ঝুমুর এক হাত দিয়ে ডালটা ধরে, নিজেকে টেনে তুলল গাছের উপরে। ওর মনে পড়ে গেল, যে ঠিক এক মাস আগে কি হয়েছিল ঠিক এই জায়গাটাতে, এই গাছটার নিচে।
সেদিন রোজকার মতো ঝুমুর দৌড়ে গিয়েছিল জঙ্গলে, মা, বাবা, ঠাম্মি, দাদু, ঝেঠু, মাসীমণি সবাই ওকে পঞ্চাশ না একশোবার তাকে বলেছে জঙ্গলে না যেতে। ও কথা শোনেনি।
আসলে ওর খুব ভালো লাগে পায়ের তলায় ঘাস পেতে। গন্ধরাজের মিষ্টি গন্ধ তার নাকটাকে চেপে ধরতে, গাছের মধ্যে, সেই জঙ্গলটার মধ্যে ঝুমুরের মনে হয় কিছু একটা দুর্ধর্ষ, কিছু একটা অসাধারণ ঘটতে চলেছে, যেমন ওর গল্পের বইতে ঘটে। কিন্তু সাধারণত কিছু হয় না। হয়তো একটা পাখি বা হরিণ দেখতে পায় এই যা।
আবার, সেই দিনটা সাধারণ ছিল কে বলেছে?
ঝুমুর সেই দিন রোজগার মতন খালি পায়ে জঙ্গলে দৌড়াচ্ছিল। পায়ের তলের শুকনো পাতা মচমচ করে উঠছিল, রোদে গরম পাথরের উপর পা হড়কে যাচ্ছিল, কিন্তু ও দৌড় থামায় না।
ব্যাপার হল জঙ্গলের ঠিক মাঝখানে একটা গাছ আছে। সেই গাছটার মগডালে উঠলে পুরো জঙ্গল দেখা যায় দূরের পাহাড় দেখা যায়। ওই ছোটো বিলটা যেটায় মাছ ধরতে গেলে কেবল মশার কামড় নিয়ে ফিরতে হয়, দেখা যায়। আকাশের মেঘগুলি কাঁধে হাত বুলিয়ে ভেসে বেরিয়ে যায়। সব শান্ত, চুপচাপ, আনন্দে ঠাসা।
কিন্তু সেইদিন ঠিক চুপচাপ শান্ত ছিল না। গাছে ওঠা সুযোগ পায়নি ঝুমুর। গাছের নিচে কোমরে হাত দিয়ে মুখের ছোট্ট হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল একটা মেয়ে - লম্বা, কালো চুল, খয়েরি মেশানো। গায়ের রং হালকা সবুজ মতন। কান খোঁচা খোঁচা। সরু সরু কাঠির মতো আঙুল। নদীর মতো নীল চোখ। পরনে লম্বা কুর্তা, দেখে মনে হয় পাতার তৈরি। প্যাঁচার সোনালী চোখের রঙের প্যান্ট। হিল-জুতো, ঈগলের পালকের মত সাদা।
ঝুমুরের মনে পড়ে গেলো ও কীভাবে এক লাফে দু হাত পিছিয়ে এসেছিল। কী ভয় পেয়েছিল। মেয়েটা কীভাবে ঠিক তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল। কীভাবে ঝুমুরের ভয় দেখে সে মিষ্টি হেসেছিল। ‘ত-তুমি না আপনি ক-কে?’
“সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা হল এটা তোমার”, মেয়েটা হাত বাড়ালো, সূর্যের আলোয় ঝকঝক করছে একটা রুপালি চেন।
“এ-এটা তো আমার নয়” চোখ বড় বড় করে বলেছিল ঝুমুর। মুখে হাসি নিয়ে মেয়েটা বলেছিল “আমি উপহার দিলাম।“ চেনটা ঝুমুরের হাতে ফেলে, “আসি তাহলে” ফিসফিস করে বলে, মেয়েটা কোথায় যেন মিলিয়ে চলে গিয়েছিল।
ঝুমুর সেইদিন থেকে চেনটা ওর গলায় রেখেছে, ও এখনও বুঝতে পারিনি চেনটা কী করে, ও চেনটা কেন পেয়েছে, ওকে কে ঠিক দিয়েছিল চেনটা। কিন্তু ঝুমুর চেনটা তাও পরে থাকে। দিনের শেষে, এই প্রথম তো তার সঙ্গে কিছু দুর্ধর্ষ, জাদুকর হয়েছিল।
ঝুমুরের গাছটার তলায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব মনে পরে গেল। রোজ যেমন করে, ও এদিক-ওদিক একবার চেয়ে দেখল। কে বলতে পারে, হয়তো সেই মেয়েটা আবার এল?