টলমল পায়ে মণিমালা দেবী বিছানার ওপর ধপ্ করে বসে পড়লেন। তার গাল দিয়ে বয়ে চলেছে নোনা ধারা।
মণিমালা বসু ও চিন্ময় বসুর তৈরি বাড়ির ভিত মজবুত হলেও চিন্ময়বাবুর মৃত্যুর পর যেন তা কোথাও না কোথাও আলগা হয়ে গিয়েছিলো।
তাদের একমাত্র সন্তান, সৌমাল্য। সে আসেনি তার বাবার কাজে বরং সে এখন ব্যস্ত তার স্ত্রী ও সন্তানের সঙ্গে ক্যালিফোর্নিয়ার জনবহুল রাস্তায় আনন্দ করতে।
মণিমালা দেবীর নিপুণ হাতে গড়া ছোট্ট আসনটি তার সমুর কথা মনে করায় আর মনে করায় তার ও চিন্ময় বাবুর সযত্নে লালন করা বাড়ির প্রতিটি কোণের কথা।
আজ মণিমালা দেবী ও চিন্ময় বাবুর বাড়ি নিলামের দিন।
না! সৌমাল্য আসেনি। মণিমালা দেবীর সকল স্বপ্ন, আশা আজ ধ্বংসপ্রাপ্ত ও নিলাম হয়ে গেছে তাদের স্বপ্নের বাড়ির সঙ্গে।
"দিম্মা, ও দিম্মা! শোনো না, আমাদের না একটা লেখাকে ব্যাখ্যা করতে বলেছে, তুমি আমায় একটু সাহায্য করবে? ও দিম্মা!"
মণিমালা দেবী আকস্মিক এই ডাকে পেছন ফিরতেই দেখলেন, মিমি তার গলা জড়িয়ে খাটের উপর বসে! এখনো তার গালে অতীতের কথা চিন্তা করার প্রমাণ দৃশ্যমান।
"এ বাবা, দিম্মা! তুমি কাঁদছো?"
"না, দিদিভাই! ও এমনি। তুমি বলো কী বলছিলে!"
"দিম্মা আমাদের স্কুলে না একটা লেখাকে ব্যাখ্যা করতে বলেছে! তুমি আমায় একটু বলে দেবে?"
মণিমালা দেবী মনে মনে হাসেন ও ভাবেন, "আমার সমুটাও এরকমই ছিল! কিন্তু মানুষ করতে পারলাম না ছেলেটাকে!"
"দিম্মা, বলে দাও না গো!"
-"হ্যাঁ, দিদিভা...."
তার কথা শেষ হওয়ার আগেই ভারতী বলে উঠলো, "মা, আজ আবার এই বাচ্চা মেয়েটাকে আমরা পাইছি, তোমার আরও দায়িত্ব বাইড়া গেল মা! "
মণিমালা দেবী প্রত্যহ এই দৃশ্যের সাক্ষী!
না, তিনি আজ সৌমাল্য বসুর মা নন বরং এই নিষ্পাপ, নির্যাতিতাদের মা ও তার নাতি-নাত্নীদের আদরের দিম্মা।
বহু মেয়েরা তাদের পরিবার দ্বারা নির্যাতীত হয়ে এই সংঘে বিভিন্ন কর্ম করার মাধ্যমে এখানে নিজ পরিচয় ও সম্মান সহিত জীবনযাপন করে।
সেদিন সব হারানোর পর সন্ধ্যা তাঁকে এই সংঘে নিয়ে আসে ও মায়ের সম্মান দিয়ে এখানে থাকার ব্যবস্থা করে দেয়।
সন্ধ্যাবেলা, মিমির কাছে, মণিমালা দেবী আসেন ও তাঁর প্রশ্নটি জিজ্ঞাসা করেন।
মিমি বলে ওঠে "রাত্রে যদি সূর্যশোকে ঝরে অশ্রুধারা, সূর্য নাহি ফিরে, শুধু ব্যর্থ হয় তারা।- এই কথাটার মানে কী গো দিম্মা?"
মণিমালা দেবীর নয়নদ্বয় অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে এবং উনি নিজের অন্তরকে বলে ওঠেন, "না, আমার অশ্রু ব্যর্থ হয়নি! আমি আমার সবটুকু নিঃশেষ করে হলেও আমার মনের মতো সযত্নে আমৃত্যু অবধি সমু গড়ে যাব, এবং এক অমানুষের জন্য কিছুতেই চোখের জল নষ্ট করবো না!"
যে প্রবাদ তিনি নিজের বাল্যকাল থেকে শুনে আসছেন, আজ যেন তার অন্য অর্থ তিনি খুঁজে পেয়েছেন। পেয়েছেন নিজের অপেক্ষার উত্তর! তার অপেক্ষা কেবল আজ অবসানই হয়নি বরঞ্চ তাঁকে দিয়ে গেছে জীবনের অমূল্য এক শিক্ষা, যা বইয়ের পাতায় নয় বরং থাকে অন্তরে লুক্কায়িত!
অপেক্ষা মানে কী কেবল আশা?
নাকি মনের ক্ষতরে ঢেকে,
একমুঠো আশ্বাস নিয়ে বাঁচা?