“পনেরোক্কে পনেরো, পনেরো দুগুণে তিরিশ, তিন পনেরোং…আ…মা? তিন পনেরোং কত যেন ছিল?”
“ভালো করে ভাবো।”
“…ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে! ফরটি-ফাইভ।“
“ঊর্মি, তোমার কিন্তু বাংলার অবস্থা খুব খারাপ। এবারের পরীক্ষায় তোমার যে কী হবে কে জানে! নাও, এবার ইংলিশে টেব্ল্ টা বলে ফ্যালো দেখি।“
“আচ্ছা, কিন্তু কী ভুল হয়েছিল বলবে এর পর। ফিফটিন ওয়ান জা ফিফটিন, ফিফটিন টু জা থার্টি, ফিফটিন থ্রী জা ফরটি-ফাইভ, ফিফটিন ফোর জা সিক্সটি…”
“হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক আছে, ঠিক আছে, আর দরকার নেই। আর শোনো, বাংলায় তিন পনেরোং পঁয়তাল্লিশ। ফরটি-ফাইভ হলো ইংলি…”
আর বলা হল না। প্রচন্ড একটা বাজ পড়ে গোটা আকাশটা চিরে দিল! তারপর মাকে ঊর্মির বাজ নিয়ে হাজারো প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে ঘুমোনোর সময় হয়ে গেল।
***
ভোরবেলা ঘুম ভেঙে যাওয়াতে ঊর্মি উঠে বসে দ্যাখে, এ কি! এটা আবার কার ঘর! তার বেড়াল এঞ্জেলের বদলে মোটা, কালো, মস্ত একটা ল্যাব্রাডর কী করছে? ওরে বাবা!! কামড়ে দেবে না তো! আর ওর সুন্দর ফুল ফুল আঁকা ঘরটা? ওটা তো পুরোটাই গ্রে হয়ে গেছে! মা বাবার ঘরে যাবে বলে যেই না দরজাটা খুলেছে, অমনি ঊর্মি সোজা রান্নাঘরে! রান্নাঘরের দরজাটা খুলে দ্যাখে, রাস্তা!!আর একটা পোস্টারের ওপর কী যেন হাবিজাবি লেখা আছে। একটু তলার দিকে ইংলিশে লেখা আছে, “প্যারিস – ওয়ান কিলোমিটার ইস্ট”। আর তার তলায় লেখা, “লোরেইন – ওয়ান কিলোমিটার ওয়েস্ট।“
ঊর্মি তো অবাক! মনে মনে বললো, “আমি কি ফ্রান্সে চলে এলাম নাকি??”
খানিক পরে একটা বাচ্চা মেয়ে এলো, ওই বছর পাচেঁক হবে। এসে কী যেন বকতে শুরু করলো। ঊর্মি বুঝলো, এটাই জিওগ্রাফি স্যারের বলা ফ্রেঞ্চ ভাষা। ঊর্মি ইংলিশে বললো, “আই ডোন্ট নো ফ্রেঞ্চ।“ অর্থাৎ, আমি ফ্রেঞ্চ জানিনা।
মেয়েটা আবার ফ্রেঞ্চেই চেঁচিয়ে উঠলো। এটুকু বোঝা গেল যে ও কাউকে ডাকলো। দু-তিন মিনিট পরেই একজন কাকু এসে দাঁড়ালো। মেয়েটা আবার ফ্রেঞ্চেই কাকুটাকে কী যেন বললো। তারপর কাকুটা ঊর্মির সঙ্গে ইংলিশে কথা বলতে শুরু করলো। বললো যে, “তুমি আবার কে?”
ঊর্মি একটু ভয় পেয়েই মিনমিনে গলাতে বললো, “আমার নাম ঊর্মি। আ-আপনি কে? আর এটা কোন জায়গা?”
“এটা ফ্রান্স অফ কোর্স! আর শোনো, আমাকে আপনি বলার দরকার নেই, তুমি বলো।“
কাকুটা আর কিছু বলে ওঠার আর সময় পেলো না। হঠাৎ একটা সবুজ ধোঁয়ার কুন্ডলী এগিয়ে আসছে দেখে কাকুটা ঊর্মিকে আর ওই ছোট মেয়েটাকে একেক হাতে তুলে বগলদাবা করে নিয়ে প্রচন্ড এক ছুট দিলো। ঊর্মি চেঁচিয়ে প্রশ্ন করলো, “দৌড়াচ্ছো কেন?” সে দেখলো, সেই সবুজ ধোঁয়াটা তাদের পিছনে পিছনে আসছে। কাকুটাকে বলতেই সে সঙ্গে সঙ্গে পিছনে তাকিয়ে বললো, “গ্রিসমো ( গ্রিন স্মোকের নাম)খুব কাছে এসে পড়েছে! এখন যাই হোক না কেন, মিলিয়ে যেতে হবে।“
মেয়েটাকে সেই কথাটাই বোধ হয় ফেঞ্চে বললো। অমনি মেয়েটা চোখ বন্ধ করে ডান পা টা তিনবার উপর-নীচ করলো আর তারপর পুরোপুরি ভ্যানিশ! আমি সাংঘাতিক আশ্চর্য হয়ে কাকুকে জিজ্ঞেস করলাম, “এ কীকরে হলো? কী অদ্ভুত!! পু-পু-পুরো হাওয়া হয়ে গেল কীভাবে?”
“ওহ্! তোমাকে এখনো শেখায়নি বুঝি! আমাদের তাহলে ডবল টা-ই করতে হবে দেখছি!” বলে তৎক্ষণাৎ ঊর্মিকে বুকের কাছে প্রচন্ড চেপে ধরে মেয়েটার মত পা উপর-নীচ করতে থাকলো। ভেলকির মত ঊর্মিরা একটা কাঠের বাড়িতে চলে এলো!! সেখানে সেই ছোট মেয়েটা জুস খাচ্ছিলো।
এবার একটু শান্তি পেয়ে কাকুটা আর ছোট মেয়েটার সঙ্গে আলাপটা সেরে নিয়ে ঊর্মি বুঝলো, মেয়েটার নাম সিমোন আর কাকুটার নাম জাঁক।
ঊর্মির সঙ্গে সিমোনের খুব ভাব হয়ে গেছে। কিন্তু ওর বাবা,ম মানে জাঁক কাকুএর একটুর বিশ্রামের জো নেই, কারণ যতক্ষণ ঊর্মির আর সিমোনের গল্প চলবে ততক্ষণ তাকে অনুবাদকের কাজ করে যেতে হবে! সিমোনের থেকে জানলাম, ওর মা ওর জন্মের কিছুদিন পরে “কাজে যাচ্ছি” বলে চলে গিয়েছিল, আর এতদিন পরে মা এই বছরই ফিরে আসবে।
ঊর্মি তো একটু অবাকই হলো। তার মা তো তাকে তার বাবার এই একই গল্প বলেছিলো! ঊর্মি বললো, “আমার কাছে বাবার একটা ছবি আছে, কিন্তু তার মুখের অংশটা ছেঁড়া, পকেটে আছে।“ সিমোন বললো, “আমার কাছেও আমার মায়ের একটা ছবি আছে, যেটার মুখটা ছেঁড়া!” ঊর্মি আর সিমোন ঠিক করলো, দুজন দুজনকে দেখাবে ছবিগুলো।
ঊর্মি দেখালো, সিমোন দেখেই চেঁচিয়ে উঠলো, “এ কী!! এটা তো আমার বাবার জামা!”
সিমোনের দেখানো ছবি দেখে ঊর্মি চমকে উঠে বললো, “আরে এ তো আমার মায়ের শাড়ি!!”
দুজনে এত অবাক যে আর কিছু বলতেই পারছে না। এ আবার কেমন হেঁয়ালি!!
এর মধ্যে হঠাৎ বেল বেজে উঠলো, ক্রিং ক্রিং…
জাঁক কাকু বোধ হয় জানতো কার আসার কথা। সিমোনের দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি হেসে গিয়ে দরজা খুলে দিলো। অমনি সিমোন ছুটে গেল। ঊর্মি দেখলো, এ কী!! এ তো তার মা!!
মা ঊর্মিকে দেখে বললো, “কী রে! ঊর্মি! তুমি ফ্রান্সে কীকরে এলে?”
“মা! আমি আজ সকালে উঠে দেখি আমি এখানে! তুমি কি সিমোনেরও মা? কিন্তু কীকরে?”
মা বললো, “হ্যাঁ, আর এটা তোমার বাবা।“
কাকু, মানে বাবা বললো, “জুলিয়েট, এটা আয়গনেস??” ঊর্মি হতভম্ব! বললো, “মা, আমার নাম আয়গনেস?? আমরা ফ্রেঞ্চ??”
“হ্যাঁ ঊর্মি, তোর আসল নাম আয়গনেস। আর আমরা শুধু ফ্রেঞ্চ নই, আমরা ফ্রেঞ্চ পরী।“
“মা, এবার থেকে আমরা এখানে থাকি না প্লীজ? সবাই মিলে?”
মা হেসে বললো, “নিশ্চই!”