সারাদিন বসে রইল লোকটা। সন্ধেবেলায় পিনাকীবাবু বললেন, ‘ভাই আজ থাক।’ লোকটা ওর ক্ষয়াটে করাত লাল গামছায় পেঁচিয়ে নিল অন্যদিনের মতো। বলল, ‘দাদা এই নিয়ে তিন দিন হল। কাজ নেই তো ডাকেন কেন?’ পিনাকীবাবু পকেট থেকে খাম বের করলেন। লোকটা জানে, এর মধ্যে সাড়ে তিনশো টাকা আছে। সারাদিনের মজুরি। পিনাকীবাবু হাত বাড়িয়ে বললেন, ‘নিন।’ লোকটা অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে হাইস্কুলমাস্টারের দিকে। তারপর বলল, ‘কাজ না করে মজুরি নিতে আমার ভাল লাগে না স্যার। মনস্থির করে তার পরে না হয় খবর দেবেন। চলে আসব।’ লোকটা সাইকেলে উঠল। অন্ধকার হয়ে আসা গলির মুখে মিলিয়ে গেল।
কোকিলের মতো ডেকে উঠল পিনাকীবাবুর মোবাইল ফোন। এসএমএস এলে এমন ধ্বনি বাজে। উনি জানেন এই এসএমএসে কি লেখা আছে। ‘পরিবেশ রক্ষায় এগিয়ে আসুন। গাছ লাগান প্রাণ বাঁচান।’ প্রতিদিন সন্ধেবেলা এই এসএমএসটা ঢোকে। আর এগুলো পড়েই পিনাকীবাবু কোনও সিদ্ধান্তে আসতে পারছেন না।
ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন দীপা, মানে পিনাকীবাবুর স্ত্রী। বললেন, ‘তাহলে আমার মডিউলার কিচেনটা আর হল না, তাই তো? ভাগ্য করে এমন এক আধপাগলার সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিল আমার বাবা। তুমি মোবাইল চালাও নাকি মোবাইলটা তোমাকে চালায়? অদ্ভুত মানুষ বটে।’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে, আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মুছে ঘরে ফিরে গেলেন দীপা। রাত্রিবেলার খাবারদাবারের যোগাড়যন্ত্র করতে হবে এবারে।
ভাটপাড়া হাইস্কুলের বাংলার স্যার পিনাকী বসুকে পাড়ার লোকজন পাগলা স্যার বলেই জানে। প্রকাশ্যে কিছু বলার সাহস নেই, তবে আড়ালে আবডালে, মুদির দোকানে কিংবা সব্জি-মাছের বাজারে বছর পঞ্চান্নর পিনাকীবাবুকে দেখলেই লোকজনদের বলতে শোনা যায়, ‘ওই যে পাগলা স্যার আসছে। আজ আবার কি এসএমএস এল কে জানে।’ দোকানের সামনের জয়ায়েত পাতলা হয়ে যায় দ্রুত। পিনাকীবাবু দোকানে পৌঁছে পকেট থেকে মোবাইল বের করে বলতে থাকেন, ‘আজ কি এসএমএস এসেছে জানো? বলছে, মাসে মাসে দুশ করে জমালেই কুড়ি বছর পরে এক কোটির গ্যারান্টি। শুনেছ আগে?’ কিংবা ওঁকে বলতে শোনা যায়, ‘আজকের এসএমএসটা কি বলছে শুনবে না? অমুক কোম্পানি থেকে লিখছে, ওদের কানেকশান নিলেই প্রকৃত আনলিমিটেড ইন্টারনেট উপভোগ করা যাবে। আচ্ছা, এই প্রকৃত আনলিমিটেড ব্যাপারটা নিয়ে আমরা একটু জরুরি আলোচনা করে নিই?’ পাশে থাকা লোকজন বলে ওঠে, ‘দাদা এই ফালতু এসএমএসগুলো দেখেই উড়িয়ে দিতে পারেন না?’ পিনাকীবাবু এমন প্রশ্নে সচরাচর যে উত্তর দিয়ে থাকেন, তা হল, ‘উড়িয়ে দাও বললেই এভাবে ডিলিট করে দেওয়া যায় নাকি? ওরাও তো কিছু ভেবেই পাঠিয়েছে। এটা পাঠাতে ওদেরও কিছু পয়সা গিয়েছে। তার দাম নেই?’ এক এসএমএস থেকে উনি অন্য এসএমএসে যান। ‘মেজাজটা পুরো বিগড়ে দিল’, বলতে বলতে পাশে থাকা ভিড় পাতলা হয়ে আসে।
মোবাইলে আসা বার্তাগুলো মন দিয়ে পড়ার স্বভাবটা অনেকদিন ধরেই আঁকড়ে রয়েছেন পিনাকীবাবু। লোকেরা কেন যে হেলায় উড়িয়ে দেয় কে জানে। একই এসএমএস বারবার আসে। পিনাকীবাবুও বারবার পড়েন। পড়তে ক্ষতি কি। বেশ কয়েকদিন ধরে একটা এসএমএস পাচ্ছেন। তাতে লেখা, ‘কোনও আন্তর্জাতিক কল রিসিভ করার সময় আপনার ফোনে যদি ভারতীয় নম্বর প্রদর্শিত না হয়, তাহলে অনুগ্রহ করে এই টোল ফ্রি নম্বরে রিপোর্ট করুন।’ এখনও পর্যন্ত এমন কোনও ফোন পাননি পিনাকীবাবু। কিন্তু পেলে কি করা উচিত জেনে গিয়েছেন দিব্যি। এসএমএসটা অন্যদের মতো উড়িয়ে দিলে কি এই তথ্য ওঁর কাছে থাকতো! ব্যাঙ্ক থেকে প্রতিদিন এসএমএস করে বলে ডেবিট কার্ডের পিন নম্বর কাউকে না দিতে। তা সত্ত্বেও কত জালিয়াতির ঘটনা ঘটে প্রতিদিন। স্ক্রিনে অচেনা নম্বর দেখেও জিজ্ঞেস করামাত্র কার্ডের পিন গড়গড় করে বলে দিতে শুরু করেন লোকজন। ওঁরা যদি ব্যাঙ্ক থেকে পাঠানো এসএমএসগুলো পড়তেন নিয়ম করে, তাহলে হয়তো আরও অনেক বেশি সাবধানী হতেন। অনলাইনে লটারি খেলা নিয়ে কত এসএমএস আসে। কোটিপতি হওয়ার গল্প শোনায়। এখনও খেলে উঠতে না পারলেও এমন বাহারি বার্তাগুলো পড়তে লাগে বেশ। রিটেল চেইনগুলো এসএমএসের পর এসএমএস পাঠায় নিয়ম করে। মনে হয় শুধু পিনাকী বসুর জন্যই যেন তারা সাজিয়ে দিয়েছে ‘ধমাকাদার’ সেল। ওয়ালেটে নিজেরাই ১০০ টাকা ভরে দিয়ে দুহাত দুদিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে, ‘এসো, আর ৪০০ টাকা ভরে নিয়ে ৫০০ টাকার শপিং করো চোখ বুজে।’ বিশেষ ছাড় হয়তো চলে মাসে সাত দিন মাত্র। কিন্তু প্রতিদিন এসএমএস পাঠাতে কোম্পানিগুলোর জুড়ি নেই। পড়তে আলস্য নেই পিনাকীবাবুরও। কোথায় যেন পড়েছিলেন, বিশ্বজুড়ে প্রতিদিন যে পরিমাণ এসএমএসের চালাচালি হয় তার পরিমাণ প্রায় ১৯০০ কোটি। এর সিংহভাগই বিজ্ঞাপনী এসএমএস। কেউ পড়ে বলেই না কেউ পাঠায়। লোকেরা যতই হেয় করুক, পিনাকীবাবু দিব্যি বোঝেন, হিসেব ছাড়া দুনিয়া চলে না। যা খুশি ওরা বলে বলুক, ওদের কথায় কি আসে যায়!
ভাটপাড়া হাইস্কুলে তিরিশ বছর ধরে বাংলা পড়াচ্ছেন পিনাকীবাবু। সন্তান না হওয়ার দুঃখ মনের মধ্যে গুমরে থাকেন আজও। স্কুল থেকে আড়াই কিলোমিটার দূরে ছোটখাটো একতলা যে বাড়িটা গড়ে তুলেছিলেন, তার বয়সও কুড়ি ছাড়াল। ছাদে উঠে গঙ্গার কোলে সূর্য অস্ত যেতে দেখে খুশি হতেন যে দীপা, তাঁর আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য দেখে মন ভরে না। সন্ধেবেলা স্কুল থেকে ফিরে স্নান সেরে নেন পিনাকীবাবু। তারপর হাতে চায়ের কাপটা ধরে মারি বিস্কুটে কামড় দিতে দিতে মোবাইলের এসএমএসে চোখ রেখে কয়েকটা রুটিন কথা হয় দীপাদেবীর সঙ্গে।
--সারাদিন একা থাকতে কোনও সমস্যা হয়নি তো?
--না না।
--সন্ধেবেলা ছাদে গিয়েছিলে তো?
--হ্যাঁ হ্যাঁ।
--সূর্য অস্ত গিয়েছিল তো?
--সূর্য উঠলে তো অস্ত যাবেই।
--তা বটে। দেখেছিলে তো? মন ভাল লেগেছে তো?
--হ্যাঁ হ্যাঁ।
চায়ের কাপ শূন্য হওয়ার পরে আরও বেশি করে এসএমএসে মন দেন পিনাকীবাবু। দীপাও জানেন, এই সময় ওঁকে আর কোনও প্রশ্ন করে লাভ নেই। উত্তর পাওয়া যাবে না। কোকিলধ্বনি শুনলে দীপাদেবীর এখন আতঙ্ক হয়। ওই বুঝি নতুন এসএমএস এলো। এই এক জ্বালা হয়েছে।
তবে মাসখানেক আগে সান্ধ্যকালীন গতানুগতিক কথাবার্তা বেসুরো বেজেছিল। পিনাকীবাবুর রুটিন প্রশ্নগুলো শুরু হয়েছিল। কিন্তু ও প্রান্ত থেকে উত্তর আসছিল না কোনও। ছিল স্তব্ধতা। এসএমএস থেকে মুখ তুলে তাকিয়েছিলেন পিনাকীবাবু। দীপাদেবী বলেছিলেন, ‘একটা কথা বলব?’
আরও সাতটা নতুন এসএমএস তখনও পড়া বাকি ছিল পিনাকীবাবুর। বললেন, ‘জলদি বলো।’
--আমায় একটা মডিউলার কিচেন বানিয়ে দেবে?
নিয়মিত এসএমএস পড়ার দৌলতে এমন রান্নাঘর নিয়ে ধারণা ছিল পিনাকীবাবুর। উনি জানেন, হাল ফ্যাশানের রান্নাঘরের আরেক নাম মডিউলার কিচেন। সোজা কথায় বলতে গেলে, খুব সাজানো গোছানো এক রান্নাঘর। প্রতিটা জিনিসের জন্য জায়গা মাপা। একদম এক জ্যামিতি বাক্সের মতো।
--তা বলে ভাটপাড়ায়? তা বলে এইটুকু এক রান্নাঘরে? এ তো আদ্যিকালের ডিজাইন গো।
সম্ভাব্য প্রশ্নগুলো আঁচ করে তার উত্তর মোটামুটি তৈরি করে রেখেছিলেন দীপা।
--এটুকু রান্নাঘরে করতে কে বলেছে? দেওয়ালটা ভেঙে দাও। বাঁদিকে কতটা জমি আছে, এক্সট্রা। ঘরটা বাড়িয়ে দাও।
--কিন্তু জমিতে যে শিউলিগাছ, দীপা।
--জানি তো। কেটে দাও। গাছ বাঁচাতে গেলে আর মডিউলার কিচেন হবে না।
চুপ করে যান পিনাকীবাবু। খরচ নিয়ে তিনি চিন্তিত নন। কিন্তু রান্নাঘরের জন্য দেওয়াল ভাঙবেন? তার থেকেও বড় কথা, এত বছরের সঙ্গী শিউলিগাছটাকে উড়িয়ে দেবেন? কেমন অস্বস্তি বোধ হতে থাকে তাঁর। বাঁদিকের ফাঁকা জমিতেই তো তাঁর প্রিয় শিউলিগাছ।
পিনাকীবাবুর কাপে আরও একটু চা ঢেলে দিয়ে দীপা বলেন, ‘কোনও দিন তো কিছু চাইনি। আমার সোনার হরিণ চাই না। মডিউলার কিচেন চাই।’
পিনাকীবাবুর ‘হ্যাঁ’ বলা ছাড়া কোনও উপায় ছিল না।
মোবাইলে এ সংক্রান্ত পুরনো এসএমএসগুলো ঘাঁটলেন। ফোনে কথা বললেন দুতিনটে সংস্থার সঙ্গে। বুঝলেন, লাখখানেকের গল্প। ঠিক আছে। সামলে নেবেন।
ফোন করলেন রাজমিস্ত্রিকে। দেওয়াল ভেঙে রান্নাঘরের জন্য জায়গা বাড়াতে হবে তো। রাজমিস্ত্রি বললেন, ‘হয়ে যাবে স্যার। নো প্রবলেম। আগে শিউলিগাছটা কাটিয়ে নিন। তারপরে যেদিন বলবেন, সেদিন কাজ শুরু।’ পিনাকীবাবু বলে দিয়েছিলেন, ‘কালই চলে আসুন।’
তবে এই ‘কাটিয়ে নিন’ শোনার পর থেকেই অস্বস্তিবোধটা গ্রাস করেছিল পিনাকীবাবুকে। কার যোগসাজশ কে জানে, কিন্তু রাজমিস্ত্রির সঙ্গে কথা হল যে দিন দশেক আগে, সেদিন সন্ধেবেলাতেই এসএমএস ঢুকল একটা। ‘গাছ লাগান, প্রাণ বাঁচান, গাছ আমাদের বন্ধু।’ কোথা থেকে পাঠিয়েছিল বুঝতে পারেননি পিনাকীবাবু। কোনও এনজিও হবে হয়তো। পরিবেশ মন্ত্রকও হতে পারে। কিছু লেখা ছিল না শেষে। তবে যারা পাঠিয়েছে কিছু ভেবেই তো পাঠিয়েছে। প্রথমবার এসএমএসটা পড়েই কেমন যেন উদাস হয়ে যান পিনাকীবাবু। রাজমিস্ত্রিকে ফোন করে বললেন, ‘একটা দিন ভাবি, কাল তুমি এসো না। পরশু এসো।’
গাছের মূল্য পিনাকীবাবু বোঝেন। এসএমএস পড়েই শিখেছেন। মাসছয়েক আগে কোথা থেকে একটা এসএমএস উড়ে এসেছিল ওঁর মোবাইলে। তাতে লেখা ছিল, ‘কোনও ডকুমেন্ট প্রিন্ট করার আগে দুবার ভাবুন। জানেন কি, প্রতিটা সাদা কাগজের মধ্যে মিশে রয়েছে গাছের ক্রন্দনধ্বনি? তাই, খুব জরুরি না হলে আর প্রিন্ট আউট নয়।’ ওই বার্তার প্রতিটা কথা গেঁথে গিয়েছিল পিনাকীবাবুর মাথায়। ছাত্রদের পড়ানোর জন্য ভাল কিছু রেফারেন্স মেটিরিয়াল পেলে আগে প্রিন্ট করে নিতেন ঝটপট। ওই অভ্যেসকে জলাঞ্জলি দিয়েছিলেন গাছের কান্নামেশানো এসএমএসটা পাওয়ার পরে। পিনাকীবাবুর সহকর্মীরা দেখেছিলেন, ডেস্কটপের বিরাট বড় স্ক্রিন দেখে ধীরে ধীরে হদ্দপুরনো ডায়রির পাতায় তথ্যগুলো টুকে রাখছেন বাংলাস্যার। সহকর্মীদের একাংশ বলেছিলেন, ‘মূর্খামি করবেন না পিনাকীবাবু। বেলা যে পড়ে যাবে এত কিছু টুকলে।’ পিনাকীবাবু গায়ে মাখেননি। এসএমএসটা কেউ তো ভেবেই পাঠিয়েছিল তাঁকে। তার অন্যথা করেন কি করে!
রাজমিস্ত্রির সঙ্গে কথা বলার পরের দিন, পিনাকীবাবুর ভাববার দিন সন্ধেবেলা ফের পরিবেশ প্রেমের এসএমএসটা ঢুকল। ‘গাছ আমাদের বন্ধু। গাছের যত্ন নিন।’ রাজমিস্ত্রিকে ফোন করে বললেন, ‘আর দুটো দিন ভাবার সময় দিন প্লিজ। আমি জানাবো।’
পরের দিন পিনাকীবাবুর কাছে যে এসএমএস এলো, তাতে লেখা ছিল, ‘শিউলিগাছের আরেকটা নাম কি জানেন? বিষন্নবৃক্ষ। ভোরবেলা শিশিরে ভেজা শিউলিফুল আপনাকে সুঘ্রাণ দেয়, নিজেকে নিঃস্ব করে। শিউলি বাঁচান। পরিবেশ বাঁচান। বৃক্ষপ্রেমী হোন।’ ওই এসএমএস পড়াকালীনই মোবাইলে ফের কোকিলধ্বনি। মানে নতুন কোনও বার্তা। হন্তদন্ত হয়ে এসএমএসটা খোলেন পিনাকীবাবু। তাজ্জব বনে যান। এ কি সমাপতন! এই বার্তাটা এসেছিল এক নামজাদা কোম্পানির তরফে। লেখা ছিল, ‘পেশ করা হল আমাদের নতুন ডিওডোরেন্ট। শিউলি ফুলের গন্ধমাখা প্রতিটা স্প্রে। স্প্রে করার সময় ফেলে আসা শৈশব আর বাড়ির উঠোনে থাকা, অতীত হয়ে যাওয়া শিউলিগাছের কথা মনে পড়বে। গ্যারান্টি। মনে না পড়লে পয়সা ফেরত।’
উল্টোপাল্টা বাটখারা চাপানো দাড়িপাল্লার কাঁটার মতো টালমাটাল করে পিনাকীবাবুর মন। দীপার তাগাদায় গাছ কাটার একজন লোককে ফোন করলেন পিনাকীবাবু। বলা ভাল, ফোন করতে বাধ্য হলেন। পরের দিন সকালে এসে করাত বের করল লোকটা। গাছে ঠেকানোর ঠিক আগের মুহূর্তে পিনাকীবাবু চিৎকার করে উঠলেন, ‘এই রোকো রোকো। আজ নয়।’ গত সন্ধেবেলা পাওয়া বার্তার কথা চকিতে মনে পড়ে গিয়েছিল পিনাকীবাবুর। সেই শিউলি ডিওডোরেন্টের বার্তা। লোকটা ঘাবড়ে গেল প্রথমে। তারপর বলল, ‘আসবো আরেক দিন, আজ যাই?’ স্কুলমাস্টার বললেন, ‘কাল এসো, কাল।’ সাড়ে তিনশো টাকা হাতে তুলে দিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন পিনাকীবাবু। সেদিন সন্ধেবেলাতেও ফের আবির্ভাব হল ওই এসএমএসের। পরের দিন গাছ কাটার লোকটিকে তিন কাপ চা আর দুপুরে ডিম ভাত খাইয়ে বিদায় করলেন। করাত-লোকটা ওর গাছ কাটার অস্ত্র ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া পুরনো গামছায় মুড়িয়ে নিয়ে বলল, ‘একগোছা রজনীগন্ধা হাতে নিয়ে বললাম, চললাম।’ পকেটে পুরে নিল সাড়ে তিনশো। পিনাকীবাবু হেরে যাওয়া সৈন্যের মতো ঘাড় নাড়েন। পরের দিনও একই জিনিস হল। সেদিন দুপুরে পাকা কাতলার পেটি আর কাঁচা আমের চাটনি ছিল। লোকটি বলল, ‘মনস্থির করে তার পরে না হয় খবর দেবেন স্যার। চলে আসব।’ লোকটা সাইকেলে উঠল। অন্ধকার হয়ে আসা গলির মুখে মিলিয়ে গেল। পরিবেশরক্ষার বার্তা নিয়ে ফের বেজে উঠল বাংলা স্যারের মোবাইল।
২
দীপাদেবীর সঙ্গে একচোট ঝগড়া হয়ে গেল পিনাকীবাবুর। দীপাদেবী বলেছেন, ‘তুমি না পারলে আমি আছি।’ বলেছেন, ‘এই বাড়িতে হয় শিউলি থাকবে না হয় আমি। হয় মডিউলার রান্নাঘর থাকবে না হয় শিউলি। আর শিউলি থাকলে আমাকে আর পাবে না।’
এই না মেলা সমীকরণে প্যাঁচে পড়ে গিয়েছেন পিনাকীবাবু। দীপা ছাড়া উনি যেন মণিহারা ফণী। গাছ কাটার লোকটিকে ডেকে আর মুখ কালো করতে চান না। নিজেই কিনে এনেছেন একটা ঝকঝকে করাত। ভোরে উঠে শিউলিগাছের দিকে তাকালেন। মাটি আলো করে পড়ে থাকা শিউলিফুলগুলোর দিকে চেয়ে থাকলেন। আর কয়েক ঘন্টা পরেই এসব স্মৃতি হয়ে যাবে। ঝাড়বাতির মতো জ্বলতে থাকবে মডিউলার কিচেন।
করাত নিয়ে গাছের দিকে এগিয়ে যান পিনাকীবাবু। নিজেকে কেমন যেন জল্লাদের মতো মনে হতে থাকে তাঁর। একটু দূর থেকে চেয়ে থাকেন দীপাদেবী।
গাছটার গায়ে করাত স্পর্শ করলেন পিনাকীবাবু। পরিবেশ রক্ষা নিয়ে পাওয়া প্রতিটা এসএমএস, প্রতিটা বার্তার প্রতিটা অক্ষর হাতুড়ির মতো ঘা মারতে থাকে স্কুলমাস্টারের মাথায়। বন্ধুর গায়ে ছুরি মারার মতো লাগে। চিরসখা হে, ছেড়ো না, মোরে ছেড়ো না। হঠাৎ মনের মধ্যে কেন উদয় হল এই গান? পকেট থেকে কোকিল কন্ঠ ভেসে উঠল ফের। ভেসে উঠল বলা ভুল, আর্তনাদ। এসএমএস আসার ভলিউম তো বাড়াননি তিনি। তবে শব্দ এমন উথলে পড়ল কেন? চকিতে সেই বার্তা খুললেন পিনাকীবাবু। তাতে লেখা, ‘যদি আপনি একটি গাছ কাটেন, আপনি একটি জীবনকে হত্যা করেন। গাছ বাঁচালে জীবন বাঁচে। খুনি হবেন না।’ বিদ্যুতের শক খাওয়ার মতো ছিটকে যান পিনাকীবাবু। দূর থেকে চেয়ে রয়েছেন দীপা। গায়ে যত জোর ছিল, তা দিয়ে মোবাইলটা ছুঁড়ে ফেললেন বাংলার স্যার। বমির মতো বিরক্তি উঠে আসছে তাঁর সারা শরীর জুড়ে। মোবাইলটা ছিটকে উঠল। পাঁচ টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ল শিউলিগাছের চারদিকে। হাউহাউ করে কেঁদে ফেললেন পিনাকী বসু।
মোবাইলে ভূত ভর করেছিল কি জানেন না। তবে পরের দিন সকালে উঠে বাংলার স্যার দেখেছিলেন, পাঁচটি শিউলি গাছের সদ্য ওঠা চারা সেখানে মাটিকে আদর করছে। শিশুর মতো ওরা খিলখিল করে হাসছে যেন।
পুরনো ফোনটা গেছে। নতুন একটা ফোন কিনতেই হবে পিনাকীবাবুকে। সিম লাগানোর পরে কি এসএমএস আসবে উনি জানেন। এসএমএস নয়, অঙ্কুর।
--