

-“কীরে শতাব্দী আজ এত দেরী করলি যে?”
“পড়া ছিল রে, দুহপ্তা পর থেকে আবার টার্ম ওয়ান শুরু হবে। প্রচুর চাপ”
-“আমাদের তো হাতে দিনই নেই, এই শনিবার থেকে আমাদেরও শুরু হয়ে যাবে। আর এবার একেবারে আশি মার্কসের পরীক্ষা। আগে তাও টার্ম ওয়ান আর টার্ম থ্রি-তে পঞ্চাশ মার্কসের পরীক্ষা হত। ম্যাম গাদা গাদা হোমওয়ার্ক দিচ্ছে আর স্কুলে এবারে প্রত্যেকটা চ্যাপ্টারে ধরে ধরে প্রজেক্ট, ধুৎ। .....বলছি আ্যাই, এই অঙ্কটা একটু দেখিয়ে দে নারে, তারপর বেরব নাহয়”
অঙ্ক বইটার দিকে একঝলক তাকিয়েই বলে উঠল শতাব্দী “আরে এরকম একটা তো পরশুই দেখালাম, সেই লসাগু করে তারপর যোগ করার অঙ্কটা, মনে পড়ছে?” মাথা নাড়ল তিথি “হ্যাঁ ওভাবেই করতে হবে বা তুই এটার স্কোয়ার করেও তারপর লসাগু করতে পারিস, তবে ওটা একটু কঠিন হবে। তুই লসাগু করেই যোগ কর” তিথি একটু হাসল, শতাব্দী এক বছরের বড় ওর থেকে, ক্লাস সেভেনে পড়ে ও, কিন্তু অঙ্কে মাথা খুব ভাল। কত কঠিন কঠিন অঙ্ক জলের মত বুঝিয়ে দেয় ওকে। নানারকম টেকনিকও জানে ও, একপাতার অঙ্ককে ছ'লাইনে করে দেয়। তিথি সিক্সে পড়ে, ওকেও অনেক টেকনিক শিখিয়েছে শতাব্দী। যদিও টিউশনের ম্যাম একদম ওইসব পছন্দ করে না, বলে নাকি অঙ্ক শর্টে করার চেষ্টা করতে নেই, বইয়ে দেওয়া টেকনিকগুলো অনুযায়ী করা উচিৎ ইত্যাদি...ইত্যাদি, তবে পরীক্ষার সময় এই টেকনিকগুলো ভীষন কাজে আসে ওর, নয়ত এমনিতে ওর লেখা খুব স্লো, কয়েকবার তো পেপার না কমপ্লিট করেই জমা দিয়ে আসতে হয়েছিল। তিথি আর শতাব্দী বহুদিনের বন্ধু। দুইজনেরই মাঝখানে পাঁচিল দেওয়া পাশাপাশি বাড়ি। পাড়ারই একটা স্কুলে পড়ে শতাব্দী আর তিথির স্কুলটা একটু বাইরের দিকে, প্রত্যেকদিন ওকে স্কূটিতে করে বাবা তাই পৌঁছে দিয়ে আসে সেখানে। শতাব্দী অবশ্য হেঁটেই যায় প্রায়দিন, কখনও কখনও দেরি হলে সাইকেল নেয়। তিথিকেও পরের জন্মদিনে একটা সাইকেল কিনে দেবে বলেছে বাবা, ও এখনও একটু ছোট তো। তিথির তো আর আনন্দ ধরে না, সেইদিন থেকে খালি পরের জন্মদিনের দিন গুনছে ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে। ওর ইচ্ছা শতাব্দীর কাছ থেকেই শিখবে ও সাইকেল চালানো। কথাটা একদিন বলেওছিল ও, কিন্তু বাবা কেন জানি একটু শুকনো হেসেছিলেন মাত্র। বই গুছিয়ে তিথি আর শতাব্দী কাছের মাঠটায় খেলতে যাবে, এমন সময় দেখে সামনের বাড়ির নীলাকাকিমা কেমনভাবে যেন চেয়ে আজে শতাব্দীর দিকে, ও ঠিক বুঝতে না পেরে একবার তাকাল ওর দিকে, শতাব্দী অবশ্য তত লক্ষ করেনি, তিথি দাঁড়িয়ে আছে দেখে ওকেই তাড়া দিল "কীরে চ', দেরি হয়ে যাচ্ছে তো”। মাথা নাড়িয়ে তারপর তিথি মাঠের দিকে হাঁটা দিয়েছিল ওর সঙ্গে। মাঠটা বিশাল, তবে তার এক প্রান্তে ছোট্ট একটা জায়গাতেই খেলে ওরা, বাকি কোনো জায়গায় পা বাড়ানোর সাহসও করলেও বড় ছেলেপিলেগুলো তেড়ে আসে, খুব মারকুটে ওরা৷ একবার তিথিদের বলটা একটু বাইরের দিকে ভুল করে চলে গিয়েছিল, বলটা তো দেয়ইনি, উপরন্তু একটা বড় দাদা ওদের চোখে সামনে বলটাকে ফাটিয়ে নষ্ট করে দিয়েছিল রীতিমতো। রাগে সেদিন চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে গিয়েছিল তিথির, তা দেখে ওদের কী হাসি। কত সাধের বল ছিল ওটা ওর, দাদানের দেওয়া শেষ গিফট ছিল ওটা। ওদের দিকে ও তাই তেড়ে যেতেই এক ধাক্কায় মাটিতে ফেলে দিয়েছিল ওকে, তারপর বলেছিল “আ্যাই চুটকি, খেলতে আসিস নিজের মত খেলবি, বেশি গরম দেখাতে গেলে না মাঠেই ঢোকা বন্ধ করে দেব, এই শেষবার বলে দিলাম”। খুব লেগেছিল সেদিন ওর, অনেক জায়গায় ছড়েও গিয়েছিল, তবে ও জানে, সেদিন শতাব্দী যদি ওকে হাত ধরে টেনে না নিয়ে আসলে ওরা আরও অনেক কথা শোনাত, গায়ে হাতও তুলত হয়ত। মাঠ থেকে তারপর ফেরার সময় শতাব্দী অনেক করে বুঝিয়ে বলেছিল ওদের পেছনে আর না লাগতে, তিথিরও যেচে কারুর সঙ্গে ঝগড়া করার ইচ্ছে নেই, ওদের সঙ্গে তো না-ই, তাই তারপর থেকে আরো সাবধান হয়ে খেলে ওরা, তবুও মাঝে মাঝে ওরাই আগ বাড়িয়ে তিথিদের সঙ্গে ঝগড়া করতে চলে আসে, ওরা ঝগড়া-ঝাটির দিকে যায় না, চুপ করে থাকে একদম তখন, অনেকসময় মাঠ থেকে চলে আসে ঝামেলা এড়ানোর জন্য। আজ এক্কা দোক্কা খেলছিল ওরা, পাশ থেকে হঠাৎ শুনতে পেল, “এটাকে পাগলা গারদে দেয় নাকেন রে? মাথায় তো আমার ঠাকুমার থেকেও বেশি ছিট, হি হি হি”, কাকে নিয়ে ঠিক কথাটা বলল বুঝতে পারল না ঠিক তিথি, ওরা আর তিথিরা ছাড়াতো কেউ নেই। “কীরে তোর পালা তো এবার” শতাব্দীর ডাকে আবার খেলায় মন দিল সে, যদিও মনটা খচখচ করতে থাকল, কারণ মাঝে মাঝেই দেখেছে লোকে অদ্ভুত ভাবে ওর দিকে চেয়ে থাকে, হাসাহাসিও করতে ছাড়ে না আড়ালে, যেমন নীলাকাকিমা চেয়েছিল আজ। বৃষ্টি বা ঠাণ্ডার দিন ঘরে ওরা লুডো বা দাবা-টাবা খেললেও মাঝেই মাঝেই মাকে একদুৃষ্টে ওদের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে, অথচ ও বুঝতে পারে না ওর দোষটা কোথায়! বাইরে ফিটফাট পরিপাটি হয়েই বেরোয় ও, শতাব্দীও তাই, তবুও। আচ্ছা, আজ কী ওর সম্পর্কেই কথা বলছিল ওই দাদাগুলো?
বলছিল হয়ত, সে যাক।
গাড়ির হাল্কা ঝাঁকুনিতে একটু যেন ঘুম পেয়ে গিয়েছিল তিথির, পাশে মা বসে, বাবা গাড়ি চালাচ্ছে সামনে। হাইরোডের মধ্যে দিয়ে ছুটন্ত গাড়ির দিকে যেন একরাশ ঠাণ্ডা হাওয়া প্রতি মূহুর্তে ছুটে আসছে। প্রতিবারে মত ইঞ্জেকশনটারই সাইড এফেক্ট এটা এবারেও.....ভীষন ঘুম পাচ্ছে ওর, চোখে সামনে সব কিছু আবছা হয়ে যাচ্ছে, মাথাটা ঝিনঝিনও করছে কেমন। মাথার মধ্যে হাজার ভাবনার ভাবনার রেষগুলো আস্তে আস্তে রামধনুর মত মিলিয়ে গেল তিথির, চোখ বন্ধ হয়ে এল আবার।
জানালার দিকে একমনে তাকিয়ে বসে আছে তিথি, কাছের বাড়িটার কার্নিশে অলসভাবে বসে কী একটা ঠোকরাচ্ছে পায়রাগুলো, দুটো শালিক রাস্তার পাশের পোলে জমিয়ে বসে ঝগড়া করছে। আজ তিনদিন হল শতাব্দীর দেখা নেই, তিনদিন কী সত্যিই? নাকি তারও বেশি? দুই বছর.......রূপোলি পর্দার সিনেমার মতো এক এক করে ফ্ল্যাশব্যাকগুলো আসতে লাগল ওর মাথায়।
“গ্লু শেষ তো” “এই রে, এই ভয়টাই পাচ্ছিলাম” তিথি বলে উঠল। গুছিয়ে তিথির প্রোজেক্ট ডেকোরেট করে দিচ্ছিল শতাব্দী, এমনসময় বিপত্তি। “কী করবি? বাড়িতে তো কেউ নেই” বলল শতাব্দী। “কাল এটা জমা না দিলে শিল্পাম্যাম মেরে পাট করে দেবে একেবারে, দেওয়ার কথা তো আজই ছিল, আমি তাও বলে-কয়ে আরও একটা দিন সময় নিয়েছি” বেশ চিন্তায় পড়ে গেল তিথি। “হুম”...... একটু ভেবে নিয়ে বলল শতাব্দী “গ্লু আমার আছে, কিন্তু বাড়িতে তো মেন গেট দিয়ে ঢুকতে হবে। ভেতরের দরজাটা এতক্ষণে বন্ধ করে দিয়েছে মা সুতরাং পাঁচিল টপকে যাওয়ার পথ দেখছি না” “মানে রাস্তা দিয়ে যেতে হবে? কিন্তু এইসময় তো খুব গাড়ি যাওয়া আসা করে৷ আর কী স্পিড! তুই পারবি?” তিথির জিজ্ঞাসা। শতাব্দী ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে, বলল “তুইও চল তবে, একসঙ্গে আস্তে আস্তে যাব, এইটুকু তো”। দুই বাড়ির মেনগেটের দূরত্ব একটু বেশিই। তিথি আর শতাব্দী, দুজনের বাড়িতেই চওড়া বাগান কিনা। বাইকটা এরকমভাবে পেছন থেকে চলে আসবে বুঝতে পারেনি শতাব্দীরা। রাস্তার ধার দিয়েই হাঁটছিল ওরা, তবুও শেষরক্ষা হল না৷ মূহুর্তের মধ্যে শতাব্দী এক ঝটকায় রাস্তার অন্যদিকে ঠেলে দেয় তিথিকে, নিজেও অন্যদিকে সরে আসতে চেয়েছিল হয়ত, কিন্তু প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায় রাস্তার মাঝখানে, বাইকটার একেবারে সামনে। সেকেন্ডের ঘটনা.....তারপরেই - গগনবিদারী একটা আর্তনাদ.......!
“শতাব্দী তুই?” পায়ের আওয়াজ পেয়ে ঘুরে তাকায় তিথি “হ্যাঁ আমি” স্বভাবসুলভ উত্তর আসে শতাব্দীর “ ওই হস্পিটালে ছিলাম কদিন, কিছুই হয়নি, আর কখনও ওরকম যাব না রে। যাই হোক খেলতে যাবি তো? চল” কিছুক্ষণ থমকে থেকে তারপর বলটাকে নিয়ে খেলার জন্য তৈরি হল তিথি। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে সবই দেখছিল তনুজা, বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল প্রায়......কার সঙ্গে কথা বলছে তিথি? “মা দেখ শতাব্দী এসেছে, ওর কিচ্ছু হয়নি দেখ মা” “ও, তাই?” একটা শুকনো হাসি হেসে বলল তনুজা, শতাব্দীকে তো একসপ্তাহ আগেই বার্নিং ঘাটে......“আমি যাই মা?” মেয়ের আর তর সয়না, “যাও” কাঁপা কাঁপা গলায় উওর তনুজার। “চল শতাব্দী” পাশে তাকিয়ে বলল তিথি, বলা বাহুল্য তনুজা ছাড়া কেউই নেই ঘরে। নীরবে সব দেখছিল সে, ঘর থেকে বেরিয়ে গেল তিথি, অদৃশ্য কারুর হাত ধরে।
“হুম, বুঝেছি। স্কিৎসোফ্রিনিয়া। আনকমন নয়, বাচ্চা তো, শক পেয়েছে” বললেন ডা. বসু। “আমরা তো ওকে বলিওনি যে ওর ফিউনারেলের কথা যাতে ও কষ্ট না পায়, বলেছি হস্পিটালে আছে” উদগ্রীব ভাবে উত্তর অঞ্জনের। “দেখুন, সেরে যাবে সেটা হান্ড্রেড পারসেন্ট বলতে পারি তবে অনেকটা টাইম লাগবে, কয়েক বছরের কম তো নয়ই” চিন্তিত ভাবে বললেন ডা. বসু। “আমি আমার সাধ্যমত চেষ্টা করব, তবে আপনারা এই সম্পর্কে ওকে মারধোর বা কোনোরকম টর্চার, বকা-ঝকা করবেন না, একটু খেয়াল রাখবেন যেন বেশি দূর না যায় আর এই নিয়ে কিছু বলারও দরকার নেই ওকে। এই ওষুধগুলো লিখে দিলাম, সকাল- সন্ধ্যা বারো ঘন্টা গ্যাপে খাইয়ে দেবেন, আর দু' মাসে একবার ওকে খালি আনবেন এখানে, একটা ইঞ্জেকশনের জন্য - আর বেশি স্ট্রেস নেবেন না এটা নিয়ে” - প্রেসক্রিপসন লিখতে লিখতে বলে উঠল ডক্টর।
“মা দেখ না শতাব্দী আর আসছে কেন কদিন ধরে, তুমি একটু যাও না ওদের ওখানে” রান্নাঘরে ছিল তনুজা, হঠাৎই তিথির গলা পেল ও। “মা শোন, তোকে একটা কথা বলব?” রুটি বেলতে বেলতে উওর তনুজার। “বলো” বলল তিথি। “আয়, চল ওই ঘরে যাই, বসে তোকে কটা কথা বলার ছিল” হাতের কাজ রেখেই পাশের ঘরে নিয়ে গেল মেয়েকে তনুজা।
নতুন ফ্ল্যাটের কাছেই লেকটা। উনত্রিশ বছরের তিথি লেকের ধারে বসে আছে একটা ছবি হাতে নিয়ে, ওর আর শতাব্দীর একমাত্র ছবি, তখন তো এত ফোন-টোন ছিল না। ক্যামেরায় তোলা। তিথি আর ওর পাশাপাশি দাঁড়ানো একটা ছবি - কী সতেজ প্রানবন্ত ছিল মেয়েটা! তেরো বছর আগে ঘটে যাওয়া সেই ঘটনাগুলি আজ সবার স্মৃতির অতলে, শুধু ওরই মনের মণিকোঠায় রয়ে গেছে ছোট্ট সেই মেয়েটি। আজ শতাব্দীর জন্মদিন, এখনও মনে আছে তিথির, পনেরোই সেপ্টেম্বর। ঠাণ্ডা বাতাস দিচ্ছে হালকা হালকা, কল্লোলিনী তিলোত্তমার ব্যস্ত বিকেলে, শহরতলির ছোট্ট সেই অভাগা মেয়েটির জন্মদিনে আজও তাকে মনে পরছে কারুর। ছবিটাকে মুঠোয় আঁকড়ে ধরে বুকের কাছে চেপে ধরল তিথি, কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো তার গাল বেয়ে।
kk | 2601:14a:502:e060:21d4:d6a8:3250:***:*** | ৩০ মে ২০২৩ ০১:৩৬520122
kk | 2601:14a:502:e060:21d4:d6a8:3250:***:*** | ৩০ মে ২০২৩ ০১:৪৯520132
b | 14.139.***.*** | ৩০ মে ২০২৩ ১০:০৪520135
... | 192.139.***.*** | ১৭ জুন ২০২৩ ০৩:২৯520454
Bithika Datta | 203.***.*** | ২২ জুন ২০২৩ ১০:২২520628
খড়্গপুর DAV | 96.23.***.*** | ২৩ জুন ২০২৩ ০৮:৪৮520651