"ওই দ্যাখ, খাল পরিষ্কার করার একটা লোক পাঁকে পড়ে আর উঠতে পারছে না," কে যেন চিৎকার করে উঠল। সদ্য ঘুম ভাঙা মুখগুলো অমনি একসঙ্গে ঘুরে গেল কাদাজলে ভরা খালটার দিকে। দু'দিন তুমুল বৃষ্টির পর যেটা কানায় কানায় ভরা আর ময়রার দোকানে সদ্য তৈরি গরম রাবড়ির ট্রে-র ওপর থেকে ওঠা অল্প সাদা ধোঁয়ার মতো যার পুরোটা জুড়ে উঠছে তীব্র দুর্গন্ধের ভাপ।
এমনিতেই কেষ্টপুর খালের ধারের বস্তিগুলোর ঘুম ভাঙে অনেক সকালে, কল আর পায়খানার দখল নিয়ে মেয়েদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। ঢালু পারে জায়গা প্রচুর, কিন্তু আব্রু নেই। তাই ওখানে কেবল বাচ্চা আর পুরুষ মানুষের ভিড়। ঝগড়াঝাঁটি ক্যালোর ব্যালোর লেগেই আছে।
তার ওপর আবার একটা জলজ্যান্ত মানুষ খালে নেমে দ্রুত পাঁকে ডুবে যাচ্ছে, এই নতুন উত্তেজনায় গোটা বস্তি ভেঙে পড়ল খালের ধারে। কারও হাতে নিমডালের আধ খাওয়া দাঁতন, কেউ সেফটিপিন আটকান ব্লাউজের ফাঁকে ঝুলে পড়া মাই চোষা বাচ্চা কোলে করে দাঁড়িয়ে আছে, সোমত্ত মেয়েরা নজর আটকাবে বলে ব্রা হীন নাইটির বুকের ওপর আলগোছে গামছা ফেলে রেখে ঝুঁকে পড়ে ডুবন্ত লোকটাকে দেখার চেষ্টা করছে। এর মধ্যেই আবার ঘরের খেয়ে বনের মোষ-চরানেরা দৌড়ে গেল পুজো প্যান্ডালের পাশে রাস্তা আটকে ফেলে রাখা লম্বা বাঁশ আনতে।
সব মিলিয়ে বেদম হৈ চৈ হচ্ছিল। গেল গেল রবের সঙ্গে, বাঞ্চোতটা কী করতে ওখানে নেমেছিল, সেই খোঁজ নেওয়া এবং আরও নানা হাঁকডাকে যেন রথের মেলা বসে গেল। কিন্তু যাকে নিয়ে এতো সব, সে ঘটনার আকস্মিকতায় ভ্যাবলার মতো আকাশে চোখ তুলে দাঁড়িয়ে আছে। দূর থেকে চোখের সাদা ড্যালাটাই চোখে পড়ছে, সেখানে কোনো দৃষ্টি নেই। কিন্তু বিপদের আসল রূপটা সেইই চিনতে পারছিল সবচেয়ে বেশি, বুঝতে পারছিল একটু নড়লেই কত দ্রুত তাকে গিলে নিচ্ছে কাদা। এই তার কোমর অব্দি ডুবে ছিল, এই বুক অব্দি উঠে এলো নোংরা কালো জল।
অথচ লোকটার গ্রামে জলের বড় কষ্ট। কষ্ট বলতে ভয়ানক কষ্ট! দুপুরের দিকে তেষ্টায় গলা ফেটে যাবে, মনে হবে কণ্ঠা ভর্তি শুধু ছাই বালি, নুড়িপাথর। মনে হবে, মাথার চাঁদি ফুটো করে সূর্যের তাপ শরীরের ভেতরে সোজাসুজি ঢুকে যাচ্ছে, আর সেই তাপে দেহের রক্ত বীর্য ঘাম চোখের জল সব শুকিয়ে কাঠ। সেই জ্বালাপোড়ার আঁচ যে একবার সয়েছে সে জানে, মানুষ আর তখন মানুষ থাকে না, হয়ে যায় বাজ-পড়া পোড়া একখান গাছ। কিন্তু মরে যাও আর বাঁইচ্যে থাক, পথে ঘাটে একফোঁটা জলও পাবে না গলা ভেজাবার জন্য। কোনো গেরস্তের বাড়ি জল ভিক্ষা চাইলে, সে যত ছোট সম্ভব একখান মাটির খুরিতে এক ঢোঁক মাত্র জল দেবে। দু-ঢোঁক মাঙলে হাত জোড় করে বলবে,
"হা দেখ কত্তা, বইসতে পিঁঢ়া দুব, ভাত খাইতেও দুব, কিন্তুক জল দিতে লাইরব।"
আর এখানে দ্যাখো, তার বুকের সমান উচ্চতায় চারদিক ঘিরে থমকে আছে দুর্গন্ধ পাঁকভর্তি জল। এতো জল, তবু এক ফোঁটা মুখে দিবার উপায় নাই! অথচ সেই এক জ্যৈষ্ঠ দুপুরের মতো আজও তার অন্তরাত্মা এক আঁজলা জলের জন্য হাহাকার করছিল। ছাতি থেকে চাপা গুড়গুড় শব্দ উঠে আসছিল, যেমন মরণকালে বুড়া মাইনষের বুকে কান পাতলে শোনা যায়।
মল মূত্র, হাসপাতালের বর্জ্য, পাশের গোটা বস্তির শৌচ ও বাসন মাজার নোংরা জল, ছাই, বাচ্চাদের হাগা মুড়ে ফেলা হলদেটে কাগজ, মেয়েদের মাসিকের ন্যাকড়া-পচা সব তার শরীরের দু'পাশ দিয়ে অনন্ত বয়ে যাচ্ছিল। আর সবার চোখের আড়ালে বিশাল এক পিচ্ছিল পাঁকের অজগর তার দুই পা জড়িয়ে তাকে আস্তে আস্তে মরণ টানে নিচের দিকে টেনে নিচ্ছিল। অনাদরে ছুঁড়ে ফেলা নষ্ট ভ্রূণের পচা গন্ধে নাক কান বুজে আসতে সে শুধু একবার মা বলে ক্ষীণ ডাকল।
হ্যাঁ, অজগরটা তাকে আস্তই গিলে নিচ্ছিল, এক অব্যর্থ অমোঘ টানে ঢুকিয়ে দিচ্ছিল নিজের অন্ধকার পেটের ভেতর। মরণ কালে বুদ্ধিনাশ, তাই সব ছেড়ে হঠাৎ তার মনে হল সূর্যের চারপাশে ঘুরে চলা পৃথিবীর আনহিক গতির কথা। বাইরে থেকে কিছু বোঝা যায় না, কিন্তু সর্বক্ষণ একটু একটু করে ঘুরে যাচ্ছে হেলে থাকা গোলকটা। বন্ধ হলেই প্রলয়, সেহরি গাছের হলুদ পাতা খসার মতো টুপটাপ ঝরে যাবে ছয় ঋতু, এলোমেলো হয়ে যাবে চন্দ্র সূর্যের হাজিরা। সে এক মহা হুলুস্থুল কান্ড ৷ সেই রকম অনিবার্য তার একটু একটু করে ডেবে যাওয়া আর পাঁকে দম বন্ধ হয়ে মরা।
বইয়ে লেখা কথাগুলো মাথায় ফিরে আসতেই গ্রামের স্কুলটার কথা মনে পড়ে তার। যখন সে আনহিক গতির কথা জানতে পারে সেই ক্লাস সেভেনের কথা নয়, একেবারে শুরুর কথা, খুলে পড়া হাফপ্যান্ট এক হাতে, আরেক বগলে বই স্লেট, মউলের ঝরা ফুল মাড়িয়ে সে ছুটছে ল্যাজ তোলা বকনা বাছুরের মতো। এবড়োখেবড়ো পাথর ভর্তি রাস্তার পাশে ফুটে আছে অজস্র হলদে ঘৃতকুমারীর ফুল। বহেড়া হরিতকীর ছায়ায় দাঁড় করান মাটির ঘরটিতে স্লেট আর খড়ি নিয়ে অ আ লেখা, মাস্টারের চিৎকার, "অ,আ টুকুনো লেখতে শিখিস নাই? হা ভাল্, অ এর পর এমনি করে একটা দাঁড়ি টান্-এই যে, এই হইল আ।"
পাথরে কোঁদা মূর্তির মতো শক্তপোক্ত সুরেন মাস্টরকে এখনই মনে পড়ে তার।
ঠাকুমার কাছে শুনেছিল মৃত্যুর আগে একেবারে গ্যাঁদাবেলার কথাও মনে পড়ে যায় দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। তাহলে সত্যি কী তার মরণই হতে যাচ্ছে? হতাশা আর ভয়ে ডুকরে ওঠে জোয়ান মদ্দ, আতঙ্কে তার পেচ্ছাপ বেরিয়ে যায়। তাতে জলের কুৎসিত গন্ধ বা চেহারা কোনটাই বাড়ে বা কমে না, কিন্তু সেই গন্ধ আর উষ্ণতায় আকৃষ্ট হয়ে কী না কী কে জানে, তার খেটে খাওয়া শরীরের লোহার মতো দাবনায় কিছু একটা জোরে কামড়ায়। জলে ডোবা দাবনা, তবুও বেদম জ্বালা হতে থাকে।
জলে কতো রকম পোকা থাকে। সাপখোপ হতে পারে। বা মাংস-খেকো মাছ। রাক্ষুসে-মাগুরের মতো বিকট তাদের চেহারা। বড় গোল চোখ। একবার বর্ষাকালে শিলাবতীতে ঘোলাটে জলে হুটোপাটি করছিল সে বন্ধুদের সঙ্গে। জলের কী টান আর কী তার গর্জন ! হঠাৎ তার বন্ধু গোপাল আঃ বলে চেঁচিয়ে ওঠে, তার কনুই বেয়ে ঝরঝর করে রক্ত পড়ে। ছায়ার মতো লম্বাটে কী যেন ঢেউয়ের ওঠা নামার সঙ্গে শরীর মিলিয়ে পাশ দিয়ে উধাও হয়ে যায়। ঘরে ফিরে কান মলা খায় সে, "হা দেখ্, বর্ষার নদীতে কেমন একটা অজানা টান থাকে, সেটাও নাই জানিস। আর সেই টানে কতরকম জানা, অজানা মাসখাওয়া মাছ ভাস্যে আসে। উকে ত গজার মাছে কামড়াইছে। তুই যদি যাইস্ তবে তর চইখ দুটাও খুবলাই খাবেক রে ছঁড়া।"
অন্ধ হয়ে যাওয়াকে চিরকাল ভয় পেয়ে এসেছে সে, বড় অসহ্য জিনিস, কেউ নাই, কিছু নাই, চেনা জগতটাই হাওয়া হয়ে গেল, গোটা পৃথিবীতে মানুষটা তখন একদম একা। নিজের ছায়াটাও সাথ দেবে না। অনন্ত অন্ধকারে সাঁতার কাটা আর রাস্তায় লাঠি ঠুকে ঠুকে চলা একই ব্যাপার। সুরেন মাস্টারের একমাত্র ছেলে ছিল অন্ধ। কুসুম গাছে সদ্য গজানো লাল পাতার ছায়া পড়ে এমন মাটির বারান্দায় ছেলেটা সারা দিনমান বসে থাকত, একদম একা, সাদা চোখদুটো কোনদিকে তাকায় না, অথচ বসার ভঙ্গিতেই বোঝা যায়, ছোঁড়া সমস্ত শরীর দিয়ে শুষে নিচ্ছে মউল ফুলের বাস, ল্যাংটা বাচ্চাদের ধুলো-মাখা হৈ চৈ।
থুতনিতে হিম ঠান্ডার পরশ পেয়ে তার খেয়াল হয়, আর একটু বাদে তার নিজের চোখদুটোই চলে যাবে কাদা জলের তলায়! বেদম ভয়ে নোনতা জলের ধারা নামতে থাকে নাকের পাশ দিয়ে। গোঁফের ওপর দিয়ে পুরু ঠোঁটের কোণা অব্দি তা গড়িয়ে এলে, মরণ তৃষ্ণায় সেই জলই লোকটা জিভে চেটে চেটে খায়।
গোপালকে বিষমাছে কামড়েছে কিনা দেখার জন্য বন্ধুরা সবাই তাকে ধরাধরি করে নিয়ে গেছিল কেনামতীর কাছে। কিছু ঝাড়ফুঁক সে জানত, সে তো অনেকেই জানে, কিন্তু গাঁয়ে গুজব, কেনামতী নাকি ডাইনি। অমন উছলে ওঠা শরীরের মেয়ে ডাইনি হয় কেমন করে, কে জানে! তবু গুজগুজ বাড়তির দিকে আর রাতে দরজায় টোকা পড়ার বিরাম নাই দেখে কেনামতী প্রাণের ভয়ে চলে যায় ফুলডুংরির অনাথ আশ্রমে। যেদিন ঝাড়ফুঁক করবার জন্য মাছে মাস-খাওয়া গোপালকে নিয়ে তারা আশ্রমে উপস্থিত হল, কেনামতী সেদিন অনাথ বাচ্চাদের জন্য ডিমের ঝোল রান্না করছিল। উনুনে খানিক কাঠ গুঁজে সে সোজা হয়ে দাঁড়ায়, যেন নিজেই একখানি আমলা বৃক্ষ, সরল দীর্ঘ কান্ড, শুশ্রূষার প্রাচীন নিদান। গোপালকে সে "কিছু হবেক নাই, ঘরকে যা" বলে ছেড়ে দিলেও তার সবুজ কাচের মতো চোখের মণি স্থির হয়ে যায় আজকের ডুবতে থাকা লোকটার মুখের ওপর, সে তখন সদ্য গোঁফের রেখা ওঠা লাজুক কিশোর।
হাতছানি দিয়ে তাকে ডাকে কেনামতী,
"ইদিগে আয়, দলিজে বইস্। কার বেটা বটিস্? তোর নাম?"
দাওয়ায় বসার পর বাবার নাম বলার আগেই কেনামতী জোর করে তার লাজুক হাত নিজের সবুজ শাড়ির কোলের ওপর টেনে নিয়েছিল। শুধু তো কপাল নয়, হাতের রেখাও দেখতে হবেক।
পেছনের খোড়ো চালার ভেতর থেকে ডিমের ঝোলের ঝাল গন্ধ উঠে আসছিল, ভাতের হাঁড়ির টগবগানি, মাথার পেছনে রুখু চুলের বিরাট গোল খোঁপা, তাতে একখান শিমূল ফুল গোঁজা ছিল কিনা এখন আর মনে পড়ে না, কেনামতী তার হাতে চোখ ডুবিয়ে চমকে ওঠে। আবার কপাল জরিপ করে। তারপর অনেক দূর থেকে আবছা বলে,"হায় গ্য, তুমার মরণকালে কেউ তুমার সঙ্গে থাইকবেক নাই, তুমি মইরবে একা, বেবাক একা।"
একে তো এই তুই থেকে তুমিতে চলে যাওয়া, তারপর অমন আবছা কিন্তু ভারী গলায় কথা বলা, ছেলেটার ভয় লাগে, আবার ভালও লাগে। এতো কাছে বসে থাকা কেনামতীর শরীর থেকে উঠে আসা ডিম আর হলুদের গন্ধ, সাদা শাঁখের গোল আঙটি পরা শক্ত আঙুলের চাপ, তার কিশোর শরীরে নিষিদ্ধ শিরশিরানি ছড়িয়ে দিচ্ছিল, প্রবল ভাবে জেগে উঠছিল সে। মন চাইছিল আরও কিছুক্ষণ হাতে হাত ধরা থাক, কিন্তু ও যে ডাইন, বশীকরণ জানে, এইরকম মনে হতে নিজেকে ছাড়িয়ে ভয়ে দাওয়া হতে লাফিয়ে নামে ছেলেটা, দৌড়তে থাকে দিকবিদিকশূন্য হয়ে। পেছনে ছেলের দল হো হো করতে করতে ছোটে, কিন্তু তাদের ছাড়িয়ে জঙ্গলে ঢুকে পড়ে সে, তবু পিছু ধাওয়া করে কেনামতীর বলা কথা ক'টি, "তুমি বট্যে মইরবে একা, বেবাকই একা।"
আর দ্যাখো, সে এখন একাই মরছে, গ্রাম পাহাড় শিলাবতী থেকে অনেক দূরে, অচেনা শহরের পূতি গন্ধময় এঁকেবেঁকে যাওয়া বিশাল খালে পচা পাঁকের মধ্যে ডুবে মরছে। কোন কথা যে কখন কী ভাবে ফলে যায়! তবে কি কেনামতী সত্যি ডাইন ছিল!
"কোন ঠিকেদারের লোক আমি কী করে জানব। সাত সকালে নামিয়ে দিয়েছে পাঁক পরিষ্কার করতে! জমা বিষাক্ত গ্যাসও তো থাকতে পারে। বেশ তো তার জন্য মাস্ক না দিক, একটা দড়ি তো দেবে!
আর কে ছিল এর সঙ্গে, দেখেছ কাউকে?"
কেউ অসহায় বিরক্তি আর রাগ নিয়ে চেঁচায়। সত্যি কথা, তারা তো কেউ খোদ কর্পোরেশনের লোক নয়। ঠিকেদারের দয়ায় বাঁচা ঠিকে কর্মী। নিজের পাওনা থেকে ঠিকেদারকে তোলা দেবে প্রত্যেক হপ্তায়, এই কড়ারে তাকে গ্রাম থেকে নিয়ে এসেছিল শম্ভু। এতো অল্প টাকায় শহরে ঘরভাড়া দিয়ে থাকা যায় না, তাই শম্ভু এবং আরও দু তিনজনের সঙ্গে বাদুতে থাকছিল সে। আলো না ফুটতে উঠে পড়া, পান্তা খেয়ে লজঝড়ে বাস ধরে কাজের জায়গায় যাওয়া। সবাই সবসময় একসঙ্গে। নির্জনে থাকলেই কোথা থেকে ভেসে আসে কেনামতীর বলা কথা, "তুমি মইরবে বেবাক একা৷"
ভয় করে তার। সে এখন হুমদো এক জোয়ান, বয়সে সেই কিশোরের বাপ, তবু তার শরীর মন আনচান করে। যেন ভিড়ে থাকা, কারও সঙ্গে থাকা তার বেঁচে থাকার পক্ষে খুব জরুরি। এই ভয় তার মধ্যে ঢুকিয়ে দিল কেনামতী, কিন্তু ক'মাস পরেই জলার ধারে তার থ্যাঁতলানো বিবস্ত্র দেহটা উপুড় হয়ে মাটির বাস শুঁকছিল যেন। তারও ধারেকাছে তখন কেউ ছিল না। আসলে নিজের কপালের লেখা তো পড়া যায় না, নিজের হাতও ঠিক কথা বলে না।
শম্ভু আর মদন আজও তার সঙ্গে ছিল, চওড়া শাবলের মাথায় কচুরিপানা, অন্যান্য আগাছা, প্লাস্টিক, ন্যাকড়া তুলে উঁচু পাড়ে তারা অবলীলায় ছুঁড়ে দিচ্ছিল। সেও তাই। ড্রেজিং হবে, কোর্টের নির্দেশ, তাই আগে কিছুটা হলেও খাল পরিষ্কার করতে হবে। দামী ড্রেজিং মেশিনে প্লাস্টিক ইত্যাদি ঢুকে গেলেই বারটা বেজে যাবে।
সঙ্গীরা অনেকটা এগিয়ে গেলে, মাঝখান দিয়ে ভেসে যাওয়া ফুলে ফেঁপে ওঠা একটা পলিব্যাগকে লাঠি দিয়ে বাগে আনবার চেষ্টা করতে করতে কেমন করে পা পিছলে মাঝ খালে গিয়ে পড়ল সে নিজেও জানে না। ড্রেজিং হয় না বহুদিন, তাই খালের ঠিক মধ্যখানে উঁচু হয়ে ওঠা পাঁকের অজগরটা ওঁৎ পেতেই ছিল। একটু বেকায়দা হতেই পায়ের হাঁটু অব্দি ডুবে গেল এক ঝটকায়। তারপর যতই সে দাপায়, নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করতে থাকে, ততই আরও ভাল করে পলিতে গেঁথে যায়। যেন বর্ষাকালে ধান খেতে বর্শা-গাঁথা লালচে পুরুষ্টু মাছ একখান, লাফিয়ে ছটফটিয়ে ভালো করে নিজের মাংসের পরতে পরতে গেঁথে নিচ্ছে শিকারির সূচিমুখ মারণ অস্ত্রটিকে।
এতক্ষণে বড় বাড়িগুলির আড়াল থেকে উঁকি দেওয়া সূর্যের আলো এসে পড়ছে খালের কালো জলের ওপর, তার তেল চকচকে কালো বাবরি চুল কাদার ছিটে সত্ত্বেও আরও কালো লাগছে। বহুতলের জানালাগুলো একে একে খুলে যাচ্ছে, উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে অনেক মুখ। সরু মোটা গলায় নানান কথা ভেসে আসছে, কিন্তু তার কিছুই বুঝতে পারে না লোকটা। এ তল্লাটে খবর চাউর হয়ে গেছে ডেজিংয়ের পূর্বপ্রস্তুতিতে খাল পরিষ্কার করতে এসে এক লেবার পাঁকে তলিয়ে যাচ্ছে। দুপারে অজস্র লোক ভিড় করে মোবাইলে তার ছবি তুলছে। কেউ কেউ এমন ভাবে সেলফি নিতে দাঁড়াচ্ছে, যেন আতঙ্কিত মুখ নিয়ে দূরে ডুবন্ত সে, আর সামনে ছবি-তুলিয়ের হাসিমুখটি পরিষ্কার দেখা যায়।
আবার কেউ চেঁচিয়ে ওঠে, "কর্পোরেশন অফিস তো খুলবে বেলা এগারোটায়। জল এখনই থুতনিতে উঠে এসেছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এই কষ্টকর ঘটনা দেখতে হবে? ইমার্জেন্সি রেস্কিউয়ের কোনো ব্যবস্থাই আমাদের নেই নাকি! পুলিশকে জানান হয়েছে? "
ততক্ষণে পুজো কমিটির মাতব্বর পারমিশন দেওয়ায় বস্তির ছেলেরা একটা বাঁশ নিয়ে এসেছে। সাবধানে ঢালে নেমে তারা বাঁশের মাথা এগিয়ে দেয় লোকটার দিকে। সেটা থেকে তার দূরত্ব তখন পাঁচ হাতেরও বেশি। আরও অসহায় লাগে তার। এরা বুঝতে পারছে না, বিন্দুমাত্র নড়াচড়া করলেই সে ভুস করে তলিয়ে যাবে। আর কখনও উঠতে পারবে না।
ছেলেরা প্রথমে তাকে ভয় নেই, আমরা আছি, সাবাস ইত্যাদি বলে সাহস যোগায়। কে একজন উৎসাহের আতিশয্যে বলে বসে, আউর থোরা, হেঁইও। কিন্তু তারপরও সে নড়ে না চড়ে না দেখে বেজায় খেপে গিয়ে খিস্তি ঝাড়তে থাকে, "শ্লা, তোকে বাঁচাতে এত কান্ড কল্লুম, সেকি তোর ঢ্যামনামি দেখব বলে! একটু এগোলেই তো দড়ি ছুঁড়ে দোব। উঠে আসবি।"
তাও সে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে দেখে বেদম খেপে ওঠে তারা। শুকনো ডাঙায় লাফালাফি করতে থাকে জ্যান্ত জিয়ল মাছের মতো, মুখে অশ্রাব্য গালি, "ধর বাঞ্চোত, বাঁশ চেপে ধর, নাহলে তোর পোঙ্গায় ওটা ঢুকিয়ে দেব রে হারামজাদা।"
আসলে ছেলেগুলো ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। পারমিশন চাইতে গিয়ে দাদার ঘুম ভাঙেনি বলে গেটের সামনে ঘোরাঘুরিই করতে হয়েছে এক ঘণ্টা। এই নাটক খতম হলে দৈনন্দিনতার মধ্যে তারা ফিরে যেতে পারে। তাছাড়া তারা থাকতে বিনা চেষ্টায় লোকটা তলিয়ে যাবে, তাও আবার হয় নাকি!
ছেলেদের পিড়াপিড়িতে সে যেই বাঁশের দিকে ডানহাতটি বাড়াতে যায়, অমনি ভুস করে জল উঠে আসে তার চোখের নিচে। ডাঙায় তোলা কাতলা মাছের মতো খাবি খায় সে। গব গব করে গিলতে থাকে কালো দুর্গন্ধ জল, জলের ছোট ছোট পোকা। লাল চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসে তার, যত হাঁকপাঁক, ততই তলিয়ে যায়। তাই দেখে হাহাকার করে কেঁদে ওঠে একটা পাঁচ/ ছ' বছরের বাচ্চা, "মা লোকটা ডুবে যাচ্ছে, ওকে বাঁচাও।"
ওর মায়েরও চোখ ছলছল করে, আহা গো, ছেলেটাকে দেখতে তার হারিয়ে যাওয়া ভাইটার মতো। তেমনই ঘন চুল, বড় বড় চোখ!
লোকটার কান মুখ দিয়ে জল ঢুকছিল হুহু করে। নাকের ফুটো বন্ধ হয়ে খাবি খাচ্ছিল সে। বড় বড় বুদবুদ উঠছিল ভারী জলের ভেতর থেকে। ওপরে উঠে ফেটে যাচ্ছিল। চাঁদিটুকু দ্রুত অদৃশ্য হয়ে গেলেও, তার হাত দুটো কিছুক্ষণ জেগে রইল জলের ওপর। যেন আকাশকে আঁকড়ে সে বাঁচতে চাইছে।
কিন্তু সব শেষ হবার পূর্ব মুহূর্তে, অত আওয়াজে কেউ শুনতে পাক, নাই পাক, একমাত্র সেইই শোনে বাচ্চাটার কান্না। বন্ধ দমচাপা বুকে ঢুকে পড়া খোলা বাতাসের মতো সেই কান্না ব্যর্থ করে দিতে থাকে মৃতা কেনামতীর অদ্ভুত ভবিষ্যৎ বাণী। তাই নিঃশ্বাস বন্ধ হবার ঠিক আগে তার খাবি খাওয়া বিকৃত মুখটা মুহূর্তের জন্য হাসি হাসি হয়ে যায়, "কেনামতী তু মিছা বইল্যেছিলি কেনে? মরণকালে এতো জনা হামার লেগে দাঁড়াই আছে। হামার লেগে বাচ্চাটা হাপুস কানতে লেগেছে দ্যাখ।
তু ডাইন নয় রে কেনামতী, তু মিছা বলা একটা ফালতু মেয়াছেল্যা বট্যে।"
কাদামাখা দেহটাকে প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা সাদা কাপড়ে জড়িয়ে যখন এম্বুলেন্সে তোলা হল, তখনও লোকটার পুরু ঠোঁটে কাদার সঙ্গে মিচকে হাসি লেগেছিল।
দমকল, পুলিশ, টিভি, জন প্রতিনিধির গাড়ি একে একে বেরিয়ে গেলে খালের ধার শুনশান হয়ে যায়। না খাটলে পেটে কিল, তাই এতোটা সময় নষ্ট করে সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। সেই অবুঝ শিশুটি শুধু ডুবে যাবার জায়গাটিতে চোখ লাগিয়ে বসে থাকে। হাওয়ায় তার রুখু চুল ওড়ে ৷ নাক থেকে গড়ানো জল সে হাতের উলটো পিঠে মুছে নেয়। তার কান্না মোছা চোখে দৃঢ় বিশ্বাস, কাদার মন্ড সরিয়ে লোকটা আবার উঠে আসবে। যতক্ষণ তা না হবে, সে এইখানেই বসে থাকবে, মা ডাকলেও যাবে না। তাকে অমন অনড় দেখে পোষা বেড়ালটি এসে গুটিসুটি তার গা ঘেঁসে বসে, মাটিতে মৃদু মৃদু ল্যাজ আছড়ায়।
এক অবুঝ শিশু আর এক বুদ্ধিহীন পশু যেন অনন্ত প্রতীক্ষায় খালধারে এইভাবেই নির্জন বসে থাকে। খালের ঠিক মাঝখানে কাদার বড় বড় বুদবুদ অনবরত ওঠে, ভাঙে, আবার উঠে আসে!