দিনটা ছিল রবিবার – তাই অফিসেও ছুটি, বসে বসে খবরের কাগজ পড়া ছাড়া কাজ ছিল না। ঘড়ি দেখলাম, সকাল আটটা বাজে। চাকর বীরু চা দিয়ে গেল। হ্যাঁ, প্রথমেই একটা কথা বলা দরকার যে আমি নাস্তিক ছিলাম ২১ বছর বয়স পর্যন্ত। কিন্তু দশ বছর আগে যা ঘটে গেল, তার কথা ভাবলে এখনও গায়ে কাঁটা দেয়। সেই ঘটনার কথাই আজ আপনাদের বলব।
তখন আমার বয়স ছিল ২১ বছর – একটি কলেজে পড়ি। আমার একজন কাছের বন্ধু ছিল অমল। আমরা দুজনেই নাস্তিক ছিলাম তখন। আমাদের দুজনার মধ্যে আরো একটি আশ্চর্য্য মিল ছিল – আমাদের দুজনারই সাতকূলে কেউ ছিল না। আমার নয় বছর বয়সে ও অমলের এগারো বছর বয়সে বাবা-মা গত হয়েছেন।
একদিন আমি বাড়িতে বসে আছি – হঠাৎ দরজায় টোকা পড়ল। দরজা খুলতেই দেখি অমল দাঁড়িয়ে আছে। ওকে ভিতরে এনে বসালাম আর বীরুকে বললাম আমাদের জন্য চা নিয়ে আসতে। তখন বীরু সবেমাত্র আমাদের বাড়িতে এসেছে – না হলে অমল এলে আর আলাদা করে চা করার কথা বলতে হত না। অমলের সাথে গল্প গুজব করার ফাঁকে একসময় সে প্রায় হঠাৎ করেই অন্য প্রসঙ্গ এনে বলল, “আচ্ছা শ্যামল, তুই ভূতে বিশ্বাস করিস?” আমি ওর প্রশ্নে অবাক হলাম। তার পরেই সামলে নিয়ে বললাম – না। এই কথা শুনে অমল বলল, “আমিও করি না, কিন্তু রাস্তায় আসতে আসতে কিছু লোক একটি চায়ের দোকানে এই আশেপাশের এক ভূতের বাড়ি সমন্ধে আলোচনা করছিল। আমি জিজ্ঞেস করাতে তারা আমাকে একটি কার্ড দিল তাতে ঠিকানা আছে ওই বাড়ির”।
এই বলে অমল আমার দিকে কার্ডটি এগিয়ে দিল। আমি হাতে নিয়ে দেখলাম তাতে লেখা আছে - “নন্দনপুর আদর্শ নিকেতন”, গ্রাম + পোষ্ট – নন্দনপুর, থানা – করিমপুর, নদীয়া। কার্ডটি ফেরত নিয়ে অমল বলল, “তাহলে কি আজ রাতে যাবি নাকি একবার ঘুরে আসতে এই বাড়ি দিয়ে? অনেকদিন তো একসাথে কোথাও বেরোনো হয় নি”। আমি সেই প্রস্তাব প্রায় লুফে নিয়ে বললাম – “খুব যায়”! আরো খানিক গল্প করে অমল উঠল সেদিনের মত – আর বলল, “তাহলে সন্ধ্যের দিকে দেখা হচ্ছে আবার। আমি রওয়ানা দিয়ে তোর বাড়ি হয়ে যাব – তুই রেডি থাকিস”।
সারা দিন আমার বেশ উত্তেজনার মধ্যে কেটে গেল – বিকেল শেষ হয়ে সন্ধ্যে হল। আমার এবার কেন জানি না কেমন একটা হতে লাগল। নানা কিছু ভাবতে ভাবতে জামাকাপড় পরে রেডী হয়ে রইলাম। আর একটু রাত বাড়িতেই দরজায় টোকা – বুঝতেই পারছিলাম অমল এসেছে। দরজা খুলে দেখলাম তাই। দুজনে বাড়ি থেকে বেরিয়ে সেই সকালের ঠিকানা লেখা বাড়িটার দিকে এগুলাম। খুব বিশাল কিছু দূরে না হলেও একদম কাছেও নয় সেই বাড়িটি – তার উপর আমরা হেঁটে যাচ্ছিলাম। তাই সেই বাড়ির কাছে গিয়ে পৌঁছাতে রাত আরো গভীর হল। একদম কাছাকাছি গিয়ে দেখলাম কার্ডে যেমন লেখা ছিল, এই বাড়িটি আগে একটা স্কুল ছিল – ভেঙে যাওয়া ফলক দেখে জানলাম এই স্কুল প্রায় ১০০ বছর আগে এখানে ছিল।
এই বাড়ির আরেক কোণে স্কুল শিক্ষক-দের নাম লেখা। তাতে অর্ধেক বোঝা যায় এমন কিছু নাম আমি আর অমল অনেক কষ্টে উদ্ধার করলামঃ
১) কার্তিক পাল
২) অয়ন দে
৩) অলোক মন্ডল
৪) প্রণব দাঁ
এবার আমরা সেই বাড়ি ওরফে স্কুলে ঢুকলাম – আমি নাস্তিক হলেও আমার গা ছমছম করে উঠল – বাড়িতে অনেক ঘর। তার একটি ঘরে আমরা প্রবেশ করলাম। ঢুকেই সর্বনাশ – দুম করে শব্দ করে ঘরের দরজা বন্ধ হয়ে গেল। আমি প্রাণপণে টানলাম, কিন্তু খুলল না। তখন অমল বলল, “খুবই পাতলা কাঠের তৈরী দরজা দুই লাথিতে ভেঙে ফেলব”। কিন্তু দুই লাথি কেন – বারবার অনেক লাথি মারলেও কিছুই হল না সেই দরজার! হঠাৎ খুলে গেল সেই দরজা এবং ভেসে এল বিকট অট্টহাসির শব্দ।
সেই ঘর থেকে বেরিয়ে আমরা প্রায় দৌড়ে অন্য ঘরে ঢুকলাম – সেই ঘরে ঢুকেছি কি, একটা দড়ি হঠাৎ করে অমলের গলায় চলে এল এবং তাকে উঠিয়ে নিল শূন্যে! তার প্রাণ যায় যায় অবস্থা! তখন মনে পড়ে গেল আমার কাছে থাকা মায়ের একটা মাদুলির কথা। যদিও আগেই বলেছি আমি নাস্তিক – কিন্তু মা সেই সব কথা না শুনে হাতে মাদুলি পড়িয়ে রাখত, মরা যাবার আগে মা আমাকে সেই মাদুলি খুলতে বারণ করে গিয়েছিল। তাই এখনো সেই মাদুলি রয়ে গেছে তত বড় বয়েসেও। তা আমার কি মনে হল – ভাবলাম দেখি মায়ের কথায় কিছু কাজ হয় কিনা, মানে মাদুলি আমাকে সেই বিপদের হাত থেকে বাঁচাতে পারে কিনা। চট করে সেই মাদুলি অমলের কাছে নিয়ে গিয়ে ওর গায়ে ঠেকিয়ে দিলাম। এবং আমাকে অবাক করে গায়ে মাদুলি ঠেকাতেই সেই দড়ি অদৃশ্য হয়ে গেল এবং অমল ঝপ করে মেঝেয় পড়ে গেল। আমরা দুজনে কোনক্রমে সেই ঘর এবং স্কুল বাড়ি থেকে ছুটে বেরিয়ে আর না থেমে বহুদূর ছুটলাম। স্কুল থেকে অনেক দূরে এসে একটু হাঁপ ছেড়ে বাড়ি ফিরলাম। বুঝতেই পারছেন, সেদিন যা প্রাণে বাঁচলাম, তা কেবল ওই মাদুলির জন্য!
কিন্তু এর পরে আমাদেরও জেদ চেপে গেল। বাড়িটার প্রতি যেন আমরা একটি টান অনুভব করছি। অমলেরও একই অবস্থা। কী মনে হল আমরা আবার একদিন রাতে সেই বাড়িতে গেলাম। এবার মনে হল কিছু একটা ঘটছে। সেই বাড়িতে ওই দুটি ঘর ছাড়া অন্য একটি ঘরে ঢুকলাম এবং সেখানে প্রচুর ভৌতিক কান্ড ও আওয়াজ পাচ্ছিলাম। আমরা ভয় পাই নি, কারণ বুঝতে পেরে গিয়েছিলাম ভয় পেয়ে গেলেই আমাদের মৃত্যু অবধারিত। আজ অমলকেও একটা মাদুলি পড়িয়ে এনেছিলাম – তাই ওর ভয়ও অনেকটা কমেছে। আমরা দেখি একটি উড়ন্ত চৌকি ও তাতে দেখলাম অস্পষ্ট একটি ধুঁয়া দিয়ে তৈরী একটি লোক – তার জামায় লেখা – কার্তিক পাল। এই রকম অনেক চৌকি এবং তার উপর সেই রকম লোক। তাদের কারুর জামায় লেখা অয়ন, কারো জামায় লেখা অলোক, প্রণব এবং কারোর জামায় লেখা মুকেশ। আরো একজনকে দেখে মনে হল সেই এখানকার প্রধান শিক্ষক, কারণ তার জামায় লেখা HM -
এরা সবাই আমাদের দিকে এগিয়ে এল। আমি বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলাম, কিন্তু বুদ্ধি হারাইনি। আমি আমার মাদুলিটা ওদের দিকে ছুঁড়ে দিলাম। হঠাৎ করে ওরা অদৃশ্য হয়ে গেল এবং ঠং করে আওয়াজ হলে দেখলাম দেখলাম মাদুলিটা মেঝেতে পড়ে আছে। এরপর আমরা অন্য একটি ঘরে গেলাম – সেখানে দেখলাম মেঝে থেকে কিছু হাত উঠে আসছে তারা আমাদের ধরতে আসছে না, তারা আমাদের মেরে ফেলতে আসছে। আমরা সেই ভৌতিক ঘর থেকে বেরিয়ে মাঠে এলাম – সেখানে অমলের মোবাইল বেজে উঠল। এত রাতে এই মুহুর্তে কে কল করবে! আমার মত অমলও অবাক – আমরা দেখলাম যে কোন নাম্বার নেই সেই কল-এ। অমল ফোন ধরল – আমি দেখলাম তার মুখটা আসতে আসতে ফ্যাকসা হয়ে গেল, এবং ফোন রেখে দিল। আমি তাকে জিজ্ঞেস করাতে সে বলল যে ফোনে যেন সবসময় একটাই আওয়াজ হচ্ছে “চলে যাও, চলে যাও”! আমরা মুখ তুলে দেখলাম আমাদের পিছনে পৃথিবীর যত ভূত আসছে। আমরা সেই আগের দিনের মতই ছূট লাগালাম নিজেদের বাড়ির দিকে।
তারপরে আমি আর অমল অনেক আলোচনা করলাম এবং ঠিক করলাম যে ঘরে আমরা আটকে পড়েছিলাম সেই ঘরটি ভেঙে ফেলতে হবে। যখন সেটি ভাঙা হল তখন তার তলা থেকে বিভিন্ন অজানা যন্ত্র বের হল। সেই থেকে সেই বাড়িতে ভূতের উপদ্রব বন্ধ হল। তবে হ্যাঁ, সেইখানেই তখনও কিছু ঘর ছিল এবং সেই খানে একটি মাত্র নির্দিষ্ট ঘরে গেলে একটি নম্বরবিহীন ফোন আসে ও কোনও কথা হয়না। সেই ঘরটি আজও রয়ে গেছে।