি বসিয়ে দুধ দোয় । খড়ের জাবনা কেটে তাড়ে ঢেলে পুকুরে যায় বাসন নিয়ে ।
সকাল সকাল স্নান সেরে, তুলসি গাছে জল ছিটিয়ে শাশুড়ি এসে মন্দিরের কাজে লাগে । ধুতি পেড়ে কাপড়, ভারি চেহারার সুহাসিনীর কপালে চন্দনের রসকলি । মন্দিরের বারান্দাটা লাল সিমেন্টের । গ্রামের কোন ভক্ত করে দিয়েছিল । সেটা ধুয়ে ঝাঁটিয়ে ঠাকুরের বঁটিতে ফল কুটতে বসে সুহাসিনী । গাছের কলাটা, আমটা ভক্তরাই দিয়ে যায় । অঘোর বামুন দুইবেলা আসে পুজো করতে । প্রথমে রাধাগোবিন্দর পুজো, তারপর কালী । বৎসরান্তে ভক্ত সম্মিলন হয় । ব্রজকিশোরের গুরুদেব আসেন । অষ্টম প্রহর হরিনাম গুনগান কীর্তন চলে । গ্রাম থেকে দলে দলে এসে সব ভোগ খেয়ে যায় । নিঃসাড় ভিটেটা জেগে ওঠে মানুষের কোলাহলে ।
ফল কুটতে কুটতে সুহাসিনী নজর করে ইন্দুকে । পুকুরে শরীর ভিজিয়ে আসা দীর্ঘাঙ্গী ইন্দুর দেহের গড়ন দেখে । ভেজা কাপড়ে পুকুর থেকে উঠে আসতে আসতে ইন্দু তাকায় শাশুড়ির দিকে, চোখ নামায় । বিড়বিড় করে সুহাসিনী, রাধাগোবিন্দ, রাধাগোবিন্দ! ছেলে-বউমার সঙ্গে থাকে না সে, গ্রামের ভেতরে বিধবা বোনের কাছে থাকে । বউকে নিয়ে ছেলের আশ্রম জীবন । দুপুরে রাধাগোবিন্দর ভোগ রান্নার জন্য ইদানীং বায়না ধরেছে ব্রজকিশোর ।
-রাতে গোপীনাথ স্বপ্নে এসেছিলেন মা, ফলাহারে তাঁর মন ওঠে না, বললেন, তোরা যাই খাস দুটা সিদ্ধ ভাত শাক, আমারেও দিস । রাধাগোবিন্দর অন্নসেবা লাগে মা ।
ইন্দু নয়, বোনের বাড়ি থেকে ঠাকুরের ভোগ রান্না করে আনেন সুহাসিনী । কাঁসার থালায় ঘি মাখানো ভাত, আলুর সাদা তাল, ভাতের চূড়োয় ধোয়া তুলসির পাতা বসানো । চমৎকার গন্ধ হয় । দেবতাকে অর্পণের পর সুহাসিনী থালা হাতে বোনের বাড়ি ফিরে যায় ।
গাছের ঠাণ্ডা ছায়ায় পড়ে থাকে একটা প্রাচীন ঢেঁকি । শাশুড়ি ওখানে চাল গুঁড়ো করে মাঝে সাঝে, ইন্দুকে ডেকে নেয় ইশারায় । মাথার ওপর বাঁশটা ধরে শাশুড়ি বউমা ঢেঁকির পাড় দেয় নীরবে ।শুধু পাড় দেবার শব্দ হতে থাকে অবিরাম ...
২
ফুলশয্যা হয়নি ইন্দুলেখার । বিছানায় আঁজলাভরা নয়নতারা ফুল ছড়িয়ে তার ওপর দু-পা মুড়ে বসে স্বামী শুধিয়েছে,
-গান শুনবা?
ব্রজকিশোর কীর্তনের সুরে খালি গলায় কয়েক কলি কৃষ্ণদাসের পদ গায় ।
সখীর স্বভাব এক অকথ্য কথন ।
কৃষ্ণ সহ নিজ লীলায় নাহি সখীর মন ।।
কৃষ্ণ সহ রাধিকার লীলা যে করায় ।
নিজ কেলি হইতে তাহে কোটি সুখ পায় ।।
রাধার স্বরূপ কৃষ্ণ প্রেম-কল্প লতা ।
সখীগণ হয় তার পল্লব পুষ্প পাতা ।।
গান থামিয়ে কবিয়াল যেমন কথা ধরে, কিছুটা মেয়েলি সুরে ব্রজকিশোর বলেছে,
-ইন্দুলেখা নাম তোমার, আহা, জানো কে এই ইন্দুলেখা? রাধারানীর পরমশ্রেষ্ঠ সখীদের একজন গো । ললিতা, বিশাখা, চিত্রা, চম্পকলতা,ইন্দুলেখা!
থুতনি তুলে ধরে স্বামী । মুখে কী দেখে । উথালি পাথালি করে ইন্দুর । চরম ক্ষণটি বুঝি এল । না, আসে না । হ্যারিকেনের বাতি উসকে দিয়ে ব্রজকিশোর উঠে দাঁড়ায় । স্বামীকে সম্পূর্ণ দেখে । লম্বা সিঁড়িঙ্গে, মাথায় বাবরি চুল । পরনে ধুতি, সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি । গলায় তুলসি কাঠের মালা, কণ্ঠ তিলক অস্পষ্ট, খড়িমাটির গুঁড়ো লেগে আছে । কণ্ঠির উঁচু হাড় গাইবার সময় ঠেলে বেরিয়ে আসে । মেয়েছাঁদ মুখ, হাঁটাটাও দুলে দুলে ।
-পালা গানে সখী সাজি যে গো, দেখবা?
বলে বাইরে অন্ধকারে কোথায় বেরিয়ে যায় । ফিরে এসে ঘরে যে ঢোকে তাকে দেখে আঁতকে ওঠে ইন্দু । শাড়ী, ব্লাউজ, মুখে রঙ চং মাখা বউ! লাল ঠোঁটে সাদা দাঁত বের করে হাসে ব্রজকিশোর । হাতে হাতে ঠুকে রঙিন কাঁচের চুড়ির থোকা ঝন ঝন করে বাজিয়ে দেয় । দুলে দুলে খানিক নাচও দেখায়, বসে পড়ে, মাথার উইগ খুলে দেয় । ব্লাউজের ভেতর হাত ঢুকিয়ে বের করে আনে দুটো কাপড়ের গোলা, দু হাতে তুলে তাকে দেখায়, হাসে ।
সারারাত ঘুমোতে পারেনি ইন্দু সেদিন । খাটের ওপর শাড়ি ব্লাউজ পরা এক পুরুষের ভোঁস ভোঁস ঘুমনোর শব্দ । দেয়ালের চারকোণা ফোঁকরের দিকে তাকিয়ে বসে থেকেছে সে । অন্ধকার পাটের বনে হাওয়া লেগে সর সর করে । দূর গ্রাম থেকে ভেসে আসে খোলের আওয়াজ । কারা কীর্তন গাইছে এত রাতে...
পর পর কয়েকটা রাত । ব্রজকিশোর বোঝায়, বাইরে সে পুরুষ কিন্তু ভেতরে তার শ্রীরাধিকা । মহাপ্রভুর মত । রাধার যেমন পরম প্রিয়কে পাওয়ার আকুলতা, সেভাবে ডাকতে পেরেছে বলেই না ব্রজকিশোর পেয়েছে কৃষ্ণ গোঁসাইকে! রোজ তার স্বপ্নে গোপীনাথ আসেন ।
-আহা, অন্তরে নারী না থাকলে কি কণ্ঠে সুর আসে গো? শিল্পী হয়? সাধক হয়? মনে নারীর ব্যথা, নারীর সমর্পণ না দিলে কি এমন অশ্রুপতন হয়? সব মানুষই হল তোমার ঐ দ্বৈত,দুই । নারীরে জড়ায়ে উঠে পুরুষ গাছ ।
মন্দিরের সামনে তেঁতুলকে জড়িয়ে থাকা বটগাছটার কথা ভাবে ইন্দু ।
রাতের পর রাত । বিছানাকেই হরিবাসর করে তোলে ব্রজকিশোর । ইন্দু হাই তোলে । কোন কোন রাতে স্বামীর গান শুনতে শুনতে তার কোলেই ঘুমে ঢলে পড়ে । মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় স্বামী । ততদিনে ইন্দু বুঝে উঠতে পেরেছে, সে ঠকে গেছে, ব্রজকিশোর উত্থানরহিত।
৩
রাধাগোবিন্দের পাশেই কালী মূর্তি । গায়ের রঙ নীল, স্মিত মুখে ধরা বাঁশি, নিধুবনী কালী । শিবের ছাতির ওপর জিভ বের করে দাঁড়ানো কালীর উগ্র মূর্তি পছন্দ নয় বৈষ্ণবদের । তাই এই মূর্তি রচনা । ব্রজকিশোর যখন কীর্তন দলের সঙ্গে চলে যায় কৃষ্ণনগরের কোন গ্রামে গাইতে, আলো পড়ে আসা বিকেলগুলোয় ইন্দু মূর্তিটার সামনে দাঁড়ায় । তেল ভরা মাটির প্রদীপ জ্বলে । আলো আঁধারিতে ছমছমে দেবী রূপ । এমন মূর্তি সে আগে দেখেনি । কৃষ্ণ নয়, কালির মুখেই বাঁশি দেখতে ভালো লাগে । মোহমুগ্ধ তাকিয়ে থাকে । রাধাকৃষ্ণ মূর্তির আরেক কোণে অনাদরে স্থাপিত । একা লাগে দেবীকে । চোখে শান্ত পিপাসা নিয়ে তিনি তাকিয়ে থাকেন যুগল মূর্তির দিকে ।
সাইকেলের বেল বাজে । পাটক্ষেতের গা ঘেঁষে সরু আল ধরে চলে যায় নিধু মাস্টার । ঝুঁকে থাকা পাটের পাতা ছড়ে যাচ্ছে হ্যান্ডেলে । হাত তুলে সে বলে যায়, হরে কৃষ্ণ! ইন্দু চোখ নামিয়ে ফিস ফিস করে, হরে কৃষ্ণ । পালাতে চেয়েছে ইন্দু এই বাড়ি ছেড়ে । শাশুড়ি তখন বোনের বাড়ি গিয়ে ওঠেনি । নজরের তীক্ষ্ণ পাহারায় থেকেছে । এক আধবার সেই চোখে চোখ রেখেছে । মুখে নয়, দৃষ্টি আর নজরে কথা হয়েছে । দৃষ্টি প্রশ্ন করে,
-সেলের বিয়া দেলেন কেন? সব জানতেন, তবু ঠগাইলেন । জীবনডা নষ্ড করলেন আমার ।
নজর ধমকে ওঠে,
-সুপ মার মাইয়া, বড় সোহাগের লোভ, না? লজ্জা শরম নাই? নষ্ড? কিডা নষ্ড? ঘর সংসার কর, সাধন ভজন কর, নিরামিস খা । শুক্লপক্ষের পূর্ণিমা তিথির অষ্টম দিনে রাধাগোবিন্দের নামে উপাস দে । দেহের তাপ শান্ত অইব । দিয়া দে, গোবিন্দ গোঁসাইরে সব দিয়া দে । অ্যাদ্দিন আমি জীবনডা কাটাইলাম কেমনে?
দৃষ্টির সঙ্গে নজর পেরে ওঠে না যখন, চোখ নামায় সুহাসিনী ।
-ব্রজ তার বাপের মতন বিবাগী না হয় । রঙে ঢং-এ ভুলাইয়া রাখবা ।
-আপনের সোয়ামির তো টিকে নাই, মন!
-আমার ব্রজ গেলে বাঁচবা না রে বউ!
রাতে মুখোমুখি বসিয়ে কাম-ইচ্ছা বন্ধনের পাঠ দেয় ব্রজকিশোর ।
-কামকে জ্বাল দিয়া ঊর্ধ্বরেতা করতে পারলে হয় প্রেম । বাউল সাধনে যেমন, কৃষ্ণ সাধনেও তেমন । এই যে গরুর দুধে জ্বাল দাও, উতরায়ে পড়লে হবে না, জ্বাল দিয়া দিয়া গাঢ় কর । খেজুর রস হাঁড়িতে রাইখা দিলে গ্যাঁজলা উঠে । জ্বাল দিলে, গুড়, রাধাগোবিন্দের প্রেম তেমনই, কামগন্ধ নাই ।
ইন্দু বোঝে না, স্থির তাকিয়ে থাকে । তত্ত্বজ্ঞানী স্বামী সাধনগীতি ধরে ।
কামনা বাসনা আদি
তাই দিয়ে সাজালেম বেদী
বয়ে যায় মা আসান নদী
কুলহারা সাগরে ধায়
ধুপ জ্বেলেছি হৃদ মন্দিরে
দীপ জ্বালি নাই ।
সাজায়েছি ফুলের ডালা
মালা গাঁথি নাই ।
-শুধু কামনা বাসনা দিয়া বেদী সাজালে গো, দীপ জ্বাললে না! প্রেমের প্রদীপ জ্বালতে হয় ।
পালানোর চেষ্টা করেছে ইন্দুলেখা । গাঁয়ের ভেতর শত নজর । পাট ক্ষেত দিয়ে হেঁটে গেলে কায়েত পাড়া, বাউরি পাড়া । কাপালিদের বসতি পেরিয়েই বাস রাস্তা । বাস ধরে সোজা দেবগ্রামে দাদার কাছে । বউদি খোঁটা দেয় দিক । মুখ বুজে পড়ে থাকবে, তবু এখানে নয় । ঠা ঠা দুপুরে শাশুড়ির চোখ লাগতেই কাপড়ের পুঁটলি হাতে পাট বন দিয়ে ছুট ছুট । বামে দেবল রাজার পুকুর । কত আগের কথা । এক কুমোর রাজা হয়েছিল । তার মাটির মহল । মহলের চারপাশে পরিখা । পরিখা খোঁড়ার মাটি জমে টিলার মত উঁচু সব ঢিবি । বিশাল এই পুকুর খুঁড়েছিল । জল পেত সারা গ্রাম । দেবল রাজা বড় ভক্ত । রাধাকৃষ্ণের মন্দির গড়েছিল । রাস উৎসবে ভেঙে পড়ত গ্রামকে গ্রাম । রাজা হয়েও সে তার পেশা ভোলেনি । সারাদিন চাকা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মাটির তালে কত কি গড়তো।
এক সাধুর পরশপাথর চুরি করেই কুমোর নাকি রাজা হয়েছে । নালিশ হয় । সমন পেয়ে দেবল রাজা যাবে শহরে, কাজির কাছে । সঙ্গে দুটো পায়রা । একটা সাদা, একটা সবুজ । রাজা মামলা জিতলে মহলের চূড়ায় উড়ে এসে বসবে সাদা কবুতর, হারলে সবুজ পায়রা । মামলা হারলে রাজা আর ফিরবে না । অসম্মান নিয়ে রাজা বেঁচে থাকবে না । রাজা না বাঁচলে রাজার পরিবারও বাঁচবে না । দেবল রাজার নির্দেশ, সবুজ পায়রা উড়ে এলে তার পরিবারের সবাই যেন পুকুরে ঝাঁপ দেয় । মামলায় জিত হয় রাজার কিন্তু ভুল করে দেয় সবুজ পায়রা উড়িয়ে । রাজা গ্রামে পৌঁছনোর আগেই পরিবারের কুড়িজন সদস্য সেই গভীর জলাশয়ে ঝাঁপ দিয়ে মরে । সেই দুঃখে রাজাও ঝাঁপ দেয় । এমনই গল্প ঘোরে গ্রামের ঘরে ঘরে । টিলা প্রমাণ মাটির ঢিবি সব সময়ের জলে ধুয়ে গেছে । অভিশপ্ত পুকুর আসছে বুজে । সেখানে মাটি কাটার কাজ চলে । মাটি কাটতে কাটতে উঠে আসে করোটি, হাড়গোড় । লোকে বলে দেবল রাজার ঘরের লোক । যারা এই গল্প মানে না তারা বলে, নীলকর সাহেবরা মেরে পুঁতে দিয়েছিল যে চাষাদের! তবু কারা যেন অশরীরী হয়ে পূর্ণিমার রাতে পাট বনে ঘুরে বেড়ায় । চাঁদের আলো পড়ে মায়াময় হয়ে থাকে পাট ক্ষেত । তারা ঊর্ধ্ববাহু হয়ে দলবেঁধে নাচে, কীর্তন গায় । মৃদঙ্গ বাজে । সেই মৃদঙ্গ তৈরি করে দেবল রাজা । মৃৎ অঙ্গ, মাটি দিয়ে গড়া অঙ্গ যার । কতবার কষ্টিপাথরের কৃষ্ণ উঠে এসেছেন সেই পুকুর থেকে । কতবার অষ্টধাতুর যুগল । পুলিশ এসে নিয়ে গেছে মূর্তিগুলো । সরকারি সম্পদ ।
কানাই দাস, বলাই দাস দুই ভাই দেবল রাজার পুকুরে সারা দুপুর কোদাল চালায় । পুকুরের মাটি চুরি করে । অসুরের চেহারা তাদের । আগে ডাকাত ছিল, নাম ছিল করিম শেখ, মহিম শেখ । মুসলমান, বৈষ্ণব ধর্ম নিয়েও ছোঁক ছোঁক যায়নি । এখনও এদিক ওদিক চুরি চামারি করে বেড়ায় । স্বভাব দোষে দুজনেরই বউ পালিয়েছে । কোদাল চালায় আর তাদের কষ্টি পাথরের গা বেয়ে দর দর ঘাম নামে । ঝুড়ি ঝুড়ি মাটি কেটে গরুর গাড়িতে করে দূর গ্রামে বেচতে যায় । চাষের কাজ ছাড়া এখানে কোন কাজ নেই । ছেলেপুলেরা লায়েক হয়ে উঠলেই সীমান্ত পাহারার কাজে চলে যায় দলে দলে । হৈ দূরে দেখা যায় পূব বাংলার সীমানা, এখন বলে বাংলাদেশ । সন্ধেবেলা দুই ভাই চলে যায় কীর্তনের মহড়ায়, বায়না পেলে দলের সঙ্গে খোল বাজাতে যায় । কাপড়ের পুঁটলি কোলে একটা মেয়েমানুষকে পুকুর পাড়ে উঠতে দেখেই কোদাল ফেলে ছুটে আসে দুই ভাই । পথ আটকে দাঁড়ায় । কানাই পান খাওয়া দাঁত বের করে হাসে । বলে,
-রাধেকৃষ্ণ! বউদিদি, একলা যাইবা কই? ঘরে ফিইরা যান!
বলাই কবিগানের দোয়ারকির ঢঙে দাদাকে সঙ্গত দেয়,
-ঘরে ফিইরা যান!
সাইকেলের বেল বাজে আবার । ঘুটঘুটে আঁধারে কিছু দেখা যায় না । ছাত্র পড়িয়ে ফিরে যায় নিধু মাস্টার । ব্রজকিশোর না থাকলে হা হা নির্জনতায় বুক ফেটে মরে যেতে ইচ্ছে করে ইন্দুর । সে ব্রজকিশোরের সঙ্গে যেতে চায়,
-ভয়ে যে মরে যাই । নিয়ে চল গো আমারে, তোমার সাথে আমিও সখী সাজি?
-সে হয় না । কিসুই জানো না তুমি, কিছু শিখও না । ভয় কীসের? রাধাগোবিন্দ আসেন, মা কালী আসেন । বিপদে তাঁরা রক্ষা করবেন।
৪
বাঁশঝাড়ে বাতাস লেগে ভুতুড়ে শব্দ ওঠে । প্রেতাত্মার ছায়ার মত উঠোনে, পুকুর পাড়ে সার দাঁড়িয়ে এ বংশের পূর্বপুরুষগণ । বৃক্ষনামা । যেন কোন বোবা সাক্ষীর মত থমথমে মুখে তারা চেয়ে থাকে । ডাহুক ডেকে চলে একটানা । রাতপোকাদের কট কট । গাছের পাতায় ঝড়ঝড় করে ওঠে কোন রাতপাখি । এমন নির্জন অন্ধকারে দুইজনা আসতে পারে, এক অশরীরী, নয় সে প্রেমিক । অঘোর বামুন আসে, রাধাগোবিন্দের মন্দিরের পুজারী । বৈষ্ণব ধর্ম নিয়ে এখনও বামুন! মাটির প্রদীপের সলতে উসকে দেয় ইন্দু । মন্দিরের লাল সিমেন্টের মেঝেতে উবু হয়ে বসে থাকে অঘোর । মাথা নিচু । তার এই বিনীত ভাব ভালো লাগে । ভিখিরির মত আসে । জয় রাধে! ভক্তরে দুটি অন্ন দিবেন মা-এর মতন আহ্বান! আমি পরম বৈষ্ণব, আপনার অন্নেই দেবতার ভোগ । অঘোরের স্ত্রী শয্যাশায়ী, দুই মেয়ে । একটি ছোট, অন্যটি ইস্কুলে পড়ে । রাজি হয়নি ইন্দু । অঘোর জোর করেনি । সাধকের ধৈর্য আর অধ্যবসায় নিয়ে বসে থেকেছে নির্জন মন্দিরে, রাতের পর রাত । ইন্দু হার মানে একসময় । এখন নিঃসাড় পায়ে অঘোর ঢোকে তার ঘরে । তেল ফুরিয়ে সলতে পুড়ে ছাই হতে থাকে । মন্দিরের প্রদীপ নিভে আসে । অন্ধকারে নিঝুম দাঁড়িয়ে থাকেন কুল দেবতারা ।
সকালে ঠাকুরের বঁটিতে ফল কুটতে কুটতে সুহাসিনী নজর করে ইন্দুকে । পুকুর থেকে ভেজা কাপড়ে উঠে আসতে আসতে ইন্দু তাকায় শাশুড়ির দিকে । দৃষ্টি জিজ্ঞেস করে নজরকে,
-ও, তাই এমন কইরা রাতে একলা সাইরা যান?
নজর বঁটির পানে নামে ।
-ভাবেন, এমন কইরা বাইন্ধা রাখবেন?
-একডা পুলাপান আইলে সংসারডায় মন টিকব তর, বংশ টিকব ।
দৃষ্টি হাহা হাসে । বৃক্ষরাজিকে কটাক্ষে দেখে ।
-কার পুলাপান?
-গোবিন্দর । তিনিই গভ্ভ ধারণ করাবেন । বাকি সব নিমিত্ত ।
বিকেলে লাল গাইটার জন্য যখন খড় কুচোতে বসে, খুঁটোয় বাঁধা গাইটা তাকিয়ে দেখে, তাকে দেখিয়েই মাটিতে শোয়া বাছুরটাকে চেটে দেয় সস্নেহে ।
সন্ধেবেলা মন্দির চাতালে দোতারা গলায় ঝুলিয়ে শ্রীনাম গাইছে ব্রজকিশোর । সাইকেল থেকে নেমে মন্দিরটায় এসে চুপ করে বসে নিধু মাস্টার।
গৃহে থাক, বনে থাক, সদা হরি বলে ডাক,
সুখে দুঃখে ভুল না’ক
বদনে হরিনাম কর রে ।।
মায়াজালে বদ্ধ হয়ে, আছ মিছে কাজ লয়ে,
এখনও চেতন পেয়ে,
রাধামাধব নাম বলরে ।।
ব্রজকিশোরের গুরুদেব যখন আসেন, তত্ত্বকথা হয়, খোল, করতাল, হারমোনিয়াম আর আড়বাঁশিতে গান হয় মহা সমারোহে । এক কোণে বসে শোনে নিধু মাস্টার, চোখে জলের ধারা । ক্যানসারে প্রিয়তমা বউ মরেছে গেল বছর । টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারেনি । তিল তিল করে চোখের সামনে সে মরে যায় । এ ভব সংসার ব্যর্থ মনে হয় । সে সাধকের পা জড়িয়ে ধরে,
-আমারে সঙ্গে নিয়ে চলেন বাবা, দীক্ষা দেন । গণ্ডীর জীবন থেকে মুক্তি দেন, আর সহ্য হয় না ।
গুরুদেব বলেন,
-অশ্রুপতন সহজ নয় গো । তান মান গান রসে মজাইয়া যেমন । সুর ছন্দ আর কথা মিলে নাম । সেই নাম করতে করতে ভক্তি গাঢ় হয়, ভাব আসে । ভাব গাঢ় হলে আসে প্রেম । প্রেম স্পর্শ করে শোক, বিবেক, তবেই না অশ্রুপাত!
-এই অশ্রু কেবল নিজের কারণে বাবা, নিজের স্বার্থের কারণে ব্যাকুল হইসি ।
-ভক্তি আসে? নইলে কী করবা গিয়া? গাঢ় ভক্তিতে ঈশ্বর আপন হন । হালকা ভক্তি হল বাইরের । বহিরঙ্গ নিয়া করে নাম সংকীর্তন, অন্তরঙ্গ নিয়া হয় প্রেম আস্বাদন ।...সন্ন্যাসীর এ জীবন আমারও কি ভালো লাগে? নীলাচলের পথে যেতে যেতে মহাপ্রভুও গেয়ে উঠেসিলেন,
সন্ন্যাস লইনু যবে ছন্ন হইল মন,
কিবা কাম সন্ন্যাসেতে প্রেম প্রয়োজন ।।
বুজলে হে, সন্ন্যাস নয়, প্রেম প্রয়োজন তোমার ।
গানের শেষে শুনশান মন্দিরে একা আরও খানিকক্ষণ বসে থাকে নিধু মাস্টার । ইন্দু প্রদীপ রাখতে যায় । নিধু মাস্টার তাকিয়ে দেখে তাকে । ব্রজকিশোরের এই বউটির বড় দুর্নাম গাঁয়ে । নিষ্ঠাবান বৈষ্ণবের ঘরেও এমন অসংযমীর বাস! তবু বড় রহস্যের, বড় আকর্ষণের এই নারী! গান শোনার, প্রসাদ পাবার অছিলায়, ছেলে ছোকরা থেকে বুড়ো মুরুব্বিরাও চাতালে উবু হয়ে বসে থাকে, যদি ডাক আসে! নিধু মাস্টার মুখে বলে, হরে কৃষ্ণ! তাকায় না ইন্দু । ফিস ফিস করে, হরে কৃষ্ণ! এক মুখ চাপদাড়ি, অগোছালো মাথার চুল । বউ মরা, ছন্নছাড়া পাগল একটা লোক । গাঁয়ের গরীব ছাত্রদের মানুষ করা যার ব্রত । আবার বৈষ্ণব না হয়েও মহাপ্রভুকে নিয়ে পদ লেখে । সেই পদে সুর দিয়ে গায় ব্রজকিশোর । ছাত্র পড়িয়ে ফেরার সময় কখনো মন্দিরে এসে বসে । ব্রজকিশোরের গান শোনে । ইন্দু একা থাকলে আসে না । অন্ধকার ধানক্ষেতের আল দিয়ে ভেতর গ্রামের দিকে তার সাইকেলের বেলের শব্দ মিলিয়ে যায় । নামগানে শান্তি খুঁজতে এসেও কেমন অস্থির হয়ে থাকে মানুষটা । প্রদীপ রেখে পিছন ফিরে চলে যায় ইন্দু । জানে, তাচ্ছিল্যে ভরা দুটো চোখ চেয়ে থাকে তার চলে যাওয়ার দিকে ।
৫
অঘোরের শ্রান্ত দেহের লোম নখে কুরে কুরে ইন্দু বলে,
-আমারে নিয়ে পালায়ে চলেন ঠাকুর ।
ব্রজকিশোরের আলাদা ঘর । অঘোর চলে আসে মন হলেই । কে জানে কেন, রাতের মুহূর্তগুলোর সময়ই ব্রজকিশোর এখন বারান্দায় খোল নিয়ে বসে । রাত গভীর পর্যন্ত বাজাতে থাকে । শুরুতে অসুবিধে হত । ইন্দু আনমনা হয়ে পড়ত, অঘোরের মনসংযোগে বাধা । যেন শব্দ দিয়ে মৃদঙ্গ তার অনুচ্চার আর্তনাদ রেখে যায় । তারপর অভ্যেস হয়ে গেছে । খোলের শব্দেই বরং অঘোরের শরীর জাগে এখন ।
-সংসার আসে যে । রুগ্ন স্ত্রী, সন্তানাদি । মাইয়া দুইডা বড় বাপ সোহাগী হইসে ।
ভুল করে একটা সবুজ পায়রা উড়ে এসে বসে নাকি তার ঘরের চালে? অথচ সাদা পায়রাটারই আসবার কথা ছিল । অধৈর্য হয়ে পড়ে ইন্দু দিন দিন । বুঝে শুনে অঘোর আসা কমিয়ে দেয় । অথচ দিনের আলোয় কত স্বাভাবিক পুরুষ মানুষ । ঠাকুর প্রণামে গেলে শান্তি জল ছিটিয়ে দেয় মাথায় । চাল ফল মূল গামছায় বেঁধে দিতে বলে । অমলিন হেসে শুধোয়, সব কুশল মঙ্গল তো মা জননী?
এখন একেক রাতে শূন্য বিছানায় নিষ্ফল খোলের তান যখন দরজায় এসে ধাক্কা দেয়, অস্থির ইন্দু চেঁচিয়ে ওঠে,
-থামঅ, থামঅ! শান্তিরে ঘুমাইতে দিবা না নাকি!
খোল থেমে যায় ।
পাটক্ষেতের ভরা বনের মধ্য দিয়ে ছিঁড়ে ফুঁড়ে সে ছোটে । বাস রাস্তা কত দূর? দেবল পুকুরের পাড়ে এসে গতি শ্লথ হয় । কোদাল ফেলে কাঁঠাল ছায়ায় দাঁড়িয়ে বিড়ি টানছে কানাই বলাই । তাদের সবল শরীর বেয়ে ঘাম গড়িয়ে নামে । কানাই হাত জড়ো করে,
-জয় রাধে বউদিদি! আবার কোথা যাইতে আসেন একলা?
-দাদার কাসে । সাইরা দে রে একটিবার ।
-কী দিবা?
-আমার কাসে তো কিছু নাই, সুদু বাসভাড়াটুকু ।
-ডাকাতি সাইরা খাঁটি বৈষ্ণব হইসি এখন আমরা, ভিক্ষা যে দিতি হবে বউদিদি । এট্টু পোসাদ দেন তবে । গাঁ সুদ্ধ ভোগ পাইতাসে শুনতে পাই, আমরা কী দোষ করসি!
বলাই হাত বাড়িয়ে বলে,
-আমরা কী দোষ করসি?
খি খি হাসির শব্দকে পেছনে ফেলে ছুটে ঘরে ফিরে দোর দেয় ইন্দু ।
ভক্ত সমাগম মন্দিরে । চার কীর্তনিয়া মৃদঙ্গে ঝড় তুলেছে । নেচে নেচে বাজাচ্ছে তারা । হরিবোল ধ্বনিতে বারে বারে ঊর্ধ্ববাহু হচ্ছে ভক্তরা । গুরুদেব আজ পুজো করছেন । রাধাগোবিন্দ আর নিধুবনী কালী । কৌপীন ছেড়ে নারীর সাজ তাঁর আজ । আজ তিনি গুরুমা । লালপেড়ে কাপড়, লাল ব্লাউজ । মাথায় দীর্ঘ নকল কালো চুলের সম্ভার । ভোগ আরতির পঞ্চপ্রদীপ ঘোরাতে ঘোরাতে মন্ত্র বলেন জোরে জোরে । সারা অঙ্গ তাঁর দুলে দুলে নেচে যাচ্ছে । ঘামে ভেজা ললাটের লাল টিপ ঘেঁটে গেছে । চেনা যাচ্ছে না মানুষটাকে । ভয় করছে । আজ নারী শক্তির ভর গুরুদেবের ওপর । গ্রামের বউরা ভিড় করেছে । কেউ কেউ মাটিতে সাষ্টাঙ্গ হচ্ছে । গুরুমা’র মুখ দিয়ে আজ ভগবান কথা বলবেন । সবার মনোবাসনা পূর্ণ করবেন ।
রাত বাড়লে পুজোর কাজ সমাধা হয় । আসনে উপবিষ্ট শ্রান্ত, বিধ্বস্ত গুরুমারূপী গুরুদেব । এখনও সাজ ছেড়ে রাখতে পারেননি । সামনে স্থির একটি দীপ জ্বলছে । রাতের আহার তাঁর সামান্য । কয়েক টুকরো ফল সেবা করেন আর ডাবের জল । অন্য কারও হাতে অন্ন গ্রহণ করেন না । ইন্দু তবু কাঁসার গ্লাসে লাল গাইয়ের ঘন দুধ এনে রাখে । হাঁটু মুড়ে বসে । আজ তারও চাইবার আছে । সব শোনেন তিনি । মৃদু হাসেন ।
-অক্ষম নয় আমার ব্রজকিশোর । পুরুষ আদলে আসলে নারী জন্ম তার । প্রাকৃত সৃষ্টি তার দ্বারা সম্ভব না । ভাব রসের অপ্রাকৃত সৃষ্টির পথেই তার মুক্তি ।
-কোন উপায় নাই বাবা?
তিনি ভাবেন,
-বয়েস হইসে আমার, তবু দেহ এখনও বীর্যবান । কিন্তু তোমার এ যে কঠিন সাধন মা, পারবা?
ইন্দু স্পষ্ট চোখে দেখে নারীরূপী সাধককে, অধরে বক্র হাসি ফুটে ওঠে । ধীরে মাথা নাড়ে, পারবে ।
৬
প্রতি গ্রীষ্মে খটখটে শূন্য আর শীর্ণ হয় চূর্ণির খাল । রাধাচূড়ার ডালে ডালে বাতাস লেগে ঝুর ঝুর ঝরে পড়ে পাতা, ফুল উড়তে থাকে প্রখর রৌদ্রে । গাছের তলায় পরিপাটি করে হলুদ ফুলের বিছানা পাতে রোজ । ক্লান্ত ফকির, সাধকরা বিশ্রাম পায় সেখানে । জমির আল ধরে গাইতে গাইতে যায় কোন বাউল,
মন তুই রইলি খাঁচার আশে
খাঁচা যে তোর তৈরি কাঁচা বাঁশে
কোনদিন খাঁচা পড়বে খসে ।
আলের ওপর সাইকেল থামিয়ে একমনে শোনে নিধু মাস্টার । দীক্ষা নিয়ে গুরুর দেওয়া নতুন নাম হয়েছে তার, শ্রীহরি দাস । কণ্ঠি ধারণ করেছে, গলায় তুলসি কাঠের মালা । দূরে গাছপালার ফাঁকে রাধাগোবিন্দ মন্দিরের চূড়া দেখা যায় । শ্রীচৈতন্য প্রবর্তিত দোচালা মন্দিরের প্যাটার্ন । খড়ের চাল সরিয়ে এখন পাকা হয়েছে । অনেকদিন যায় না সে, ঘেন্নায় । অথবা অন্তরস্থিত কীসের এক দহন । বহুকাল পর সে যখন ইন্দুলেখার কথা লিখবে,
‘তাহাকে জানিতাম পাপাচারিণী । মধ্যযামে ব্রজকিশোরের খোল বাজিলেই গ্রাম জানিত, গোঁসাই জায়ার ঘরে নতুন লোক ঢুকিয়াছে । কিন্তু যেইদিন হতে রজনীর দ্বিপ্রহরে কানাই দাস, বলাই দাস দুই ভাইকে মন্দির অঙ্গনে উবু হইয়া বসিয়া থাকিতে দেখিলাম, আমার সমস্ত প্রকার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙিল । যতই নাম ভাঁড়াইয়া বৈষ্ণব হউক তাহাদের বীজ হইল যবন মুসলমানের । ওহে নারী, তুই প্রকৃত নরকের দ্বার । আর কত নিচে নামিবি পতিতা? কিছুদিন মন্দিরের পথ মাড়াইলাম না । কিন্তু স্থির থাকিতে পারি না । ঐ পবিত্র স্থান কেমন নরককুণ্ডে পতিত হইতেছে ভাবিয়া ব্রহ্মতালু জ্বলিয়া উঠে । একদিন একাকী নির্জনে তাহাকে তীব্র ভর্ৎসনা করিলাম । তাহার বিকার নাই । হাসিয়া তত্ত্বকথা শুনাইল...’
-মন্দির তো এখানে নাই গো গোঁসাই, ঐ যে মন্দির, আমার ঘরে! সেখানে সাঁই আর গোঁসাইয়ে কোন ভেদ নাই, বামুন বাউরি মারামারি নাই, হিঁদু মোসলমানে সুঁতমারগো নাই । যাবা নাকি!
উপগত হবার আগে কানাই দাস, বলাই দাস পা চেপে ধরেছে ইন্দুর । মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করেছে । দেহ হল মন্দির, সেই পবিত্রতার কাছে মাথা নত হয়েছে । ক্লান্ত শরীর থেকে নেমে কোন অপরাধবোধে হাউ হাউ করে কেঁদেছে তারা । নিচ জাতের বীজ বহন যদি করেও বা, নারী শরীরকে তারাই প্রথম সম্মান দিয়েছে, আর কেউ না ।
নিধু মাস্টার লিখছে,
‘ক্রমে বুঝিতে পারিলাম ঘৃণা হইতেও অধিক এই নারীকে লইয়া প্রবল কৌতূহল আমার । অনাবৃত রহস্য যেন তার ঐ নৌকা সদৃশ চক্ষুতে জমা হইয়া আছে । সে চক্ষুতে অশ্রু নাই । মরা নদীর পারে শুষ্ক বালুতে যেরূপ অবহেলায় নৌকা পড়িয়া থাকে । ভিতর ফুঁড়িয়া আমার উঠিয়া আসে, কেন? কেন? সন্তান কামনায় অধীর নারী? নাকি একবার যে দ্বার খুলিয়া দিয়াছে তাহার অর্গল আর দিতে পারে নাই? অথবা সেই সব কিছুই নহে । নিছক ক্লেদ ঘাঁটিয়া সুখ খুঁজিতেছে?’
-যে পুরুষ মাইনসের তরে প্রেম নাই, তারে শরীরে ধারণ করবার জ্বালা তুমি কি বুঝবা গোঁসাই, আগে নারী হও!
৭
প্রকৃতির বিপুল সৃষ্টি রাজ্যে বৃক্ষে, লতায় যেমন ফুল আসে, রেণু মুখে উড়ে যায় মধুকর, অন্য ফুলে বসে । ফল হয়, ফলের বীজ ঠোঁটে উড়ে যায় পক্ষীকুল, দূরে কোথাও ফেলে । মাটি তার গর্ভে ধারণ করে সেই বীজ, জেগে ওঠে নবাঙ্কুর, তাদের পিতৃপরিচয়ের অপেক্ষা না রেখে, তেমনই স্বাভাবিকতায় সন্তান আসে ইন্দুলেখার । শিশু ক্রমে বালক হয় । ছুটে বেড়ায় অঙ্গনময় । অঘোর বামুন লুকিয়ে তাকে দেখতে গিয়ে মন্ত্র ভুলে যায় । বৎসরান্তে ভক্ত সম্মিলনে বালকের গলায় সুমিষ্ট হরিনাম শুনে মুখ উজ্জ্বল হয় গুরুদেবের । খেলতে খেলতে কখনো সে দেবলরাজার পুকুরের পাড়ে চলে এলে গামছায় ঘাম মুছে তার চিবুক ছুঁয়ে আদর করে দেয় কানাই, বলাই । আরেকজন দেখে তাকে দূর থেকে, সে ব্রজকিশোর । নিরুচ্চার অভিমান মুছে কখন যে কাছে যাবার আকুতি তৈরি হয়, সাহস হয় না । ইচ্ছে করে বালককে সঙ্গে নিয়ে যায় গাছেদের কাছে, চিনিয়ে দেয়, তোর পিতামহ, স্বর্গীয় গোলোকনাথ সাহা, পিতামহী, স্বর্গীয় সুহাসিনী দাসী । ঐ তোর প্রপিতামহ, স্বর্গীয় ভুজঙ্গ সাহা ।...
সন্ধের সংকীর্তনে দোতারা গলায় যখন গেয়ে ওঠে বালক,
নগর ভ্রমণ করি আমার গৌর এল ঘরে
ধেয়ে গিয়ে শচীমাতা গৌর কোলে করে ।
দেখরে বাপ নরহরি থেকো গৌরের কাছে ।
পরান পুতুলি গোরা ধূলায় পড়ে আছে ।।
ডুকরে কেঁদে ওঠে ব্রজকিশোর । অযাচিত বাৎসল্যের রসধারা অশ্রু হয়ে নামে তার দু’ চোখ বেয়ে ।
**
গল্প থামায় শ্রীহরি দাস ওরফে নিধু মাস্টার । শ্রোতা আমি, জিজ্ঞেস করি,
-আর ইন্দুলেখা?
- সবারে অবাক কইরা একদিন গৃহত্যাগী হয় । দুই টাকার নৌকা পারানি দিয়া নবদ্বীপ ঘাটে সেই যে গেল, আর ফিইরা আইল না । আশ্রম কইরা আসে । এখন সে গুরুমা । বালগোপালের ভোগ রান্না করে নিজের হাতে । গোপালকে স্নান করায়, ভোগ সেবা করায় তারপর সেই ভোগ নিজে গ্রহণ করে ।
-আপনি বললেন ইন্দুলেখার জীবনে পাঁচ গোঁসাই ছিল । পঞ্চমজন কি আপনি?
জিভ কেটে তিনি বলেন,
-রাধাগোবিন্দ! আরে না-না । কী এক রহস্যময় কারণে সে আমারে তার কাসেই ঘেঁষতে দেয় নাই!
-তাহলে ?
-খুঁজো, খুঁজার মত খুঁজলে তারে ঠিক পাওয়া যায়!
৮
ঘরের ফোঁকর দিয়ে এই মধ্যরাতে অপূর্ব আলো আসে । ইন্দুলেখা তাকায় । শরীরে চন্দন গন্ধ, হাতে তাঁর বাঁশি । গন্ধ আর ধ্বনিতে ভরে ওঠে ঘর । তিনি ইন্দুলেখার দেহে উপগত হতে চান । শরীর আর নিতে পারে না তাঁকে, বড় ভার, এই ভারে আনন্দ নেই, কষ্ট হয় কেবল। এ জীবনে মিলনের আনন্দ অধরাই থেকে যায় ইন্দুর । নিথর পড়ে থাকে । ঝাপসা চোখের কোল বেয়ে বিন্দু জল গড়িয়ে নামতে চায় । তা আটকে রাখতেই মৃদু অনুযোগের সুরে বলে ফেলে,
-প্রভু আপনার সেয়ে নিধুবনী কালী মায়ের মুখে বাঁশিটা মানায় ভালো!
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।