ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে...
ইদ এসে গেল। ইদ এলেই শুরু হয় ঘরে ফেরার তোড়জোড়। পড়াশোনা কিংবা পেশাগত, যে কারণেই নিজের গ্রাম ছেড়ে বাইরে থাকা হোক না কেন, ইদের আনন্দ ভাগ করে নিতে জন্মভূমিতে ফিরে যান শহরের মানুষজন। ইদে সবাই ঘরে ফেরে। যে শহরে চাকরি করে, সে যেমন ফেরে তার বাবা-মা, আত্মীয়-পরিজনের কাছে ইদের খুশি নিয়ে; তেমনই শহরের ফুটপাতে ঘুরে ফেরা বেকার ছেলেটিও ফেরে মা-বাবার দীর্ঘশ্বাসের অশ্রুতে। সবাই ঘরে ফেরে — সাধ ও সাধ্যের মাঝে নিজেকে রাঙিয়ে নেয় উৎসবের রঙে। বাসস্ট্যান্ড, রেলস্টেশনে মানুষের উপচে পড়া ভিড়ে নিদ্বির্ধায় নাম লেখায় সবাই বাড়ি ফেরার প্রতিযোগিতায়। এত হুলস্থূলের মাঝে যখন ইঞ্জিনের ধপ ধপ শব্দ নিয়ে রেলগাড়ি চলতে শুরু করে, তখন দিনের আলোয় ফেলে আসা শহরে যেন আর ফিরতে ইচ্ছে হয় না কিংবা রাতে যখন কামরা-ভরা ঘুম আচ্ছন্ন করে রাখে সকল যাত্রীকে তখনও যেন চোখ জেগে থাকে আম-কাঠালের ছায়াঘেরা বাড়িতে ফিরবে বলে। কখন থামবে ট্রেন স্বপ্নের সেই স্টেশনে — যেখানে দাঁড়িয়ে থাকবে তার গ্রামের দিকে যাওয়ার বাসটি। যাত্রীদের ব্যস্ততা, কুলির হাঁকাহাঁকির মাঝেও নিশ্চয় কেউ একজন কাঁধে রাখবে হাত স্নেহ অথবা ভালোবাসায়। কত না আনন্দ এই ঘরে ফেরায়। মায়ের আঁচল, আব্বা-ভাই-বোনদের স্নেহ-ভালোবাসা-খুনসুটি ভরিয়ে দেবে জীবনের সমস্ত না-পাওয়া।
রমজান এলেই ইদের আমেজ শুরু হয়। শুরু হয় বাস-ট্রেনের টিকিট কাটার তোড়জোড়। মনে জেগে ওঠে বাড়ি ফেরার তাড়া। দিন গোনা শেষে স্বজন-পরিজনের সঙ্গে ইদের আনন্দ ভাগাভাগি করার লক্ষ্যে বাড়ির পথে ছোটা শুরু হয়ে যায়। দুয়ারে দাঁড়িয়ে আঁচলে চোখ মোছা প্রিয়জনকে রেখে জীবিকার খোঁজে যে ‘বিদেশ-বিভূইয়ে’ আসা, ইদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে সে দেশে ফেরার উৎসাহে উদ্বেল হয়ে ওঠে সবার মন। গ্রামমুখী যাত্রীদের ভিড়ে ভর্তি হয়ে যায় বাস-ট্রেন-ট্রাক। কিন্তু ধীরে ধীরে কমছে সেই অতিপরিচিত দৃশ্য। না, যানবাহন বেড়ে গেছে তাই ভিড় কমেছে এ কথা বলা যাবে না। ভিড়টাই কমে গেছে। কিন্তু কেন?
রুজি-রোজগারের তাগিদে বাংলার, বিশেষ করে মুর্শিদাবাদ, মালদা, দিনাজপুরের লক্ষ লক্ষ মানুষ চলে যান কেরালা, মুম্বই, দিল্লি।সেখানে তারা খুঁজে নেন জীবিকা। কেউ স্বর্ণশিল্প, কেউ পোশাক তৈরি, আবার কেউ বা কৃষিকাজ কিংবা রাজমিস্ত্রির কাজ করে উপার্জন করেন। সেই অর্থ বাড়িতে পাঠালে উনুনে হাঁড়ি চড়ে বহু পরিবারের। অনিয়মিত কাজের সুযোগ, কম মজুরি, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তাহীনতা ও সর্বোপরি অদক্ষতা প্রভৃতি কারণের জন্য ‘বিদেশে’ পাড়ি দিতে হয়। এই বিদেশ দেশের মধ্যে; কেরালার আখের ক্ষেত, মুম্বইয়ের স্বর্ণ শিল্পক্ষেত্র, দিল্লি-নিউ টাউনের বহুতল নির্মাণ এলাকা। এইসব কাজে রয়েছে রিস্ক, তবু জীবনের ট্রাপিজে চলে সংগ্রাম।
ভারতববর্ষে ৭০ শতাংশ মানুষ এখনও গ্রামে বাস করে। কিন্তু ক্রমশই তা কমছে। গ্রাম থেকে মফসসল, মফসসল থেকে শহরে উঠে যাচ্ছে জনপদ। দিল্লি, মুম্বই, কলকাতার মতো মফসসলগুলি হয়ে উঠছে আরবানাইজড। এর একটি অন্যতম কারণ হল অর্থনৈতিক পশ্চাৎপদতা। কাজের খোঁজে গ্রাম থেকে শহরে পাড়ি দিচ্ছে সবাই। অর্থনীতির কচকচানির হিসেবে হয়তো জিডিপি-তে আমরা চিনকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যাব, কিন্তু স্বচ্ছল হচ্ছে না ভারতবাসী। সমীক্ষা বলছে ৩০ শতাংশের বেশি মানুষ এখনো দারিদ্রসীমার নিচে বাস করে। গ্রাম এলাকায় এটা প্রায় ৩৫-এর ওপরে। তাহলে জিডিপি কি শুধুই লোকদেখানো, কর্পোরেট ইন্ডিয়ানদের? দরিদ্র ভারতবাসীর নয়? গ্রাম মানেই সবুজ ক্ষেতের মনোরম দৃশ্য নয়, সেখানে রয়েছে খেতে না পাওয়া, কাজ না পাওয়া মানুষ, বেকার যুবক, আর রয়েছে খরা। সর্বোপরি কৃষকের আত্মহনন। যেটাকে এখন অনেকে ফ্যাশন বলে চালাচ্ছেন। এটা যদি ফ্যাশনই হয় তবে তাতে ভারত শীঘ্রই শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা লাভ করতে চলেছে।
ভারতে মাইগ্রেশন হয় মূলত কাজের খোঁজে। বিয়ের জন্য বহু মেয়ে স্থান পরিবর্তন করে। কিন্তু পুরুষদের ক্ষেত্রে অধিকাংশই পাড়ি দেয় এই জন্য। শিক্ষার জন্য আছে, সেটা নগণ্য। গ্রাম-মফসসল ছেড়ে কলকাতা, দিল্লি, আলিগড় পড়তে যায় বহু মুসলিম ছেলে-মেয়ে। হ্যাঁ, মুসলিম মেয়েরাও পিছিয়ে নেই। আল-আমীন আন্দোলন এগিয়ে দিয়েছে এই সংখ্যালঘু সমাজকে। তাই ইদ আসলে ঘরে ফেরে শিক্ষার্থীরাও।
পরীক্ষা-সহ বিভিন্ন আনুষঙ্গিক কারণে তারা ইদে বাড়ি ফিরছে না। ইদের দিনও অনেক সময় পরীক্ষা, সেমিনার থাকে৷ ছুটির ফুরসত পায় না তারা৷ আর শ্রমিকরা চাইছে কুরবানির ইদে ফিরতে। এই ইদে এলে তো আবার আসতে হবে। কেন এত খরচ? অর্থের অভাবে ইদ কাটবে প্রিয়জন ছাড়াই।
ইদ আসলে কিছু প্রশ্নও আসে
------------------------------
ইদ আসলেই অবধারিতভাবে কয়েকটা প্রশ্ন এসে পড়ে। আমরা কে? আমাদের কদর কতটুকু। রেখেছ ভোটার করে, নাগরিক করোনি। তাই দুর্গাপুজো, কালীপুজোতে যে ব্যাপক প্রচার প্রচারমাধ্যম করে, তার ছিঁটেফোটাও করে না ইদ এলে। এই কুলীন উৎসবগুলোকে যেভাবে বাজারি অর্থনীতির চেষ্টায় সার্বজনীন-রূপে প্রচার করা হচ্ছে,তা-কি দেখা যায় ইদ এলে? মনসা পুজো বা আদিবাসী উৎসবগুলো না পায় স্পেস, না পায় ফুটেজ। অথচ অভিধানে আসে সাঁওতাল মানে অসভ্য জাতি। আর খবরের কাগজে লেখা হয় ‘সাঁওতাল রমণীর উদ্দাম যৌবন উপভোগ করতে পুরুলিয়া চলুন’। ইদ এলে ভুল বানানের ক্যাপশানে কোলাকুলির ছবি দেখতে দেখতে বড়ো হলাম। ইদ মানে শুধুই কোলাকুলি? লাচ্চা, সিমাই, হালিম? রেড রোড, নাখোদা? আর কিছু না! এসব গ্রামসির কালচারাল হেজিমনি কিনা সেটা সেমিনারে আলোচনা হবে, কিন্তু উপেক্ষা আর কতদিন! আমরাও চাই কুমোরটুলির পুজো-প্রস্তুতি দেখতে, কিন্তু তার সঙ্গে সঙ্গে সুদূর মুর্শিদাবাদের নদী-ভাঙ্গনপীড়িত মানুষদের ইদের খবরও জানতে চাই। জানতে চাই ইদের আগে ইদগাহের সেজে ওঠা। শারদীয় সংখ্যা তো প্রচুর রয়েছে। এই বাংলায় ইদ সংখ্যা ক’টা? এটা সাম্প্রদায়িক প্রশ্ন নয়, অধিকারের দাবি।
ইদ আসুক সবার ঘরে
----------------------
ইদ আসুক কুঁড়ে ঘরে, বস্তিতে, ফুটপাতে। ভিখারির পাত্রে, রেলের ঝুপড়িতে। ইদ আসুক গাজা, ফিলিস্তিনে, সিরিয়ায়, আফগানিস্তান, কাশ্মীরে। ইদ আসুক যুদ্ধের ময়দানে।
ইদ তো আমাদের অনেক কাছে নিয়ে আসতে পারে। যারা পরস্পরকে জানি না, আরেকটু জানার চেষ্টা করতে পারি। বিভেদ ঘোচাতে পারব না হয়তো, মনের মালিন্য দূরে সরিয়ে রেখে হৃদয়ে হৃদয় রাখতে পারি।
দেশের জনসংখ্যার বিশাল অংশ সুবিধা বঞ্চিত। কিন্তু ইদ সবার জন্য ও সার্বজনীন উৎসব। এ আনন্দে দরিদ্র মানুষগুলোকে অসহায় দর্শক বানানো নিতান্তই অমানবিকতা। মাহে রমজান আমাদের ত্যাগ-কুরবানির প্রশিক্ষণ দেয়। সেই প্রশিক্ষণের উত্তম প্রতিফলন হবে যদি সমাজের সবাই যার যার পাশের সুবিধা বঞ্চিত মানুষের সঙ্গে ইদের আনন্দকে ভাগাভাগি করে নিতে পারি। ইসলামের সামাজিক শিক্ষাও এটাই।
রমজানকে সমাজ গঠনের হাতিয়ারে পরিণত করতে হবে। রোজাদারদের সম্মিলিত সহযোগিতা ও সহমর্মিতা সমাজের চিত্র পাল্টে দিতে সক্ষম। ইসলামে জাকাত ও ফিতরার বিধানের মধ্য দিয়ে সমাজের বিত্তবানদের সম্পদের মাঝে অসহায় দরিদ্রদের হক নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। এর ফলে সমাজের দারিদ্র্যের নিষ্ঠুর কষাঘাতে নিপতিত অনেক অনাহারী মানুষ ক্ষুধা-তৃষ্ণার অসহনীয় দুর্ভোগ থেকেও মুক্তি পেতে পারে। এর জন্য গ্রামে গ্রামে গড়ে উঠুক বিতরণ কেন্দ্র (বাইতুল মাল)।
আবার ইদে আলোর রোশনাই, আতশবাজির নামে জোর করে চাঁদা আদায় হোক, এটাও চাই না। যেমন চাই না সাহরির সময় রাতদুপুরে মাইকে গজল চালানো। এই ইদে চাই সম্প্রীতির বাতাস, মিলনের আনন্দ। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে। সিমাই-লাচ্চা, ইদের চাঁদ দেখে হেসে উঠুক সবার মুখ। খুশিতে ভেসে যাক হৃদয়।