

মাকড়সার জালের মতো ছড়িয়ে পড়া অন্ধকার ফিকে হয়ে এলো। কুকুরটা আড়মোড়া ভাঙল। স্টেশনের ধারে চা দোকানের লোকটা রাস্তায় জল ছেটাতে গিয়ে দু-চার ফোঁটা ফেলল তার গায়েও। তৎক্ষণাৎ গা ঝেড়ে নিয়ে কুকুরটা চলে গেল নিজের চরকায় তেল দিতে।
গতরাতে, বৃংহণ বসু সাড়ে ন'টায় অফিস বেরোবেন বলে সাতটা তিন-এ আ্যলার্ম দিয়ে ঘুমিয়েছিলেন। রোজই দেন। তবে সাতটায় না দিয়ে কেন সাতটা তিন, এর কোনও উত্তর জানা যায় না। সরকারি কর্মচারী। ঢাকুরিয়ার বাসিন্দা। একটা দু-কামরার ফ্ল্যাটে একাই থাকেন। জীবনে একটাও মশা মারেননি। আ্যলার্ম বেজে বেজে ক্লান্ত। অ্যালার্ম থাবড়ে থামিয়ে তিনি গায়ের চাদরটা আরও জড়িয়ে নিলেন।
বৃংহণবাবুর যখন ঘুম ভাঙল, ততক্ষণে প্রতিবেশী সান্যালবাবুর সকালের চা দু-বার খাওয়া হয়ে গিয়েছে। হঠাৎ ঘুম ভেঙে ঘড়িতে চোখ পড়তেই আঁতকে উঠলেন। সোয়া ন'টা। ঘুম যদিও হঠাৎ ভাঙেনি, ভেঙেছে দরজায় প্রবল ধাক্কাধাক্কির শব্দে। হোম ডেলিভারি। দ্রুত স্নান করে, তৈরি হয়ে, নাকেমুখে গুঁজে ছুটলেন অফিসে। ঘড়ি লাফিয়ে তখন দশটা পার। বাসে উঠে কিছুদুর যাওয়ার পর বসার জায়গা পেলেন। মনে হল, কিছু একটা তিনি ভুলে গেছেন। কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারলেন না। চেনা কন্ডাক্টরের দিকে চোখ পড়তে সে হাত নেড়ে হাসলেও বৃংহণবাবু স্থির, নির্বাক।
'একটা এক্সাইড তো দাদা?'
কন্ডাকটরের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লেন।
'আরে দাদা, আর বলবেন না সকাল থেকেই…'
'ধ্যাৎ থুথু ছেটাচ্ছে! দূরে দাঁড়াও! আর তোমার রোজনামচা শোনার ইচ্ছে, সময় কোনটাই আমার নেই। যত্তসব!'
কন্ডাকটর সাড়ে সাত সেকেন্ড হাঁ করে থেকে, পিছনের দিকে এগিয়ে গেল। অফিসের স্টপ আসতেই বাস থেকে দ্রুত নেমে গেলেন বৃংহণবাবু। রাস্তা পারাপারের সময় আচমকা একটা গাড়ি সামনে এসে যাওয়ায় দুটো বাজে গালাগাল দিলেন। ড্রাইভার না শুনতে পাওয়ায় এই যাত্রায় বেঁচে গেলেন। ঝামেলা ১-০ গোলে হেরে গেল।
অফিসে ঢুকতেই, ডেস্কের সামনে একটা ঘ্যানঘ্যানে লোক আর স্তুপাকার ফাইলের দৃশ্য তাঁকে গিলে খেতে এলো।
'স্যার, আমার কাজটা করে দিন, পরশু বলেছিলেন আজ আসতে। সব এনেছি স্যার – কাগজপত্রগুলো -'
'ওগুলো এক গ্লাস জল দিয়ে কোঁত করে গিলে নিন।'
বৃংহণবাবুর এইরকম উত্তরে কী বলবে বুঝতে পারে না লোকটি।
কম্পিউটারটা খুলতে সময় নিচ্ছে। সিপিউতে মারলেন ক্যাঁক করে দুই লাথি। মোবাইলটা পকেট থেকে বের করে দেখলেন সাত পারসেন্ট চার্জ। বুঝতে পারলেন গতরাতে চার্জে বসিয়ে সুইচ অন করতে ভুলে গিয়েছিলেন। বিহ্বল লোকটি তখনও দাঁড়িয়ে ছিল। সিপিউয়ের অবস্থা দেখে হাঁটা লাগাল। 'দাদা, চা।' ভোলার গলা শুনে কিছুতেই নিজেকে সংযত করতে পারলেন না বৃংহণবাবু। ভোলা মার খেতে খেতে বেঁচে গেল। তারপর চেঁচামেচি, বিচ্ছিরি কাণ্ড। সহকর্মীদের মধ্যে একজন চার্জার এগিয়ে দিল।
'সুইচড অফ করে দেব, কিন্তু তোমার চার্জার আমি নোব না। আমার নামে যে কেচ্ছা রটাও তা কী জানি না ভেবেছ!?'
কেটে কেটে কথাগুলো বলার সময়, কব্জির ওপর বসে থাকা মশাটাকে এক চাপড়ে মেরে ফেললেন। জীবনে প্রথম।
কেউ কেউ মুচকি হাসল, আবার কারোর চোখের পাতা পড়ল না। তারা দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারেনি মিশুকে, হাসিখুশী, মিষ্টভাষী বৃংহণ বসু এত দুর্ব্যবহার করতে পারেন। সারাদিন তিনি গুম হয়ে বসে রইলেন। লাঞ্চব্রেকেও বাইরে গেলেন না। কেউ তাঁকে আর বিশেষ ঘাঁটাল না। স্কোরবোর্ড ১-১।
ঢাকুরিয়া স্টেশন। ছ'টা দশের বারুইপুর লোকালের হুইসেলের শব্দের শেষে সন্ধ্যা নামল।
বাড়ি ফেরার পথে, সঙ্গী সহকর্মী সন্দীপ কুন্ডু, একটা হাত বাসের হাতলে, চোখের কোনায় আঞ্জনি, ঠোঁটে শিয়ালী হাসে ঝুলিয়ে বলল,
'আজ পরতে ভুলে গেছেন, না?'
বৃংহণবাবু চমকে তাকালেন।
'ঠিক ধরেছি, আমার কম বয়স তো হল না! হয় হয়, এক একদিন হয়ে যায়। আমারও হয়েছিল, গতমাসে।'
তারপর আরও অনেক কিছু বলে চলল। বৃংহণ বসুর কানে কিছুই এসে পৌঁছোল না। শুধু মনে মনে বললেন,
'ইস! সত্যিই তো। তাই এত ফাঁকা লাগছে।'
পরের স্টপে নেমে ঢুকলেন বাড়ির গলিতে। অকেজো স্ট্রিট লাইট অন্ধকারে একা দাঁড়িয়ে।
বাড়িতে ঢুকে ফ্রেশ হলেন। তারপর চা বানিয়ে বসলেন টিভির সামনে। বাজে বকবক করছে নিউজ অ্যাঙ্কার। তাকে দেখতে গিয়ে বিস্কুটটা তলিয়ে গেল চায়ে। গুটিশুটি মেরে শুয়েছিল যে, আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। বাঁ হাতের ঝটকা। গুঁড়িয়ে গেল চায়ের কাপ। রাতের খাবার দিয়ে গেল হোম ডেলিভারি বয়।
প্রবল খিদেকে দমিয়ে রাখা অসম্ভব। খাওয়া শেষ। মুখ ধুতে ধুতে ভাবলেন সারাদিনের কথা। কী করে তিনি পরতে ভুলে গেলেন! আক্ষেপে দুবার মাথা নাড়লেন। না, আজ আর জেগে থাকা উচিত হবে না। শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দিয়ে চোখ বুঝলেন। ঘুম আসে না। কাশলেন দু-বার। খাট থেকে নেমে টেবিলে ভাঁজ করা খোলসটা গলিয়ে বিছানায় ফিরে এলেন। কোন রিস্ক তিনি আর নেবেন না। আজকের মতো ভুল যেন কোনদিন না হয়। প্রতিজ্ঞা করলেন সব ভুলে গেলেও খোলস পরতে কখনও ভুলবেন না।
মুখে শান্তির হাসি। চারদিকের কোলাহল থেমে গেল।
একদৃষ্টিতে সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে, চোখে ঘুম মায়ের গায়ের গন্ধের মতো এসে মনকে শান্ত করে দিল। বাইরে ঝোড়ো হাওয়া শুকনো পাতাদের উড়িয়ে নিয়ে গেল নিজের দেশে।
kk | 68.184.***.*** | ১৩ ডিসেম্বর ২০২১ ২১:৩১502070
Abhyu | 198.137.***.*** | ১৪ ডিসেম্বর ২০২১ ০০:৩০502081
aranya | 2601:84:4600:5410:b40f:b06c:fe21:***:*** | ১৪ ডিসেম্বর ২০২১ ০০:৪৩502082
সে | 2001:1711:fa42:f421:20db:4b0c:2324:***:*** | ১৪ ডিসেম্বর ২০২১ ০৪:৫৭502083
b | 14.139.***.*** | ২৩ ডিসেম্বর ২০২১ ১১:৫৭502273
মালবিকা | 2409:4060:2d9a:c6af::b749:***:*** | ০৬ মার্চ ২০২২ ০০:১৫504727
সোমনাথ চক্রবর্তী | 117.227.***.*** | ০৮ মার্চ ২০২২ ২০:৫৮504785
জ্ঞান তিলক | 103.89.***.*** | ০৮ মার্চ ২০২২ ২৩:১১504789
অনিমেষ সরকার | 2401:4900:16cd:311b:1:1:d050:***:*** | ০৮ মার্চ ২০২২ ২৩:১৬504790
শাশ্বতী দত্ত রায় | 2409:4060:85:a6e1::1013:***:*** | ০৮ মার্চ ২০২২ ২৩:৩৮504791
প্রদীপ মুখার্জী | 2402:3a80:1cd1:ec32:278:5634:1232:***:*** | ০৯ মার্চ ২০২২ ০৬:৪১504792
Tulika Chakraborty | 2409:4060:310:99bf::a22:***:*** | ০৯ মার্চ ২০২২ ১২:৩২504796
সুমন মজুমদার | 2409:4060:210a:708b::1ca2:***:*** | ০৯ মার্চ ২০২২ ১৬:০২504798
পাঠক | 173.49.***.*** | ১৮ ডিসেম্বর ২০২২ ০৬:৩২514685
Mahasweta Mahapatra Sau | 42.***.*** | ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৫:২৯516749