দুরন্ত যশবন্তপুরম স্টেশন পৌঁছানোর কিছু আগে থেকেই শুরু হয়ে গেল নামার তোড়জোড়। সর্বজিতবাবু আর ঋষভ সিটের তলা থেকে টেনে টেনে জিনিস বের করছে। বাবা ও দাদার সঙ্গে রিদিমও হাত লাগালো।
সুচরিতা দেবী বাথরুমে গিয়েছিলেন। ফিরে, সিটে থাকা মোবাইল, চার্জার, চিরুনি হ্যান্ডব্যাগে ঢোকাতে ঢোকাতে বললেন- কৃষ্ণা দি কল্লোল দা কি স্টেশনে আসবেন?
ঋষভরা ব্যাঙ্গালোরে এই কল্লোলবাবুদের বাড়িতেই গিয়ে উঠছে। কল্লোলবাবুর স্ত্রী হলেন কৃষ্ণাদেবী, সর্বজিতবাবুর বহুদিনের পুরনো বন্ধু এরা।
হ্যাঁ হ্যাঁ, কল্লোল তো আসবে বলছে স্টেশনে - কৃষ্ণাদেবী চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে বললেন।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রেন যশবন্তপুরম স্টেশনে এসে থামল। কল্লোলবাবু একেবারে ঠিক জায়গাতেই দাঁড়িয়েছিলেন। ট্রেন থেকে নেমে কল্লোলবাবুকে আর কষ্ট করে খুঁজতে হয় নি রিদিমদের। স্টেশনে ঠিক সময়েই ট্রেন পৌঁছেছে। স্টেশন থেকে বেরিয়ে সামনেই একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকল সর্বজিতবাবুরা। কথা ছিল হালাসুরুতে কল্লোলবাবুদের বাড়িতে গিয়েই ব্রেকফাস্ট করার, কিন্তু হঠাৎই কৃষ্ণাদেবীর সুগার ফল করায় এই রেস্টুরেন্টে ঢুকতে হল। তাছাড়া সুচরিতা দেবীর ট্রেনের ঝাঁকুনিতে কোমর ব্যথা হয়ে গেছে। এর মধ্যে আবার গাড়ির ঝাঁকুনি হলে কোমরের অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে।
স্টেশনের কাছেই একটা বাগানে ঘেরা রেস্টুরেন্টে ঢুকল ঋষভরা। খুব সুন্দর সুন্দর ফুলে সাজানো রেস্টুরেন্টটা। ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা, সুইট উইলিয়াম, ক্রাউন অফ থর্ণস ইত্যাদি প্রচুর ফুলে সাজানো বাগান। বারোটার মধ্যে ঋষভরা বেরিয়ে গেলো। বড় বড় বিল্ডিং দুপাশে রেখে ঋষভদের গাড়ি চলেছে হালাসুরুর পথে।
রাস্তা, জায়গা দেখেই বোঝা যাচ্ছে কলকাতা, মুম্বাই, দিল্লির থেকে কোনো অংশে কম নয় এই ব্যাঙ্গালোর। উন্নত শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম এটি।
স্টেশন থেকে হালাসুরু অর্থাৎ কল্লোলবাবুর বাড়িতে পৌঁছতে সময় লাগলো প্রায় চল্লিশ মিনিট।
হালাসুরুতে প্রত্যেকটি বাড়ি বেশ অনেক বড় বড়। সামনে বাগান। দু তিন তলা বাড়ি। বারান্দায় হরেক রকম ফুলের গাছ।
বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই রিদিমের হঠাৎ চোখ পড়ল আশেপাশের বাড়িগুলোর ওপর। প্রত্যেকটি বাড়িতেই এক অদ্ভুত ভয়ংকর জিনিস রাখা আছে। বাড়িগুলোর বারান্দায় ফুলের গাছগুলির পাশে রাখা আছে এক ভয়ংকর রাক্ষসের মূর্তি। কি ভয়ানক দেখতে সেইগুলো।
- এই দাদা এই মূর্তিগুলো দেখ। কি ভয়ংকর তাই না! প্রত্যেকটা বাড়িতেই এই এক মূর্তি।
ঋষভ সুটকেসটা পাশে রেখে বলল- হুম তাই তো!
- কি রে তোরা এখানে দাঁড়িয়ে আছিস, ভেতরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নে। - সর্বজিতবাবু এগিয়ে এলেন বারান্দায়।
রিদিম বললো- দেখো বাবা এখানে প্রত্যেকটা বাড়িতে একটা করে রাক্ষসের মূর্তি।
- কই? সর্বজিতবাবু রেলিংয়ে হাত রেখে ওই বীভৎস মূর্তিগুলো দেখল। - হুম তাই তো!
কি দেখছিস তোরা ওইভাবে- কল্লোলবাবু একটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে এগিয়ে এলেন রিদিমদের কাছে।
সর্বজিতবাবু কল্লোলবাবুকে বললেন- এইখানের সব বাড়িতে একটা করে রাক্ষসের মূর্তি কেন?
কল্লোলবাবু সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে বললেন- ওহ! মূর্তিগুলো দেখছিস তোরা। আসলে মূর্তিগুলো রাখার পেছনে একটা কারণ আছে। এইখানে কেউ যাতে কারোর বাড়িতে নজর দিতে না পারে তাই এই বিকৃত মুখগুলো রাখা হয়েছে।
- ও বাবা নজর না লাগার জন্য রাক্ষসের মূর্তি রাখা হয় এখানে! - সুচরিতা দেবী বারান্দার দিকে এগিয়ে এলেন।
সিগারেটে একটা টান দিয়ে ব্যঙ্গ করে স্মিত হেসে কল্লোলবাবু বললেন - হ্যাঁ বৌদি। কি আর বলব, এখনো মানুষের মন থেকে কুসংস্কার যায়নি।
রিদিম বলে উঠল - আর মনে হয় না যাবে। এই কুসংস্কারগুলো মানুষের মনে একেবারে গেঁথে আছে।
- এই বিষয় নিয়ে আবার পরে আলোচনা করা যাবে। এখন গিয়ে সবাই ড্রেস চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে নাও। - কৃষ্ণা দেবী সকলের উদ্দেশ্যে এই কথা বললেন।
ওই দিন তেমন আর ঘোরাঘুরি হয়নি। ট্রেনের জার্নিতে সবাই ক্লান্ত ছিল। দুপুরে হালকা লাঞ্চ করে রাতে তাড়াতাড়ি ডিনার করে ঘুমিয়ে পড়ল সবাই।
পরের দিন রিদিমের ঘুম ভাঙলো পাখিদের কিচির মিচির আওয়াজে। বারান্দায় গিয়ে রিদিম দেখে ঋষভ ছোট ছোট পাখিদের খেতে দিচ্ছে।
- আয় তুইও এসে ওদের খেতে দে - ঋষভ ভাঙা গমের দানা ছড়াতে ছড়াতে বলল।
রিদিমও ঋষভের সাথে পাখিদের গম খেতে দিল।
- পাখিদের খাওয়ানো হলে নিজেরা খেতে আসিস। আধ ঘন্টার মধ্যে বেরোবো কিন্তু আমরা।- সর্বজিত বাবু রিদিমদের কাছে গিয়ে বললেন।
ব্রেকফাস্ট করে ঋষভরা রওনা দিল হ্যাল এয়েরোস্পেস জাদুঘরের দিকে।
বাগানে ঘেরা জাদুঘরটা অপূর্ব। একদিকে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রচুর এরোপ্লেন। বিভিন্ন ধরনের এরোপ্লেনের মডেল আছে জাদুঘরটাতে। কোনোটা যুদ্ধের আবার কোনোটা ট্রাভেলের। একটা বড় রকেটের মডেল আছে ওখানে। সেই জাদুঘরের সেলস্ কাউন্টার থেকে রিদিম একটা লাল রঙের হেলিকপ্টার কিনলো।
এরপর ওরা গেল ব্যাঙ্গালোর সাইন্স মিউজিয়ামে। মিউজিয়ামে ঢোকার পর রিদিম দেখল একটা তাবুকে একটা লোক হাওয়া দিয়ে ফোলাচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাবুটা বড় হয়ে গেল এবং একটা ইগলুর মতো ডোমের আকৃতি নিল। ঋষভরা ওটার মধ্যে ঢুকে পড়ল। সবাই ঢোকার পর অন্ধকার হয়ে গেল চারপাশটা। অন্ধকার তাবুটার মধ্যে রিদিমরা দেখলে কত তারা। ওইসব তারাদের সম্পর্কে একজন ভদ্রমহিলা ইংরেজিতে বোঝাচ্ছিলেন।
এরপর এক এক করে রিদিমরা লালবাগ বোটানিকাল গার্ডেন, ব্যাঙ্গালোর প্যালেস, ব্যাঙ্গালোর ফোর্ট, ব্যাঙ্গালোর অ্যাকুরিয়াম, ন্যাশনাল গ্যালারি অফ মডার্ন আর্ট, ব্যাঙ্গালুরু গভর্নমেন্ট জাদুঘর এবং টিপু সুলতানের সামার প্যালেস দেখল।
ইতিহাসে টিপু সুলতানের কথা বহুবার পড়েছে রিদিম। ইংরেজদের বিরুদ্ধে তিনি বীরত্ব সহকারে যুদ্ধ করেছিলেন। তিনি তার শৌর্যবীর্যের কারণে শের-ই মহীশূর অর্থাৎ মহীশূরের বাঘ নামে পরিচিত ছিলেন। এই বীর যোদ্ধার প্যালেস দেখে রিদিম আপ্লুত।
রাতে ঋষভদের গোয়েন্দাগিরির কথা উঠলো।
- শুনলাম তোরা নাকি আগে তিনটে কেস সলভ করেছিস - কল্লোলবাবু ঋষভ ও রিদিমকে বললেন।
রিদিম বলল - তিনটে আর কোথায়। সলভ করলাম তো মাত্র দুটো। একটা কলেজের 'প্রশ্ন চুরি'র কেস আর একটা নন্দ জেঠুর কাছে মহাদেব বাবুর দেওয়া 'হুমকির চিঠি'।
কৃষ্ণাদেবী বললেন - সৃজনীদির বাড়িতে টাকা চুরি ওই কেসটা কি হলো?
ঋষভ বলল - না না ওটা তো আর এগোয় নি। আসলে সৃজনী কাকিমা বুঝেছিলেন যে ওই টাকাগুলো ওনারই কোনো পুরোনো বিশ্বস্ত লোক চুরি করেছে। তাই উনি আর কেসটা এগোতে চান নি। ওখানে স্থগিত হয়ে গেল কেসটা।
কৃষ্ণা দেবী বললেন - হুমকি চিঠির ব্যাপারটা কী?
রিদিম বলল - তোমরা নন্দলাল জেঠুকে চেনো তো?
- সর্বজিত, তোর ওই দাদা তো - সর্বজিতবাবুকে কল্লোলবাবু বললেন। সর্বজিতবাবু মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন।
রিদিম আবার বলতে শুরু করল - নন্দ জেঠুর বিজনেস পার্টনারের ছেলে মহাদেব বাবু হুমকির চিঠি পাঠায়।
কৃষ্ণদেবী জিজ্ঞাসা করলেন - হুমকির চিঠিটাতে কি লেখা ছিল?
ঋষভ বলল - প্রথম যে চিঠিটা আসে সেটাতে লেখা ছিল 'আপনার মৃত্যু নিশ্চিত' আর পরের বারের চিঠিতে টাকার উল্লেখ ছিল। ওনার ২৫ লক্ষ টাকা চাই।
কল্লোলবাবু বললেন - তোরা কীভাবে বের করলি যে চিঠিটা, মানে হুমকিটা আর টাকাটা, কী যেন নাম বললি ছেলেটার
রিদিম বলল - মহাদেব
- হ্যাঁ, মহাদেব লিখে পাঠিয়েছে।
ঋষভ বলল - ওই চিঠি দুটো নিয়ে অনির্বাণ কাকুর কাছে গেলাম। উনি পরীক্ষা করে বললেন লেখাটা যে লিখেছে সে লেফটি। ফলে ধরতে ওনাকে খুব সুবিধা হয়েছিল।
রিদিম বলল - জানো লোকটা এত দুষ্টু যাতে ওর দিকে কারোর সন্দেহ না হয় তাই উনি ওই বাড়ির একজন কর্মচারীর মেয়ের আঁকার খাতার পৃষ্ঠাতে হুমকিটা দেন, আর পেনটা নিয়েছিলেন নন্দ জেঠুর ছেলে অমিতদার কাছ থেকে।
কল্লোলবাবু দুহাতে তালু ঘষে বললেন - মহাদেব তো একেবারে পাকা খেলোয়াড়।
কৃষ্ণদেবী চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে বললেন - সত্যি! আর প্রশ্ন চুরির কেসটা ঠিক কী ছিল?
রিদিম বললো - আমাদের কলেজে কয়েকজন ছেলেমেয়ে প্রশ্নপত্র চুরি করেছিল। তাদের সাহায্য করেছিল কলেজের আরদালি। প্রিন্সিপালের সুগার প্রবলেম ছিল ফলে উনি বারবার ওয়াশরুমে যান। এরই ফাঁকে ওনার বিশ্বস্ত আরদালি স্যারের আলমারির চাবির ছাপ তুলে নিয়ে ডুপ্লিকেট চাবি বানায়। তারপর একদিন সুযোগ বুঝে দারোয়ানের নাকে ক্লোরোফর্ম শুকিয়ে প্রশ্নপত্র চুরি করে নেয়।
কল্লোলবাবু বললেন - হুম। আগের থেকে প্ল্যান করেছিল লোকটা।
রিদিম বলে উঠল - এখানে যদি একটা কেস পাওয়া যেত তাহলে ছুটিটা বেশ ভালই কাটতো।
সুচরিতাদেবী বলে উঠলেন - উফ, আর কেসের কথা বলিস না।
ঋষভ বলল - হুম, একটা কেস হলে কিন্তু মন্দ হয় না।
পরের দিন ব্যাঙ্গালোর থেকে রিদিমরা মাইসোর গেলো।
মাইসোরে ঋষভরা চারজন গেলো। হঠাৎ কল্লোলবাবুর কাছে ফোন এলো কলকাতা থেকে। কল্লোলবাবুর মায়ের অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। ভালমন্দ যা খুশি হয়ে যেতে পারে। তাই সর্বজিতবাবুকে চাবি দিয়ে কল্লোলবাবু আর কৃষ্ণাদেবী কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন।
ভারতের ঐতিহাসিক শহরগুলির মধ্যে মাইসোর একটি।
গাড়িতে যেতে যেতে সর্বজিতবাবু বললেন - মাইসোরের আসল নাম কী বলতো?
ঋষভ বলে উঠলো - মহীশূর। ওয়াদিয়ার রাজবংশ দ্বারা শাসিত ছিল এটি।
ঋষভ এবার রিদিমকে প্রশ্ন করল - বলতো মহীশুরের নাম শুনলে কার কথা মনে আসে ?
রিদিম জবাব দিল - হায়দার আলীর কথা। ওনার নেতৃত্বেই তো ইঙ্গ মহীশূর ও দ্বিতীয় ইঙ্গ মহীশূর যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। ওনার ছেলেই তো টিপু সুলতান।
সর্বজিতবাবু প্রশ্ন করল - টিপুর পুরো নাম জানিস তোরা?
ঋষভ বললো - সৈয়দ ওয়াল শরীফ সুলতান ফতেই আলি সাহাব।
সুচরিতা দেবী বলে উঠলেন - টিপু সুলতানের মসজিদ তো আমাদের বাড়ির সামনে।
সর্বজিতবাবু বললেন - হ্যাঁ, ওনার ছেলের নামেই তো আমাদের রাস্তার নাম প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোড আর প্রিন্স গোলাম মহম্মদ শাহ রোড। আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় যে আনোয়ার শাহ আর গোলাম মহম্মদ শাহ আলাদা ব্যক্তি, কিন্তু এক ব্যক্তিরই নাম। প্রিন্স গোলাম মহম্মদ আনোয়ার আলি শাহ, টিপুর এক ছেলের নাম। তোদের একটা গল্প বলি শোন। ওয়াদিয়ার রাজবংশের রাজত্বকালে ১৭৫০-এর দিকে সুলতান হায়দার আলির পুত্র টিপু মহীশূরের রাজা হন। টিপুর রাজত্বকাল ছিল ১৭৫০-১৭৯৯ পর্যন্ত।
রিদিম বলে উঠল - তার মানে টিপু উনপঞ্চাশ বছর রাজত্ব করেছিলেন
ঋষভ বলল - হ্যাঁ, একদিকে যেমন তিনি সুলতান ছিলেন, অপরদিকে ছিলেন বড় মাপের পণ্ডিত ও কবি।
সর্বজিতবাবু হালকা হেসে বললেন - হ্যাঁ ঋষভ ঠিক বলেছিস। মহীশূরের রাজধানী শ্রীরঙ্গাপত্তনম ব্রিটিশ বাহিনী দখল করে নেয়। ব্রিটিশ বাহিনী দখলের পর এবং টিপু সুলতানের মৃত্যুর ছয় বছর পর তৎকালীন ব্রিটিশ শাসক ১৮০৬ সালে টিপুর সমস্ত পরিবারকে কলকাতায় পাঠিয়ে দেয়। ধীরে ধীরে তারা হয়ে ওঠেন কলকাতাবাসী। টিপু সুলতানের পুত্র গোলাম মোহাম্মদ ছিলেন তার পিতার মতোই বিভিন্ন গুণাবলী সম্পন্ন। তিনি জড়িত ছিলেন নানাবিধ সমাজ কল্যাণমূলক কাজের সাথে। গোলাম মোহাম্মদ শাহ কবরস্থান, প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডের মুখে টিপু সুলতান মসজিদ, বাঙুর হাসপাতাল ও তার পিছনে খ্রিস্টান সিমেট্রি এবং কেওড়াতলা শ্মশান- এই পাঁচটা জমি একই দিনে ১৮৪২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি উনি দান করেন। তাই কেওড়াতলা শ্মশানের আরেক নাম শা'নগর মহাশ্মশান।
মাইসোরে মাইসোর প্যালেস, সেন্ট ফিলোমেনাস ক্যাথিড্রাল, জগমোহন প্যালেস, ফোকলোর মিউজিয়াম, চামণ্ডি হিল, লুক আউট ভিউ পয়েন্ট ইত্যাদি স্থান ঘুরে ওরা রওনা দিল স্রোবোনোবেলেগলার দিকে।
স্রোবোনোবেলেগলার পথে যেতে যেতে রিদিমের চোখ পড়ল এক মূর্তির দিকে। পাহাড়ের কোল থেকে উঁকি মারছে মূর্তিটা। মূর্তিটা এক জৈন তীর্থঙ্করের। সবাই মূর্তিটাকে দেবতাজ্ঞানে পুজো করে।
স্রোবোনোবেলেগলা ঘুরে ঋষভরা যাত্রা করল বেলুড়ের পথে।
বেলুড়ের মন্দির গুলো অসাধারণ। বেলুড়, হেলেবেদু ঘুরে রিদিমরা আবার ব্যাঙ্গালোর ফিরে এলো।
পরের দিন সকালে ব্যাঙ্গালোর থেকে ট্রেনে করে ঋষভরা হস্পেটের উদ্দেশ্যে রওনা দিল। হস্পেটে হোটেল কার্তিকে উঠল ওরা।
রাতে বিশ্রাম নিয়ে পরের দিন সকালে হাম্পিতে গেলো ওরা চারজনে। হাম্পি বিজয়নগরের রাজধানী।
হাম্পি ঘোরার পরও সময় থাকার কারণে ঋষভরা আইহোলে গেলো। আইহোলে একটি মন্দির ছাড়া কিছুই ছিল না তেমন। তাই ওরা আইহোল থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে আরো তেরো কিলোমিটার এগিয়ে গেল পাত্তাদাকাল নামক এক স্থানে। জায়গাটি দারুন। বেশ কয়েকটি হিন্দু এবং জৈন মন্দির সংযোগে গড়ে উঠেছে এই অঞ্চলটি।
পাত্তাদাকালে পৌঁছে রিদিমরা দেখল সেখানে রেস্টোরেশনের কাজ চলছে। জায়গাটি দারুন লেগেছে রিদিমের।
ঘুরতে ঘুরতে রিদিমের হঠাৎ চোখে পড়ল একজন লোকের দিকে। লোকটা চারিদিকটা দেখে নিল তাকে কেউ দেখছে কিনা। রিদিম লুকিয়ে পড়ল একটা গাছের আড়ালে। আড়াল থেকে রিদিম দেখল লোকটার কাণ্ড।
লোকটা একটা পুরোনো ভাঙ্গা গনেশের মূর্তি তোয়ালেতে মুড়ে নিল। রিদিম লোকটাকে ফলো করলো। কিছুটা এগিয়ে লোকটা তার স্ত্রীর হাতে থাকা একটি ব্যাগে তোয়ালে জড়ানো মুর্তিটা ঢুকিয়ে দিলো।
রিদিমের বুঝতে বাকি রইল না যে লোকটি মূর্তিটা চুরি করেছে। সঙ্গে সঙ্গে রিদিম জিন্সের পকেট থেকে ফোনটা বের করে ঋষভের ফোন নম্বর ডায়াল করল।
ফোনের ওপার থেকে ঋষভ বলল - তুই কোথায়? তোকেই ফোন করতে যাচ্ছিলাম।
- আমার কথাটা আগে শোন। তুই সিকিউরিটিদের কাছে গিয়ে বল সব দরজা বন্ধ করে দিতে আর সমস্ত টুরিস্টদের যেন ব্যাগ চেক করে দরজার বাইরে যেতে দেয়। - উত্তেজিত গলায় রিদিম বলল।
- কেন কী হয়েছে?
- একজন লোক পুরনো ভাঙ্গা এক গনেশের মূর্তি চুরি করেছে। আর সেই মূর্তিটা তিনি তার স্ত্রীর ব্যাগে ঢুকিয়েছে। আমি লোকটাকে ফলো করছি। আমি ইশারা দিলে সিকিউরিটিদের বলিস ওনাদের ব্যাগ ভালো করে চেক করতে।
- হ্যাঁ তুই লোকটাকে চোখের আড়াল হতে দিস না। আমি সিকিউরিটিদের বলছি। ঋষভ সিকিউরিটি অফিসের দিকে যেতে যেতে রিদিমকে বলল - কেমন দেখতে লোকটা? আর কেমন লাগলো? মানে প্রফেশনাল চোর নাকি...
ঋষভের কথা শেষ করার আগেই রিদিম বলল - না না প্রফেশনাল চোর নয়, সঙ্গে স্ত্রী এবং দুটো বাচ্চা আছে। আর লোকটির বয়স চল্লিসের আশেপাশে হবে। গায়ে নীল রঙের শার্ট আর কালো প্যান্ট, গৌরবর্ণের লোকটি। আমি লোকটাকে ফলো করছি।
- 'হুম' - ফোনটা কেটে দিলো ঋষভ।
- দাদা এখানের দরজা বন্ধ করে দিন আর টুরিস্টদের ব্যাগ চেক করে তবেই বাইরে বেরোতে দেবেন। - সিকিউরিটি অফিসে গিয়ে ঋষভ (ইংরেজিতে) বলল।
একজন সিকিউরিটি ঋষভের দিকে ঝাঁঝালো গলায় (ইংরেজিতে) বলল - তুমি কে? যা বলবে তাই করব। আর কেনই বা লোকের ব্যাগ চেক করবো?
সিনিয়র এক সিকিউরিটি (ইংরেজিতে) বললেন - দাঁড়াও ওভাবে কথা বলো না। হ্যাঁ আপনি কি বলছিলেন দরজা বন্ধ করে দেবো, কেন?আর সবার ব্যাগ চেক করবো কেন?
প্রথম সিকিউরিটির ওইরকম ভাবে কথা বলাতে ঋষভ খুব রেগে গেল। রাগের মাথায় কিছু বলতে যাবে হঠাৎ ঋষভের কাঁধে একজন হাত রাখল। পিছন ঘুরে ঋষভ দেখলো সর্বজিতবাবু।
সর্বজিতবাবু বললেন - কী হয়েছে ঋষভ?
ঋষভ কিছুটা ঠান্ডা হয়ে বলল - একজন লোক এখানকার একটা ভাঙা গণেশের মূর্তি চুরি করেছে। ওই মূর্তিটা ভারতের সম্পত্তি, কেউ ওটা নিতে পারে না বাবা। তাই ওনাদের বলছিলাম সব দরজা বন্ধ করে দিতে আর সবার ব্যাগ চেক করে বাইরে বের করতে।
- তুই কি দেখেছিস লোকটাকে?
- না বাবা, রিদিম দেখেছে ও এখনো ফলো করছে লোকটাকে।
- আচ্ছা। সর্বজিতবাবু এবার সিকিউরিটিদের (ইংরেজিতে) বললেন - অফিসার, ঋষভ ঠিকই বলেছে। আপনি সব দরজা বন্ধ করে দিন, আর সবার ব্যাগ চেক করার ব্যবস্থা করুন। - এই বলে সর্বজিতবাবু ওয়ালেট থেকে তার ভিসিটিং কার্ডটা বের করলেন।
যে সিকিউরিটি ঋষভের সঙ্গে রূঢ় ভাবে কথা বলেছিলেন তিনি ঋষভকে উদ্দেশ্য করে নম্রভাবে বললেন - আগে তো বলবেন যে আপনি উকিল বাবুর ছেলে। সরি স্যার, আমি এক্ষুনি সব ব্যবস্থা করছি।
ঋষভ বলল - হুম, ঠিক আছে। আমি যাকে দেখাব তার ব্যাগটা ভালো করে চেক করবেন।
- ওকে স্যার।
সিকিউরিটি গার্ড চলে গেলেন আরো কয়েকজন সিকিউরিটিকে নিয়ে।
- এভাবে আপনারা আমাদের ব্যাগ চেক করছেন কেন?
- কী হয়েছে আসলে?
- কী চুরি হয়েছে?
- এভাবে আমাদের হ্যারাস করছেন কেন?
- আপনারা শান্ত হোন। আসলে এখান থেকে একটি মূর্তি চুরি হয়েছে, যেহেতু মূর্তিটা ভারতের সম্পদ তাই কেউ নিলে খুব সমস্যা হবে। আমরা আপনাদের সন্দেহ করছি না, আবার সন্দেহের বাইরেও রাখছি না। আপনারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন আমি কি বলতে চাইছি। তাই প্লিজ আমাদের সাথে সহযোগিতা করুন। - সিকিউরিটি ইনচার্জ ইংরেজিতে সবার উদ্দেশ্যে এই কথা বললেন।
হঠাৎই ঋষভ রিদিমকে দরজার দিকে এগিয়ে আসতে দেখে একজন সিকিউরিটিকে বলল - যিনি মূর্তিটা হাতিয়েছেন তিনি আসছেন আমি বললেই তাদের ব্যাগটা ভালো করে সার্চ করবেন।
- ওকে স্যার।
রিদিম ঋষভকে দেখতে পেয়ে ইশারা করে বোঝালো কোন লোকটা মূর্তিটা হাতিয়েছে।
গেটের সামনে ভিড় দেখে লোকটা ইতস্তত বোধ করতে লাগলো তবুও তিনি এগিয়ে গেলেন গেটের দিকে।
ঋষভ সিকিউরিটিদের বলে দিলো কে কাজটা করেছে।
- ম্যাডাম আপনার ব্যাগটা দেখান - একজন মহিলা সিকিউরিটি বললেন।
- আমার ব্যাগ, কিন্তু কেন? ভদ্রমহিলা বললেন।
- আপনার ব্যাগটা দেখান তাহলেই বুঝতে পারবেন।
- এই নিন।- এই বলে ভদ্রমহিলা তার ব্যাগটা মহিলা সিকিউরিটিকে দিয়ে দিল।
ব্যাগ হাতরাতে হাতরাতে সিকিউরিটির হাতে অবশেষে তোয়ালেতে ঢাকা একটা গণেশের মূর্তি পড়ল।
- এই দেখুন - বলে মহিলা সিকিউরিটি মূর্তিটা ভদ্রমহিলাকে দেখালেন।
মূর্তিটা দেখে ভদ্রমহিলা বিস্মিত হয়ে বললেন - এটা কি করে সম্ভব! এতে তো আমার বাচ্চাদের জামা, ফল ইত্যাদি আছে। এই মূর্তি আমার ব্যাগে কিভাবে এলো ?
- এই প্রশ্নটি আপনি আপনার হাসব্যান্ডকে করুন- রিদিম মহিলাটিকে বলল।
- ওনারা কি বলছে? আর এই মূর্তিটা এলো কিভাবে আমার ব্যাগে, বল - ভদ্রমহিলাটি তার হাসবেন্ডকে জামা ধরে ঝাকাতের শুরু করলেন।
- আমার ভুল হয়েছে। আমার বোঝা উচিত ছিল, যে এটা ভারতের সম্পদ। আমার নেওয়া উচিত হয়নি৷, আমাকে ক্ষমা করে দিন।- লোকটা হাত জোড় করে ক্ষমা চাইল।
সর্বজিৎবাবু বললেন - ওনাকে ছেড়ে দেওয়াই উচিত, লোভের বশে এমন একটা অন্যায় করে ফেলেছেন।
রিদিম বলল - হ্যাঁ উনি দুর্লভ জিনিস দেখে নিজেকে সামলাতে পারেননি।
- ওনাকে ছেড়ে দিন, আমি বলছি। - সর্বজিতবাবু বললেন।
সিকিউরিটি ইনচার্জ বললেন - বেশ আপনি যখন বলছেন স্যার ছেড়ে দিচ্ছি, কলকাতা হাইকোর্টের সিনিয়র উকিল আপনি। লোকটিকে বলল - যান আপনারা, তবে এমন কাজ ভবিষ্যতে কোনোদিন করবেন না।
- হ্যাঁ হ্যাঁ মনে থাকবে। থ্যাংক ইউ - এই বলে লোকটি তার স্ত্রী ও বাচ্চাদের নিয়ে চলে গেলেন।
সুচরিতাদেবি বললেন - ওরা আমাদের কোনো ক্ষতি করবে না তো
- না না ম্যাডাম, ওরা মনে হয় না আর কিছু করবেন। তবুও যদি মনে হয় আপনাদের, এই নিন আমার নম্বর কোনো অসুবিধা হলে যোগাযোগ করবেন।
সেখান থেকে বাদামি হয়ে হোটেলে ফিরে গেল রিদিমরা। রাতে বিশ্রাম নিয়ে পরদিন সকালে চেক আউট করে ব্যাঙ্গালোরে চলে গেল।
বিকেলের কলকাতাগামী ট্রেন ছিল। ট্রেনে ডিনার শেষ করে ঋষভ বলল - 'কেসটা ঠিক জমলো না'
রিদিম বলল - হ্যাঁ, হাতেনাতে একটা চুরির কেস, মগজাস্ত্র প্রয়োগের কোনো সুযোগই পাওয়া গেল না।
সুচরিতাদেবী বললেন - আর মগজাস্ত্র প্রয়োগ করতে হবে না। এবার মগজকে একটু বিশ্রাম দাও, চুপচাপ শুয়ে পড়ো।
রিদিম-ঋষভ লাইট নিভিয়ে শুয়ে পড়ল।
ট্রেনের দুলুনিতে আর এসির ঠান্ডা হাওয়ায় রিদিম কিছুক্ষনের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল।